বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

‘আমি কি তোমার বোন নই?’

‘আমি কি তোমার বোন নই?’

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

‘কেন আমাকে মারছ? কেন এ ভাবে হাত তুলছে আমার উপরে? আমি কি তোমাদের বোন নই?’ এই কাতর আবেদন করেছিল উনিশ বছরের এক কুকি মেয়ে, মেইতেই মেয়েদের কাছে। ৩ মে ইম্ফলে কুকি আর মেইতেইদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে সে লুকিয়ে ছিল এক মুসলিম মেইতেই বন্ধুর বাড়িতে। কিন্তু কোনও ভাবে খবর পেয়ে তাকে জোর করে একটা গাড়িতে উঠিয়ে এক দল মেইতেই পুরুষ নিয়ে যায় মেইতেই-প্রধান একটি এলাকায়। সেখানে এক দল লোক তাকে মারতে শুরু করে। তাদের মধ্যে ছিল মেইতেই মেয়েরাও। মারধরের সঙ্গে সঙ্গে কাঁচি এনে তার চুলও কেটে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর মেয়েটিকে পুরুষদের হাতে তুলে দিয়ে মেইতেই মেয়েরা বলে, ‘ওকে শেষ করে ফেলো।’ এমনই জানিয়েছে ওই কুকি মেয়েটি, সাংবাদিকদের কাছে। বহু নির্যাতনের পর ভাগ্যক্রমে সে বেঁচে গিয়েছে।
ইম্ফলের পোরোমপাট-এর একটি নার্সিং হস্টেলের বাইরে জমা হয়েছিল উন্মত্ত জনতা। ঘরে ঢুকে মেইতেই মেয়েরা সব মেয়েদের আধার কার্ড দেখতে চায়। উনিশ এবং কুড়ি বছর বয়সী দুটি মেয়েকে কুকি বলে জানতে পেরে তাদেরকে বের করে নিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে কুকি মেয়ে দুটির উপরে। ওই দুই কুকি তরুণীর জবানবন্দি, মেইতেই মেয়েরা নিজেরা তাদের মারেনি, কিন্তু ক্রমাগত অন্যদের উস্কে গিয়েছে — “কেন ওদের বাঁচিয়ে রাখছ? রেপ করো, টুকরো টুকরো করে কাটো, জ্যান্ত জ্বালিয়ে দাও।”
মণিপুর থেকে মেয়েদের উপর ধর্ষণ, নির্যাতন, খুনের এমন সব বিবরণ ক্রোধ, শোকের আবর্তের ভিতর তৈরি করছে আর এক গভীরতর শঙ্কার আবর্ত। মেয়েদের চূড়ান্ত অপমানে, কদর্য নির্যাতনে হাত লাগাচ্ছে মেয়েরাও, এটা কী করে হয়? মনুও বোধহয় পুরুষতন্ত্রের এমন দাপট কল্পনা করতে পারেননি। মহাভারতের রচয়িতাও ভাবতে পারেননি, মেয়েদের বিবস্ত্র করতে হাত লাগাবে মেয়েরা। আমরা দেখি, কৌরব সভায় দ্রৌপদীর হেনস্থার পরে কুরুকুলের মহিলারা সজল চোখে দ্রৌপদীর কাছে আবেদন করছেন, তিনি যেন তাঁদের স্বামীদের ক্ষমা করে দেন। আজ পুরুষতন্ত্র এবং হিন্দুত্ববাদী, বিদ্বেষপন্থী রাজনীতি মিলে সমাজকে এমন নিষ্করুণ করে তুলেছে যে নারীত্বের অলঙ্ঘনীয় সম্ভ্রমের ধারণা — যা সভ্য সমাজের অন্যতম চিহ্ন — ধূলিসাৎ হচ্ছে, এবং সেই বিপত্তির অংশিদার হচ্ছেন মেয়েরাও।
মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী মেইতেই, আর প্রধানত পাহাড়ে বাসরত কুকি, জ়ো প্রভৃতি আদিবাসীদের দীর্ঘ দিনের সহাবস্থান কী করে পরিণত হল এমন ভয়ানক সংঘর্ষে? তার আন্দাজ করতে কিছু সময় লেগেছে বাকি দেশের। মূল সমস্যা কী — তা কি মেইতেইদের ‘আদিবাসী’ পরিচয় পাওয়ার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে কুকিদের ক্ষোভ, নাকি পাহাড়ের জমিতে মেইতেইদের ভাগ বসানোর আশঙ্কায় কুকিদের প্রতিবাদ, পাহাড়ে আফিমের কারবার নিয়ে অশান্তি, নাকি চূড়াচন্দ্রপুর এলাকায় খনিজ তেলের সন্ধান — তা স্পষ্ট হওয়ার আগেই বিষয়টি ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়েছিল হিংসার আগুনে। এক দিকে মণিপুরবাসীর আর্তি, অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতা, এবং গোদী মিডিয়ার মণিপুরের ভয়ানক পরিস্থিতির প্রতি উদাসীনতা, বিভ্রান্ত করেছে মানুষকে। শেষ অবধি দুই কুকি মহিলাকে নগ্ন করে ঘোরানোর একটি ভিডিয়ো (ঘটনার প্রায় দু’মাস পরে যা সামনে আসে) ভাইরাল হওয়াতে সারা দেশ আলোড়িত হয়, এবং সংঘর্ষের সূচনার ৭৬ দিন পরে প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলতে বাধ্য হন। তাতে অবশ্য পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়নি — মণিপুরে ইন্টারনেট বন্ধ করায় ভিতরের খবর প্রায় কিছুই বাইরে আসছে না, বাইরের সাংবাদিকদের মণিপুরে যাতায়াতও কড়া ভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। কিন্তু মণিপুরের গোষ্ঠীহিংসা, গৃহযুদ্ধ তথা গণহত্যার পরিস্থিতিকে ‘ও তেমন কিছু না’ বলে দেখানো যে চেষ্টা করছিল কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিজেপি সরকার, তা ধূলিসাৎ হয়েছে। দুটি মেয়ের উপর বর্ষিত চূড়ান্ত অপমানের ভি়ডিয়ো মণিপুরের নারী নির্যাতনকে ‘মেইতেই-কুকি বিরোধ’ থেকে, ‘মানবতা-বিরোধী অপরাধ’ বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে জগতের কাছে।
সেই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে মেইতেই মেয়েদের সংগঠন ‘মিরা পাইবি’-এর ভূমিকা নিয়ে। মেইতেই মেয়েদের মঞ্চ ‘মিরা পাইবি’ যেমন সংগঠিত ভাবে কুকি অঞ্চলে সেনা ট্রাকের যাওয়া আটকেছে, আদিবাসী গ্রামগুলিতে খাবারের ট্রাক যাওয়া রুখছে, কুকি মেয়েদের বিরুদ্ধে মেইতেই পুরুষদের উত্তেজিত করেছে, তা অস্বস্তি জাগাতে বাধ্য। এক সময়ে এই মেয়েরা, যাদের ‘মণিপুরের মা’ বলা হয়ে থাকে, সেনার হাতে মণিপুরের মেয়েদের ধর্ষণ-নির্যাতন আটকাতে নগ্ন মিছিল করে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন। আজ মিরা পাইবি-র সদস্যরা ধিক্কৃত হচ্ছেন কন্যাসম আদিবাসী মেয়েদের ধর্ষণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতদানের জন্য। ‘দ্য শিলং টাইমস’-এর সম্পাদক প্যাট্রিশিয়া মুখিম একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি সাময়িক পত্রে লিখেছেন, দুটি সম্পূর্ণ অসহায় মেয়েকে দেহ-মনে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার ঘটনাটির যে ভিডিয়ো রেকর্ড করা ধর্ষকাম মানসিকতার (‘স্যাডিজ়ম’) পরিচয়। “দুর্ভাগ্যবশত মণিপুরে স্যাডিজ়ম রয়েছে, এবং তাকে উৎসাহ দিচ্ছে মেইতেই সমাজের তথাকথিত অভিভাবকরা — মিরা পাইবি — যারা এই সব রক্তলোলুপ দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার অতীতে রুখে দিয়েছে, এই অজুহাতে যে তারা মেইতেইদের গৌরবের রক্ষা করছে। আর এখন মিরা পাইবি নীরব! অন্য গোষ্ঠীর মেয়েরা যখন চরম অত্যাচারীর হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে, তখন কি তাদের কিছুই বলার নেই? মেয়েরা কি নিজেদের জনজাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি এতই অনুগত, যে তারা বসে বসে দেখবে কেমন করে তাদের ছেলেরা, ভাইয়েরা নারীত্বের সম্ভ্রমকে ভূলুন্ঠিত করছে?” (জুলাই ২০, ২০২৩, ইন্ডিয়া টুডে)
যে মেয়েরা অন্য গোষ্ঠীর মেয়েদের বিবস্ত্র করতে হাত লাগাচ্ছে, তারা কতটা ব্যবহৃত হচ্ছে, আর কতটাই বা নিজের সিদ্ধান্তে কাজ করছে, এ নিয়ে বিতর্ক সহজে থামার নয়। মনে পড়তে পারে গুজরাতে নরোদা পাতিয়ায় মুসলিমদের উপর ভয়াবহ আক্রমণের আগে সেই এলাকার বিধায়ক মায়া কোডনানির উস্কানি-দেওয়া ভাষণ, যার জন্য তাঁকে দাঙ্গার ষড়যন্ত্রে দোষী সব্যস্ত করেছিল নিম্ন আদালত (গুজরাত হাইকোর্ট অবশ্য পরে তাঁকে বেকসুর খালাস করে)। মুসলিম-প্রধান নরোদা পাতিয়ার উপর হিন্দুত্ব বাহিনীর আক্রমণের ঘটনায় গর্ভবতী মুসলিম মেয়েদের পেট কেটে অজাত সন্তানকে বার করে আগুনে ফেলে হত্যার খবর সামনে আসতে আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল দেশ। নরোদা পাতিয়ায় ৯৭ জন মুসলিম খুন হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছত্রিশজন মেয়ে, সকলের উপরেই যৌন নির্যাতন হয়েছিল। গুজরাত দাঙ্গার শুরুই হয় নরোদা পাতিয়া গণহত্যা, গণধর্ষণ দিয়ে। ২০০২ সালের ওই দাঙ্গায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মহিলা সংগঠন দুর্গা বাহিনীর ভূমিকা ছিল, ভিএইচপি এমন অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে অনেকে এমনও বলেন যে, ভোটার লিস্ট এবং ট্রেড লাইসেন্স-এর তালিকা থেকে খুঁজে খুঁজে মুসলিমদের চিহ্নিত করার কাজটা মেয়েরাই করেছিল। তাই মণিপুরের কুকি মেয়েরা যখন বলেন, মিরা পাইবি-র মেয়েরা এসে তাঁদের আধার কার্ড দেখতে চেয়েছেন, তখন ভারতের প্রতিটি অ-বর্ণহিন্দু মেয়ে আতঙ্কিত বোধ করবে, এবং জাতি-পরিচয় নির্বিশেষে সব মেয়েই অসহায় বোধ করবে।
মণিপুর আর গুজরাত, দুটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই, ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব এমন জোরালো হয়েছে যে সমাজের প্রচলিত সব সম্পর্ক, মূল্যবোধকে বহুগুণে ছাপিয়ে যাচ্ছে। ‘বাইরে থেকে এসে কেউ আমার জায়গায় অনধিকার প্রবেশ করেছে, আমার স্বত্বে ভাগ বসাচ্ছে, তাদের নিঃশেষ না করলে আমার পরিবার, আমার গোষ্ঠীর দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না’ — এই ভয় অভিভূত করছে আর সব বোধকে। সেই ‘বাইরে’ গুজরাতে ছিল পাকিস্তান, অসমে ছিল বাংলাদেশ, মণিপুরে তা হল মায়ানমার।
মণিপুর থেকে মেয়েদের উপর নির্যাতনের যে সব বয়ান বেরিয়ে আসছে, অনেক দেরিতে এবং খুব বিক্ষিপ্ত ভাবে, সেগুলিতে আমরা বারবার শুনছি প্রকাশ্যে মেয়েদের হেনস্থা, তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ এবং মারধরের কথা, মেয়েদের পেট ফুঁড়ে লোহার রড ঢুকিয়ে মারার কথা। গর্ভের উপর আক্রমণের বার্তাটা প্রতীকী — শত্রুকে একেবারে পৃথিবী থেকে নিকেশ করে দেওয়ার ইচ্ছা, যাতে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মও মুছে যায়। সেই সঙ্গে, নিজের স্ত্রী-বোন-মাকে যৌন নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর অক্ষমতাকে বিপক্ষের চরম দুর্বলতা, বা ‘পুরুষত্বহীনতা’ বলে দেখানো। এই নকশা অতি পরিচিত।
পুরুষতন্ত্রের রূপ স্বতঃই হিংস্র — হিংসা নইলে অসাম্য টিকিয়ে রাখা যায় না। সাধারণত পুরুষতন্ত্র পরিবারের দারোয়ানির ভূমিকাটি দেয় মেয়েদের — নিয়ত নজরদারি, আর শতসহস্র ছোট ছোট উপায়ে বালিকা, কিশোরীদের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদার বোধ খর্ব করার কাজটি পায় বয়স্ক মহিলারা। শক্তিময়ী দেবীর কল্পনা করলেও, সংসার-সমাজে মেয়েদের শক্তিপ্রদর্শনে বিশ্বাসী নয় পুরুষতন্ত্র। যোদ্ধা হিসাবে মেয়েদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ সমর্থন করেনি নাৎসিরা বা ফ্যাসিস্টরাও, চেয়েছিল মেয়েরা যেন উৎকৃষ্ট যোদ্ধাদের জন্ম দেয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদ এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যেখানে একটি ধারণাকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করা, এবং তার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রদর্শন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছিল। এতটাই যে, মানবিকতার একেবারে গোড়ার কথাগুলিও তার পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানিতে এক মহিলা ক্যাম্প রক্ষীর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘দ্য রিডার’ (২০০৮) ছবিটি। ছবিতে যখন সেই রক্ষীকে প্রশ্ন করা হয়, একটি চার্চে বোমা পড়ে আগুন লাগলেও তার ভিতরে আশ্রয়-নেওয়া মহিলা ও শিশু বন্দিদের তিনি দরজা খুলে দিয়ে মুক্ত করেননি কেন, তখন সেই মহিলা বলেন, “কিন্তু দরজা খুলে দিলে ওরা তো পালিয়ে যেত!”
যে সব অমূল্য অনুভূতি রয়েছে মানব সভ্যতার কেন্দ্রে, যেমন মেয়েদের সুরক্ষা, শিশুর প্রতি স্নেহ, আর্তের সহায়তা, অতিথিকে আপ্যায়ন, অপরিচিতের প্রতি সৌজন্য — সে সব তুচ্ছ হয়ে যায় সাধারণ গৃহস্থ পুরুষ-মহিলার কাছেও, যখন তার আশেপাশের মানুষ আত্মসমর্পণ করে বিদ্বেষপন্থী, আধিপত্যবাদী, দম্ভসর্বস্ব রাজনীতির কাছে। এ কথাগুলো নতুন করে মনে বাজে, যখন দেখি সংবাদ চ্যানেলের সামনে মেইতেই মেয়েরা বলছেন, “অসম রাইফেলের জওয়ানরা সব কুকি, তাই ওদের ঢুকতে দেওয়া যাবে না।” “আদিবাসীরা বাইরে থেকে এসে আমাদের সব কিছু দখল করছে, ওরা মণিপুরের কেউ নয়।” এই ‘অপরত্ব’-এর বোধ এমন তীব্র হতে পারে, যে মানুষে-মানুষে, মেয়েতে-মেয়েতে সহমর্মিতার কোনও জমিই পড়ে থাকে না। এমনকি পুরুষদের হাতে কিছু মেয়ের প্রকাশ্য নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডেও অন্য মেয়েরা আপত্তিকর কিছু দেখে না, বরং তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করতে পারে। ‘অপর’-কে পীড়নের রাজনীতি আমাদের অমানুষ করছে এমন ভাবেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.