বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— এবারের বাজেট, ২০২২-২৩ সালের বাজেট যখন পেশ করা হচ্ছে তখন দেশে সাধারণ মানুষের দু:খ-কষ্ট ক্রমাগত বাড়ছে- তীব্র বেকারত্ব, আয় ও সম্পদে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, উর্ধগামী মুদ্রাস্ফীতি, দুবছর ধরে বিদ্যালয়ে না যাওয়া শিশু, অতিমারিতে প্রকট হওয়া অতি অপ্রতুল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। প্রয়োজন ছিল, অবশ্যই কর্পোরেট সাঙাত এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল না, জনসাধারণের দুর্দশা কমানোর জন্য কিছু বন্দোবস্ত থাকবে, সঙ্গে থাকবে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের জন্য ভাবনার সম্যক প্রতিফলন। কিন্তু বাজেট, ২০২২এ পর্বত মূষিক প্রসব করল। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের জন্য কোনও প্রচেষ্টা বা নিম্নবিত্ত, দরিদ্রদের জন্য কোনও সুবিধে কিছুই বাজেটে নেই। ফলে বাজেট একটা তুচ্ছ বিষয়ে দাঁড়িয়ে গেল। যদিও অধুনালুপ্ত পাঁচসালা পরিকল্পনার মত কোনও দলিলের অবর্তমানে অর্থনীতির দিক নির্দেশের জন্য বাজেটের গুরুত্ব বেড়ে গেছে তবুও ‘অমৃতকাল’, ‘পিএম গতিশক্তি’ এইসব চটকদার শব্দসমূহের মধ্য দিয়ে যেসব ঘোষণা হয় তার কার্যকারিতা, এবং তার কোনটা কার্যকর করা হবে তা জানা দুস্কর।
দেশের বাজেটগুলি ফিবছর কিছু না কিছু ঘোষণা করে, পরে সেসব লক্ষ্যের কথা আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলা হয়। যেমন ধরা যাক বুলেট ট্রেনের কথা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জাপনি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে পাশে নিয়ে মোদিজি সগর্বে ভারতে আহমেদাবাদ-মুম্বাইএর মধ্যে বুলেট ট্রেন চালানোর কথা ঘোষণা করেছিলেন। ও দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে তা সম্পূর্ণ করার ঘোষণাও করেছিলেন। ২০১৮ সালের বাজেট থেকে শুরু করে ২০২১ সালের বাজেট পর্যন্ত বাজেটে বুলেট ট্রেন নিয়ে কতা থাকত। এবছরের বাজেটে বুলেট ট্রেন সম্পর্কে একটি শব্দও পাওযা গেল না, যদিও তার চালু হওয়ার কথা ছিল এবছরেই। যতদূর জানা যায়, আগামী ৫ বছরের মধ্যেও সেটি চালু হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এমনটাই এই দ্রুতগতিতে ছুটে চলা আত্মনির্ভর ভারতের প্রকল্প ভাবনা। গত বছর বাজেটে ঘোষিত পিএম আত্মনির্ভর স্বস্থ ভারত যোজনার কথা মনে করুন। তার মধ্যে বহুকিছুর সাথে ছিল ব্লক স্তরে ১১টি রাজ্যে জনস্বাস্থ্য ল্যাব তৈরি, ৬০২টি জেলায় ক্রিটিকাল কেয়ার ব্লক তৈরি, ১৫টি জরুরি স্বাস্থ্য অপারেশন কেন্দ্র, দুটি মোবাইল হাসপাতাল প্রভৃতি। রূপায়নের যে খতিয়ান দাখিল করা হয়েছে সেখানে এগুলির কোনও উল্লেখ নেই।
এই বাজেটটি কী মানুষের দুর্দশা দূর করতে বা অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের জন্য কোনও প্রচেষ্টাই গ্রহণ করেছে। মনে হয় না। অপরদিকে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ঘটনাক্রম উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করছে। যদিও ২০২১-২২এ দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে,তবুও খুঁটিয়ে দেখলে বোখা যাবে যে বাস্তব ভোগ ব্যয় ২০১৯-২০ সালের স্তরে পৌঁছয়নি। ফলে ভোগ্যপণ্য শিল্পে উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহারের হার পূর্বের সময়ে পৌঁছয়নি, বরং পূর্বে গৃহীত বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ফলে যেটুকু উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে তা সেই হারকে আরো কমিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ওই ক্ষেত্রে অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতার পরিমাণ আরো বেড়েছে। ফলে ওই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ভোগব্যয়ের উপরে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ও অর্থনীতিতে তা স্লথতা সৃষ্টি করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
বাহ্যিক দিক থেকে দেখলে বোঝাই যাচ্ছে যে তেলের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে এই সব নির্বাচন মিটে গেলে সরকার পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়াবে বলেই মনে হয়, কারণ এই সরকার পেট্রলের দাম কমিয়ে রেখে রাজস্ব হারানোর বান্দা নয়। তেলের দাম বাড়লে জিনিসের দাম বাড়বে। এতদিন ধরে আমেরিকায় সুদের হার অত্যন্ত কম ছিল, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির ফলে সেক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়েছে ও সুদের হার বাড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমেরিকায় সুদের হার কম থাকার দরুণ ভারত বিশ্ববাজার থেকে বিদেশি মুদ্রা দেশে আসার সুবিধে পাচ্ছিল তার অবসান ঘটতে পারে। তা ঘটলে টাকার দাম ডলারের নিরিখে কমবে। ফলে তেলের দাম টাকার অঙ্কে আরো বাড়বে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাকে নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উটবে। ফলে বেকারি ও অর্থনৈতিক শ্লথতা আরো দু:সহ হয়ে উঠতে পারে।
এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য বাজেট অবশ্যই ভোগব্যয় বাড়াতে সক্ষম এমন খরচ বাড়াতে পারত, ও অত্যাবশ্যক গণ পরিষেবার ব্যাপ্তি ঘটাতে পারত যা অপরদিকে কর্মসংস্থান বাড়াত। তা না করে যোগানের দিক থেকে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর কথা ভাবা হয়েছে। মূলধনী ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে বিপুল পরিমাণে, যদিও যে পরিমাণ বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে আদতে তাতে কারচুপিও রয়েছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রকল্প এমএনআরইজিএ-র জন্য বাজেট বরাদ্দ সংশোধিত (২০২১-২২) বরাদ্দের তুলনায় অনেকটাই কমানো হয়েছে, এমন একটা সময়ে যখন কোভিড ও তজ্জনিত ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের অত্যাচার বজায় রয়েছে। ফলে গ্রামাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজের চাহিদা রয়েছে।
যাই হোক না কেন বাজেট তৈরি হয়েছে। তবে তা প্রায় ডিজিটাল বাজেট। অর্থমন্ত্রীর বকলমে প্রধানমন্ত্রী কাগজহীন বাজেট, কাগজহীন করের রিটার্ন এগুলিকে আক্ষরিক অর্থে এতটাই গ্রহণ করেছেন যে, দেশের সমস্ত সমস্যার জন্য ডিজিটাল সমাধানের বটিকা হাজির করেছেন। তাই এই অতিমারির সময়ে প্রিয়জন হারানো, রুজি হারানো, মিডডেমিল হারানো, শ্রেণীকক্ষ হারানো, কাজ হারানো, সম্পদ হারানো দেশবাসীকে আগামী ২৫ বছরের অমৃতকালের ধোঁকা দিতে তাঁর একটুও বাধেনি। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার, সকলের জন্য ঘর বানানোর, ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বানানোর, সব কালো টাকা ফেরত আনার, বছরে ২ কোটি বেকারের চাকুরির বিবিধ প্রতিশ্রুতি জলাঞ্জলি দিয়ে ২৫ বছরের নয়া দীর্ঘকালীন সময়সীমা ধার্য করেছেন দেশকে ও তাদের জনসাধারণকে ডিজিটাল অমৃতলোকে পাঠানোর জন্য।
ভেবে দেখুন ২৫ বছর বাদে শত বছরের ভারতবর্ষের কথা যেখানে টিভির চ্যানেল দিয়েই শিক্ষালাভ হবে। ডিজিটাল শিক্ষকরা ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদান করবে। কৃষকেরা তাদের শস্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন কিষান দ্রোনের মাধ্যমে। তাই তো অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “শস্য মূল্যায়নে, জমির রেকর্ডে, কীটনাশক ছড়ানোতে কিষান দ্রোনের ব্যবহার কৃষি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ঢেউ তুলবে।” তাই কৃষিক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর তেমন দরকার পড়েনি। এমনকি ৩ বছর আগে শুরু করা গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে কৃষকদের ভোট বাগানোর পিএমকিষান প্রকল্প কোনও বরাদ্দ বাড়ানো হযনি। যদিও গত তিন বছরে মূল্যবৃদ্ধিতে কোনও ফাঁক পড়েনি, ফলে টাকার দাম কমেছে।
ডিজিটালের দুনিয়ায় গরিব মানুষ ডিজিটাল টাকায় ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং পরিষেবা গ্রহণ করবে, ডিজিটাল খরচ করে ডিজিটাল সম্পদ গড়বে। জাতীয় টেলি-মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দারিদ্রকে অনায়াসে মানিয়ে নিয়ে খিদে ভুলিয়ে রাম-কৃষ্ণ-শিব মন্দিরে আচ্ছন্ন করে দরিদ্র জনতার মানসিক স্বাস্থ্যকে সবল করে তুলবে; তাছাড়া সর্বব্যাপী ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হবে।
এই ডিজিটাল কালে দেশ জুড়ে অসাম্য ও বৈষম্য বিরাজ করলেও তাকে অমৃত হিসেবে গলাধকরণ করতে হবে। ভুলে যেতে হবে যে দেশে চরম অসাম্য তৈরি হয়েছে। তাই বাজেট বক্তৃতার কোথাও ক্রমবর্ধমান অসাম্য নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। অর্থমন্ত্রীর ভাবনার চৌহদ্দিতে অর্থনৈতিক অসাম্যের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না।
যদিও অর্থনৈতিক অসাম্য কেবল ন্যায় ও সমতার বিষয় নয়, উন্নয়ন ও বৃদ্ধির জন্যও তা যথেষ্ট সমস্যার বিষয়। দেশে যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে তা সরকার এবং জনগণের পক্ষে উদ্বেগের বিষয় হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অবশ্য অসাম্যের এই বাড়বাড়ন্তের কারণ হল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ধরন— কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধি। এবিষয়ে বহুল পরিমাণ আলোচনা সত্বেও বৃদ্ধির দায়িত্ব ডিজিটাল অর্থনীতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে সপে দেওয়ার ভাবনায় মশগুল দেশের ‘চিন্তানায়কেরা’। আদতে এই বন্দোবস্তকে পাল্টাতে গেলে প্রয়োজন অর্থনীতির সম্পূর্ণ পরিমার্জন যেখানে উপযুক্ত কর্মসংস্থানকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে পরিগণিত করতে হবে। এই বাজেট কর্মসংস্থানকে কেবল মুখের কথায় পর্যবসিত করেছে। কোন কোন উৎপাদন ক্ষেত্রে কী পরিমাণ কর্মসংস্থান হতে পারে তা কোথাও বলা হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় ৬ বার নিয়োগ (এমপ্লয়মেন্ট) ও ৩ বার কাজ (জব) শব্দদুটির উল্লেখ আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে একবার। ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থান সেই ‘আত্মনির্ভর ভারত’ বাগাড়ম্বরের ক্ষেত্রগুলিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কতদিনে হবে তার উল্লেখ নেই। ২০১৪ সালের বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারের সেই বছরে ২ কোটি চাকুরির কোনও টুকরোও বাজেটে নেই, যদিও গত ৭ বছরের গুণকীর্তনের কল্পকথা বাজেটে ছলকে ছলকে পড়েছে।
কয়েকটি সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের দিকে একটু দৃষ্টি দিয়ে দেখা যাক বাজেট ২০২২ কী চাইছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ২০২১-২২ সালের বাজেট বরাদ্দের (৯৩,২২৪ কোটি টাকা) তুলনায় সংশোধিত বরাদ্দ, ৮৮,০০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ২০২১-২২ সালে শিক্ষা খাতে ব্যয় না করে সরকার ৫,২২২ কোটি টাকা বাচিয়েছে। বর্তমান বাজেটে অবশ্য বরাদ্দ বাড়িয়ে ১,০৪,২৭৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। গতবারের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ১১,০০০ কোটি টাকার এই বরাদ্দ বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির সুবাদে বেশ খানিকটা কম। তার উপরে ওই ডিজিটাল শিক্ষা পরিকাঠামোর জন্যই এর বেশির ভাগটা ব্যয়িত হবে। যখন দরকার ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখি করে তুলে গত দুবছরে যে লাখো লাখো ছাত্রীছাত্র শিক্ষাঙ্গনের বাইরে চলে গেছে তাদের বিদ্যালয়মুখি করে তোলার তখন ডিজিটাল শিক্ষার উপরে জোর দিয়ে তাদের আরো বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। ই-বিদ্যার জন্য ২০০ টি টিভি চ্যানেল, ৭৫০ ভার্চুয়াল ল্যাব, ৭৫টি ই-ল্যাবের ঢক্কানিনাদ কতটা কার্যকরী হবে জানা নেই। কিন্তু তা অধিকাংশ বিদ্যালয় ছুটদের যে বিদ্যালয়ের বাইরেই রেখে দেবে তাই নয় ডিজিট্যাল-বিভক্ত সমাজে শিক্ষা ক্ষেত্রে আরো বেশি অসাম্য সৃষ্টি করবে। যেখানে দেশের ৮০% শিক্ষার্থীর কাছে ডিজিটাল পরিকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ বা পয়সা নেই সেখানে এর মানে কী? আদতে এর মাধ্যমে শিক্ষাকে আরো বেশি করে বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাওযাই উদ্দেশ্য। সেই জন্যই যে ১১ লক্ষ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে সে ব্যাপারে বাজেটে কোনও উল্লেখই নেই। সেই লক্ষ্যেই পূর্বের মিড-ডে-মিল প্রকল্পে, বর্তমানে যার গালভরা নাম হল পিএম পোষণ শক্তি নির্মাণ,টাকার বরাদ্দ গত কয়েক বছর ধরেই কমছে, এবারো কমানো হয়েছে। গত বছরের ১১,৫০০ কোটির থেকে ১,৩০০ কোটি কমিয়ে ১০,২০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। যা ২০২০-২১ বাজেটের(১২,৯০০ কোটি)র তুলনায় ২,৭০০ কোটি টাকা কম। সরকারের যদি বিদ্যালয়ছুট ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়ে আসার সদিচ্ছা থাকত তাহলে বরাদ্দ বাড়ত, কমত না।
১০০ দিনের কাজের জন্য বাজেটে ৭৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যদিও গত বছরের সংশোধিত বরাদ্দের পরিমাণ ৯৮,০০০ কোটি টাকা। ওই পরিমাণ বরাদ্দ সত্বেও ১ ফেব্রুয়ারি,২০২২ তারিখের তথ্য অনুসারে ৭৭ লক্ষ পরিবারের কাজের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ৭০০০ কোটি টাকার বিশি সংশোধিত বরাদ্দের থেকে বেশি খরচ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে ওই বকেয়া মিটিয়ে থাকবে ৬৬,০০০ কোটি টাকার মত, যা ২০২১-২২ এর সামগ্রিক খরচ ১,০৫,০০০ কোটি টাকার তুলনায় ৪০% কম। গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেও সরকার বাজেট বরাদ্দ (১,৩৮,২০৩ কোটি) গত বছরের সংশোধিত খরচের (১,৫৫,০৪২ কোটি) তুলনায় কমিয়েছে, প্রায় ১৭,০০০ কোটি টাকা।
গত বছরের বাজেটের তুলনায় সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণে অধিক ব্যয় করেছিল। ফলে সংশোধিত খরচ হযেছিল ৮৬,০০০ কোটি টাকা। এবছর, অতিমারির সময়ে ও পরে যখন স্বাস্থ্যের প্রয়োজন সর্বাধিক তখন টাকার অঙ্কে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। বছরে ৬% মূল্যবৃদ্ধিকে ধরলে যা গত বছরের ব্যয়ের তুলনায় ৫,০০০ কোটি টাকা কম।
অতিমারির অমৃতকালে খাদ্যে ভর্তুকিও কমছে গত বছরের সংশোধিত বরাদ্দ ২,৯৯,৩৫৫ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২,০৭, ২৯১ কোটি টাক, ৯২,০৬৪ কোটি টাকা কম। যদি ৬% মুদ্রাস্ফীতিকে ধরা হয়, তাহলে হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াবে ১,১০ ০০০ কোটি টাকায়। অসাম্য ও দারিদ্রের ফলে যখন খাদ্যের পরিমাণ সর্বোচ্চ তখন খাদ্যে ভর্তুকি কমানোর ভাবনাই পাপ। ঠিক এই দিক দিয়েই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিষয়টিকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি বাজেটে। যদিও অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, “সকলের জন্য উন্নয়ন সরকারের অগ্রাধিকার যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১ কোটি কৃষকের জন্য লাভজনক গম, ধান, খরিফ ও রবিশস্যের সংগ্রহ”। তিনি এও বলেন যে, ১৬৩ লক্ষ কৃষকের কাছ থেকে ১,২০৮ লাখ মেট্রিক টন গম ও ধান কেনা হবে। তাদের খাতায় সরাসরি ২.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া হবে। কিন্তু বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ১,৩২, ৫১৪ কোটি টাকা দেখানো হয়েচে যা গত বছরে বরাদ্দ ১,৩১, ৫৩১ কোটির তুলনায় মাত্র ৯৮২ কোটি টাকা বেশি। এক্ষেত্রেও যদি মুদ্রাস্ফীতিকে ধরা হয় তাহলে বরাদ্দ প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা কম।
বাজেটের খরচের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৯.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা, অনুমিত জিডিপি ২৫৮ লক্ষ কোটি টাকার ১৫.৩%। চলতি বছরে সংশোধিত খরচের পরিমাণ হবে ৩৭.৭ লক্ষ কোটি টাকা, অনুমিত জিডিপি ২৩২ লক্ষ কোটি টাকার ১৬.২%। ফলে জিডিপির অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ কমেছে। কেবল তাই নয়, যদি ৬% হারে মুদ্রাস্ফীতি ধরা হয় তাহলে চলতি বছরের ব্যয়কে ধরে রাখতে বাজেট বরাদ্দ দরকার ছিল ৪০ লক্ষ কোটি টাকা। ফলে বাস্তবে বাজেট বরাদ্দ কমেছে। ওই ৩৯.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ের জন্য জিডিপির চলতি মূল্যে ১১.১% বৃদ্ধি ধরা হয়েছে। কিন্তু যদি বৃদ্ধিকে ৮.৫%-এ ধরা হয় তাহলে মুদ্রাস্ফীতির হারকে হতে হবে ২.৬%।অপরদিকে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার ৬%-এর কাছে। ফলে যে মুদ্রাস্ফীতির হারকে অনুমান করে বাজেট তৈরি হয়েছে তা বাস্তবানুগ নয়; বরং বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি যে হারে ঘটছে তাতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই, বাজেটের মোট ব্যয় বরাদ্দকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
এই বাজেটের গরিমার দিক হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয়ের প্রভূত বৃদ্ধির ঢাক পেটানো হচ্ছে। একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এটিও একটি জুমলা।
অমৃতকালে ‘বিনিয়োগের অমৃতচক্র তৈরি করার জন্য সরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন বেসরকারি বিনিয়োগকে উদ্বুদ্ধ করতে’। এমনটাই নির্মলাজির বাণী। ফলস্বরূপ অর্থমন্ত্রী বাজেটে মূলধনী ব্যয়কে ২০২১-২২-এর বাজেটের ৫.৫৪ লক্ষ কোটি থেকে ৩৫.৪% বাড়িয়ে ২০২২-২৩-এ বাজেট বরাদ্দ ৭.৫ লক্ষ কোটি করেছেন। অর্থাৎ বৃদ্ধির পরিমাণ ১.৯৬ লক্ষ কোটি টাকা। অসত্য ভাষণ এই সরকারের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকার মূলধনী ব্যয়ের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের উদ্যোগগুলিকে মূলধন ও ঋণের মাধ্যমে প্রদত্ত বাজেট সহায়তাও রয়েছে। এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের উদ্যোগগুলিও বাজার থেকে নিজেরা সম্পদ সংগ্রহ করে। তাই ওই দুটির যোগফলকে সামগ্রিক সরকারি ক্ষেত্রের মূলধনী ব্যয় বলা যেতে পারে। তাছাড়া রাজ্য সরকারগুলিকে প্রদেয় কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণকেও কেন্দ্রীয় মূলধনী ব্যয় বলা হলেও তা রাজ্যগুলির মূলধনী ব্যয়, কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয় নয়।
এবার ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩এর বাজেটের কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয়কে খতিয়ে দেখা যাক। ২০২১-২২ এ সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয় ছিল ৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা, রাজ্য সরকারগুলিকে ঋণ ০.১ লক্ষ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহ ৫.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা। রাজ্য সরকারকে প্রদত্ত ঋণ ব্যতিরেকে মোট ১১.২৭ লক্ষ কোটি টাকা, এবং ওই ঋণ সমেত ১১.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২-২৩-এর বাজেটে ওই পরিমাণগুলি হল যথাক্রমে ৬.৫, ১, ৪.৬৯, ১১.১৯ ও ১২.১৯ লক্ষ কোটি টাকা। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ ৮ হাজার কোটি টাকা কমেছে (রাজ্য সরকারের ঋণকে ধরলে তা ৮২ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে)। যদি ২০২১-২২-এর সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ৬ লক্ষ কোটিকে ধরা হয়, তাহলে ২০২১-২২ এ রাজ্য সরকারকে প্রদত্ত ঋণ ব্যতিরেকে মোট ১১.৭৩ লক্ষ কোটি টাকা, এবং ওই ঋণ সমেত ১১.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয় ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ ৫৪ হাজার কোটি টাকা কমেছে (রাজ্য সরকারের ঋণকে ধরলে তা ৩৬ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে)। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তা ১.৯৬ লক্ষ কোটি টাকা বাড়েনি।
বাজেটকে খতিয়ে দেখলে এরকম বহু অসামঞ্জস্য চোখে পড়বে। কিন্তু একটি বিষয়ে এই সরকার মোটামুটি স্পষ্ট যে, গরিবের জন্য তাদের তূণীরে রয়েছে হিন্দুত্ব ও মুসলিম বিদ্বেষের অস্ত্র। বড়লোকদের জন্য আছে দেশের অন্য সব সম্পদ।