বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

‘কমিউনিস্ট পার্টি’ তো অনেক, কিন্তু কমিউনিস্ট কারা!

‘কমিউনিস্ট পার্টি’ তো অনেক, কিন্তু কমিউনিস্ট কারা!

দীপক পিপলাই

photo

মুখবন্ধ


বাবা-মা থেকে শুরু ক’রে আমাদের যৌথ পরিবারে এবং ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়দের মধ্যে ন’জন ছিলেন ব্রিটিশ আমলে (তিরিশের এবং চল্লিশের দশকে) কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাঁদের সান্নিধ্যে ও প্রভাবেই আমার প্রথম লালাঝাণ্ডা কাঁধে নিয়ে মিছিলে হাঁটা। পারিবারিক সূত্রে পার্টি-ইতিহাসের বহু ঘটনা জেনেছি নানা সময়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে, যা কোনও ‘ইতিহাস’-এ লেখা নেই। কিছু নেতা সম্পর্কে এমন সত্যও জানতে পেরেছি, যা তাঁদের অ-কমিউনিস্ট চরিত্রকেই উন্মোচিত করেছে আমার সামনে। বইপত্র এবং গবেষণাপত্র যেটুকু পড়েছি, তা-ও আমার চিন্তা-ভাবনাকে পুষ্ট করেছে। সারাজীবনে শ্রমজীবী মানুষের গণ-আন্দোলনের সাথী হিসেবে এবং বাস্তব রাজনীতির জগতে যতটুকু নড়াচড়া করেছি, সেখান থেকেও মগজের রসদ যথেষ্টই সংগৃহীত হয়েছে।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পর, বহু যন্ত্রণা ও প্রশ্ন জমা হয়েছে মনে। আজ যখন দেশে একটাও প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি নেই, যখন কোথাও কোনও বলশেভিক নেতৃত্ব দেখা যাচ্ছেনা, তখন স্তালিন কথিত “পার্টি বহির্ভূত বলশেভিক” (‘Non-Party Bolsheviks’)-রাই আমার ভরসাস্থল। তাঁদের কাছে বলার জন্যেই আমার এই লেখা।
বারবার ‘শিব গড়তে বাঁদর’ হয়ে যাচ্ছে কেনও!
অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভাঙন-পরবর্তী সিপিআই, সিপিআই(এম), সিপিআই(এম-এল), সিপিআই(মাওবাদী), ইত্যাদি বিভিন্ন পার্টির নানা সমালোচনা অনেকসময়েই করেছি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও তাত্ত্বিক বোধের ভিত্তিতে। আমি আজও সেইসব সমালোচনাকে সঠিক মনে করি।
কমিউনিস্ট আদর্শ আন্তর্জাতিক; মানবসমাজের ভালো-মন্দ তার বিচারের বিষয়। কিন্তু দেশ ও সমাজ বিশেষে তার প্রয়োগ পদ্ধতি অবশ্যই ভিন্ন। বিভিন্ন দেশের দার্শনিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োগ পদ্ধতির ভিন্নতাও অনিবার্য।
শিশুবেলায়, স্তালিনের নেতৃত্বে পরিচালিত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাবতে শিখেছিলাম সমাজতন্ত্রের স্থায়ী দুর্গ। চীন-বিপ্লব পরবর্তী মাও ৎসে-তুঙের পরিচালনাধীন চীন আমার কাছে ছিল সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয় দুর্ভেদ্য অচলায়তন। কিন্তু, সময়ের সঙ্গেসঙ্গে সব স্বপ্ন ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেলো! দুটো আলাদা দেশ, স্বতন্ত্র সমাজ, ভিন্ন অর্থনীতি, পৃথক কমিউনিস্ট পার্টি, আলাদা নেতৃত্ব; কিন্তু মতাদর্শিক ভিত্তি একই। দুটোই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনে আস্থাশীল ছিল। কয়েক কোটি মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও আত্মবলিদানে দুটো দেশেরই সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের ভিত গড়া হয়েছিল। অথচ ব্যাপক অর্থনৈতিক সাফল্য, রাজনৈতিক অর্জন, সামাজিক অবদান, মানবিক মহত্ব, – সবকিছুই যেনো ব্যর্থ হয়ে গেলো! যাদের বিরুদ্ধে এতো লড়াই ও আত্মবলিদান, সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল দুই দেশেই! নানা রকম সীমাবদ্ধতা নিয়েও পৃথিবীর নানা দেশে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল, তা-ও প্রচন্ড রকম ধাক্কা খেলো। পুঁজিবাদী শিবিরের তরফ থেকে সমাজতন্ত্র তথা কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচার ও মিথ্যাচার তীব্র হয়ে উঠলো দুনিয়া জুড়েই। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার বুকে লালঝান্ডার দৃপ্ত অভিযান দুর্বল হয়ে পড়লো!
প্রশ্ন হল, ‘শিব গড়তে বাঁদর’ কেনও তৈরি হল লেনিন-স্তালিন-মাও ৎসে-তুঙের দেশে? বিভিন্ন দেশেও কেনও একই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি ঘটে চললো? আত্মপ্রবঞ্চনায় না ভুগে, নিজেদের সর্বজ্ঞ পন্ডিত না ভেবে, গভীরভাবে প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে দেখা জরুরি। কমিউনিস্ট আন্দোলনের যা’কিছু অভিজ্ঞতা জড়ো হয়েছে, যা’কিছু ইতিহাসে লেখা হয়েছে, – সেখানে ‘শেষ কথা’-ও লেখা আছে, সেখান থেকেই সব উত্তর পাওয়া যাবে, – এমনটি মোটেও না। সব অজানাই মানূষের জানা হয়ে যায়নি, কোনওদিনই যায় না, যাবেও না। তাই, চিরদিনই বহুকিছু মানুষের ‘অজানা’ থেকেই যায়। নিরন্তর চর্চা যদি না চলে, তবে অনন্ত গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাওয়াই আমাদের ভবিতব্য হয়ে থাকবে।

ব্যাপক ও গভীর ব্যর্থতা কেন?


সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি এবং রাশিয়ার মতাদর্শিক অধঃপতনের জন্য নিশ্চয়ই সিপিআই দলের নেতৃত্বকে দাযী করা যায়না। চেকোশ্লোভাকিয়া বিলুপ্ত হবার জন্য সিপিআই(এম) নিশ্চিতভাবেই দায়ী না। আলবেনিয়ার চরিত্র বদল কখনোই সিপিআই(এম-এল)-এর জন্য হয়নি। চীনের আদর্শিক বিচ্যুতির দায় সিপিআই (মাওবাদী) দলের হতেই পারেনা। বাংলার তথা ভারতবর্ষের কোনও দলই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে পশ্চাদ্গতির জন্য দায়ী না।
বাংলায় তথা ভারতবর্ষেও প্রকৃত সংগ্রামী কমিউনিস্ট আন্দোলন আজ নিষ্প্রভ। তেল মাখানো বাঁশে বাঁদরের ওঠা-নামা অঙ্কের মতো, সংসদীয় নির্বাচনে জেতা-হারার চোরাগলিতে ঘুরপাক খাওয়াই বর্তমানে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে! শ্রমজীবীদের উপর বুর্জোয়াদের শোষণ যদিও কমার কোনও লক্ষণই নেই। কমিউনিস্ট শিবিরের কেউ ‘ব্যালট’-কেই প্রধান হাতিয়ার করেছেন; কারও সর্বক্ষণের একমাত্র হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ‘বুলেট’। একই ‘দেশ’, একই ‘রাষ্ট্র’, একই শাসকদল, একই মতাদর্শ; কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই রাস্তায় চলছে সমাজতন্ত্র অর্জনের প্রয়াস! এবং কমিউনিস্ট শিবিরে আজও মাঝেমধ্যেই নিজেদের মধ্যে চলে সংঘর্ষ ও খুনোখুনি। শোষকশ্রেণী অধরা!
দুনিয়া জুড়ে সমাজতন্ত্রের পতাকাও আজ ভুলুন্ঠিত। হাল আমলে নির্বাচনের মাধ্যমে যেখানে যতটুকু ‘সমাজতান্ত্রিক’ অগ্রগতি বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তার পিছনে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সম্ভাব্য ভূমিকা এখনও স্পষ্ট না! পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবে কতটুকু বিঘ্নিত হয়, তা আগামী দিনগুলোতেই বোঝা যাবে। দীর্ঘ ও তিক্ত অভিজ্ঞতার পর, ‘লাল’ রং দেখলেই উচ্ছসিত হয়ে ওঠার দিন এখন অতীত। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি হামলায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা মেপে দেখার বিষয়। কিন্তু ‘লাল’ শিবিরের মধ্য থেকেই বিশ্বাসঘাতকতার অথবা বিপথগামিতার কিম্বা বিচ্যুতির ফলেই যে সমাজতন্ত্রের এই বিপর্যয় এবং পুঁজিবাদের এই বিশ্বজোড়া দাপট পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে’কথা ভুললে চলবে না।

আমার নিজের কাছেই প্রশ্ন


১) দুনিয়া জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোটিকোটি শরিকের চাইতেও ব্যক্তি-আমি ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ বেশি বুঝি, এমনটা তো হতেই পারেনা।
২) যে কোটিকোটি কমরেডের আত্মবলিদানে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিশ্ব-ইতিহাস গড়ে উঠেছে, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ব্যক্তি-আমার উপলব্ধি তার চেয়েও গভীর হওয়া একেবারেই অসম্ভব।
তা হ’লে?
কিসের বা কাদের ব্যর্থতার জন্য বাংলা তথা ভারতবর্ষ তথা বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই বিপর্যয়?
নাকি, আন্তর্জাতিকভাবে সব সাফল্য অনিবার্যভাবেই ‘সাময়িক’?
ব্যর্থতা-সাফল্য-ব্যর্থতা-সাফল্য … এই পথপরিক্রমা কী অনিবার্য?
সব ব্যর্থতাই যদি ‘সাময়িক’ হয়, তবে পর্যায়ক্রমে আসা সব সাফল্যও কী ‘সাময়িক’?
“বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর” – এই ভাবনার উপর ভরসা করেই কী সমাজতন্ত্রের ও সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখা!
‘সমাজ’ বহুমাত্রিক, কোনও ‘হিসেব’-ই মেলে না।
প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তেই মানবসমাজে অজস্র অদল-বদল ঘটে। বিশ্বের নানা প্রান্তের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ভাষিক, ইত্যাদি অজস্র উপাদানের চলমান আদান-প্রদান এক স্বাভাবিক ও অনিবার্য বাস্তবতা। চিরকালই। তবে অতি-আধুনিক প্রযুক্তির যুগে, এই দেওয়া-নেওয়ার যোগাযোগ কোনও সামাজিক শক্তির ইচ্ছা-নিরপেক্ষ। এবং তা অপ্রতিরোধ্য। ব্যক্তি-মানুষ (Individual), কোনও জাতি (Nationality), জাত (Caste), গোষ্ঠী (Community), শ্রেণী (Class), সকলেরই জীবনযাপন-ইচ্ছা-ভাবনা-মূল্যবোধ সবকিছু প্রতি মুহূর্তেই প্রভাবিত হচ্ছে এবং দ্রুত বদলে যাচ্ছে এই প্রযুক্তিগত যোগাযোগের প্রভাবে। লোকালয় ছেড়ে হিমালয়ের কোলে আশ্রয় নেওয়া ‘সাধু’-কেও বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দেখেছি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে যা-ই ঘটুক – সাম্রাজ্যবাদের তান্ডব, গণ-আন্দোলনের জোয়ার, ধর্মীয় উন্মাদদের হামলা, উগ্র জাতি-বৈরিতার আস্ফালন, কৃষিব্যবস্থার অকল্পনীয় অগ্রগতি, কিম্বা মঙ্গলগ্রহে মানুষের যাত্রা – আধুনিক সময়কালে তা মুহূর্তমধ্যে সকলেই জানতে / দেখতে পারেন। ফলে, জনগণের অভিজ্ঞতা অতি দ্রুত বেড়ে চলে; তাঁদের জ্ঞান এগিয়ে চলে দ্রুত গতিতে। কিন্তু আমরা – কমিউনিস্টরা – এখনও পঞ্চাশ, একশো, দেড়শো বছর আগেকার সামাজিক হিসেব-নিকেশেই নিরঙ্কূশ আস্থাশীল! সময়ের অগ্রগতির বা পরিবর্তনের ছাপ আমাদের বহুজনেরই চিন্তা-ভাবনা-কাজে সাধারণভাবে প্রতিফলিত হয়না!
কার্ল মার্কসের সব ‘হিসেব’ বা স্বপ্ন কী মিলেছে? কিম্বা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের? ভি আই লেনিন, অথবা জে ভি স্তালিন, কিম্বা মাও ৎসে তুঙ, কার প্রত্যেকটি আশা পূরণ হয়েছে কিম্বা ‘হিসেব’ মিলেছে? মেলেনি, মিলতে পারেওনা। কারণ তাঁরা কেউই ‘ভগবান’ অথবা ‘আল্লাহ্’ ধরনের সর্বজ্ঞ ছিলেন না! তাঁরা সকলেই ছিলেন স্বাভাবিক ও মানবিক সীমাবদ্ধতা সম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী। তাঁদের ‘ত্রিকালদর্শী মহাপুরুষ’-এর আসনে বসিয়েছে বাস্তবতা বোধহীন কিছু মানুষ।
যে কোনও দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সফলতার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হল: “বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ” (‘Concrete analysis of the concrete situation.’)। আমাদের এখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলন ১২২-বছরেও সেই কাজটুকু করে উঠতে পারলো না! সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে ব্যক্তিগত ও বিক্ষিপ্ত কিছু গবেষণার প্রয়াস ছাড়া, সুসংবদ্ধ ও সুগ্রথিত কোনও দিশা আজও কমিউনিস্ট কর্মীদের সামনে নেই! অসম্পূর্ণ ও পুরানো কেতাবি জ্ঞান নিয়েই চলছে তথাকথিত ‘সমাজ পরিবর্তন’-এর প্রয়াস!
ভারতীয় ভূখণ্ডে জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পরম্পরাগত –
ক) জাত-ব্যবস্থার (Caste-system) সুগভীর প্রভাব;
খ) অসম অর্থনৈতিক (Economic) পরিস্থিতি [আদিম ‘ঝুম’ চাষ থেকে আধুনিকতম ট্রাক্টর]-এর প্রভাব;
গ) সাংস্কৃতিক (Cultural) বাস্তবতার রংধনু সৌন্দর্য;
ঘ) নৈতিকতা বোধের (Ethos) বিভিন্নতা;
ঙ) মানবিক মূল্যবোধ (Humane Values)-এর ধারা;
চ) প্রাচীন দার্শনিক (Philosophical) শিক্ষার মহিমা; –
এসব কোনও কিছুই যথাযথ গুরুত্ব পেলো না কমিউনিস্ট শিবিরের কাছে! গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বাস্তবতাকে না জেনে, চিনে, বুঝে, উপেক্ষা করাই কমিউনিস্ট আন্দোলনের দস্তুর হয়ে রইলো! শুধু উপলব্ধিহীন মন্ত্রোচ্চারণের মতো কিছু বাঁধাধরা রাজনৈতিক শব্দাবলীর ক্লান্তিকর ব্যবহার! বাংলার তথা ভারতবর্ষের রথী-মহারথী বহু সংসদবাদী কমিউনিস্ট নেতা মুখে সর্বদাই ‘কমিউনিস্ট’, কাজে সর্বদাই পুঁজিবাদে আস্থাশীল।
মার্কসবাদের তাত্ত্বিক শিক্ষা সম্পর্কে চরম অজ্ঞ, কলে-কারখানায় ক্ষেতে-খামারে বাস্তব শ্রেণীশোষণ ও শ্রেণীসংগ্রামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাহীন, ‘আভিজাত্য’ সম্পন্ন এবং ‘উচ্চশিক্ষিত’ দপ্তরজীবী পেটিবুর্জোয়া নেতারাও এখানে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সারা জীবন মাতব্বরি করার সুযোগ পান! কিন্তু মাঠে-ময়দানে যে অজস্র কমিউনিস্ট লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যান জীবনপণ ক’রে, নির্মম অত্যাচার সহ্য করেন শ্রেণীশত্রুদের হাতে, আত্মত্যাগের মহত্বপূর্ণ ইতিহাস রচনা ক’রেন, কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিত গড়ে তোলেন যাঁরা– তাঁদের খোঁজও মিলবে না পার্টির ইতিহাসে! শুধুই ‘নেতা’-দের স্তাবকতাসর্বস্ব গুণকীর্তন। পরিণতি যা হবার, তা-ই হয়েছে।
ভারতবর্ষে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হল কবে!
গঠনকাল থেকেই, তা সে ১৯২০ বা ১৯২৫, যা-ই হোক,আদৌ কোনও কমিউনিস্ট পার্টি ভারতবর্ষে গঠিত হয়েছে কিনা, শতবর্ষ পরে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
দেশের শ্রমজীবীদের মধ্যে শিকড়হীন এবং নানারকম মানসিকতার কয়েকজন মানুষ প্রথমে একটা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার উদ্যোগ নেন বিদেশের মাটিতে বসে। এঁদের কেউ হয়তো অতীত বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের কুশীলব এবং বিপুল আর্থিক তছরূপের পান্ডা; কেউ কেউ ইসলামিক বিশ্বের (Pan-Islamism) স্বপ্নপূরণের জন্য দেশত্যাগ করেছিলেন; কেউ কেউ বিবাহ করেছিলেন সন্দেহজনক অতীত সম্পন্ন বিদেশিনী মহিলাদের। এঁরা হঠাৎ রাশিয়ার তাসখন্দে বসে সস্ত্রীক একটি ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ তৈরি করে বসেন(১৯২০)। এমন একটি পার্টি প্রকৃত অর্থে বাংলার বা ভারতবর্ষের কোনও কমিউনিস্ট পার্টি হতেই পারেনা।
দলবদ্ধ কিম্বা ব্যক্তিগত, যে কোনও ব্রিটিশ-বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামকে কামান-বন্দুক-চাবুক-বেয়নেট-ফাঁসি দিয়ে মোকাবিলা করাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ধারাবহিক পদ্ধতি। মজনু শাহ, ভবানী পাঠকদের নেতৃত্বে ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহ; জগন্নাথ শাহ, রাণী চূড়ামণীদের নেতৃত্বে চূয়াড় বিদ্রোহ; সিধো, কানহোদের নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে, ১৯০৮ সালে বোমা ছোঁড়ার মিথ্যা অভিযোগে ক্ষুদিরাম বসুকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো কিম্বা ১৯১৫ সালে অসম যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (‘বাঘা যতীন’)-কে গুলি ক’রে হত্যা, - একই শাসন পদ্ধতির সহিংস ধারাবাহিকতা।
১৯১৭ সালে রুশ-বিপ্লবের জয় দুনিয়ার পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বুকে মৃত্যুভয় জাগিয়ে তোলে। তারা দুনিয়া জুড়েই কমিউনিস্টদের সম্পর্কে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। সেই পরিস্থিতিতে, সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ ভারতবর্ষে, একদা সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত এবং পরবর্তীকালে আহমেদাবাদে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর আশ্রমিক সত্যভক্ত, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে কানপুরে (১৯২৫) আহ্বান করেন “প্রথম ভারতীয় কমিউনিস্ট কনফারেন্স।” প্রায় ৩০০ কমিউনিস্ট সেই প্রকাশ্য অধিবেশনে জড়ো হ’ন। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট এম.পি. সাপুরজি সালাতওয়ালা লিখিত বক্তব্য পাঠিয়ে আশা প্রকাশ করেন, “এই কংগ্রেস ভারতবর্ষে একটি বৃহৎ ও স্থায়ী কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনায় পরিণত হবে।” এবং, আবার একটি ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠিত হয়! ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসন চলাকালীন এবং ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের উপর সহিংস দমনপীড়নের মধ্যে, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশ্যে ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠনের এই ইতিহাস সত্যিই বেশ চিত্তাকর্ষক!
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দমন-পীড়ণের মধ্যেই ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট নেতার (সত্যভক্ত) ‘‘প্রকাশ্য কমিউনিস্ট পার্টি’’ গড়ার উদ্যোগ; শারীরিক অসুস্থতা-র কারণে কমিউনিস্ট নেতাকে (মুজফ্ফর আহমদ) সাম্রাজ্যবাদী শাসক দয়াপরবশ হয়ে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া; কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকে (অবনী মুখার্জী) ব্রিটিশ পুলিশ ‘অভিযোগ’ থেকে ছাড় দেওয়া; প্রধান প্রতিষ্ঠাতা (মানবেন্দ্রনাথ রায়) অপর এক প্রতিষ্ঠাতাকে “ভবঘুরে” (‘Vagabond’) মনে করা; এক নেতাকে (যতীন মিত্র) এক প্রতিষ্ঠাতা নেতা “নির্বোধ এবং অকেজো” (‘Stupid and useless’) হিসাবে চিহ্নিত করা; –ইত্যাদি তথ্যও খুবই মজার!
১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনের আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব কেনও ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির কোনও অস্তিত্বই স্বীকার করেননি, তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না।
শত্রুর কারাগারে বন্দী কমিউনিস্ট নেতাদের কেনও পাঁউরুটিতে মোটা ক’রে মাখন মাখানোর এবং মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট রাঁধার রাজকীয় সুযোগ দেওয়া হয়! তাঁদের কাছে প্রশাসনিক কর্তারা কোন ভরসায় মার্কসবাদী বইপত্তর নিশ্চিন্তে পৌঁছে দেয়! বিদেশে যাবার জন্য কারাগার থেকে পুলিশ ভ্যান কেনও বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতাকে বিমান বন্দরে পৌঁছে দেয়! কমিউনিস্ট নেতা সম্পর্কে “ব্রেকিং নিউজ” সংগ্রহের জন্য, চিকিৎসা কেন্দ্রের বাইরে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম কিসের স্বার্থে দিনের পর দিন ক্যামেরা নিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে ! – এইসব বিস্ময়ের জবাবও কিছুটা অন্তত আঁচ করা যায় – ঔপনিবৈশিক দেশে ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠনের বিস্ময়কর তথ্যাবলী থেকে। পরবর্তীকালের ইতিহাস তো অবিরাম পার্টি ভাঙা-গড়ার, এবং পেটিবুর্জোয়া নেতাদের তরফ থেকে পার্টি-দখলের লক্ষ্যে মরিয়া প্রচেষ্টার বিবেকহীন ধান্দাবাজির ও নোংরামির বিচিত্র কাহিনীতে ভরা!
কয়েক হাজার কমিউনিস্ট কর্মীকে হত্যার ও অত্যাচারের জন্য দায়ী এবং অনুশোচনাহীন একাধিক বুর্জোয়া দলের মধ্যে কারা বেশি ‘গণতান্ত্রিক’, সেই বে-সরম চর্চাতেই এখন সংসদবাদী কমিউনিস্ট নেতারা ব্যস্ত! সংসদীয় রাজনীতির স্বার্থে এইসব জল্হাদ দলগুলোর মধ্যে কাদের সঙ্গে ‘ঐক্য’ বা ‘জোট’ কিম্বা ‘মোর্চা’ অথবা ‘মডেল’ গড়ে তোলা যায়, সেটা ঠিক করাই এখন সংসদবাদী কমিউনিস্ট নেতাদের কাছে “বাম ও গণতান্ত্রিক” কর্তব্য হয়ে উঠেছে!
কমিউনিস্ট আন্দোলনের ১০২-বছর পার হয়ে গেলেও, আজও এখানকার বিশাল বিশাল কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা “না ঘরকা, না ঘাটকা” হয়েই রইলেন। এঁরা না হ’তে চাইলেন গণবিপ্লবের অগ্রণী সৈনিক, না হ’তে পারলেন সংসদীয় রাজনীতির সফল খেলোয়াড়। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে শিকড়হীন কিছু পেটিবুর্জোয়া দপ্তরজীবী ‘বাবু’ নেতারাই সমাজে কমিউনিস্ট পরিচয় নিয়ে দাপিয়ে বেড়ালেন! সদস্য-কর্মীদের মধ্যে কমিউনিস্ট উপাদান চিরকালই ছিল এবং আছে। কিন্তু ‘নেতা’-রা কখনোই পেটিবুর্জোয়া সীমাবদ্ধতার বাইরে বেরোতেই চাইলেন না।

প্রত্যক্ষ বিশ্বাসঘাতকতার জ্বলন্ত নজির


বাংলায় বা ভারতবর্ষে, জনবিরোধী শাসকের সশস্ত্র হামলাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে যখনই স্থানীয় কমিউনিস্টদের উদ্যোগে কোথাও কোনও সংগ্রাম সশস্ত্র প্রতিরোধের স্তরে উঠেছে, পার্টির উচ্চস্তরের ‘নেতা’-রা তখনই সেই সংগ্রামকে শেষ ক’রে দেওয়ার কাজে তৎপর হয়েছেন। এঁদের মধ্যে থেকে পুলিশের চরবৃত্তিরও প্রমাণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়ে। নেতৃত্ব চিরকালই নানাভাবে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন কৃষক সমাজ এবং শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি। তেলেঙ্গানা ও নক্সালবাড়ির চিরউজ্জ্বল কৃষক বিদ্রোহ তেমনি দু’টি জ্বলন্ত নজির।
১) ১৯৪৬ সালে শুরু হওয়া তেলেঙ্গানা কৃষক সংগ্রামে প্রথমে নিজামশাহির এবং তারপর কংগ্রেসী আমলের সেনা হামলায় শহীদ হয়েছিলেন চার হাজার কৃষক। মুক্ত হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার গ্রাম। পাঁচ বছর পর, ১৯৫১ সালে “স্টপ ইনকিলাব পর বেটার ইনকিলাব”-এর মতো বিশ্বাসঘাতকতার লাইন নিয়ে, দপ্তরজীবী পেটিবুর্জোয়া পার্টি-নেতৃত্ব রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে সংগ্রামী যোদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন। “পার্টি-শৃঙ্খলা”-র দোহাই দিয়ে, শ্রেণী-যোদ্ধাদের হাতে-পায়ে কার্যত শৃঙ্খল পরিয়েছিলেন সেদিনের কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট (!) নেতারা।
২) ১৯৬৭ সালের ২৪ মে, বছরের পর বছর জোতদার-জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নক্সালবাড়ি অঞ্চলের কয়েক হাজার কৃষক-শ্রমিক বিদ্রোহ ঘোষণা করার পরদিনই, ২৫ মে, ‘মার্কসবাদী’ (!) কমিউনিস্ট নেতাদের পরিচালনাধীন ‘যুক্তফ্রন্ট’ সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে আটজন কৃষক রমণী [যাঁদের মধ্যে তিনজন সিপিআই (এম)-এর সদস্য] এবং দুটি শিশু সহ এগারো জনকে। নক্সালবাড়ির এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র দার্জিলিং জেলা কমিটিরই নেতৃত্বে। এর পর থেকে একের পর এক হত্যা, গ্রেপ্তার, অত্যাচার চলতেই থাকে সংগ্রামী কৃষক ও শ্রমিকদের উপর। পুলিশের গুলিতে ‘নক্সালপন্থী’-দের মৃত্যু না হওয়ায়, সিপিআই (এম) দলের এক বাঘা বিপ্লবী নেতার কদর্যতম উক্তি - “পুলিশের গুলিতে কী নিরোধ লাগানো আছে?” - ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছে! এরই পাশাপাশি চলতে থাকে পার্টির উচ্চস্তরের নেতাদের নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও হুমকি।
সংসদীয় রাজনীতির দয়ায় যখন যেখানে যতটুকু শাসন ক্ষমতা হাতে পেয়েছেন এঁরা, জনগণকে কিঞ্চিৎ আর্থিক সুবিধা দেওয়া ছাড়া, পুরো ক্ষমতাই ব্যবহার করেছেন বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের এবং পুঁজিপতি ও সামন্তপ্রভুদের স্বার্থে। সরাসরি জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের কাজে। এমনকি মানুষের প্রতিবাদী / প্রতিরোধী / সংগ্রামী মানসিকতাকে নষ্ট ক’রে দিয়ে, ধারাবাহিকভাবে শ্রমিক শ্রেণী, কৃষক সমাজ সহ সমগ্র শ্রমজীবী জনগণের প্রত্যক্ষ শ্রেণীসংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে জনগণের সংগ্রামী মেরুদন্ড ভেঙে দিয়ে, কার্যত তাঁদের পরিণত করার চেষ্টা চালিয়েছে “একদল ভোটদাতা ভেড়ার পাল”-এ (এঙ্গেলসের ভাষা)। শ্রমজীবী মানুষদের গ’ড়ে তুলতে চেয়েছেন শুধুমাত্র মিছিল, মিটিং, ডেপুটেশন, ধর্না, নির্বাচনের মতো কর্মসূচির অসহায় বোড়ে। শ্রেণীসংগ্রামকে উচ্চস্তরে উন্নীত করার সচেতন চেষ্টা চালিয়ে যাবার প্রকৃত কমিউনিস্ট কর্তব্যের বদলে, দলগত নির্বাচনী কামড়াকামড়ি-খেয়োখেয়ী-মারামারি চালিয়ে যাবার মতো বুর্জোয়া রাজনীতির ‘জঙ্গী’ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছেন শ্রমজীবী মানুষকে!
এঁরা নিজেরা একেকটি রাজনৈতিক দল তো অবশ্যই; কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর কমিউনিস্ট পার্টি কখনোই না। বরং নিপাট পেটিবুর্জোয়া পার্টি। “সীমাবদ্ধ ক্ষমতা” নিয়েও এঁরা নিজেদের শাসনাধীন অঞ্চলে অসীম দমন-পীড়ন-অত্যাচারের উদাহরণ তৈরি করেছেন বারবার। কিন্তু শোষকশ্রেণীর গায়ে আঁচড়টিও কাটেননি। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার কিম্বা আফ্রিকার প্রশ্নে এঁরা ভয়ঙ্কর প্রগতিশীল (!) ভূমিকা পালনে তৎপর হয়ে ওঠেন! ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটা একসময়ে বাংলায় তথা ভারতবর্ষে, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের কাছেই ছিল শ্রদ্ধেয় – তাঁদের সততা, ত্যাগ, আদর্শনিষ্ঠার জন্য। কিন্তু এইসব ভোটবাদী নেতাদের কার্যকলাপের দৌলতে, জনগণমনে কমিউনিস্ট শব্দটাই যেনো হয়ে উঠেছে ‘সুবিধাবাদী’ ও ‘বিশ্বাসঘাতক’-এর সমার্থক শব্দ!
পাশাপাশি, সমান্তরাল কমিউনিস্ট ধারা হিসেবে রচিত হয়ে চলেছে আত্মবলিদানের, আত্মত্যাগের, বিপ্লবী ঘৃণার এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। কিন্তু বাস্তব বোধহীনতা এঁদের বেলাতেও প্রকট। ব্যাপক এবং সংগঠিত গণসংগ্রাম ও শ্রেণীসংগ্রামের বদলে, ব্যক্তিগত প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার বেদনাদায়ক কর্মসূচিই এঁদের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী-সামন্তবাদী শক্তির, বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের গায়ে এঁদের শ্রেণী-ঘৃণার ছোঁয়াও লাগেনা। যে সমাজ-পরিবর্তনের তাড়নায় এঁদের এতো পবিত্র আত্মাহুতির আয়োজন, সেই ‘সমাজ’ কিন্তু শহীদদের এক সাগর রক্তপ্রবাহ দেখেও বিচলিত হয় না! বিপ্লবের স্বপ্ন বুকে নিয়ে শৌর্য, বীর্য, মেধা ও ত্যাগের এমন আরাধনার রাজনৈতিক মূল্যায়ন শেষপর্যন্ত কী হয়, তা ভবিষ্যতই বলবে।
কমিউনিস্টদের ‘নীতি’ আন্তর্জাতিক, ‘পদ্ধতি’ জাতীয়
কমিউনিস্টরা ইতিহাস অধ্যয়ন করে অতীত ঘটনার অন্ধ অনুকরণ করার জন্য নয়। ঘটনাবলী থেকে মূল শিক্ষা গ্রহণ ক’রে, বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই শিক্ষা প্রয়োগ করার তাগিদে। অতীতে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রতিটি বিপ্লবেরই নিজস্ব (Particular) বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু প্রতিটি বিপ্লব থেকেই দুটি সাধারণ (General) সত্যও বেরিয়ে এসেছে, যা সকল দেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
১) সশস্ত্র শাসকশ্রেণী কোনওভাবেই ক্ষমতার গদি থেকে শান্তিপূর্ণ পথে সরে যায়না।
২) শোষিত শ্রেণীকেও শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে শস্ত্রভাবেই মোকাবিলা করতে হয় শোষক শ্রেণীর। কারণ, অন্যায়ের প্রতিরোধী সংগ্রামকে শেষপর্যন্ত শাসকের সশস্ত্র আক্রমণের মূখে পড়তেই হয়।
পৃথিবীতে এর কোনও ব্যতিক্রম আজও দেখা যায়নি। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, শেষপর্যন্ত যে “বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে” - এই অমোঘ সত্যই বিভিন্ন সময়ে, দুনিয়ার দিকে দিকে বারবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইতিহাসে। এখানকার বিভিন্ন ‘কমিউনিস্ট নেতা’-র মনোগত ইচ্ছা ও পচ্ছন্দের উপর নির্ভর ক’রে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হতে পারে না।
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে কমিউনিস্টদের আদর্শিকভাবে মৌলিক কোন (What) কাজ করতে হবে, সেই শিক্ষা আন্তর্জাতিক। কিন্তু কীভাবে (How) করতে হবে, তা অতি অবশ্যই স্থানীয় বৈশিষ্ট্য নির্ভর। একটি পুঁজিবাদী, কিম্বা সমাজতান্ত্রিক, অথবা আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশে সমাজতন্ত্র গঠনের পথ ও পদ্ধতি আলাদা হতে বাধ্য। কিন্তু শোষিত শ্রেণীর শাসন কায়েমের লক্ষ্য সর্বদা আন্তর্জাতিকভাবেই প্রযোজ্য। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ১৭৪ বছরের ইতিহাস আমাদের অনেককিছুই শিখিয়েছে। কিন্তু কোনও দেশের সমাজ পরিবর্তনের নির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি কী হবে, তা সেখানকার কমিউনিস্টদের কাছে অজানা থাকতে বাধ্য। সংগ্রাম এগোতে এগোতেই ঠিক হয় পথ। প্রতিটি দেশেই সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী-ই সেই নির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি ঠিক হয় এবং হবে। এটা অনিবার্য। সেই নতুন পথের অন্বেষণ সমসাময়িক ও প্রকৃত কমিউনিস্ট কর্মীবাহিনীরই কর্তব্য। বাংলার তথা ভারতবর্ষের বিপথগামী এবং বিপ্লবভীরু কমিউনিস্ট নেতৃত্ব এ’কাজে প্রমাণিত অক্ষম ও অনিচ্ছুক। এ’কথা বারবার প্রমাণিত।
এইসব দপ্তরজীবী পেটিবুর্জোয়া ‘কমিউনিস্ট’ নেতাদের বদলে, বাস্তব ও কঠোর শ্রেণীসংগ্রামের ময়দান থেকে উঠে আসা কমিউনিস্ট নেতৃত্বেই আগামীতে রচিত হবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নতুন অধ্যায়। “শ্রমিক শ্রেণীগুলোর মুক্তি শ্রমিক শ্রেণীগুলোকে নিজেদেরই জয় ক’রে নিতে হবে।” (“The emancipation of the working classes must be conquered by the working classes themselves.”) – কার্ল মার্কসের এই গভীরতম পর্যবেক্ষণকে যথার্থই উপলব্ধি করতে হবে। এবং প্রতিমুহূর্তে তা স্মরণে রাখতে হবে কমিউনিস্ট কর্মীবাহিনীকে। প্রকৃতই শোষণহীন, বৈষম্যহীন, অত্যাচারহীন সমাজতন্ত্রের দিকে মহত্তম যাত্রাকে নীতিনিষ্ঠভাবে সফল করাই কমিউনিস্টদের দীর্ঘমেয়াদি কর্তব্য।

শ্রেণী-চেতনাই প্রকৃত কমিউনিস্ট চেনার কষ্টিপাথর


‘গণতন্ত্র’ জোরদার করার ধূয়া তুলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়েছে; সেখানে বেদনাদায়কভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’-র গালভরা বাণী শুনিয়ে চীন-ও অধঃপতিত হয়েছে একটি পুঁজিবাদী দেশে; বিশ্বের নানা প্রান্তে সে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার অর্থনৈতিক ঋণের ভয়ঙ্কর ফাঁদ। আমাদের এখানেও যখন কমিউনিস্ট নেতাদের তরফ থেকে শ্রমিকশ্রেণীর শাসন কায়েমের বদলে বুর্জোয়া ‘গণতন্ত্র’ জোরদার করার দাবি ওঠে, এবং ‘শিল্পায়ন’-এর মোড়কে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকেই শক্তিশালী করার তত্ত্ব ফেরি করা হয়, তখন পুঁজিবাদের সিঁদুরে মেঘ দেখে সাধারণ কমিউনিস্ট কর্মীদের আতঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক।
সংগঠনের বিশালতা, জনমোহিনী ভাষণ, বর্নাঢ্য মিছিল, উত্তপ্ত শ্লোগান, – কোনওকিছুতেই কমিউনিস্ট চরিত্র বোঝা যায় না। একটি আপাদমস্তক বুর্জোয়া দলেরও এ’সব বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। পুঁজিবাদ-সাম্রজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং সমাজতন্ত্রের স্বার্থে, নিরন্তর ও নিরলস শ্রেণীসংগ্রাম চালানোই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কিম্বা দলবদ্ধ কমিউনিস্টদের কর্তব্য। কথায় বলে, “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়।” কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিপর্যয়ের সিঁদুরে মেঘ দেখলেও, কমিউনিস্টরা আবার শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামী ঘর বাঁধে। হাজারো দক্ষিণপন্থী কিম্বা বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটলেও, কমিউনিস্টরা কখনোই ভুলতে পারেনা কমিউনিস্ট ইস্তেহারের সেই মহত্তম আহ্বান, “পৃথিবীর সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ, ঐক্যবদ্ধ হও।” (‘Working Men of All Countries, Unite.’) এই ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে (অবিরাম ভাঙনের পথে নয়) পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের চিরতরে বিলুপ্ত করাই প্রকৃত কমিউনিস্টদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। দৈনন্দিন কাজকর্ম সেই লক্ষ্যপূরণে কতটুকু সাহায্য করতে পারছে, কমিউনিস্টদের কাছে তা নিয়মিত মূল্যায়নের বিষয়। শুধুমাত্র সমাজে চুরি জোচ্চুরি জালিয়াতি এবং সম্প্রদায়গত ঘৃণা-মারামারি-কাটাকাটি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াই নয়; জাতি-জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জনগণের উপর চলমান শ্রেণী-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম চালানোই কমিউনিস্টদের মূল কর্তব্য। কমিউনিস্টরা ছাড়া আর সকলেই এই সংগ্রাম চালাতে সম্পূর্ণ অপারগ, অনিচ্ছুক।
পুঞ্জিভূত হাজারো প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই খুঁজতে হবে। সমাজকে এবং সামাজিক আন্দোলনকে চেনা-জানা-বোঝার গভীরতম চেষ্টাও চালাতেই হবে। “অজানাকে বশ ক’রে তুই করবি আপন জানা।” (রবীন্দ্রনাথ) – এটা শুধুমাত্র কবির মনোগত বাসনাই না; কমিউনিস্টদেরও ছেদহীন কর্তব্য। প্রশ্নহীন, চিন্তাহীন, তথাকথিত ‘আনুগত্য’ নিয়ে কলুর বলদের মতো অবিরাম ‘কাজ’-এর জোয়াল কাঁধে ঘুরে চলা কোনও কমিউনিস্ট কর্মীর কর্তব্য হতে পারে না।
নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে কারা কারা বর্তমানে বাংলার জনগণকে ‘উদ্ধার’ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ?
১) গোঁড়া হিন্দু সাম্প্রদায়িক, উগ্র মুসলমান বিরোধী, কমিউনিস্টদের ঘোষিত শত্রু, এবং ফ্যাসিস্ট হিটলারের আদর্শগত সমর্থক সংগঠন আরএসএস-এর রাজনৈতিক প্রতিনিধি– বিজেপি।
২) বনেদি রাজা-মহারাজা এবং বৃহৎ ভূস্বামী, বড় পুঁজিপতি এবং ব্রিটিশ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিশ্বস্ত প্রতিনিধি, কয়েক হাজার কমিউনিস্ট নিধনকারী দল– কংগ্রেস।
৩) বিন্দুমাত্র নীতি-নৈতিকতাহীন, হাজার হাজার কমিউনিস্ট হত্যাকারী জল্হাদ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের রাজনীতিতে দীক্ষিত, শ্রমজীবী মানুষের সংবিধানসম্মত আন্দোলনের উপরেও সর্বদাই হামলাকারী, কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাস, এবং অকল্পনীয় ঘুষ-চুরি-জালিয়াতি-মিথ্যাচারের ইতিহাস সৃষ্টিকারী– তৃণমূল কংগ্রেস
৪) ‘কমিউনিস্ট’ পরিচয় নিয়েও পুঁজিবাদের সহযোগী শক্তি, বুর্জোয়া ‘গণতন্ত্র’-কে বাঁচিয়ে রাখতে এবং শক্তিশালী করতে ঘোষিত ভাবেই বদ্ধপরিকর, বারবার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র হত্যার অপরাধে কলঙ্কিত– সিপিআই(এম)।
এই দলগুলোই পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ময়দানে প্রধান প্রধান খেলোয়াড়। তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ ছিল এদেরই অবদান; তথাকথিত ‘পরিবর্তন’ হয়েছে এদেরই হাত ধ’রে; এখন তথাকথিত ‘পরিত্রাণ’-ও নাকি আসতে পারে এদেরই দয়ায়!
কংগ্রেসের বদলে বিজেপি এবং বিজেপি-কে হারিয়ে আবার কংগ্রেস; কংগ্রেস-এর বদলে সিপিআই(এম) এবং সিপিআই (এম)-কে হারিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস; … এই অনন্ত চোরাগলিতে ঘুরপাক খাওয়াই ‘সংসদীয় রাজনীতি’। সব দলই ক্ষমতার লোভে (প্রয়োজনমতো) সব দলের ‘বিরোধী’! শুধু ‘নির্বাচনে জয়ী’ সব শাসকেরই গণতান্ত্রিক শাসনের ঠ্যালা বোঝে খেটে খাওয়া মানুষ। তাই সংসদীয় মিথ্যার প্রমাণিত চোরাগলিতে ঘুরপাক না খেয়ে, প্রতিটি শাসক দলের প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ/ প্রতিরোধ অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদই হতে হবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধান শত্রু। ‘ভবিষ্যৎ’ মূল লক্ষ্যে অবিচল থাকা কমিউনিস্টদের আদর্শিক কর্তব্য। যে কোনও পরিস্থিতিতেই।
জটিল ও অজানা চলার পথে যেকোনও সময়ে বিচ্যুতি ঘটতেই পারে। তবে সদিচ্ছা থাকলে তা শুধরেও নেওয়া যায়। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতাদের সচেতন বিপথগামিতা ক্ষমার অযোগ্য। সমাজবাদের নাম ক’রেও পুঁজিবাদের সেবা, শ্রমিকশ্রেণীর শাসনের বদলে বুর্জোয়া শাসনের উমেদারি – সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই না। আশা করা যাক, দুনিয়া জুড়ে একদিন শক্তিশালী হয়ে উঠবেই সমাজতন্ত্র অর্জনের মরণজয়ী লড়াই। প্রকৃত কমিউনিস্ট কর্মীদের প্লাবনে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠবে নিষ্প্রভ কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুনিয়া। একপক্ষের যুক্তি এবং তিরস্কার, আর তার পাল্টা যুক্তি ও ধমক, -- কমিউনিস্ট আন্দোলনে এই অন্তহীন, অমীমাংসিত ও শত্রুতামূলক তর্কাতর্কির নিষ্ফলা আত্মবিনাশী চর্চা বন্ধ হলেই মঙ্গল! শুরু হোক, যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির ‘সমন্বয়’ (Synthesis)। মনে রাখতে হবে, কোনও কমিউনিস্ট পার্টির ‘নেতা’ কিম্বা ‘সদর দপ্তর’ কখনোই বিজ্ঞতার কেন্দ্র (centre of wisdom) না। গণসচেতনতার মহাসমুদ্র মন্থন ক’রে এবং শোষিত জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, লড়াই-সংগ্রামের ময়দানেই খুঁজতে হবে আগামীর পথ। সেটাই প্রকৃত কমিউনিস্টদের কর্তব্য।

উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিশা


সময়ের সঙ্গেসঙ্গে পুঁজিবাদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছিল সমাজে। কোনও পূর্বনির্ধারিত তাত্ত্বিক আদর্শ অনুযায়ী নয়। পুঁজিবাদ গড়ে ওঠার পরেই তৈরি হয়েছে তাদের নানারকম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। কিন্তু সমাজতন্ত্র এক সচেতন প্রয়াসের ফসল। শোষণ-অত্যাচারের প্রচলিত ব্যবস্থার বিকল্প ভাবনার ফসল। আপনাআপনি তা গড়ে উঠতে পারেনা। শ্রমজীবী মানুষের সচেতন ও সুসংগঠিত লড়াইয়ের মাধ্যমেই তা অর্জিত হওয়া সম্ভব। তবে “বাইরে থেকে” শ্রমিকশ্রেণীগুলোর কাছে সমাজতান্ত্রিক চেতনা পৌঁছে দেবার প্রাথমিক কাজে, পড়াশুনা জানা মধ্যবিত্ত/ পেটিবুর্জোয়াদের ভূমিকা নিঃসন্দেহেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শেষপর্যন্ত শ্রমজীবী জনগণের ঘাড়ে সমাজতন্ত্রের এই পেটিবুর্জোয়া চিন্তা-বাহকরা চিরতরে চেপে বসে থাকেন জগদ্দল পাথরের মতো! এটাই অন্তত বাংলার তথা ভারতবর্ষের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। ১) শোষণহীন আনন্দময় জীবনযাপনের স্বার্থে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা, এবং ২) সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের শিক্ষা এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস – এ’সব যখন গতরে খাটা শ্রমিকশ্রেণীগুলো আত্মস্থ ক’রে আগামী দিনে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠবেন, একমাত্র তখনই সমাজতন্ত্র অর্জনের সংগ্রাম হয়ে উঠতে পারে অপরাজেয়। শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত, সকলের মধ্যেই কমিউনিস্ট শিবিরের ‘কাজ’ কিন্তু কখনোই থেমে নেই; ব্যালট-কেন্দ্রিক অথবা বুলেট-নির্ভর, যে ধরনের কর্মসূচিই হোক না কেন। কিন্তু সমাজে শ্রেণী-শোষণ তবুও অব্যাহতভাবেই চলছে।
শ্রমিকশ্রেণীগুলো তথা শ্রমজীবী জনগণের তরফ থেকে সমাজতন্ত্র অর্জনের সচেতন ও সঠিক প্রয়াস যদি অব্যাহত থাকে, তবে শেষপর্যন্ত পুঁজিবাদ অবলুপ্ত হবেই। ‘শিক্ষিত’ পেটিবুর্জোয়াদের দাপটে কখনোই তা হবার নয়। সমাজে শ্রমজীবী স্রষ্টারা তখনই হয়ে উঠবেন তাঁদের সকল সৃষ্টির ‘মালিক’। শ্রমজীবী জনগণের উপর পরগাছাদের যন্ত্রণাদায়ক মাতব্বরিরও তখন অবসান ঘটবে চিরতরে। সমাজতন্ত্র অর্জনের লক্ষ্যে, শতশত বছর ধ’রে অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ তখনই পাবে তার পূর্ণ সফলতা। তার আগে নয়।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.