বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা থেকে শ্রমজীবীর সংহতি

শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা থেকে শ্রমজীবীর সংহতি

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ নভেম্বর, ২০২১— সারা ভারত কিসান মজদুর সভা-র সাধারণ সম্পাদক এবং সংযুক্ত কিসান মোর্চার অন্যতম পরিচালক আশিস মিত্তল-এর একটি সাম্প্রতিক বার্তার বাংলা অনুবাদ শ্রমজীবী ভাষা পত্রিকার ১ অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতের চলমান কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার শুরুতেই তিনি বলেছিলেন:“এই কৃষক আন্দোলন মূলত একটি ধারাবাহিক আন্দোলন। এটা শিল্প ধর্মঘট বা ছাত্র ধর্মঘটের মতো বিষয় নয়। ধর্মঘটে লোকে কাজ বন্ধ করে প্রতিবাদ অবস্থানে বসে পড়ে। কিন্তু এখানে কৃষকেরা তাঁদের পেশাগত কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রতিবাদও চলছে।” কীভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে, সেটা তিনি খুব অল্প কথায় চমৎকার ব্যাখ্যা করেছিলেন। এখানে তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। বস্তুত, কৃষক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। শ্রীমিত্তলের প্রস্তাবনাটি থেকে শ্রমজীবী মানুষের সামগ্রিক লড়াইয়ের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতের পক্ষে প্রাসঙ্গিক একটা ভাবনা উঠে আসে; সেই বিষয়েই দু’একটি কথা বলা যেতে পারে।
ধর্মঘট, বিক্ষোভ, অবস্থান ইত্যাদি আয়োজনগুলি দুনিয়া জুড়েই আন্দোলনের পুরনো এবং বহুব্যবহৃত প্রকরণ। একদিকে যেমন সেগুলি প্রয়োজনীয়, অনেক সময় অপরিহার্য, অন্যদিকে আবার তাদের অতিব্যবহার এবং অপব্যবহার আন্দোলনের ক্ষতিও করে। এই প্রশ্নে তর্কবিতর্ক এবং টানাপড়েন বরাবরই আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে বলেই মনে হয়। যাঁরা স্থিতাবস্থাকে চিরস্থায়ী করার জন্য তৎপর, বিশেষ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে বলবৎ রাখা এবং উত্তরোত্তর তাকে জোরদার করে চলা যাঁদের লক্ষ্য, আন্দোলনের এই প্রকরণগুলিকে দেশের উন্নয়নের পক্ষে ক্ষতিকর বলে প্রমাণ করতে তাঁরা চেষ্টার ত্রুটি করেন না, ধর্মঘট বা বিক্ষোভের ফলে দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের দুর্দশা কত বাড়ে তা নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনে তাঁদের ক্ষান্তি নেই— যেন সেই দুর্দশা মোচনের চিন্তায় সম্বৎসর তাঁদের রাতে ঘুম হয় না। এঁদের ছেঁদো কথা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন দেখি না, সময়েরও অভাব। বিশেষ করে শ্রমজীবীর সংগঠিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ধারাটি যখন এই দেশে বেশ কিছুকাল যাবৎ অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়েছে, যেটুকু আন্দোলন হচ্ছে তাকে দমন করতেও কর্পোরেট পুঁজি এবং তার কব্জাগত রাষ্ট্রযন্ত্র যখন বদ্ধপরিকর, তখন এই প্রশ্নেই মনোনিবেশ করা জরুরি যে— ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী সংগঠন ও আন্দোলনকে কীভাবে জোরদার এবং কার্যকর তোলা যায়। আশিস মিত্তলের বক্তব্যে তার একটি সূত্র ধরিয়ে দেওয়া আছে, সেই সূত্রটি ধরেই এই লেখার অবতারণা।
কৃষক, শ্রমিক, শ্রমজীবী
প্রাথমিকভাবে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। মাসের পর মাস কৃষক আন্দোলন চলছে, কিন্তু কৃষিকাজ বন্ধ থাকেনি; শ্রমিকের কাজ বন্ধ না রেখে শ্রমিক আন্দোলন চালানো যাবে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলা দরকার— দুটো আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত বা ভিত্তিভূমি এক নয়। যে কৃষকরা আন্দোলন করছেন তাঁদের মধ্যে অনেকে অন্তত অংশত শ্রম-জীবী হতে পারেন, কিন্তু সেটা তাঁদের একমাত্র অবস্থান নয়, সাধারণভাবে প্রধান অবস্থানও নয়। তাঁরা অনেকেই জমির মালিক, সেই জমির পরিমাণ বেশি হোক বা কম হোক। বিশেষত এই আন্দোলনের ভিত গড়ে উঠেছে কৃষিজমির মালিক তথা শস্য-বিক্রেতাদের স্বার্থকে কেন্দ্র করে, তাঁরাই এই ধারাবাহিক আন্দোলনের শক্তি জোগাচ্ছেন, একে পরিচালনা করছেন। শ্রমিকদের অবস্থান আলাদা। তাঁদের কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনের উপকরণের উপরে তাঁদের মালিকানা দূরস্থান, সচরাচর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, শ্রমশক্তিই তাঁদের একমাত্র সম্পদ; সুতরাং ‘কাজ চালু রেখে’ প্রতিবাদী এবং প্রতিস্পর্ধী আন্দোলন করার প্রশ্নটা কৃষক আন্দোলনের সমগোত্রীয় হতে পারে না, হওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। এমনিতে এই কথাটা এতটাই প্রাথমিক যে আলাদা করে বলবার কোনও প্রয়োজন হয় না, কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের ‘কর্মবিরোধী’ চরিত্র নিয়ে নিন্দা ও সমালোচনা এত বেশি প্রচলিত যে, একেবারে গোড়ার কথাগুলোও স্পষ্ট করে বলে নেওয়া ভাল। বলে নেওয়া ভাল যে— শ্রমশক্তিই যাঁদের একমাত্র সম্পদ, কাজ বন্ধ রাখাটা সেই শ্রমশক্তির ব্যবহারের উপর তাঁদের নিজের অধিকার প্রয়োগ করার অন্যতম প্রধান উপায়।
কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। অন্তত দুটো প্রশ্ন। এক, ধর্মঘট ইত্যাদি কাজ-বন্ধ-রাখার প্রকরণগুলির উপরেই সর্বদা এবং সর্বত্র নির্ভর না করে অন্যান্য উপায়ে শ্রমিক আন্দোলন করা যাবে না কেন? দুই, কাজ বন্ধ রেখে যদি পুঁজিমালিক এবং রাষ্ট্রশক্তির উপর চাপ সৃষ্টি করতেই হয়, তবে এক দিনের বা সীমিত সময়ের ‘প্রতীকী’ ধর্মঘটে লাভ কী, দীর্ঘ এবং নাছোড় আন্দোলনের পথ আরও অনেক বেশি নেওয়া হবে না কেন? প্রশ্ন দুটো আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন, এমনকি পরস্পরের বিপরীত। কিন্তু আসলে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং শ্রমিক আন্দোলনের বাস্তবতাকে দুটো দিক থেকে দেখার চেষ্টা এবং সেই কারণেই পরস্পর সংযুক্ত। আমরা সেই সংযোগ নিয়েও লেখার শেষাংশে দু’একটা কথা বলার চেষ্টা করব। তবে তার আগে জোর দেব দ্বিতীয় প্রশ্নটার উপরেই। তার একাধিক কারণ। প্রথমত, প্রচলিত ছকের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে সংগঠিত বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সংযোগ সাধনের কথা নানা উপলক্ষে আলোচিত হয়ে থাকে, কেবল এ দেশে নয়, দুনিয়া জুড়েই সেই সংযোগের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে বিস্তর সমীক্ষা এবং তত্ত্বচর্চা হয়ে আসছে। তুলনায় দ্বিতীয় প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা কম হয়। দু’নম্বর কারণ হল, দ্বিতীয় প্রশ্নটা থেকে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত আমরা প্রথম প্রশ্নে পৌঁছে যাই, এবং তাতে দুটো প্রশ্নের উপরেই কিছুটা আলো পড়তে পারে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটাতে জোর দেওয়ার আরও একটা কারণ এই যে, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ-প্রশ্নের রাজনৈতিক গুরুত্ব খুবই বেশি। বড় পুঁজি এবং আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রশক্তির যে সমন্বয়ের কথা বলেছি, তার মোকাবিলায় বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদী আন্দোলন একেবারেই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ধারাবাহিক এবং বহুমুখী প্রতিবাদ ও চাপসৃষ্টির। কৃষক আন্দোলন সেটা কিছুটা করতে পেরেছে বলেই ক্ষমতার অধীশ্বররা এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। লক্ষণীয়, গত বছর কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই সংসদে পাশ করিয়ে নেওয়া শ্রম আইনের বিরুদ্ধেও ইতিমধ্যে কিছু প্রতিবাদ, সমাবেশ, ধর্মঘট ইত্যাদি হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রীদের উপর তার প্রতিক্রিয়া নিতান্ত সীমিত, অন্তত কৃষক আন্দোলনের তুলনায় অনেক কম। সুতরাং, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদ যদি কার্যকর করতে হয়, তবে বড় আকারে এবং দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম জরুরি। হঠকারী বা ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি নয়, যথার্থ সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, যাতে বহু মানুষ যোগ দেবেন, কথা বলবেন, সক্রিয় হবেন, বহু মানুষের মতামত অনুসারে যে আন্দোলন চলবে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও একই কথা বলছে। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার যে, সাম্প্রতিক কালে এমন একটি দেশে শ্রমিক-কর্মীরা বড় আকারের ধর্মঘট এবং আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, যেখানে অনুরূপ কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা গত কয়েক দশকে রীতিমতো বিরল। দেশটির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনেক কাল ধরেই সেখানে শ্রমিক সংগঠন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে এসেছে, শ্রমিক-কর্মীর সংগঠিত প্রতিবাদও সেই অনুপাতেই নিস্তেজ হয়েছে। কিন্তু ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক মহাসঙ্কটের পর থেকে অবস্থায় পরিবর্তন ঘটছিল, গত দেড় বছরে অতিমারির ধাক্কায় সেই পরিবর্তন জোরদার হয়েছে। পরিবর্তনের কিছু কিছু প্রতিফলন ঘটছে রাষ্ট্রীয় পরিসরেও, ডেমোক্র্যাট দলের বামপন্থী অংশটির চাপে জো বাইডেনের মতো স্থিতাবস্থার ধারকরাও কিঞ্চিৎ বেসামাল। তার পাশাপাশি দেশের বহু এলাকায় শ্রমজীবীরা শোষণ এবং বঞ্চনার প্রতিবাদে মুখর ও সচল হয়েছেন, বিক্ষোভ আন্দোলন আক্ষরিক অর্থে দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মঘটের তরঙ্গ এতটাই ছড়িয়েছে যে, অক্টোবর মাসের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্ট্রাইক্টোবর’— সমালোচকরা ব্যঙ্গ করে এ-নাম দেননি, এটি উদ্ভাবন করেছেন প্রতিবাদীরাই। তার পাশাপাশি বহু কর্মী এই কথা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়ে কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন যে— এই টাকায় এই অমানুষিক কাজ করে যাওয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে সংক্রমণের ভয় কাঁধে নিয়ে। রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে এই প্রতিবাদের প্রভাব পড়ছে, সেটা দেশের দক্ষিণপন্থী প্রচারমাধ্যমেও— উদ্বেগ এবং ক্রোধের সঙ্গে— স্বীকৃতি পাচ্ছে।
শ্রমজীবী মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদে ও প্রতিকারে বড় রকমের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন নিয়ে আমাদের দেশেও সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই, সেই প্রয়োজন যাঁরা স্বীকার করেন না তাঁদের চেতনা হয় মারা গিয়েছে নয়তো অচলায়তনের মালিকদের কাছে দাসখত লিখে দিয়েছে। কিন্তু বড় এবং দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের জন্য যে সামর্থ্যের প্রয়োজন, সেখানে বড় আকারের ঘাটতি আছে। ঘাটতি সংগঠনের, ঘাটতি রসদের। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলেও এই ঘাটতির স্বরূপ বোঝা যায়। সেখানে সংগঠন এবং অর্থবল দুইয়েরই অভাব হয়নি। শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তার একেবারে উল্টো, সে ক্ষেত্রে দুইয়েরই অভাব। বিশেষত, আক্ষরিক অর্থে দিন-আনি-দিন-খাই-এর এই দুনিয়ায় অর্থের প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুতর। লক্ষ করার ব্যাপার হল, মার্কিন দুনিয়ায় শ্রমিক-কর্মীদের যে বড় আকারের ধর্মঘট বা পদত্যাগ দেখা যাচ্ছে, তার পিছনে সামাজিক নিরাপত্তার সরকারি আয়োজনের একটা ভূমিকা আছে। সেই আয়োজন প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল, সেই ঘাটতি কমানোর জন্য সে দেশের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে প্রবল টানাপড়েন চলছে, কিন্তু কর্মহীন নাগরিকদের জন্য যেটুকু সরকারি অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা আছে, বিশেষত কোভিডের কালে যে বিশেষ সাহায্য করা হয়েছে, গৃহঋণের কিস্তি বা বাড়িভাড়ার মতো কিছু খরচের দায় থেকে তাঁদের সাময়িকভাবে রেহাই দেওয়া হয়েছে, সেটা শ্রমিক-কর্মীদের লড়াই করার সামর্থ্য বাড়িয়েছে। এই সত্যটা সবচেয়ে বেশি প্রকট হয় আন্দোলন-বিরোধীদের প্রতিক্রিয়ায়— তাঁরা তারস্বরে প্রচার করছেন যে, সরকারি সাহায্য না কমালে কর্মীরা কাজে আসবে না, বসে বসে সরকারের অন্ন ধ্বংস করবে। অর্থাৎ— ওদের ভাতে মারো, তা হলেই সুড়সুড় করে কাজে যোগ দেবে। পুঁজির চেহারা পাল্টেছে, ভাষা পাল্টেছে, মনের কথা পাল্টায়নি।
অতএব, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য রসদের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ভারতের মতো দেশে শ্রমিক-কর্মীদের প্রায় সকলের কাছে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যাপারটাই আকাশকুসুম। বাজারদর আকাশছোঁয়া, সরকারি সাহায্য অকিঞ্চিৎকর— এই অবস্থায় কাজ বন্ধ রেখে পুঁজিমালিকের উপর, এবং রাষ্ট্রের উপর, চাপ সৃষ্টির জন্য রসদের দরকার, যে রসদ দিয়ে শ্রমজীবীরা দীর্ঘ আন্দোলন সংগঠনের পাশাপাশি নিজেদের জীবনটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। ‘স্ট্রাইক ফান্ড’-এর পুরনো ছককে যত দূর সম্ভব ব্যবহার করার দরকার আছে, সে জন্য নতুন করে তহবিল নির্মাণের উদ্যোগও নিশ্চয়ই দরকারি, কিন্তু শিল্পের বদ্ধদশা এবং শ্রমিক সংগঠনের দুর্বলতার কারণে সেই উপায়টি অন্তত অদূর ভবিষ্যতে যথেষ্ট কার্যকর হবে বলে ভরসা হয় না। তা হলে উপায়?
সংযোগের প্রসার
এখানেই শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের সংযোগ সাধনের গুরুত্ব। সমাজ মানে শ্রমজীবী মানুষের সমাজ, যে ‘শ্রমজীবী’-র সংজ্ঞা ‘শ্রমিক’-এর নির্দিষ্ট ধারণায় সীমিত নয়, যার মধ্যে চলে আসেন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাঁরা প্রধানত নিজেদের শ্রমের উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকেন। অধিকাংশ কৃষিজীবী তো বটেই, তার সঙ্গে বেশির ভাগ ‘স্বনিযুক্ত’ মানুষ, কোনও না কোনও ভাবে গ্রাসাচ্ছাদনের চেষ্টা করে চলা অগণিত আধা বেকার বা ছদ্ম বেকার ইত্যাদি বর্গের নাগরিক, সকলেই এই শ্রমজীবী-র পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা সকলেই দরিদ্র, কিন্তু তাঁদের অভাব-অভিযোগ দাবিদাওয়ার চেহারা-চরিত্র নানা ধরনের। সেই সব দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে নানা জায়গায় নানা পরিসরে নানা উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভ আন্দোলন চলতেই থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে সংযোগ সাধন করা জরুরি। যদি সেটা করা যায়, তা হলে একেবারে নীচের তলা থেকে শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক সংহতি গড়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন বর্গের শ্রমজীবীর সেই সংহতি পরস্পরকে শক্তি সরবরাহ করবে, বেঁচে থাকার সামর্থ্য জোগাবে। সেই পারস্পরিক সহযোগিতাকে কোনও মহানুভবতা বা পরার্থপরতার বায়বীয় আদর্শ হিসেবে দেখার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই, বাস্তব জীবনসংগ্রামের তাগিদ থেকেই সেই সহযোগিতা উঠে আসবে।
বিভিন্ন দেশে, এ-দেশেও কোথাও কোথাও, তেমন সহযোগিতার নিদর্শন দেখা গিয়েছে, তার নতুন নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে। ‘মিউচুয়াল এড সোসাইটি’ বা ‘সলিডারিটি ইকনমি’ এখন দুনিয়া জুড়ে পরিচিত, ইন্টারনেটের কল্যাণে তার বহু দৃষ্টান্তের খবর এবং তথ্য পরিসংখ্যান সহজলভ্য। তার কল্যাণেই এটাও এখন আমরা জেনে নিয়েছি যে, শ্রমজীবীরা যেখানে এই ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতার বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে পেরেছেন সেখানে অতিমারির আর্থিক অভিঘাত সামলে টিকে থাকার লড়াইয়ে তাঁরা তুলনায় সফল হয়েছেন। সেই লড়াইয়ের অঙ্গ হিসেবে একটি সংস্থার শ্রমিকরা যেখানে ধর্মঘট বা পাইকারি পদত্যাগ পথ নিয়েছেন, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় মানুষ, যাঁরা ওই সংস্থার শ্রমিক নন, কিন্তু শ্রমজীবী।
শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গতি বা সামর্থ্য বাড়িয়ে তোলার প্রশ্ন থেকে আমরা এই বৃহত্তর বা প্রসারিত সংহতির কথায় পৌঁছেছি, কিন্তু প্রশ্নটা কেবল সামর্থ্যের নয়, আন্দোলনের সামগ্রিক শক্তি এবং কার্যকারিতারও। বিভিন্ন বর্গের শ্রমজীবীর দাবিদাওয়া এবং প্রতিবাদের পারস্পরিক সংযোগ যত বাড়বে, ক্ষমতাবানদের সঙ্গে টানাপড়েনে তাঁদের আপেক্ষিক শক্তি তত বেশি হবে, এটা নিতান্ত সাধারণ বুদ্ধির কথা। উত্তর-পশ্চিম ভারতের কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেছে— বিভিন্ন বর্গের কৃষিজীবী প্রতিবাদ সমাবেশে শামিল হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় ব্যাপারিদের কিছু কিছু সংগঠন, সংহতি জানিয়েছে কিছু শ্রমিক সংগঠনও। এই সংহতি ও সমন্বয়ের ফলে প্রতিবাদীদের সঙ্কল্প জোরদার হয়, মনের জোর বাড়ে, অন্য দিকে ক্ষমতার অধীশ্বরদের ওপরে চাপ বাড়ে, বিশেষত যখন তারা ভয় পায় যে সেই সংহতি নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে এই প্রক্রিয়াগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
এইখানে এসে আমরা ফিরে তাকাতে পারি পূর্বোক্ত প্রথম প্রশ্নটির দিকে: কাজ বন্ধ না রেখেও শ্রমিক আন্দোলন করা যাবে না কেন? শ্রমিক আন্দোলন বলতে সচরাচর আমরা যা বুঝি, তাতে এ-প্রশ্নটা অবান্তর মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পুঁজিমালিক বা নিয়োগকর্তার সঙ্গে টানাপড়েনের মাধ্যমে নিজেদের দাবি আদায় করা যে আন্দোলনের লক্ষ্য, সেখানে চাপ সৃষ্টি ছাড়া আর কোন উপায় শ্রমিকের হাতে থাকতে পারে? এবং, চাপ সৃষ্টির একমাত্র উপায় যে কাজ বন্ধ রাখা সেটা তো আমরা আগেই দেখেছি। এক কালে জাপানের উদাহরণ দেখিয়ে বলা হত, সে দেশে শ্রমিকরা প্রতিবাদ জানাতে কাজ বন্ধ না রেখে বেশিক্ষণ কাজ করে। আজকাল আর সে-গল্প শোনা যায় না, শ্রোতারা সেয়ানা হয়ে গেছে বলেই নিশ্চয়। সত্য এই যে, শ্রমিক আন্দোলনের ধারণাটিকে প্রসারিত না করতে পারলে এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাবে না। সেই আন্দোলন যদি বিভিন্ন বর্গের শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন ধরনের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারে, তবেই তার প্রকরণও পাল্টাতে পারে, বিস্তৃত হতে পারে। এবং পুঁজিমালিকের ওপর তার চাপও বাড়তে বাধ্য। বিশেষ করে এই কারণে যে, এই সংহতি শ্রমজীবীর রাজনীতিকেও জোরদার করে তুলবে।
শেষ করার আগে একটা কথা বলা দরকার। গত কয়েক দশক ধরে দুনিয়া জুড়ে, এবং আমাদের চেনা দুনিয়াতেও, নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্রের দিগ্বিজয়ের একটা ভয়ানক পরিণাম হল— শ্রমিকের সংগ্রাম ক্রমশই খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই সংগ্রামের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক উত্তরোত্তর খর্বিত হয়েছে। এটাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, ধনতন্ত্রের প্রবক্তারা এই প্রক্রিয়াকে যুক্তিসঙ্গত ও উন্নয়ন-প্রসারী বলে অভিহিত করে থাকেন। তাঁদের বক্তব্য, একটি সংস্থার শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়োগকর্তার টানাপড়েনে ‘বাইরের লোক’ আসবে কেন, বাইরের রাজনীতিই বা সেখানে কেন নাক গলাবে? স্পষ্টতই, এই ‘যুক্তি’ আসলে সম্পূর্ণত পুঁজির অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের কৌশল, শ্রমিকদের দুর্বল করে এবং তাঁদের রাজনীতিকে নিষ্ক্রিয় করে যে কৌশল চরিতার্থ হতে চায়। আর সেটাই বলে দেয়, এই বিচ্ছিন্নতার উল্টো দিকে এগিয়ে চলাটাই প্রথম কাজ। কেবল বিভিন্ন সংস্থা ও শিল্পের শ্রমিকের সংহতি নয়, সমস্ত শ্রমজীবীর সংহতি গড়ে তোলাই পুঁজির অভিযানকে প্রতিহত করার শর্ত। আবশ্যিক এবং জরুরি শর্ত।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.