বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট, ২০২১— শৃঙ্খল ছাড়া শ্রমিকের কিছুই হারাবার নেই— এই সত্য যে কেবল মুক্তির মন্ত্র নয়, ভয়ঙ্কর বাস্তবও বটে, কার্ল মার্ক্স অন্তত সেটা বিলক্ষণ জানতেন। তাঁর তত্ত্ব এবং রাজনীতির গোড়ার কথাটাই এই যে, শ্রমিকের সম্পদ বলতে আছে কেবল তার শ্রমশক্তি, সুতরাং তার হারাবার বলতেও এক এবং একমাত্র বস্তু হল সেই শ্রমশক্তির বাজার, যে বাজারের আপাত-স্বাধীনতার আড়ালে আছে শ্রমিককে বেঁধে রাখার সর্বময় শৃঙ্খল। বাজারে শ্রমশক্তির চাহিদা না থাকলে শ্রমিকের ঘরে হাঁড়ি চড়বে না। এমন চমৎকার ব্যবস্থাটির অবসান ঘটাতে হলে শ্রমিকদের একজোট হয়ে শেকল ছিঁড়তে হবে, অন্য পথ নেই। এটা অবশ্যই বৃহৎ এবং মহৎ সত্য। কিন্তু ব্যবস্থাটি যতক্ষণ জারি আছে, ততক্ষণ এই ক্ষুদ্রতর সত্যের কবল থেকে শ্রমজীবী মানুষের নিস্তার নেই যে— তার কাজ চাই, যে কাজের বিনিময়ে মজুরি মিলবে। কাজের বাজার বন্ধ হয়ে গেলে তার সর্বনাশ। আক্ষরিক অর্থেই সর্ব-নাশ।
কোভিড অতিমারি সেই সর্বনাশকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে সংক্রমণের মোকাবিলা করতে গিয়ে বারংবার অর্থনীতির ঝাঁপ ফেলে দেওয়ার ফলে এক জন দু’জন নয়, অগণিত শ্রমজীবী হঠাৎ দেখেছেন, তাঁদের কাজ নেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বহু কাজ স্রেফ নেই হয়ে গিয়েছে। কর্মসংস্থানের প্রচণ্ড দুর্দশার নানা হিসেব ক্রমশ আমাদের সামনে এসেছে। সেই হিসেব দিয়ে বাস্তবকে কত দূর ধরা যায়, তা নিয়ে গভীর সংশয় আছে, আমাদের দেশে কর্মসংস্থান এবং বেকারত্বের পরিসংখ্যান বরাবরই নানা ত্রুটিবিচ্যুতি এবং অনিশ্চয়তায় কণ্টকিত। কিন্তু মধুর অভাবে গুড়ই মেনে নিতে হয়। আর, কাজের বাজারের পুরো ছবিটা পরিসংখ্যানে ধরা না পড়লেও গতিপ্রকৃতির একটা আভাস তা থেকে পাওয়া যায়। যেমন, সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি-র (সিএমআইই) সমীক্ষায় আমরা জেনেছি, গত মে মাসে ভারতে বেকারত্বের হার প্রায় ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। নির্দিষ্ট অনুপাতটা বড় কথা নয়, বড় কথা এটাই যে, ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসের, অর্থাৎ লকডাউনের প্রথম পর্বের পরে বেকারত্বের হার এত চড়ায় আর ওঠেনি। জুন মাসে অনুপাতটি কিছুটা কমেছে, কিন্তু সেটা নিতান্তই আপেক্ষিক বিচারে, এবং সেই ‘উন্নতি’ কত দিন স্থায়ী হবে বলা কঠিন।
বেকারত্বের অনুপাত শ্রমজীবী মানুষের হাল-হকিকতের পুরো ছবি দেখাতে পারে না, তার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, ওই অনুপাত থেকে কেবল ছবিটার সন্ধান শুরু হতে পারে। বেকারত্বের পাশাপাশি আর একটা হিসেব প্রাসঙ্গিক। সেটা হল মোট কর্মরত মানুষের সংখ্যা। স্বাভাবিক অবস্থায় এই সংখ্যাটা জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত বেড়ে চলে, এবং অনেক সময়েই জনসংখ্যার তুলনায় দ্রুততর গতিতে বাড়ে। ভারতে এ-বছরের জানুয়ারি থেকেই, অর্থাৎ সংক্রমণের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আসার আগেই প্রতি মাসে কর্মরত মানুষের সংখ্যা কমেছে। কমেছে দু’ভাবে: এক, অনেকে কাজ খুঁজছেন এবং পাচ্ছেন না; দুই, অনেকে কাজ খুঁজছেনই না। যাঁরা প্রথম বর্গে আছেন কেবল তাঁরাই হিসেবের খাতায় বেকার হিসেবে গণ্য হন, অর্থাৎ যাঁরা কাজ খুঁজছেন তাঁদের সাপেক্ষে বেকারত্বের অনুপাত মাপা হয়। যাঁরা কাজ খুঁজছেন না তাঁদেরও অধিকাংশেরই কাজ দরকার, কিন্তু নিরুপায় হয়েই এঁরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন, বিশেষ করে গ্রামে যাঁদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন থাকেন। কাজ খুঁজতে গেলে শহরে থাকতে হবে, তার খরচ আছে, সেই খরচ মেটানোর সাধ্য নেই, তাই আপাতত গ্রামে ফিরে গিয়ে পেটে কিল মেরে বসে থাকা। এই ব্যাপারটার তাৎপর্য অশেষ। সমস্ত কর্মক্ষম মানুষের কত শতাংশ কাজ করছেন অথবা কাজ খুঁজছেন, অর্থাৎ কাজের বাজারে অংশগ্রহণ করছেন বা করতে চাইছেন, সেই অনুপাতটিকে পরিভাষায় বলে ‘লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট’। এই হারটি নানা কারণেই কম বা বেশি হতে পারে। কিন্তু কর্মক্ষম দরিদ্র মানুষ যদি হাল ছেড়ে দিয়ে কাজের বাজার থেকে সরে দাঁড়ান, তা হলে বেকারত্বের অনুপাত কম দেখাতে পারে, কিন্তু তাতে খুশি হওয়ার কারণ নেই, দুশ্চিন্তার কারণ আছে। ভারতে সেটাই ঘটছে।
আর একটি হিসেবও প্রাসঙ্গিক। সিএমআইই-র সমীক্ষা অনুসারে, দিন-আনি-দিন-খাই বর্গের মানুষ যাঁরা, শুধু গত মে মাসেই তাঁদের মধ্যে এক কোটি সত্তর লাখ লোক একেবারে বসে গেছেন। এইদলে একদিকে আছেন নানা কাজে নিযুক্ত দিনমজুরেরা, অন্যদিকে আছেন সেই সব মানুষ যাঁদের পোশাকি ভাষায় ‘স্বনিযুক্ত’বলা হয়, কিন্তু আসলে তাঁরা কোনও কাজ পাননি বলেই স্বনিযু্ক্ত হয়েছেন। যেমন, হকারদের একটা বিরাট অংশ, কিংবা যাঁরা নানান বাজারে অল্প কিছু শাকসব্জি বা ছোটখাটো মাছের চুপড়ি নিয়ে বসেন, অথবা যাঁরা বাড়িতে বসে এটা-সেটা তৈরি করে এখানে-ওখানে ঘুরে বিক্রির চেষ্টা করেন। এঁদের সঙ্গে দিনমজুরের কাজের ধরনে তফাত আছে, কিন্তু দারিদ্র এবং অনিশ্চয়তার মূল চরিত্রে কোনও তফাত নেই, তফাত নেই যেভাবে হোক বেঁচে থাকার তাগিদে। স্পষ্টতই, মে মাসে দেশের অনেক জায়গায় নতুন করে অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে এই বিপুল সংখ্যাক শ্রমজীবী রুজি হারান। পরবর্তী সপ্তাহগুলিতে তাঁদের অনেকে সম্ভবত কোনও না কোনও কাজে ফিরেছেন, কিন্তু সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খড়কুটো আঁকড়ে ভেসে থাকার ব্যাপার, তার বেশি কিছু নয়।
আবারও খেয়াল করা দরকার যে, কর্মহীনতার এই সব পরিসংখ্যানের কোনওটাই নিশ্চিত বা নির্ভুল নয়। আমাদের দেশে, যেখানে শতকরা নব্বই ভাগ কর্মীই ‘অসংগঠিত’ ক্ষেত্রে কাজ করেন, সেখানে তেমন পাকা হিসেবের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষ করে খেটে-খাওয়া মেয়েদের ও শিশুদের একটা বিরাট সংখ্যা সব হিসেবের বাইরে থেকে যায়। অর্থাৎ, সমীক্ষার রিপোর্টে আমরা শ্রমজীবীর সর্ব-নাশের যে ছবিটা দেখি, সেটা দুর্দশার চূড়া, বেশির ভাগটাই থাকে চোখের আড়ালে। কিন্তু যাঁরা পরিসংখ্যানে ঠাঁই পেয়েছেন তাঁদের দুর্দশা বাড়ছে আর যাঁরা ঠাঁই পেলেন না তাঁদের অবস্থা ভাল হচ্ছে— এমনটা কখনও হয় না, হতে পারে না। তাই পরিসংখ্যান যত অসম্পূর্ণই হোক, তা থেকে সঙ্কটের ভয়াবহ গতিপ্রকৃতি বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধে নেই।
সঙ্কটের অন্য কয়েকটি মাত্রার কথা এখানে বলা দরকার, যেটা কর্মী এবং বেকারের পরিসংখ্যানে আদৌ ধরা পড়ে না। প্রথমত, কাজের বাজারে, বিশেষ করে সেই বাজারের নীচের তলায় কর্মীদের আয় এক ধাক্কায় অনেক কমে গেছে। এটা ঘটেছে দু’দিক থেকে। এক দিকে, বহু মানুষ বেশি উপার্জনের কাজ হারিয়ে বাধ্য হয়ে আগের তুলনায় অনেক কম উপার্জনের কাজ করছেন। অন্য দিকে, অনেক কাজের জন্যই আগে যে টাকা দেওয়া হতো এখন তার চেয়ে অনেক কম দেওয়া হচ্ছে। কম দেওয়ার নানা কারণ। সেই কারণগুলিকে আবার দুটি প্রধান বর্গে ভাগ করা যায়। এক, যাঁরা কর্মীদের কাজ দেন তাঁদের আয় মন্দার ধাক্কায় কমেছে, ফলে কর্মীদের তাঁরা কম মজুরি দিচ্ছেন। এটা বিশেষ করে ঘটছে ছোটখাটো ব্যবসায় বা অফিসে। দুই, কাজের বাজার হঠাৎ এতটা খারাপ হওয়ার ফলে কর্মপ্রার্থীরা কম টাকায় খাটতে বাধ্য হচ্ছেন, অনেক সংস্থা বা নিয়োগকর্তাই তার সুযোগ নিয়ে মজুরি কমিয়ে দিয়েছেন। সাদা বাংলায়, ঝোপ বুঝে অতিরিক্ত শোষণের কোপ মারছেন। সমস্তটা মেলালে মোদ্দা কথাটা দাঁড়ায়— যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের আয় কমেছে। মনে রাখতে হবে, তাঁদের আয় এমনিতেই অত্যন্ত কম। সেই আয়ে কোপ পড়লে আক্ষরিক অর্থে পেটের ভাতে টান পড়তে বাধ্য। দেশ জুড়ে বুভুক্ষার প্রকোপ কতটা বেড়েছে, তার কিছু হিসেব ইতিমধ্যে একাধিক সমীক্ষায় পাওয়া গেছে। যেমন বেকারত্বের ক্ষেত্রে, তেমনই ক্ষুধার ক্ষেত্রেও প্রকৃত দুর্দশার ছবি সমীক্ষার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ হবে, এটা ধরেই নেওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, কর্মীদের নিরাপত্তা কমেছে। এমনিতেই আমাদের দেশে অধিকাংশ কর্মীর স্বাস্থ্য তথা সামাজিক নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা নেই, যাঁদের আছে তাঁদের ক্ষেত্রেও সেই আয়োজন অত্যন্ত সীমিত। সেটাও নষ্ট করার জন্য প্রবল চেষ্টা চলছে। যেমন, গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে যে নীতি চালু করতে চাইছেন, তার একটি লক্ষ্য হল— যে কোনও রাজ্য সরকার যেন ইচ্ছে করলেই ‘অকুপেশনাল সেফটি’র নিয়মকানুনগুলোকে শিথিল করে দিতে পারে। কিন্তু সেই সামগ্রিক বা সাধারণ প্রবণতার বিশদ আলোচনার মধ্যে না গিয়ে এখানে আলাদা করে বলা দরকার, অতিমারির পরিস্থিতিতে এই সমস্যা কীভাবে বেড়েছে। সংক্রমণ থেকে নিজেকে যথাসম্ভব সুরক্ষিত থাকার সুযোগ যাঁদের আছে, তাঁরা নিজের নিজের ঘরে বসে কাজ করে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীর সেই সুযোগ নেই। তাঁদের আক্ষরিক অর্থে প্রাণ হাতে নিয়ে কাজে বেরোতে হচ্ছে। ‘অকুপেশনাল সেফটি’ বলতে সাধারণভাবে কাজের জায়গায় নিরাপদ পরিবেশকেই বোঝানো হয়, কিন্তু এই অতিমারির পরিস্থিতিতে তার সঙ্গে সঙ্গে যাতায়াতের নিরাপদ বন্দোবস্তও অত্যন্ত জরুরি। দেশ জুড়েই সেখানে বিপুল ঘাটতি। সংক্রমণের কালে শ্রমজীবী মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে তাঁদের চলাচলের পরিকাঠামো প্রসারিত করার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দূরে থাকুক, সেই পরিকাঠামো প্রবলভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কথাই যদি ধরা যায়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে আমরা দেখছি, কী অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে এবং কী পরিমাণ ঝুঁকি নিয়ে অজস্র মানুষ রুজির তাগিদে যাতায়াত করছেন অথবা রুজি রোজগারের সুযোগ হারাচ্ছেন।
তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার আর একটি বড় সঙ্কট তৈরি করেছে চিকিৎসার খরচ। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবীর ক্ষেত্রে কোভিডের মতো আকস্মিক ব্যাধি মানেই সর্বস্বান্ত হওয়ার কানাগলি। এমনকি যাঁরা সংগঠিত ক্ষেত্রের ‘সুবিধাভোগী’ কর্মী, তাঁরাও অনেকেই এই বিপন্নতার শিকার। তার একটা প্রমাণ— গত এক বছরে কোভিডের চিকিৎসার জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে টাকা তোলার জন্য ইপিএফ-এর দফতর প্রায় ৭৫ লাখ আবেদন মঞ্জুর করেছে, তুলে-নেওয়া টাকার পরিমাণ প্রায় ১৯০০০ কোটি টাকা। বলা বাহুল্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীর পিএফ নেই, তাঁরা যেটুকু সঞ্চয় ছিল তা ভেঙে, চড়া সুদে ধার নিয়ে, ঘটিবাটি বেচে কোভিডের সঙ্গে লড়াই করেছেন, করছেন। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সীমিত এবং অপটু, ফলে বহু নিরুপায় মানুষ চিকিৎসার জন্য বাজারের দ্বারস্থ হয়েছেন, যা প্রায়শই মুনাফাসর্বস্ব কালোবাজারের রূপ নিয়েছে। কর্মীরা— যাঁরা কাজ হারাননি বা যাঁদের প্রাপ্য কমেনি তাঁরাও— সেই বাজারের তাড়নাতেই নাজেহাল।
সব মিলিয়ে বলা যায়, অতিমারির কারণে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে যে সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে, সেগুলো মোটের ওপর চার রকমের: কাজের অভাব, উপার্জন হ্রাস, কাজের তাগিদে সংক্রমণের ঝুঁকি নিতে বাধ্য হওয়া এবং সংক্রমণের শিকার হলে চিকিৎসার বিপুল খরচ। মোটের ওপর এটাও বলা যায় যে, যাঁরা আর্থিকভাবে যত দুর্বল তাঁদের বিপদ তত বেশি। এটাও আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অসাম্যের একটা পরিণাম এবং তার একটা রূপ, আবার এর ফলে সেই অসাম্য আরও বেড়ে যাবে। অতিমারির দেড় বছরে দুনিয়া জুড়ে অসাম্য বৃদ্ধির যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে আমরা আছি, এটি তারই অঙ্গ।
কিন্তু এই পরিণামগুলিকে নানা দিক থেকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা মূল সত্যকে চোখের আড়াল হতে দেওয়া যায় না। সেই সত্যের নাম: পুঁজিতন্ত্র। পুঁজিমালিকদের উদ্বৃত্ত বাড়িয়ে চলার দুর্নিবার অভিযানই সেই তন্ত্রের সাধনপন্থা। অভূতপূর্ব এই সঙ্কট সেই অভিযানকে তীব্রতর করে তুলেছে। একদিকে শ্রমজীবী মানুষের শ্রমশক্তি আরও বেশি মাত্রায় কাজে লাগিয়ে এবং অন্যদিকে তাঁর প্রাপ্য আরও কমিয়ে দিয়ে উদ্বৃত্তের হার তথা শোষণের মাত্রা বাড়ানোর এই প্রচণ্ড তৎপরতা বোঝার জন্য কোনও পরিসংখ্যানের প্রয়োজন নেই, আমাদের চার পাশে তার অজস্র ছবি প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। অগণন মানুষ যে কোনও মজুরিতে এবং যে কোনও শর্তে যে কোনও কাজ করতে রাজি, কারণ তাঁরা নিরুপায়। উদাহরণ হিসেবে শুধু খেয়াল করতে পারি তাঁদের কথা, কোনও রকমে দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করার তাগিদে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে নাগরিকেরা পিঠে বিরাট বোঝা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে নানা রকম পণ্যের ডেলিভারি দিয়ে চলেছেন। তাঁরা এক নতুন অর্থনীতির অন্যতম প্রতীক, আবার সেই অর্থনীতির— আক্ষরিক অর্থে— বাহক। এই অর্থনীতিতে শ্রমজীবীর নতুন নাম ‘প্রিকেরিয়েট’— যাঁরা কেবল শ্রমশক্তি-সম্বল সর্বহারা নন, যাঁদের পায়ের নীচে চোরাবালি, মাথার উপরে সারাক্ষণ খাঁড়া ঝুলছে— এই বুঝি চাহিদার অভাবে শ্রমশক্তি মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এই বাস্তবকে স্বীকার করে তার মধ্যে থেকেই এবং তাকে ব্যবহার করেই শেকল ছেঁড়ার উপায় খুঁজতে হবে।
কিন্তু, শেকল ছেঁড়ার উপায় কী? ‘লাখ টাকার প্রশ্ন’ বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না। একই সঙ্গে চিন্তা এবং চেষ্টার মধ্যে দিয়েই সেই উপায় খুঁজতে হবে, খুঁজতে হবে সমবেত ভাবে। এই বিষয়ে অনেকটা আলোচনার অবকাশ আছে। আলোচনা মানে সকলে মিলে ভাবা, বলা, শোনা, করা— সবটাই। সেই আলোচনা বাস্তবের নানা দিক নিয়ে, নানা পরিসর থেকে শুরু হতে পারে। তেমন একটি পরিসরের কথা উল্লেখ করে আপাতত থামা যাক। উল্লেখের বেশি কিছু নয়, আমাদের ভাবনাগুলোকে উসকে দেওয়ার জন্য উল্লেখই যথেষ্ট। গত কয়েক সপ্তাহে আমেরিকার নানা অঞ্চলে কয়েকটি শহরে বেশ কিছু রেস্তরাঁ, খাবার বিক্রির ‘আউটলেট’, সুপারমার্কেট ইত্যাদি জায়গায় কর্মীরা কাজ বন্ধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। শোষণ শব্দটা অবশ্য ওঁরা বলছেন না, ওঁরা বলছেন, ‘ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার মতো মজুরি না পেলে কাজ করা যায় না, তাই আমরা কাজ বন্ধ রাখছি, দুঃখিত।’ নানা জায়গায় প্রতিবাদের নানা বয়ান, কিন্তু মোদ্দা কথা একটাই: যা চলেছে, তা আর চলবে না।
এই সব প্রতিবাদ আন্দোলনের জোর কতটুকু, ভবিষ্যৎই বা কী, জানি না। সম্ভবত কেউ জানে না। কিন্তু আমেরিকার বুকে এই জিনিস হতে পারছে, তার একটা মানে আছে। ভুল হল, অনেকগুলো মানে আছে। আপাতত একটা মানে-র কথা বলা যাক। সে দেশে কোভিডের মোকাবিলায় সরকার শ্রমজীবীদের জীবনধারণের জন্য কিছু কিছু বিশেষ সাহায্যের বন্দোবস্ত করেছে। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, কিন্তু যেটুকু হয়েছে, সেটাই কর্মীদের পায়ের নীচে কিছুটা দাঁড়াবার জায়গা করে দিয়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে তাঁরা লড়াই করতে পারছেন। সরকারি সাহায্যটা দেওয়া হয়েছে নেহাতই তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য, কিন্তু সেটাই তাঁদের সংগ্রামী শক্তি সরবরাহ করেছে, যে শক্তি শোষণের মাত্রা কমানোর আন্দোলনে কাজে প্রয়োগ করছেন, করতে পারছেন শ্রমজীবীরা।
আমেরিকার সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা চলে না, আবার চলেও। চলে এই কারণে যে, এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা একটা প্রাথমিক এবং মৌলিক সত্যের সন্ধান পাই। শ্রমজীবী মানুষকে লড়াই করতে হলে তার দাঁড়াবার জায়গা চাই, চোরাবালির মধ্যে দাঁড়িয়ে লড়াই করা যায় না। সেই দাঁড়াবার জায়গাটা নানা ভাবেই তৈরি হতে পারে। শ্রমজীবীদের নিজেদের সংহতি ও সমবায় যেমন একটা উপায়, তেমনই সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কিংবা, এমনকি, ত্রাণের জন্য প্রদত্ত সরকারি বা সামাজিক সাহায্যও একটা উপায় হতে পারে। সেই রসদটুকুই তাঁদের লড়াই করার বাড়তি শক্তি দিতে পারে। এটা, অবশ্যই, সম্ভাবনামাত্র, তার বেশি কিছু নয়। সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য চাই সংগঠন, চাই আন্দোলন, চাই শিক্ষা— সচেতনতার শিক্ষা। এই নিয়েই বড় রকমের আলোচনা শুরু হতে পারে না কি?