বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

আব কোমর বাঁধ তৈয়ার হো

আব কোমর বাঁধ তৈয়ার হো

অর্ক রাজপন্ডিত

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২১— ভাগ্যিস তাঁর ট্রাক ছিল আর ট্রাকের সিট ছিল! টানা পনেরো দিন খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন ট্রাকেই। কখনো ট্রাকের নিচে বিছানা পেতে তোফা ঘুম।

উত্তরপ্রদেশের বেরিলি থেকে ট্রাক নিয়ে বেড়িয়েছিলেন মুনাজির খান, লাইলাপুরের পাহাড় জঙ্গল ঘেরা রাস্তায় আটকে থেকেছে তাঁর ট্রাক। দিনের পর দিন। ট্রাক ঘিরে থেকেছে সিআরপিএফ বাহিনী। মিজোরাম সীমান্ত থেকে ধেয়ে এসেছে গুলি।

জংলা পোষাক পড়া কোন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর রাইফেল থেকে নয়, দেশের মধ্যেই এক রাজ্যের পুলিশ গুলি করে মেরেছে আরেক রাজ্যের পুলিশকে। আসাম সরকার পাল্টা জারি করেছে নির্দেশিকা, আসামের নাগরিকরা যেন না যান মিজোরামে, মিজোরামের পুলিশের পাল্টা এফআইআর।

আসাম মিজোরাম সীমান্তের লাইলাপুরই হয়ে উঠেছে কদিনে মুনাজিরের দেশ, দুনিয়া! লাইলাপুরের সীমানা থেকেই মনে পড়ে বেরিলির ঘরের কথা। ট্রাকে বোঝাই ছিল কার্পেট-মাদুর, পৌঁছনোর কথা ছিল আসাম পেরিয়ে মিজোরামের রাজধানী আইজলে!

পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা আসাম-মিজোরাম সীমান্তের লাইলাপুরের বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে থেকেছেন পিয়ারুদ্দিন, এই বুঝি সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে ছুটে এল বুলেট। লাইলাপুর থেকেই আইজল যেতেন ট্রাক ড্রাইভার মনিরুদ্দিন বারভুঁইয়া, পণ করেছেন আর ট্রাক চালাবেন না, অন্য পেশা জুটিয়ে নেবেন।

আসাম মিজোরাম সীমান্তে পিয়ারুদ্দিনের ভিটে ছেড়ে পালানো, মনিরুদ্দিনের ট্রাক চালানো ছেড়ে দেওয়া আর উত্তরপ্রদেশের বেরিলি থেকে মাদুর বোঝাই ট্রাক চালিয়ে আসা মুনাজিরের লাইলাপুর সীমান্তে অনন্ত অপেক্ষার মাঝেই ফ্লিপকার্ট আর আমাজনে এসে পড়ে হইহই করে ‘ফ্রিডম সেল’!

নাহ! আজাদির পঁচাত্তরে ফ্লিপকার্ট –আমাজন বা দৈত্যাকার ই-কমার্স কোম্পানিগুলি ‘ফ্রিডম সেল’ শব্দবন্ধ গোদা বাংলায় ‘আজাদীর বিক্রিবাট্টা’ ব্যবহারের সাহস পায় কিভাবে কেউ তাদের কাছে জানতে চায়নি।

নয়া মডেলের আইফোন বিকিকিনির ‘ফ্রিডম সেল’র সপ্তাহে আমাদেরও মনে পড়ে যায় আরো একবার এল বোধহয় ওই ১৫ই আগস্ট। ইংরেজি খবরের কাগজের জানান দেওয়া উপচে পড়া ফরেন রিজার্ভের গল্প, অলিম্পিকে চোখ ধাঁধানো মেডেল লাভ, পাড়ার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কম সংখ্যায় আসতে থাকা কোভিশিল্ড কোভ্যাক্সিন আর মুম্বাইয়ের হোলি ফ্যামিলি হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে আসা ফাদার স্ট্যান স্বামীর নিথর ঠান্ডা লাশের সঙ্গেই আরো একটু বয়স্ক হয় আমাদের স্বাধীনতা দিবস, আরো খানিক বুড়ো হয়ে যান স্বাধীনতা সংগ্রামের শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্বরা।

.............................
আজাদির এই পঁচাত্তরেই কাশ্মীরের গুলমার্গে একশো ফুট উঁচু তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা লাগিয়েছে ইন্ডিয়ান আর্মি। শ্রীনগরের লালচকের বিখ্যাত ‘ক্লক টাওয়ার’ সেজে উঠেছে তেরঙ্গা আলোয়। সব কিছুই স্বাধীনতার পঁচাত্তরকে মনে রেখে, ‘আজাদি কা অম্রুত মহোৎসব’, যেমনটা স্লোগান বেঁধে দিয়েছেন মোদি।

‘আজাদি কা অম্রুত মহোৎসব’র মধ্যেই জম্মুর প্রশাসন সব জেলা সদরে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছে অবিলম্বে গোটা ষাট স্কুলের নাম পাঠাও, যাদের নাম পরিবর্তন করে রাখা হবে জম্মু কাশ্মীরে নিহত নিরাপত্তা কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।

বিড়াল চটজলদিই রুমাল হয়ে যায় কাশ্মীরে। বরাবরই। ৩০ জুলাই জম্মু কাশ্মীরের মুখ্যসচিব নির্দেশিকা জারি করেন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির ৭৫টি রাস্তা ও স্কুলের নাম নতুন করে রাখা হবে ‘সিভিলিয়ান’দের নামে, যাঁদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে জম্মু কাশ্মীরের উন্নতি সাধনে, মুখ্যসচিবের ভাষায় ‘সিভিলিয়ান’দের সম্মান জানাতে। ৩০ জুলাইয়ের সার্কুলারে কোথাও লেখা ছিল না ‘সিকিউরিটি পার্সোনেল’র নামে নতুন করে রাখা হবে স্কুলের নাম।

সার্কুলারে লেখা হয় এক, কাজে হয় আরেক। জম্মু কাশ্মীরের রাস্তা আর স্কুলের নাম পাল্টে রাখা হচ্ছে সংঘর্ষে নিহত নিরাপত্তা কর্মীদের নামে। ‘আমার বাবার নামে স্কুল হবে না? আমার বাবাকে কেউ শ্রদ্ধা জানাবে না? মৃত্যুর ১৫ বছর পর স্বাধীনতার পঁচাত্তরে আমার বাবা তাঁর মতো নিহতদের মনে রাখবে না কেউ’, প্রশ্ন তুলেছেন দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগের বাসিন্দা রশিদ খান।

২০০৬ সালের পাথরিওয়ালের এনকাউন্টারে মারা যান রশিদ খানের বাবা জুম্মা খান। তদন্তের শেষে সিবিআই জানিয়েছিল পাথরিওয়ালের এনকাউন্টার ছিল ফেক, ভুয়ো। পাথরিওয়ালের ফেক এনকাউন্টারে সরাসরি যুক্ত ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার, দু' জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, দু' জন মেজর। মৃত্যুর ১৫ বছর পর জুম্মা খানের পুত্র প্রশ্ন তুলছেন আমরা, আমরা যারা মরে পড়ে আছি গোরস্থানে, আমরা আমাদের যাদের পাশপোর্ট বাতিল হচ্ছে, আমরা যারা অন্ধ হচ্ছি পেলেট বন্দুকে আমাদের নামে স্কুল হবে না কেন!

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে কাশ্মীর থেকে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে রাজ্যের মর্যাদা। সাঁজোয়া গাড়ি আর মিলিটারি বুটের টহলের মধ্যে রোজ দিন রাত কাটাচ্ছে কাশ্মীর। ২০১৯’র ৫ আগস্টের দু' বছরের মধ্যে ২৩০০ জন কাশ্মীরি গ্রেপ্তার হয়েছেন ইউএপিএ আইনে, এক হাজার কাশ্মীরি গ্রেপ্তার হয়েছেন ‘পাবলিক সিকিউরিটি অ্যাক্টে’। দুবছর পেরিয়ে ইউএপিএ’তে গ্রেপ্তার হওয়া কাশ্মীরিদের অর্ধেক এখনও জেলে আটক, পিএসএ অ্যাক্টে বন্দীদের ৩০ শতাংশ এখনও জেলের অন্ধকার সেলে।

‘পিপলস অ্যালায়েন্স ফর গুপকার ডিক্লারেশন’র নেতাদের ডেকে বৈঠক করেছেন মোদি, সোচ্চারে বলেছেন মেটাতে হবে ‘দিল কি দুরি অর দিল্লি সে দুরি’! আজাদির এই পঁচাত্তরে রোজ বুঝছে কাশ্মীর দিল আর দিল্লি থেকে দূরত্ব মেটানো কাকে বলে!

.............................
কমিউনিস্ট, শহুরে নকশাল, জেএনইউ, জামিয়া নিয়ে গড়ে ওঠা অর্ণব গোস্বামীদের বড় পছন্দের শব্দ ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’র চমৎকার অ্যান্টি থিসিস বেঁধে দিয়েছেন মোদি। স্বাধীনতার পঁচাত্তর থেকেই শুরু হবে ‘ভারত জোড়ো’ আন্দোলনের কাজ, জুড়তে হবে ভারতকে।

দিল্লির যন্তর মন্তরে ‘ভারত জোড়ো’ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছিলেন বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়। ‘ভারত জোড়ো’ মঞ্চ থেকেই স্লোগান দিয়েছে গেরুয়া বাহিনী। ‘হিন্দুস্থান মে রহেনা হ্যায়/ জয় শ্রীরাম কহেনা হ্যায়’, আরো একধাপ এগিয়ে মুসলমানদের সরাসরি কোতল করার নিদানও হেঁকেছে গেরুয়া বাহিনী। ‘খুল্লে কাটে যায়েঙ্গে/ রাম রাজ্যে লায়েঙ্গে’, মুসলমানদের কোতল করেই রাম রাজ্য আসবে শ্রীঘ্রই। বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় সহ কিছু বিজেপি কর্মীকে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও জামিন মিলেছে পরের দিনই! মোদির ‘ভারত জোড়ো’ স্লোগানেই রয়েছে ‘ভারত তোড়ো’র অশ্লীল তামাশা।

..............
‘আজাদি কা অম্রুত মহোৎসবের’ তোড়জোড়ের মধ্যেই সিআইআই’র বার্ষিক সভায় ‘ইন্ডিয়া অ্যাট সেভেনটি ফাইভ’ বক্তৃতায় বলেছেন মোদি, ‘রিফর্মস আর ম্যাটার অফ কনভিকশন, নট কমপালসন অফ দিস গভর্নমেন্ট’। সংস্কার এই সরকারের কাছে বাধ্যবাধকতা নয় বরং প্রত্যয়।

কি আশ্চর্য সেদিনই রাজ্যসভা দেখলো মোদি সরকারের সংস্কারের প্রত্যয়। বিরোধী সাংসদদের ধাক্কা দিতে দিতে বার করে দিল মার্শালরা, রাজ্যসভার ওয়েল ঘিরে রাখলো চল্লিশ জন পুরুষ মার্শাল আর দশ জন মহিলা মার্শাল। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাংসদের গায়ের জোরে আটকে রেখে রাজ্যসভায় পাশ হল সাধারণ বীমা সংশোধনী বিল, আরও লা জবাব বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হল দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বীমা সংস্থাগুলিকে।

‘আজাদি কা অম্রুত মহোৎসব’র মধ্যেই চলছে মোদি-সীতারমণদের ‘ফ্রিডম সেল’, ফ্লিপকার্ট আমাজনের থেকেও ক্ষিপ্রতায় দেশের সম্পদ বিক্রির কাজ। দেশের রেল-ব্যাঙ্ক-বীমা-প্রতিরক্ষা-খনিজ-সড়ক-জঙ্গল সবই বিক্রি হচ্ছে মোদি সীতারমণদের ‘ফ্রিডম সেলে’। ২০২১-২০২২’র কেন্দ্রীয় বাজেটেই ঘোষণা করেছেন নির্মলা সীতারমণ, এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা চলতি অর্থবর্ষে তোলা হবে বিলগ্নিকরণ আর বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে। নীতি আয়োগ প্রকাশ করেছে ‘ন্যাশনাল অ্যাসেট মানিটাইজেশন পাইপলাইন’, দেশের সম্পদ বিক্রির খতিয়ান।

৫০টি স্টেশন আর দশটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন বিক্রি করে উঠবে ৯০ হাজার কোটি টাকা, বিএসএনএল-এমটিএনএল’র সম্পদ বিক্রি করে উঠবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, সাত হাজার কিলোমিটার বানানো ন্যশনাল হাইওয়ে বিক্রি করে উঠবে ৩০ হাজার কোটি টাকা, স্পোর্টস স্টেডিয়াম বিক্রি করে উঠবে ২০ হাজার কোটি টাকা...।

প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিক কর্মচারিদের ধর্মঘট আটকাতে সরকার অর্ডিন্যান্স এনেছে ‘এসেনসিয়াল ডিফেন্স সার্ভিস অ্যাক্ট’। বিক্রিবাট্টার বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিবাদও করা যাবে না!

আজাদির এই পঁচাত্তরেও দিল্লি সীমান্তে বসে আছেন কৃষকরা। কনকনে শীত, আগুন জ্বলা গ্রীষ্ম, ঝড়ো বৃষ্টির বর্ষা পেরিয়েও সিঙ্গু-টিকরি-গাজীপুর সীমান্ত থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন না কৃষকরা। দিল্লিতে চলছে কিসান সংসদ। দিল্লি সীমান্তে আন্দোলনে যোগ দিয়ে চার শতাধিক কৃষক মৃত্যুর পরেও নাছোড়বান্দা কৃষকরা, কৃষি আইন প্রত্যাহার করতেই হবে সরকারকে। চার শতাধিক কৃষক দিল্লি সীমান্তে মারা গেলেও হাত উল্টে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর কোন কৃষক মৃত্যুরই তথ্য নেই সরকারের কাছে!

যেভাবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংসদে হাত উলটে জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গঙ্গোয়ার, লকডাউনে কোনও পরিযায়ী শ্রমিকই মারা যাননি!

তবুও ভরসার কথা, আজাদির এই পঁচাত্তরে বিশাখাপত্তনম শহরে রোজ বাড়ছে মিছিল। ‘ভাইজাগ স্টিল প্ল্যান্ট’কে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া যাবে না, গোটা শহর রোজ নামছে রাস্তায়। তবুও ভরসার কথা, সিঙ্গু পালওয়াল গাজীপুর সীমান্তে চলছে কৃষকদের অতন্দ্র প্রহরা। তবুও ভরসার কথা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে ধর্মঘটের ডাক দিচ্ছেন বিদ্যুৎকর্মীরা। তবুও ভরসার কথা, খনি শ্রমিক থেকে ইস্পাত শ্রমিকরা মেনে নিচ্ছেন না বেসরকারিকরণ অভিযান।

আবারও দিল্লির সীমান্ত থেকে ভাইজাগ স্টিল প্ল্যান্টের গেটে, আশা অঙ্গণওয়াড়ি কর্মীদের ধরণায়, মজদুর কৃষকরা গেয়ে উঠছেন লা মার্সেই! প্যারিস কমিউনের দেড়শো বছরের গান ফিরে আসছে আমার দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে, হারীন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়। ‘আব কোমর বাঁধ তৈয়ার হো লাছ কোটি ভাইয়ো... হাম ভুখ সে মরনেওয়ালে কেয়া মৎ সে ডরনেওয়ালে... আজাদি কা ডঙ্কা বাজা... উড়াও অগ্নিধ্বজা...।’

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.