পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন
পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন
বসন্ত মুখোপাধ্যায়
শ্রমজীবী ভাষা, ১ এপ্রিল, ২০২২— কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পর পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণ করা হল।
উত্তরপ্রদেশে বিজেপির সমীকরণ
উত্তরপ্রদেশে এবং উত্তরাখণ্ডে বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা অ্যান্টি ইনকামবেন্সি বা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সাধারণ ধর্মকে অতিক্রম করেছে। লকডাউন, কোভিডে মৃত্যু, গঙ্গায় দেহ ভাসানো, চরম বেকারি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নামে দলিতদের ওপর চূড়ান্ত নির্যাতন, পেট্রোল–ডিজেলের লাগাম ছাড়া দাম— গত পাঁচ বছরে যোগী সরকারের এত সব জনবিরোধী পদক্ষেপের কারণে তাদের ক্ষমতায় ফেরার কথা নয়। তবু যোগী সরকার ক্ষমতায় ফিরেছে এবং ভোট বাড়িয়ে ফিরেছে। উত্তরপ্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের এই ব্যতিক্রমী মনোভাবের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা অবশ্যই পেতে হবে আবেগ ও পক্ষপাতশূন্য বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে।
ধর্মীয় বিভাজন, জাতপাতের সমীকরণ নিঃসন্দেহে উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের ভোটে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। এরসঙ্গে অবশ্যই কার্যকর হয়েছে অর্থনৈতিক পপুলিজম। অর্থাৎ সমাজের হতদরিদ্র অংশকে বিনা পয়সায় রেশন এবং নীচুতলার পরিবারের একাংশকে বিনা পয়সায় গ্যাস, সরকারি প্রকল্পে বাড়ি ইত্যাদি প্রদানও নির্বাচনে বিজেপিকে ডিভিডেন্ড দিয়েছে। এটাকেই মূল ধারার সংবাদপত্রে লাভার্থি (উপভোক্তা) রাজনীতি বলা হচ্ছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই সংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থনীতি যত বেশি করে বেসরকারি, ক্রোনি পুঁজির হাতে চলে যাচ্ছে, ততই সমাজের নীচুতলার মানু্ষজন সরকারি ডোলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। পশ্চিমবঙ্গে যেমন রয়েছে দুয়ারে সরকার বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো তৃণমূল স্তরে রিলিফ দেওয়ার কর্মসূচি, যে সুবিধা আম আদমি পার্টির সরকার দেয় বিনামূল্য চিকিৎসার ক্লিনিক খুলে, বিজেপিও তেমনি অর্থনৈতিক পপুলিজমমের শক্তিটা শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয়। সেকারণে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের আগে ১০০ দিনের বেশি পেট্রোল–ডিজেলের দৈনিক দামবৃদ্ধি বন্ধ রেখেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। পাঁচ রাজ্যে বিপুল জয়ের পরেও জ্বালানির দাম নিয়ে কেন্দ্র খুবই সতর্ক। একলাফে না বাড়িয়ে দাম ধাপে ধাপে বৃদ্ধির রাস্তাটাই তারা কাজে লাগাচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশে জাতপাতের রাজনীতি এখনও বেশ জোরালো। যোগীর মন্ত্রিসভায় যে ৫২ জন মন্ত্রী শপথ নিয়েছেন তাদের মধ্যে উচ্চবর্ণের সদস্য ২১ জন বা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে ব্রাহ্মণ ও রাজপুত মন্ত্রী যথাক্রমে ১৭ জন। এককথায়, গোঁড়া হিন্দু ও ধনী উচ্চবর্ণের লোকেরাই বিজেপির সমর্থনের একটা বড় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি। যাদব নন এমন ওবিসি এবং দলিত ভোটও ভাল পরিমাণে গেছে বিজেপির বাক্সে। গেছে মহিলাদের ভোটও। সব মিলিয়ে বিজেপি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটা রামধনু জোট গড়ে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এখানে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপির জয়ের এই সমীকরণ তৈরি করা হয়েছে অনেক হিসেব কষে এবং একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত একটা সক্রিয় সংগঠনের জোরে। ভোটে জেতার পিছনে বিজেপি–আরএসএস সংগঠনের ভূমিকাকে কোনওভাবেই ছোট করা যাবে না। ধর্ম, বর্ণ, লাভার্থি, সংগঠন— এই চারটি উপাদান মিলেই বিজেপির সাফল্য।
এই খানে আরও একটা প্রশ্ন। খুব ভাল করে খুঁজে বের করা দরকার কাদের ভোটে অখিলেশ তাঁর বিধায়কের সংখ্যা এতদূর বাড়িয়ে নিতে পারলেন। শুধু তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের ভোট পাননি অখিলেশ। পেয়েছেন এমন লোকের ভোট যাঁরা হিন্দু তো বটেই, এমনকী জাঠও। এই অংশটা ধর্ম ও বর্ণের প্রভাব এড়িয়ে কেন অখিলেশকে সমর্থন করলেন তা বোঝা দরকার। বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে তাঁদের তুলনায় শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান কি কাজে লেগেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। বিশেষ করে, উত্তরপ্রদেশে এবং উত্তরাখণ্ডে বিজেপি–বিরোধী ভোট ব্যাঙ্কের প্রোফাইল স্পষ্ট করা দরকার। তাহলে বিজেপি বিরোধী শিবিরের ছবিও স্পষ্ট হবে।
জানতে হবে, কেন এবার একটা বড় অংশ দলিত ভোটারের সমর্থন বিজেপির পক্ষে গেল? এটা কি লাভার্থি ও জাতপাতের রাজনীতির মিশেলের ফল? নাকি মায়াবতীর নিঃশব্দ বিজেপি–তোষণ? কয়েক শতাব্দী ধরে যারা উচ্চবর্ণের দ্বারা নিপীড়িত, যারা কয়েক দশক ধরে বিএসপির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল অন্তত নিজেদের সামাজিক আইডেনটিটি, কীসের আকর্ষণে তারা ফিরছে উচ্চবর্ণের আশ্রয়ে? একি হিন্দুত্বের শিবিরে ফিরা যাওয়া?
আরও যে বিষয়টিকে উত্তরপ্রদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হবে তাহল, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলন উত্তরপ্রদেশের ভোটরাজনীতিকে কতদূর প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। কৃষকের ধর্মীয় পরিচিতি ও কৃষক পরিচিতির মধ্যে কোনটা অগ্রাধিকার পেয়েছে তাও খুঁজে বের করা দরকার।
এখন দেখা যাচ্ছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে মডেল সফলভাবে গুজরাটে তৈরি করেছে বিজেপি আরএসএস, এবার তারা সেই মডেল প্রয়োগ করছে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের হিন্দি বলয়ে। এবং এর বিরোধিতায় কোনও বিকল্প ন্যারেটিভ এখনও তৈরি হয়নি। ফলে আগামী দিনের নির্বাচনেও হিন্দি বলয়ে বিজেপির ক্ষমতা ধরে রাখার সম্ভাবনা অবশ্যই বেশি।
বিপরীতে আরেক ভারত
এক ধর্মরাজ্যপাশে বৈচিত্রপন্থী ভারতকে বেঁধে ফেলার এই যে প্রয়াস, তার বিপরীতে রয়েছে আরেক ভারত। তা হল ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক আঞ্চলিক ভারত। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, কেরল— এগুলো হল বিজেপি বিরোধী ভারতের প্রতীক। এখানে হিন্দু–হিন্দি নয়, এখানে আধিপত্য করে ভাষা, সংস্কৃতি ও আঞ্চলিকতা। এই অঞ্চলগুলোকে বিজেপি জয় করতে পারছে না বলেই তারা কর্ণাটককে দক্ষিণ ভারতের উত্তরপ্রদেশ করে তুলতে চাইছে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষর মধ্যে দিয়ে। সেখানে কন্নড় পরিচিতির ওপরে দাঁড় করাতে চাইছে হিন্দুর ধর্মীয় পরিচিতিকে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে পাঞ্জাব বিধানসভার ফলাফলকে। পাঞ্জাবকে মোটামুটি ভাবে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। মালোয়া, মাঝা, দোয়াবা। রাজ্যের মোট ২৩ জেলার মধ্যে ১৫টিই রয়েছে মালোয়া এলাকায়। পঞ্জাব সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পাঞ্জাবে আত্মঘাতী হয়েছেন ৩০০০ কৃষক। আত্মঘাতী এই কৃষকদের ৯০ শতাংশের বেশি মালোয়া অঞ্চলের জেলাগুলির বাসিন্দা। বাকিরা দোয়াবা ও মাঝা এলাকার। মালওয়া অঞ্চলে অধিকাংশ কৃষকই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি। এই অঞ্চলে কৃষি জমির ভাড়া অত্যধিক। বিকল্প পেশার সুযোগ নেই। তাই চড়া সুদে ধার নিয়ে চাষবাসই এত বেশি কৃষক আত্মহত্যার কারণ। এছাড়া রয়েছে ভূগর্ভস্থ জলদূষণের কারণে ক্যানসার রোগের প্রকোপ। আবরা মাঝা অঞ্চলের অমৃতসর, গুরুদাসপুর, পাঠানকোট, তারনতারন ও দোয়াবা অঞ্চলের জলন্ধর, কাপুরথালা, হোশিয়ারপুরের কৃষকেরাও ঋণের দায়ে আত্মঘাতী হয়েছেন।
এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক ভোটের ফল। মালোয়া অঞ্চলে মোট আসন ৬৯। এখানে আপ পেয়েছে ৬৬টি আসন। মাঝা অঞ্চলে মোট আসন ২৫, আপ পেয়েছে ১৬টি আসন। দোয়াবায় ২৩টি আসনের মধ্যে আপ পেয়েছে ১০টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছে সব মিলিয়ে ১৮। কৃষক আন্দোলনের বিরোধী শক্তি বিজেপি ও শিরোমণি অকালি দল প্রায় মুছে গেছে পাঞ্জাব থেকে। দুই দল পেয়েছে যথাক্রমে ৪টি এবং ২টি আসন। মালোয়া অঞ্চলে ১টি আসনও পায়নি বিজেপি।
পাঞ্জাবের ফলাফল থেকেই স্পষ্ট যে, কৃষক আন্দোলনের ধাক্কায় ওই রাজ্য থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বিজেপি ও তার দোসর অকালি দল। অথচ সেই বিজেপিই ক্ষমতায় ফিরেছে উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে। অথচ পাঞ্জাবের কথাটা মূল ধারার সংবাদপত্র একবারও উল্লেখ করে না। উল্টে বিজেপিকে অজেয় হিসাবে দেখানো অব্যাহত রয়েছে। পাঞ্জাবই দেখিয়ে দিচ্ছে, শ্রেণী রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক ইস্যুকে কাজে লাগানোর মতো রাজনৈতিক শক্তি যদি থাকে, তাহলে বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়াকে আটকে দেওয়া যায়। এই হল বিজেপির যে ধর্মাশ্রয়ী ভারত, তার বিকল্প–ভারতের একটা অংশ, যেখানে কৃষি সমস্যা ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে আটকে দেওয়া যায়। যদিও এটা ঠিক যে পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে আম আদমি পার্টিকে বেছে নেওয়ার মধ্যে খুব একটা প্রাজ্ঞতার পরিচয় নেই। কারণ নীতিগত ভাবে আপ দলের কোনও বিকল্প ন্যারেটিভ নেই সুবিধাজনক পপুলিজম ছাড়া।
এভাবে বিজেপি ক্ষমতায় নেই এমন প্রতিটি রাজ্যের বৈশিষ্ট্যকে যদি চিহ্নিত করা যায়, তাহলে বিকল্প ভারতের টুকরো টুকরো ছবিগুলো উঠে আসে। দরকার এগুলিকে একইসূত্রে গাঁথা। সেই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ কংগ্রেস।
এবং গোয়া
আর এখানেই উঠে আসছে আরেক বিপদ। কংগ্রেস ধীরে ধীরে ক্ষমতা হারাচ্ছে দেখে কংগ্রেসের বহু সাংসদ, বিধায়ক, নেতা চলে যাচ্ছেন বিজেপিতে। স্রেফ ক্ষমতা ও পদের লোভে। এদেরই একাংশকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে জাতীয় দল হয়ে ওঠার উচ্চাশা পোষণ করে তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির মতো দল। এভাবে নিজেরা বড় হতে গিয়ে তারা রাজ্য রাজ্যে থাবা বসাচ্ছে কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্কে। ফলে আরও দুর্বল হচ্ছে কংগ্রেস। এবং তা কার্যত বিজেপির পালে হাওয়া যোগানো হয়ে যাচ্ছে। গোয়ায় তৃণমূল ও আপ যেভাবে ভোট ভাগ করেছে, তাতে শেষ পর্যন্ত লাভ হয়েছে বিজেপিরই। এই ভাবে আঞ্চলিক কিছু দলের ‘জাতীয় আকাঙ্খা’কংগ্রেসকে দুর্বল করে বিজেপিকে শক্তি যোগাচ্ছে। তাদের উচ্চাকাঙ্খা দুর্বল করে ফেলছে বিরোধী ঐক্যকে।
আপাতত ভারতবর্ষের রাজনীতি চলেছে এই তিন ধারাকে বহন করে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ধারা শক্তিশালী হতে পারলে বিজেপির মোকাবিলা করতে পারবে। তখনই উচ্চাকাঙ্খী শক্তিগুলি আসল পরীক্ষার মধ্যে গিয়ে পড়বে।