বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

পেগাসাস ও বিপন্ন ভারতীয় গণতন্ত্র

পেগাসাস ও বিপন্ন ভারতীয় গণতন্ত্র

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট, ২০২১— পেগাসাস। গ্রিক পুরাণের পক্ষীরাজ ঘোড়া। আসলে অবাধ গতির প্রতীক। আজকের দিনে সেটা যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র ইজরায়েলের আড়িপাতার হাতিয়ার। সামরিক স্পাইওয়্যার। তৈরি করেছে ইজরায়েলের সংস্থা এনএসও। বিক্রি করেছে শুধুমাত্র বিশ্বস্ত কয়েকটি দেশের সরকারের কাছে। কী হয় এটা দিয়ে। এই সফটওয়্যার আপনার অজান্তে নিঃশব্দে ঢুকে পড়তে পারে আপনার মোবাইল, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ট্যাবে। তারপর আপনার ফোন নম্বর, কার সঙ্গে কী নিয়ে কতক্ষণ কথা বলছেন, কাদের সঙ্গে কী নিয়ে বার্তা বিনিময় করছেন, সব জেনে যাবে এই স্পাইওয়্যার। পাঠিয়ে দেবে নজরদারি সংস্থার কাছে। মানে আপনার গতিবিধি গোয়েন্দা ও সরকারের কাছে আর গোপন নেই। আপনার জীবনের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়েছে রাষ্ট্র। এবং আপনার গতিবিধির খুঁটিনাটির ওপর নজর রাখছে।

বেশ কয়েকটি বিদেশি ও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বিস্তারিত তদন্ত চালিয়ে ফাঁস করেছে পেগাসারের নজরদারির চক্রান্ত। বের করে এনেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ৫০ হাজার ফোন নম্বর যেগুলিরও ওপর নজরদারি চালানো হয়েছিল বলে সন্দেহ। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের ৩০০ ফোন নম্বর। এগুলোর মধ্যে পরীক্ষা করে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে ৪৭টি ফোনে অবশ্যই নজরদারি করা হয়েছে।

এদেশে কারা আছেন এই পক্ষীরাজের নজরদারির তালিকায়? ২ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিক, রাহুল গান্ধী। প্রশান্ত কিশোর, অভিষেক ব্যানার্জি, প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা, একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, প্রতিবাদী সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী। বাদ যায়নি তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণোর ফোনও।

ভারতে কি পেগাসাস দিয়ে নজরদারি চালানো হয়েছে? যেহেতু বিশ্বস্ত রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কাউকে পেগাসাস বিক্রি করে না এনএসও, তাহলে কি ভারত সরকার পেগাসাস কিনেছে? এখনও পর্যন্ত দুটি প্রশ্নের উত্তরেই নীরব মোদি সরকার। তাহলে কি মৌনং সম্মতিলক্ষ্মণম্? বুঝ মন যে জান সন্ধান।

২০১৭ সালে আধার কার্ডে উল্লিখিত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত নয় সদস্যের বেঞ্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। তাতে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার (Right to Privacy) বিষয়টিকে ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত বলে বিবেচনা করা হয়। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ অনুযায়ী, ব্যক্তির জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার (Right to Life and Personal Liberty) বিষয়টি মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। ওই যুগান্তকারী রায়ে বলা হয়, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সব রকমের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। কিন্তু যদি দেখা যায়, সংবিধান পালনে দায়বদ্ধ সরকারই মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করতে উদ্যত তাহলে দেশে গণতন্ত্র যে বিপন্ন সেবিষয়ে কোনও সংশয় থাকে না।

এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন অনেক। এলগার পরিষদ ও ভীমা কোরেগাঁও মামলায় যারা জেল খাটছেন, তাদের ফোন ও কম্পিউটারে ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর পিছনেও কি সেই পেগাসাস? কেন সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির ফোনে আড়িপাতা হল? কেনই বা নিজেদের মন্ত্রীদের ফোনে আড়ি পাতল সরকার? রাফাল কাণ্ড খ্যাত অনিল আম্বানির সংস্থার প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ সংস্থার আধিকারিকদের ফোনে কেন আড়িপাতা হয়েছিল? দিনে দিনে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রশ্নের তালিকা।

এখানেই শেষ নয়। কোভিডে মৃতদের সংখ্যা আড়াল করেছে কেন্দ্র। প্রতিবাদী সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লেলিয়ে দেওযা হচ্ছে আয়কর, সিবিআই, ইডির মতো সংস্থাগুলিকে। এখানেই থামা নয়। এরপর আছে সাংবাদিকদের হত্যা। মোদি সরকারের প্রথম ৫ বছরে ৪০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। গুরুতর আহত ১৭৫ জন। সংবাদের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪২। প্রতিবাদী হলেই লাগু হচ্ছে সিডিশন আইন।

এসব কিছুকে মেলালে দেখা যাবে যে পেগাসাস, সিডিশন আইন, ইডি, সিবিআই, আয়কর — সবগুলো মিলে একটা প্রসারিত ফাঁদ তৈরি করেছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। এবং সেই ফাঁসে নাগরিক প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে যত বেশি জনবিরোধী হয়ে উঠছে সরকারের নীতি, ততই আগ্রাসী হয়ে উঠছে তারা। পেগাসাস তাতে নতুন সংযোজন। আড়ালে আরও আছে। ক্রমশ তা সামনে আসবে।

যত বেশি এই সরকার ফ্যাশিস্ত কৌশল প্রয়োগ করছে, তত বেশি সংকুচিত হচ্ছে এদেশের গণতন্ত্রের পরিসর। তাতে সামিল হচ্ছে দেশ বিদেশের শক্তিগুলি যারা এই চলতি বিশ্বব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চায়।

সেকারণে এই সময়ে প্রাথমিক কাজ হল, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এবং সেই কাজ ত্বরান্বিত হবে যত বেশি করে গণতন্ত্রের পরিসর পুনরুদ্ধারের লড়াই তীব্রতর করা যাবে। যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব মানুষকে এই লড়াইয়ে সমাবেশিত করা যাবে। এই দুই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এগোতে হবে গণতন্ত্রের শক্তিগুলিকে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.