বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

মোদি-যোগীর গড়ে থানা গেড়ে আছেন কৃষকেরা

মোদি-যোগীর গড়ে থানা গেড়ে আছেন কৃষকেরা

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

শ্রমজীবী ভাষা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— উত্তরপ্রদেশে ভোটপর্ব শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেছে টানা এক মাস জুড়ে প্রাণান্তকর রাজনৈতিক লড়াইয়ের এক কঠিনতম পর্ব। কে জিতবে এই ভোটে। ফের  ক্ষমতা দখল করে বিজেপি যদি লখনউয়ের মসনদে বসতে পারে, তাহলে দেশজুড়ে ফ্যাসিস্ত শাসনের ফাঁস আরও শক্ত হয়ে চেপে বসবে। যদি বিজেপি হারে তাহলে শুরু হবে বিকল্প রাজনৈতিক সলতে পাকানোর পর্ব। কিছুটা আলগা হতে পারে নয়া উদারবাদী শাসনের জোয়াল। সবচেয়ে বড় কথা, দীর্ঘ এক বছর ব্যাপী কৃষক আন্দোলন উত্তরপ্রদেশের ভোট রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তারও পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে যাবে এই ভোটে। একই কথা অবশ্য প্রযোজ্য উত্তরাখণ্ড ও পাঞ্জাবের নির্বাচন সম্পর্কেও।
প্রথম ও দ্বিতীয় দফা মিলে ভোটপর্ব সম্পন্ন হয়েছে মূলত রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে। এই অঞ্চলে গত বিধানসভা নির্বাচনে  জাঠ–মুসলিম বিভাজন ঘটিয়ে সাফল্য পেয়েছিল বিজেপি। এবার কি তাকে রুখে দিতে পারবে কৃষক আন্দোলনের শক্তি? এনিয়ে মুখ খুলতে চাইছে না কোনও পক্ষই। তবে কিছু কিছু ইঙ্গিতে অনুমান করা যায়।
একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় উত্তরপ্রদেশের প্রথম দিনের ভোটপর্বের খবর ছেপেছে একেবারে ভিতরের পাতায়। তার শিরোনাম আগের বিধানসভা ভোটের তুলনায় যেহেতু এবার ৩ শতাংশ ভোট কম পড়েছে তাতে সুবিধা হবে বিজেপির। কিন্তু কেন? কম ভোট মানে বিজেপি বিরোধী প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোট কম পড়েছে? ৩ শতাংশ কমেই কেন এত আনন্দ?
হিসাবটা দেখা যাক। উত্তরপ্রদেশে প্রথম দফার ভোটে ভোটদানের গড় হার ৬০.৮২ শতাংশ। জেলাওয়ারি হিসাব এরকম— আগ্রা (৬০.২৩), আলিগড় (৬১.৩৭), বাগপত (৬২.৪৬), বুলন্দসর (৬৩.৩৫), গৌতমবুদ্ধ নগর (৫৭.০৭), গাজিয়াবাদ (৫২.৪৩), হাপুর (৬০.৫৩), মথুরা (৬২.০৯), মীরাট (৬১.২৪), মুজফফরনগর (৬৫.৩২), সামলি (৬৯.৪২)।  অতএব বিকেল ৫টার গড় ভোটদানের হার (৫৭.৭৯)কে গড় ভোট হিসাবে ধরে ভোটের হার কম বলে স্বস্তি প্রকাশের কোনও কারণ ঘটেনি। মনে রাখা দরকার, বছরজুড়ে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সবচেয়ে বিশাল জমায়েতগুলো হয়েছিল শামলি, মুফফরনগর, মথুরা ও বাগপত জেলায়। (সূত্র: দ্য ইকনমিক টাইমস, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)।  বহু খাপ পঞ্চায়েতের নেতৃত্বে হাজার হাজার কৃষক এই সমাবেশগুলিতে যোগ দেন। আরএলডির ঘাঁটি এই সব জেলা আবার ছিল কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্র। সুতরাং যদি শামলি, মথুরা, মীরাট, বাগপতে অন্য জেলার তুলনায় বেশি ভোট পড়ে থাকে তাহলে তার পিছনে কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। আবার বুলন্দসর, হাপুর, মুজফফরনগর, মথুরার মতো কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চলে ২০১৪ সাল থেকে ঘটেছে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা। এসব জেলাতেও ভোটের হার গড় হারের চেয়ে বেশি। যদি পশ্চিমাঞ্চলে প্রথম দফাতেই ভোটের এমন চেহারা হয়, তাহলে ভোটের ফল নিয়ে বিজেপি যে উদ্বেগে রয়েছে তাতে সন্দেহের কিছু থাকে না।
বিজেপির দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে দ্বিতীয় দফার ভোট নিয়েও। ১৪ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশে  দ্বিতীয় দফার দিন গড়ে ভোট পড়েছে ৬১.‌২০ শতাংশ। তবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সাহারানপুরে ৬৭.১৩ শতাংশ, আমরোহায় ৬৬.১৯ শতাংশ, বিজনৌরে ৬১.৪৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। এগুলি সবই জাঠ অধ্যুষিত নির্বাচনী কেন্দ্র। আশা করা যায়, শেষ ব্যক্তিটির ভোট দেওয়া হলে এই শতাংশ আরও একটু বাড়বে। সুতরাং প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে জাঠ বলয়ে ভোটের বেশি হার উদ্বেগে রাখবে যোগীকে।
এই ভোট নিয়ে বিজেপি কতটা উদ্বিগ্ন তার প্রমাণ আরও দুটি ঘটনা। এক, নীচুতলার কৃষকদের সমর্থন হারানোর কথা জেনেও শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ ভোট এককাট্টা করতে ভোটের আগে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হল লখিমপুর খেরির খুনি অজয় মিশ্রের ছেলে আশিসকে। আবার হরিয়ানা–উত্তরপ্রদেশ সীমানার জাঠ ভোট ফেরাতে ১০ বছর পর জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা হল হরিয়ানার জাঠ নেতা অজয় চৌতালাকে। কীভাবে এই মুক্তি ঠিক ভোটের আগে ঘটল সেই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট নয়। ভোট নিয়ে খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে না থাকলে কেউ এই বেপরোয়া ঝুঁকি নেয় না।
নির্বাচনী প্রচারে মোদি, যোগি এবং শাহের হাতে বিভাজনের রাজনীতি ছাড়া আর কোনও তাস নেই। গত কয়েকবারের নির্বাচনে ব্যবহারে ফলে সেই হাতিয়ারের  আকর্ষণও কমেছে। বরং, লোকে অনেক বেশি ভাবিত করোনা–কালে রুটি রুজির সমস্যা ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে।  সেসব নিয়ে একটা শব্দও খরচ করতে দেখা যাচ্ছে না বিজেপি নেতাদের।  বরং হিন্দু–মুসলিম সংঘাতের ভীতি আকারণে খুঁচিয়ে তোলা হচ্ছে। সুকৌশলে কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ককে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে ইউপির ভোটে তার ফায়দা কুড়োনোর চেষ্টা চলছে। এটাও এক ধরনের কোণঠাসা পরিস্থিতির ইঙ্গিতবাহী। এর ওপর পশ্চিমবঙ্গের কায়দায় মোদি উত্তরপ্রদেশের প্রথম দফার পরই বলতে শুরু করেছেন, ভোটে বিজেপি জিতেই গেছে। সরকার গড়েই ফেলেছে। অতএব বিরোধীদের ভোট দিয়ে কী লাভ।
আরও লক্ষ্যণীয় হল, যত দিন যাচ্ছে ততই নরেন্দ্র মোদি কী সংসদে, কী নির্বাচনী জনসভায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণ হেনেই চলেছেন এবং তাতে ভুরি ভুরি মিথ্যা তথ্য যোগ করে। সম্ভবত মোদিরা এটা বুঝেছেন, পাঁচ রাজ্যের ভোটে তাদের ভাবমূর্তি কিছুটা ফিরে পেতে চলেছে কংগ্রেস। আর সেটা হলেই কংগ্রেসকে ঘিরে দানা বাঁধতে পারে বিরোধী ঐক্য। অতএব মারি অরি পারি যে কৌশলে। সত্য—মিথ্যা মিলিয়ে নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধীর মুণ্ডপাত করে চলেছেন মোদি। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ভীতিই তাকে বুঝি গ্রাস করেছে। আরও একটা বিষয়। গোটা জানুয়ারি মাস জুড়ে নির্বাচন কমিশন উত্তরপ্রদেশের ভোটে প্রকাশ্য সভা করার অনুমতি দেয়নি। অখিলেশের অভিযোগ ছিল, যেহেতু বিজেপির সভায় লোক কম হচ্ছে, তাই সেটা আড়াল করতেই নিষেধাজ্ঞা জারি করে কমিশন। আবার ভোটপর্ব শুরু হতেই তুলে নেওয়া হল সেই নিষেধাজ্ঞা। দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের আদলে, যেদিন যে অঞ্চলে ভোট সেদিন তারই পাশের অঞ্চলে জনসভা করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন বিজেপি নেতারা। এটাও জিততে মরিয়া মনোভাবেরই একটা কৌশল। সেখানে নিঃশব্দে শাসকের চাপের মুখে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন কমিশনের কর্তারা। সুতরাং, বাইরের নানা লক্ষ্মণ মিলিয়ে অনুমান করা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের এবারের ভোটে বিজেপির পালে অবাধ পূবালি বাতাস বইছে না। বরং ভোট পর্ব যত বেশি পশ্চিম থেকে পূব দিকের গরিব এলাকায় এগোবে, ততই বিজেপির পালে হাওয়া কমার সম্ভাবনা।
এর মধ্যে আশ্চর্যজনক হল তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা। ত্রিপুরা ও গোয়ার পর, এই গুরুত্বপূর্ণ ভোটের সময় মোদির মতোই তীব্র ভাষায় কংগ্রেসের বিরোধিতা করে চলেছেন। তাঁর বক্তব্য, কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকে ভোট দেওয়া। একথা শুনলে ঘোড়াতেও হাসবে। মোদি কেন কংগ্রেসের উত্থানের ভয় পাচ্ছেন তা স্পষ্ট। কিন্তু মোদির সুরে সুর মিলিয়ে কেন কংগ্রেসকে দুর্বল করতে উঠে পড়ে লেগেছেন মমতা, সেটা ক্রমশ এক প্রশ্নসূচক সমীকরণ হয়ে উঠছে। প্রধান বিরোধীকে দুর্বল করলে শাসকের হাতই শক্ত করা হয়, এটা লোকে সহজেই বোঝে। তাহলে কি তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী ঐক্যের কেন্দ্র হতে চাওয়া কংগ্রেসকে দুর্বল করে ফেলতে চায় তৃতীয় কোনও পক্ষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য?

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.