কৃষক আন্দোলনের শক্তি এবং বিরোধী দলগুলির দুর্বলতা
কৃষক আন্দোলনের শক্তি এবং বিরোধী দলগুলির দুর্বলতা
বসন্ত মুখোপাধ্যায়
শ্রমজীবী ভাষা, ১ নভেম্বর, ২০২১—
এক
মোদি সরকারের নয়া কৃষি নীতি এদেশের কৃষি ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী ও মৌলিক চরিত্রের বদল আনতে চায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বজুড়ে পিছু হঠেছিল সাম্রাজ্যবাদ তথা ফিনান্স পুঁজি। সেই পর্বে নানা মাত্রায় উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া দেশগুলির সামনে নানা ধরনের, নানা স্তরের অগ্রগতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক, আধা সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে কৃষির পুঁজিবাদী বিকাশের পথ উন্মুক্ত করার সম্ভাবনাও। চীন, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোচীনের একাধিক দেশে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কার্যকর করা হয় আমূল ভূমি সংস্কার কর্মসূচি। সেই কর্মসূচি কৃষি থেকে ধাপে ধাপে ঝেঁটিয়ে সাফ করে সামন্তবাদ ও আধা সামন্তবাদী অবশেষগুলিকে। এর জেরে এই সব এলাকায় গড়ে ওঠে নতুন এক কৃষি ব্যবস্থা যা দেশের স্বাধীন শিল্প বিকাশের অনুসারী হয়ে উঠেছিল। মার্কসীয় পলিটিক্যাল ইকনমির ভাষায় এ হল, নন ক্যাপিটালিস্ট পাথ অফ ডেভেলপমেন্ট। অর্থাৎ কৃষিতে পুঁজিবাদ বিকাশের যে পশ্চিম ইউরোপীয় মডেল, যা আবার ত্বরান্বিত হয়েছিল ১৮৫০এর পর ইউরোপ জুড়ে পুঁজির দ্রুত ও সর্বাত্মক বিকাশের দরুণ, সেই মডেলের সঙ্গে চীন বা ভিয়েতনামের কৃষির রূপান্তরের পথের মিল ছিল না। বরং রুশ বিপ্লবের পরবর্তী যুগে স্তালিন আমলের কৃষির রূপান্তরের মডেলের অনেক কিছু এসব দেশে অনুকরণ করা হয়েছিল।
ঔপনিবেশিকতার জোয়ালমুক্ত ভারতের কৃষি অবশ্য সে পথে হাঁটেনি। এদেশে, স্বাধীনোত্তর কালে, সাম্রাজ্যবাদের ওপর নানা ভাবে নির্ভরশীল বুর্জোয়ারা ক্ষমতা সংহত করার স্বার্থে আমূল ভূমি সংস্কারের কাজে হাত দেওয়ার সাহস পায়নি। বরং, সামন্তবাদ ও আধা সামন্তবাদের অবশেষকে টিকিয়ে রেখেই ধীর গতিতে কৃষি সংস্কারের পথে (কৃষি বিপ্লবের বিপরীত পথ)হেঁটেছিল সদ্য স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র। তবে খুব শিগগরিই সেই ধীরে চলো সমঝোতার নীতি সঙ্কটে পড়ে এবং দেশে খাদ্য সঙ্কট তীব্র হয়ে ওঠে। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতেই ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয় সবুজ বিপ্লব, যা মর্মবস্তুর বিচারে ছিল আদ্যন্ত সংস্কারের পথ। সেই পর্বে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে কৃষিক্ষেত্রে নানা ভরতুকি চালু করা হয়। এই সংস্কারের সুযোগে গ্রামাঞ্চলে বৃহৎ জমিদাররা, অনেকেই কমবেশি পরিমাণে হয়ে ওঠে পুঁজিবাদী চাষি, তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করে। এভাবে এদেশে গড়ে ওঠে বড় বুর্জোয়া বড় জমিদারদের এক সমঝোতা, যে সমঝোতা রাষ্ট্রকাঠামোয় এনেছিল এক ধরনের স্থিতাবস্থা। এই কর্মসূচির জেরে নানা ধরনের পুঁজিবাদী রূপান্তর প্রসারিত হয় একেবারে গ্রামস্তর পর্যন্ত। আবার একই সঙ্গে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে ধনী চাষিরা রক্ষা করে ও টিকিয়ে রাখে নানা ধরনের সামন্তবাদী ও আধা সামন্তবাদী অবশেষকে এবং এগুলিকে তারা কাজে লাগিয়েছে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভুত্ব কায়েম রাখার স্বার্থে।
শ্রীমতি গান্ধীর আমলে গড়ে ওঠা বড় বুর্জোয়া ও বড় জমিদারদের এই সমঝোতাকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলাই নয়া উদারবাদী ও ক্রোনি পুঁজির অর্থনৈতিক লক্ষ্য। এই প্রক্রিয়াটি চলছে গত ৩০ বছর ধরে। প্রথমে এদেশে কৃষি সংস্কারের নামে রাষ্ট্রের দেওয়া সুবিধাগুলি একে একে প্রত্যাহার করা হয়েছে ভরতুকি প্রত্যাহারের নামে। ফলে সার, বীজ, সেচের জল, বিদ্যুৎ, কীটনাশকের মতো উৎপাদনের উপকরণের দাম বেড়েছে ক্রমবর্ধমান হারে। ফলে বেড়েছে চাষের খরচ। অন্যদিকে ফসলের লাভজনক দাম দিতে নারাজ রাষ্ট্র। কারণ, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা ভরতুকির নামে পুরোপুরি লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে শিল্পমহল।
এদেশের অর্থনীতির নয়া উদারবাদী রূপান্তর যত প্রসারিত হয়েছে, তত বেশি করে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন গরিব, মাঝারি থেকে সম্পন্ন কৃষককুল। চাষ আর আগের মতো লাভজনক নয়। ফলে কৃষি ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘনিয়ে উঠেছে। এদেশে কৃষকদের বিপুল সংখ্যায় আত্মহত্যার ঘটনা সেই সংকটের প্রতিফলন। এই রকম সংকটের পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত আঘাত এসেছে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে। কৃষি বাণিজ্যে আগের আমলের সরকারি হস্তক্ষেপের ভূমিকা পুরোপুরি তুলে দিয়ে পুরো ক্ষেত্রটিকেই ক্রোনি পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে নয়া কৃষি আইনে। এতে শুধু ছোট ও মাঝারি কৃষকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, বড় জমিদার ও ধনী চাষিদের একটা বড় অংশও তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্রোনিদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। একই সঙ্গে ক্রোনি পুঁজি কৃষি বাণিজ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার পেলে খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল চাষে জোর দেবে, কারণ শিল্পনির্ভর উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে সেগুলোর লাভজনক বাজার রয়েছে। এর ফলে একসময়ে খাদ্য স্বয়ম্ভরতা থেকে বঞ্চিত হবে ভারত। পুরো কৃষি উৎপাদনটাই চেয়ে থাকবে বিদেশের বাজারের ওপর। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের পিছু হঠার যুগে আংশিক যে অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল গত শতকের ছয়, সাত ও আটের দশকে — এখন চলছে সেগুলিকে জলাঞ্জলি দিয়ে কৃষিকে পুরোপুরি নয়া উদারবাদী পুঁজির চাহিদার অনুসারী করে তোলার পর্ব, যার নেতৃত্বে রয়েছে ক্রোনি পুঁজি ও তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা। এ হল নয়া উদারবাদী ফিনান্স পুঁজির যুগে পিছিয়ে পড়া দেশগুলির আরও বেশি পিছু হঠার, আরও বেশি বিদেশি, ফিনান্স পুঁজি নির্ভরতার একটা প্রক্রিয়া। তবে শুধু কৃষিই নয়, এদেশের শিল্পেও একই প্রক্রিয়া কার্যকর রয়েছে।
দুই
মোদি সরকারের নয়া কৃষি নীতির বিরুদ্ধে যাঁরা গত এক বছর ধরে দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের নেতারা এই সংকটের মর্মবস্তুকে খুব সঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছেন।
নয়া কৃষিনীতি যে ভারতীয় কৃষিকে নয়া উদারবাদী ক্রোনি পুঁজির হাতে তুলে দিতে চায়, সেটা বোঝার ব্যাপারে কোনও অস্পষ্টতা নেই এই আন্দোলনের। সে কারণে কৃষক আন্দোলন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে মোদি সরকারকে, যে সরকার আসলে ক্রোনিদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি। সরকারের আড়ালে থাকা আদানি, আম্বানিরা যে তাঁদের শত্রু, সে বিষয়ে কৃষক আন্দোলনের কোনও সংশয় নেই। মোদি–আদানি–আম্বানি ইত্যাদিদের শক্তিশালী জোটের মোকাবিলা করতে হলে তাঁদের শক্তি যে অনেক বেশি সম্প্রসারিত করতে হবে, সে বিষয়েও সচেতন কৃষক আন্দোলন। বড় জমিদার, ধনী চাষি, মাঝারি, গরিব ও প্রান্তিক চাষি, ভূমিহীন কৃষক ও কৃষিমজুর — এই আন্দোলনে তাঁরা সমাবেশিত করেছেন সব শক্তিকে। শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যাপক মোর্চা গড়ার পথেই হেঁটেছেন তাঁরা। এভাবে কৃষকের অর্থনৈতিক লড়াই রূপান্তরিত হয়েছে মোদি বিরোধী রাজনৈতিক লড়াইয়ে। এবং এখান থেকেই ভারতীয় কৃষির জন্য বিকল্প পথের দাবি তোলা হয়েছে। এভাবে ক্রোনিদের কৃষি ন্যারেটিভের পাল্টা গড়ে উঠেছে বিকল্প এক কৃষি ন্যারেটিভ। যদিও এই ঐক্যের প্রতিফলন ঘটানোর মতো কোনও রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে ওঠেনি। সবটাই সীমিত রয়েছে কৃষক মোর্চার মতো আলগা একটি সংগঠনে।
এই কৃষক আন্দোলনে রয়েছে পরিণতি বোধের নানা অভিজ্ঞান। প্রথমত, দ্রুত নিষ্পত্তির বদলে কৃষকেরা বেছে নিয়েছেন দীর্ঘস্থায়ী বা প্রোট্র্যাকটেড আন্দোলনের পথ। এবং সরকারের সঙ্গে দ্রুত, চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পথে না গিয়ে ধাপে ধাপে বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অনেকটা সময় জুড়ে। এতে কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ যেমন বেড়েছে, তেমনি দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি হয়েছে আন্দোলনের আবহ, যা ক্রমশ নেতৃত্বকে আরো অভিজ্ঞ করে তুলেছে। বোঝাই যাচ্ছে এত দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের প্রস্তুতি মোদি সরকারের ছিল না। তাই তাদের অবস্থান পুরোপুরি দিশাহারা। লখিমপুর কিংবা হরিয়ানায় গাড়ি চাপা দিয়ে কৃষক হত্যার চেষ্টা আসলে সরকারপক্ষের দিশাহীনতা, হতাশা ও ধৈর্যচ্যুতির প্রমাণ।
সামাজিকভাবেও এই আন্দোলন অনেক নতুন বিষয় সামনে এনেছে। পাঞ্জাবের গুরুদ্বারায় লঙ্গর চালানোর যে রীতি ও ঐতিহ্য, কৃষক আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী করার ক্ষেত্রে সেই ধর্মীয়–সামাজিক ঐতিহ্য কাজে লাগানো হয়েছে।
যে জাঠ মহাপঞ্চায়েতগুলো নানা সামাজিক বিষয়ে (এমনকি মেয়েরা মোবাইল ব্যবহার করতে পারবে না ধরনের) নিদান দিতে অভ্যস্ত ছিল, সেগুলি এখন কৃষক আন্দোলনে বড়সড় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
আন্দোলনই হিন্দু–মুসলমান বিভেদকে পাশে সরিয়ে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ হতে শিখিয়েছে। জাতিগত বিভাজনকে আন্দোলনের স্বার্থে আপাতত সরিয়ে রাখতে শিখিয়েছে।
উত্তর ভারতের গ্রামীণ সমাজে টিকে থাকা সামন্তবাদী ও আধা সামন্তবাদী অবশেষগুলো ভেঙে এবারের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে উঠে এসেছেন মেয়েরা। এমনও দেখা গেছে মেয়েরা যখন সম্মেলনের কাজে ব্যস্ত, তখন তাঁদের জন্য লঙ্গরে খাবার তৈরি করছেন জাঠ পুরুষেরা। সাধারণ সময়ে এমন দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না।
আন্দোলনে সামিল পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ সহ বিভিন্ন রাজ্যের যুব সম্প্রদায় যাঁরা পড়াশোনা শেষ করে চাষকেই জীবিকা করতে চান। এই অংশটি আন্দোলনের আলোকপ্রাপ্ত মুখ।
এই আন্দোলন কৃষক বৃত্তের বাইরে গিয়ে শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্রছাত্রী, নাগরিক সমাজ— সব অংশকে সামিল করতে সক্ষম হয়েছে।
এককথায়, গ্রাম থেকে শহর, একটা চমৎকার সূত্রে গ্রথিত করেছে এই আন্দোলন যা আন্দোনলকারী ও তাদের নেতৃত্বের পরিণত রাজনৈতিক মানসিকতার প্রতিফলন।
বোঝাই যাচ্ছে, নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের এই আন্দোলন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী আন্দোলনের মতো শুধুমাত্র সামন্তবাদ বিরোধী চরিত্রের নয়। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় চেতনাও এই আন্দোলনের উৎস নয়। এই আন্দোলনের সর্বাঙ্গে নতুনের এমন সব চিহ্ন রয়েছে যা চেতনা ও রূপের দিক থেকে আধুনিক। এই আন্দোলন যেমন সামন্তবাদী, আধা সামন্তবাদী অবশেষের হাত থেকে চেতনাকে মুক্ত করছে, তেমনি যুক্ত করছে বহু পুঁজিবাদী পদ্ধতি ও উপকরণ। এসবের নির্যাস হল ক্রোনি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত নয়া উদারবাদের বিরোধিতা করা এবং এদেশের সঙ্কটগ্রস্ত কৃষিকে বিকল্প, রাষ্ট্র সমর্থিত, জনমুখী কৃষিনীতির দ্বারা পরিচালিত করা। এই আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে সামন্তবাদী, আধা সামন্তবাদী অবেশেষ থেকে মুক্তির আকাঙ্খা। রয়েছে ভারতীয় কৃষিকে আদ্যন্ত পুঁজিবাদী কৃষিতে রূপান্তরিত করার তাগিদ। আবার সেই কর্মসূচিতে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে এ হল ভারতীয় কৃষির এক রূপান্তর পর্বের মহাসূচনা, যা পরিণামে বদলে দেবে এদেশের কৃষি ও কৃষককে।
তিন
মনে রাখা দরকার যে, ওপরের যে বৈশিষ্ট্যগুলির কথা উল্লেখ করা হল তা কৃষক আন্দোলনের মধ্যে কোথাও একেবারে সুসংহত, রাজনৈতিক–সাংগঠনিক চেহারায় দেখা যাবে না। এই কৃষক আন্দোলন একটা বিশাল বহতা ধারা, যার স্তরে স্তরে এই সব চেতনার স্তর ও সাংগঠনিক রূপ বিধৃত হয়ে রয়েছে। ফলে সব ধরনের চেতনার স্তর ও সাংগঠনিক রূপ, নানা স্তরের আকাঙ্খার প্রকাশ পাওয়া যাবে আন্দলনের গোটা দেহ জুড়ে।
প্রশ্ন হল, এই সব সম্ভাবনাগুলিকে সংহত করে একটা ঐক্যবদ্ধ চেহারা দেওয়ার মতো রাজনৈতিক উদ্যোগ কি এদেশে রয়েছে। উত্তর হল, না। নেই। কৃষক আন্দোলনকে শ্রেণী ঐক্যের ওপর দাঁড় করিয়ে নির্দিষ্ট অভিমুখ দিতে পারার মতাদর্শগত ও তাত্ত্বিক সক্ষমতা থাকার কথা বামেদের। কিন্তু শক্তিক্ষয়ের কারণে এদেশে বামেরা এখন হীনবল। ফলে এই আন্দোলনে সার্বিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা বামেদের পক্ষে সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা, কংগ্রেস, বাম সহ বিজেপি বিরোধী যে সব আঞ্চলিক ও জাতপাত ভিত্তিক দলগুলি রয়েছে, তারা জাতীয় স্তরে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে সেই মঞ্চের মাধ্যমে কৃষক আন্দোলনের শক্তি রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারত বিজেপি বিরোধী ভোট ঐক্যবদ্ধ করে এবং বিজেপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
কিন্তু তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশের কথাই ধরা যেতে পারে। আগামী বিধানসভা ভোটে বিজেপির হিন্দি-হিন্দু এবং জাতাপাতভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি মোকাবিল হবে কৃষক আন্দোলনের শক্তির। এই লড়াইয়ের ফলাফলের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। অথচ যে দুই রাজনৈতিক শক্তি উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিতে পারত সেই কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে এমন সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না।
এখানেই কৃষক আন্দোলনের অগ্রবর্তী চেতনার সঙ্গে সংঘাত বাধছে রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিদের। সমাজবাদী পার্টি তাদের জাতপাতের পুরনো সমীকরণ আঁকড়ে ধরেই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা পেতে চায়। একই ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে একই উদ্দেশ্য সাধন করতে চায় কংগ্রেসও। (একই কারণে বিহারে বিভাজন বাড়ছে কংগ্রস ও আরজেডির মধ্যে)। বহুজন সমাজ পার্টি সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলো্র বিজেপি বিরোধী চরিত্র সুস্পষ্ট নয়। তারা ভোটের নামে দুর্বল করতে চায় কৃষক আন্দোলনকে। মনে রাখা দরকার, আজকের ভারতে জাতপাতের সমীকরণের রাজনীতি ক্ষীয়মান। এই রাজনীতিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে বিজেপি। এখন জাতপাত তথা হিন্দি-হিন্দু মতাদর্শের বিপরীতে ক্রমশ শক্তি বাড়াচ্ছে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বিরোধিতায় নামা নানা শ্রেণীর জোটের ঐক্যবদ্ধ অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক আন্দোলন। বার বার নানা রাজ্যে তার প্রকাশ পাচ্ছে। এই সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত কৃষক আন্দোলনের মধ্যে। একদিকে শ্রেণীস্বার্থ নিয়ে আদানি–আম্বানিদের সঙ্গে মোদি–অমিত শাহের বিরোধ নেই। অথচ অন্যদিকে, মোদি বিরোধী কৃষক আন্দোলন এবং মোদি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কোনও তালমিল গড়ে উঠছে না। রাজনৈতিক দলগুলি ভাবছে কৃষক আন্দোলনকে পুঁজি করে তারা নির্বাচনী আসর মাত করবে। যদিও সবাই জানে এককভাবে কোনও দলের পক্ষেই তা করা সম্ভব নয়।
একদিকে শ্রেণীর প্রতিনিধিরা অগ্রবর্তী চেতনার ধারক। তাঁরা চাইছেন, মেদি সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক লড়াই। অন্যদিকে তাদের সমর্থনকারী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি পড়ে রয়েছে জাতপাতের রাজনীতির পরিসরে, যে রাজনীতির ভিত্তি ক্রমশ ক্ষীয়মান। শ্রেণীর আন্দোলনের সঙ্গে শ্রেণীর স্বার্থের দাবিদার রাজনৈতিক শক্তিগুলির এই দুস্তর ব্যবধান ভারতের রাজনীতিতে একটা নতুন বৈশিষ্ট্য। ফলে রাহুল গান্ধী যখন বলেন, কংগ্রেস কর্মীদের মতাদর্শের ওপর জোর দিতে হবে, তখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যখন ক্ষমতায় গিয়ে আখের গোছানোর রাজনীতিই প্রাধান্যে রয়েছে, তখন সেই পরিমণ্ডল থেকে আদর্শবাদী রাজনীতিক পাওয়া যাবে কীভাবে? আদর্শবাদী রাজনীতির উপাদান তো রয়েছে কৃষক আন্দোলনের মধ্যেই, যারা নানা প্রলোভন ও সন্ত্রাস উপেক্ষা করে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন জারি রেখেছেন। তাদের দলের নানা স্তরে এবং প্রার্থী তালিকায় তুলে আনতে পারলেই তো আদর্শবাদী নেতা–কর্মীর সঙ্কট মেটে। আলাদা করে পাঞ্জাবে দলিত মুখ্যমন্ত্রী বেছে নিতে হয় কেন? এদেশে ক্রোনি পুঁজির অর্থে পুষ্ট নয়া উদারবাদী রাজনীতি আয়ারাম–গয়ারাম ছাড়া কোনও কিছু তৈরি করতে পারে না। রাজনীতিতে মতাদর্শের সঙ্কট মেটাতে হলে মোদি বিরোধীদের রাজনৈতিক দলগুলিকে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে শ্রেণীর আন্দোলনের সঙ্গে। তবেই তৈরি হবে নতুন রাজনীতির উপাদান এবং নতুন রাজনৈতিক সক্রিয়তা। সেই নতুন শক্তিই নয়া উদারবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
শ্রেণীর সঙ্গে শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের এই দুস্তর ব্যবধান ঘোচানো না গেলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে মেদি বিরোধী নতুন ন্যারেটিভ গড়ে তোলার কাজ।