বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার পরীক্ষাগার বিহার

ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার পরীক্ষাগার বিহার

অতনু চক্রবর্তী

photo


ইতিহাসের আরও নিষ্ঠুর পরিহাস এই যে, বিহারে ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় পরিমার্জন’ অভিযান বা স্পেশাল ইনটেন্সিভ রিভিশন (এসআইআর) শুরু হয়েছে ২৫ জুন, ২০২৫ জরুরি অবস্থা ঘোষণার ৫০তম বার্ষিকীতে — মোদি সরকার এবার ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসাবে দিনটি পালন করার ডাক দিয়েছে! বিহারে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারকে বিপন্ন করে মোদি সরকারের বশংবদ ইসি এদেশের বিপর্যস্ত গণতন্ত্রে ইতিমধ্যেই আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত সংবিধানের উপর মোক্ষম আঘাত হানল।
ইসি জানিয়েছে, বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধন করতে গিয়ে এখনও পর্যন্ত ৪১ লক্ষ ৬৪ হাজারের বেশি ভোটারকে তাঁদের ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত বিহারের ভোটার তালিকায় প্রায় ৭ কোটি ৯০ জন ভোটার ছিলেন। ইসি জানিয়ে দিল, এর মধ্যে ৫.২৭ শতাংশ ভোটারকে তাঁদের ঠিকানায় পাওয়া যাচ্ছে না! এটা পরিষ্কার, ওই বিপুল সংখ্যক ভোটারদের তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার খাঁড়া ঝুলছে।
আচমকা ইসি বিহারে এই এসআইআর শুরু করল কোনও বিরোধী দলকে না জানিয়েই। ইসি খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছে, এই কাজ এরপর পশ্চিম বাংলা সহ অন্যান্য রাজ্যেও শুরু হবে।
সকলকে হতচকিত করে মোদি ঠিক যে ভাবে নোটবন্দি করেছিলন, আজ ইসি সেই একই কায়দায় এসআইআর নামিয়ে আনল, যাকে বিহারের মানুষ আখ্যা দিয়েছেন ভোটবন্দি বলে।
বিহার নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ এ বছরের গোড়ার থেকেই চলছিল। কিন্তু কোনও পর্যায়েই বিধানসভা নির্বাচনের আগে এরকম বিরাট পরিধিতে রাজ্যব্যাপী নিবিড় ভোটার তালিকা পরিমার্জনের কোনও ইঙ্গিত দেয়নি ইসি। বিহারে সর্বশেষ এই ধরনের নিবিড় পরিমার্জন হয়েছিল ২০০৩ সালে, যখন কোনও নির্বাচন আসন্ন ছিল না। তখন ভোটার তালিকায় প্রায় ৫ কোটি মানুষ ছিল, সংশোধন প্রক্রিয়া শেষ করতে লেগেছিল মাসের পর মাস। এখন ভোটার তালিকায় রয়েছেন প্রায় ৮ কোটি মানুষ, অথচ ইসি মাত্র এক মাসের মধ্যে ওই বিপুল সংখ্যক গণনার কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেছে। আর এমন সময় এই কাজটি তারা চালাবেন, যখন মানুষ ব্যস্ত কৃষি কাজে, ভারি বর্ষা ও বন্যায় বিহারের নানা প্রান্ত বিধ্বস্ত হয় এবং বিরাট সংখ্যক মানুষ ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন রুটি রুজির সন্ধানে। আর ঠিক এই প্রতিকূল সময়কে ইসি বেছে নিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণনা করার, যা কার্যত অসম্ভব। এখান থেকে স্পষ্ট যে ইসি-র অভিপ্রায় মোটেই ভাল নয়, বরং ষড়যন্ত্রমূলক। ব্যাপক বিহারবাসীর ভোটাধিকার হরণ এর আসল উদ্দেশ্যে।
ইসির বক্তব্য, তারা ১ জানুয়ারি ২০০৩ এর ভোটার তালিকাকে ভিত্তি হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এসআইআর শুরু হয়েছে ঠিক তার পরের দিন থেকে। ওই ঘোষিত সময়সীমার পরবর্তীতে যাঁদের নাম যুক্ত রয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকেরই জন্মের তারিখ ও স্থানের প্রমাণপত্র দিতে হবে, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের পিতামাতারও একই ধরনের প্রমাণপত্র দিতে হবে। এত বছর ধরে ভোটারদের কেবল একটি এফিডেভিট জমা দিলেই চলত। এখন নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় ইসি চাপিয়ে দিল ভোটারের উপর।
প্রশ্ন উঠেছে, ইসি কেন দুই দশকেরও বেশি সময় অপেক্ষা করল আর তারপর হঠাৎ বিহার নির্বাচনের ঠিক আগে শুরু করল এই পরিমার্জন? যদি ইসি-র ব্যবহৃত ২০০৩ এর ভোটার তালিকা নিয়ে সন্দেহ থাকে তবে ইসি কীভাবে সেই ত্রুটিপূর্ণ তালিকার ভিত্তিতে হওয়া নির্বাচনী ফলাফলকে বৈধতা দেয়? কিন্তু ইসি-র এই বিশেষ পরিমার্জন অভিযানে প্রায় পাঁচ কোটি জনগণকে এই তথাকথিত যোগ্যতা প্রমাণের পরীক্ষায় পাস করতে হবে যার অনেকগুলোই ভোটারদের কাছে নেই। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, যাঁর বেঞ্চে এই সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন, তিনি পর্যন্ত এই একই কথা বলেছেন, যে সমস্ত নথি ইসি চেয়েছে, তার অনেকগুলোই তাঁর নেই। আধার কার্ড, রেশন কার্ড এমনকি কমিশনের দেওয়া ভোটার আইডি কার্ডও বৈধ বলে বিবেচিত হচ্ছে না। এই বিশেষ নিবিড় পরিমার্জন অভিযান, ২০০৩ পরবর্তী সমস্ত ভোটার তালিকাকে সরাসরি খারিজ করে দিচ্ছে।প্রশ্ন আরও রয়েছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ভারতে, বিহারের মতো রাজ্যে, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবার পরিধি এখনও সীমিত, বহু জন্ম বাস্তবে নিবন্ধিত হয় না। ইসি কীভাবে কয়েক দশক আগে জন্মানো সাধারণ ভোটারদের কাছ থেকে এই রেকর্ড আশা করে? জমির মালিকানার নথি বা স্কুল ছাড়ার সার্টিফিকেটের মতো নথি বিহারের মতো রাজ্যে খুবই বিরল, যেখানে ভূমিহীনতার হার খুব বেশি এবং ২০২৩ এর নভেম্বর এ সম্পন্ন কাস্ট সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছে। মাত্র একমাসের সময়সীমার মধ্যে এই সংগৃহীত নথির ভিত্তিতে কী নতুন তালিকা তৈরি করা সম্ভবপর? আসলে পরিমার্জনের নামে এই গোটা প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হল — প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের উপর সরাসরি হামলা — স্বাধীন ভারতে এর আগে যা কখনও ঘটেনি। এই ভাবে কিছু বিশেষ নথি থাকা নাগরিকদের মধ্যেই ভোটাধিকার সীমিত হয়ে যাবে — যা কার্যত গণতন্ত্রেরই সংকোচন করবে।
বিহার বিধানসভা ২৮ নভেম্বর ২০২১ তারিখে রাজ্যে এনআরসি চালু করার বিরুদ্ধে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব পাস করেছিল। কিন্তু আজ সহায়ক প্রমাণপত্রের নির্দেশিকা তালিকায় এনআরসি-কে ১১টি গ্রহণযোগ্য প্রমাণপত্রের মধ্যে একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইসি আবার জানিয়ে দিয়েছে, যারা প্রয়োজনীয় দলিল জমা দিতে পারবেন না, তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে।
বিহারের পূর্ব প্রতিবেশি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে পরের বছর গ্রীষ্মকালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গকেও নিশানা করা হয়েছে। এরাজ্যের বাংলাভাষী মুসলিম ও হিন্দু, এই উভয় ধর্মাবলম্বী অভিবাসী শ্রমিকদের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে ‘বাংলাদেশী’ হিসাবে দাগিয়ে নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তো ঘোষণাই করে দিলেন, আসামের মুসলিমরা তাঁদের মাতৃভাষা হিসেবে যদি বাংলা রেকর্ড করেন, তাহলে এটি আসাম সরকারকে বাংলাদেশীদের চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।
২০১৯ সালে, এই ইসি সংসদকে জানিয়েছিল, ভোটার তালিকায় বিদেশি নাগরিক থাকার কোনও ঘটনা নেই বললেই চলে। ২০১৬, ২০১৭, এবং ২০১৮ সালে বিদেশির কোনও হদিশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালে গুজরাট, তেলেঙ্গানা ও পশ্চিমবাংলা থেকে মাত্র তিনটি বিদেশির ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছিল। বিজেপির আসন সংখ্যা ২০১৯ সালের ৩০৩ থেকে নেমে ২০২৪ সালে ২৪০ এ নেমে আসার পর হঠাৎ করেই ভোটার তালিকায় ব্যাপক সংখ্যক বিদেশির অনুপ্রবেশের গল্প শোনানো হচ্ছে।
এই প্রথমবার, স্বাধীন ভারতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী কারচুপির মারাত্মক অভিযোগ উঠেছে যা আজও খন্ডন করতে পারেনি ইসি। এর নির্লজ্জ প্রকাশ ঘটে ২০২৪ এর নভেম্বরে, মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে।
গত পাঁচ বছরে শম্বুক গতিতে মহারাষ্ট্রে যে নতুন ভোটারদের ৩১ লক্ষ সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছিল, ২০২৪ র নভেম্বরে তা বিরাট এক লাফে বেড়ে দাঁড়াল ৪১ লক্ষে! এখানেই তা থেমে থাকল না। বিধানসভা নির্বাচনের দিনে বিকাল ৫.০০ পর্যন্ত ভোট প্রদানের যে হার ছিল ৫৮.২২ শতাংশ, পরের দিন আনুষ্ঠানিকভাবে ইসি-র ভানুমতীর খেলায় ভোটদানের হার বৃদ্ধি পেল ৬৬.০৫ শতাংশে! এই হঠাৎ করে ৭.৮৩ শতাংশ-বিন্দু বৃদ্ধির অর্থ হল ৭৬ লক্ষ ভোটার ভোট দিয়েছেন — মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় যা অনেক অনেক বেশি। মহারাষ্ট্রে প্রায় এক লক্ষ বুথের মধ্যে ৮৫ বিধানসভা ক্ষেত্রের ১২,০০০ বুথেই এই নতুন ভোটারদের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে — যেগুলোতে শেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র ফল বেজায় খারাপ হয়েছিল। আর ইসি-র হাত সাফাইয়ের দৌলতে বিজেপি সেই সমস্ত ৮৫টি আসনেই জয়লাভ করে। যে ১৪৯টি আসনে বিজেপি লড়ে, তার মধ্যে ১৩২টিতেই ২০২৪ র বিধানসভা নির্বাচনে তারা জয়ী হয় — স্ট্রাইক রেট হল ৮৯ শতাংশ! যা সর্বকালের রেকর্ড। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের আগে দেখা গেল, ১০ শতাংশ নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে আর বাদ পড়েছে ৫.৭৭ শতাংশ ভোটার, যারা অধিকাংশই ছিলেন আপের সমর্থক।
এবার ইসি ঘৃণ্য খেলায় নেমেছে এতদিনকার সমস্ত নীতি পদ্ধতিকে আমূল বদলে দিয়ে। ইসি নাগরিকত্ব নির্ণয়ের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও বলেছে, তার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না।
ইসি-র ভাষ্য অনুযায়ী, বিহারে ২০০৩ এর ভোটার তালিকায় থাকা নির্বাচকরা নাগরিক — তাঁরাই একমাত্র যোগ্য ভোটার। অন্য সমস্ত ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। ভারতে তৈরি হবে ভোটাধিকারচ্যুত লক্ষ লক্ষ দ্বিতীয় বর্গের অধিকারহীন, নিরাপত্তাহীন নাগরিক, যারা পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকবেন রাষ্ট্রের বা প্রথম বর্গের ক্ষমতাবান নাগরিকদের করুণার উপর। এ হল সংবিধানের মৌলিক ভিত্তিভূমির উপর নামিয়ে আনা আঘাত — মোদির কর্পোরেট ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
সমস্ত ভারতবাসীকে যা প্রতিহত করতেই হবে বহু আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত সাধারণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.