বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

জ্বলন্ত মণিপুর – সারা দেশের কাছে অশনি সংকেত

জ্বলন্ত মণিপুর – সারা দেশের কাছে অশনি সংকেত

নিলয় ঘোষাল

photo

মণিপুরের হিংসা ও বর্বরতায় সারা দেশের সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ উদ্বিগ্ন আতঙ্কিত।

বিজেপি শাসন ক্ষমতায় আসার বহু আগে থেকেই বিভাজনের খেলা শুরু করেছিল — ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন, জাতিতে জাতিতে বিভাজন, মানুষে মানুষে বিভাজনের ভিত্তিস্থাপনের লক্ষ্যে প্রচার ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চলছিল বহু আগে থেকেই। বিভাজিত মানুষকে শাসন ও শোষণ করা সহজ। শাসক শ্রেণীর অতি প্রাচীন পন্থা, ‘ডিভাইড এন্ড রুল’।

একদিকে মুসলমান বিরোধী মানসিকতা তৈরি করা। যে হিন্দু-মুসলমান শতাব্দীর পর শতাব্দী একসঙ্গে থেকেছে মিলেমিশে, তাদের পরস্পরের মনে অবিশ্বাস সৃষ্টি করা। এক বাড়িতে, এক পাড়াতে বা এক সমাজে থাকতে গেলে নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক ঝগড়াঝাটি, মনোমালিন্যকে বড় করে সত্যমিথ্যা মিশ্রিত প্রচারে বিদ্বেষ বিষ ছড়িয়ে দেওয়া এদের কাজ। একইভাবে, বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবৈরিমূলক দ্বন্দ্বকে জাতিবিদ্বেষে পরিণত করে দাঙ্গায় পর্যবসিত করা এদের কাজ।

কিন্তু ব্যপারটা শুধু ‘বিভাজন ও শাসন’ নয়। এর পেছনে একদিকে যেমন আছে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা ও আধিপত্য বিস্তার, অন্যদিকে এর থেকেও আরও গভীর চক্রান্ত।

মণিপুরের পাহাড় জঙ্গলের মাটির নীচে আছে মূল্যবান খনিজ। দরকার মণিপুরের পার্বত্য এলাকা থেকে কুকি সহ জনজাতিদের উচ্ছেদ। প্রথমে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনকে উস্কে দিয়ে জনজাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়ে দাও। আরএসএস তথা সংঘপরিবার, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আর তার সঙ্গে রাজ্যে বিজেপি সরকার, একসঙ্গে মদত দিয়ে গহত্যার, নারীধর্ষণের তাণ্ডব সৃষ্টি করলো। হিন্দু বলে যারা আজ মদতপুষ্ট, কাল তাদের উপরও আক্রমণ আসবে।

এর মধ্যে ‘বন সংরক্ষণ সংশোধনী বিল’-এর নামে বনাঞ্চল থেকে আদিবাসী ও ভূমিপুত্রদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও পাকা। আদানি-আম্বানি সহ কর্পোরেটের হাতে এই মজুত খনিজভাণ্ডার তুলে দেবার পরিকল্পনা।

লোকসভায় নতুন বন সংরক্ষণ সংশোধনী বিল (Forest Conservation bill) পাশ করিয়ে নিয়েছে মোদি সরকার। কার্যত আদিবাসীদের কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বহু লড়াই-আন্দোলনের ফসল হিসেবে অরণ্যের অধিকার আইন বামপন্থীদের সমর্থনে প্রথম ইউপিএ সরকারের সময়ে পাশ হয়েছিল। বিতর্কিত এই বিলটি পাশ করার মাধ্যমে অরণ্যের অধিকার আদিবাসীদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল। অরণ্যের উপর বিজেপির কর্পোরেট বন্ধুদের দখলদারি কায়েম করা চেষ্টা তীব্র হবে।

কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মণিপুরে বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকার যা করেছে সেটাই এবার গোটা দেশের জন্য হতে চলেছে।

মণিপুরের বন-পাহাড় থেকে কুকি খেদাও, খনিজ সম্পদ দখল কর। সেই ষড়যন্ত্রেই তিন মাস ধরে মণিপুরে জাতি হিংসার আগুন জ্বলছে। কুকি সহ আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীকে সমূলে উচ্ছেদ করার মণিপুর জুড়ে লাগামছাড়া হিংসা। চলছে কুকি গণহত্যার বেপরোয়া তান্ডব। আর এবার গোটা দেশের আদিবাসীদের অবস্থা হতে পারে মণিপুরের কুকি জনগোষ্ঠীর মতো।

পশিমবাংলায় আদিবাসী ও কুড়মি দ্বন্দ্ব গভীর উদ্বেগের। ঝাড়খণ্ড সহ আশপাশের রাজ্যে যে পাহাড় ও বনাঞ্চল, সেখানেও মাটির নীচে আছে মূল্যবান খনিজ। তাই আদিবাসী ও কুড়মি দ্বন্দ্বকে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়ার কাজ চলছে।

বিজেপি এবং আরএসএস আদিবাসীদের বরাবর হেয় করে। আদিবাসীরা ভারতের আদি জনগোষ্ঠী এটাই আরএসএস-বিজেপি মানতে চায় না। সঙ্ঘ পরিবারের কাছে আদিবাসীরা বনে থাকা ‘‘বুনো’’ মানুষ। মনুবাদী সংস্কৃতির ধারক-বাহক আরএসএস বরাবর আদিবাসীদের শুদ্রদের মতো এবং তথাকথিত ‘‘নিচু’’ হিসাবেই দেখে। আদিবাসীরা সবাই হিন্দু, এই ধারণাটাই ভ্রান্ত। মণিপুরের মতোই গোটা দেশেই আজ অরণ্য ও পার্বত্য এলাকার আদিবাসীরা আরএসএস, বিজেপি এবং কর্পোরেট পুঁজির আক্রমণের টার্গেট। যদিও আদিবাসীদের মধ্যে আরএসএস-এর শাখা সংগঠনগুলির অনুপ্রবেশ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।

মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য এক আদিবাসী নারীকে ‘রাষ্ট্রপতি’র আসনে বসিয়েছে, ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী যার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত।

২০০৬ সালের আইন সংশোধন করে জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক প্রকল্প ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রকল্পের ক্ষেত্রে বনভূমিকে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে দিল কেন্দ্র। এর ফলে বড় বড় শিল্পপতিরা চিড়িয়াখানা সাফারি পার্ক এবং ইকোট্যুরিজম বা জাতীয় স্বার্থের কোনও প্রকল্পে অনায়াসে বনভূমিকে ব্যবহার করতে পারবে। অরণ্যে বসবাসকারী আদিবাসীদের তাঁদের বাসভূমি থেকে চিরতরে উৎখাতও করতে পারবে।

এতদিন গায়ের জোর খাটিয়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদ চলেছে সেটাই এখন আইনের ছত্রছায়ায় হবে। গরিব আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা মূলত তথা অরণ্যের সম্পদের উপর নির্ভর করে। এখন ঐ সম্পদ বেহাত হয়ে গেলে তাদের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।

বিজেপি তথা আরএসএস-এর মনুবাদী সংস্কৃতি নারীকে পুরুষের অধীনস্ত এক ভোগ্য হিসাবে দেখে। তারা মধ্যযুগীয় বর্বরতার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনছে। নারী বলাৎকার, জনসমক্ষে নগ্ন করে করে পৈশাচিক উল্লাস, জ্বালিয়ে দেওয়া, এদের পৌরুষের প্রকাশ।

বহু বিবেকবান, মানবতাবাদী মানুষ মণিপুর বা মালদহের নারী নির্যাতন মেনে নিতে পারছেন না। প্রতিবাদ করছেন, এরা শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু তারা ঘটনার নৃশংসতাটুকু দেখছেন মাত্র। আসলে, বিজেপি তথা আরএসএস শুধু এক ফ্যাসিবাদী মাত্র নয়, দর্শন-সংস্কৃতিগত দিক থেকে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদতা ও বর্বরতার প্রতিনিধিত্ব করে।
এখনই যদি একে প্রতিরোধ না করা হয়, আমরা তো ভুগবোই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দেবো এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.