বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
প্রকৃতির উপর কর্পোরেট মস্তানির ফল কি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সিকিম, বার বার বিপর্যস্ত হচ্ছে উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ-সহ হিমালয়ের পাহাড়ি রাজ্যগুলি। বণিকের লালসার চশমা পরে দেশের “উন্নয়ন” দেখছে কেন্দ্রের মোদি-শাহ সরকার। পরিকাঠামো উন্নয়নের নামে এক অভূতপূর্ব ধ্বংসলীলা চালানো হচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। অতি সংবেদনশীল হিমালয়, প্রাচীন অরণ্য, নদনদী— প্রাণপ্রকৃতির কোনও অংশই আর এই কেন্দ্রীয় সরকার ও তার স্যাঙাৎ পুঁজিপতিদের করাল থাবা থেকে মুক্ত নয়। এই উন্নয়ন কী ভয়াবহ প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করতে পারে এবং প্রকৃতিই-বা কীভাবে চরম প্রতিশোধ নিতে পারে তার চূড়ান্ত উদাহরণ সিকিম, উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল।
হিমাচল প্রদেশে ২০২১ সালের বর্ষাকালে ৮৭টি পাহাড়ি ধসে, ১৬টি হরপা বান, ৭টি মেঘভাঙা অতিবৃষ্টির (ক্লাউড বার্স্ট) ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে ৯৪টি বড় ধস, ৭৫টি হরপা বান এবং ১৪টি অতিবৃষ্টির ঘটনায় ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালের ২৪ জুন থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর বড়সড় ধসের ঘটনা ঘটেছে ১৬৫টি এবং ৭২টি হরপা বানের ঘটনায় ১৪৫ জনের মৃত্যু হয়। এই বিপর্যয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি, গবাদি পশু, রাস্তাঘাট, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভেসে গিয়েছে। হিমালয় জুড়ে বর্ষা আজ মহাবিপজ্জনক, সর্বনাশা ঋতু।
২০১৩ সালে জুন মাসে, উত্তরাখণ্ডে মেঘভাঙা বৃষ্টি, হরপা বান ও ধসে সরকারি হিসাব মতে ৬,০৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৪,৫৫০টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু গ্রাম ভেসে গিয়েছে। বাস্তব্যবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা হিসাব কষে দেখিয়েছিলেন এই ভয়াবহ বিপর্যয়ে, যা মানুষের কৃতকার্যের ফলও বটে, রাস্তা ও সেতুর যে ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য প্রায় ২৮৫ মিলিয়ন ডলার, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঁধের ক্ষতির পরিমাণ ৩০ মিলিয়ন ডলার, রাজ্যের পর্যটন ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে ১৯৫ মিলিয়ন ডলার। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালেও উত্তরাখণ্ডে ক্লাউড বার্স্ট ও বন্যায় বিপুল ক্ষতি হয়েছে। প্রতি বর্ষাতেই এখন উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশ এক বিপজ্জনক রাজ্য।
এরপরও দেখা যাবে চার ধাম মহাসড়ক প্রকল্পের প্রকোপে ধারাসুর কাছে পাহাড়ের গা-বেয়ে ভাগীরথী নদীর বুক পর্যন্ত পাহাড় কাটা ও সুড়ঙ্গ খোঁড়া মাটি-পাথরের ধ্বংসাবশেষের স্তূপ। পরিবেশবিদদের হিসাব অনুযায়ী, ২০ মিলিয়ন টন মাটি-পাথর খুঁড়ে তোলা হয়েছে, এর সঙ্গে যোগ করতে হবে নির্মাণ ও পাহাড় কাটা ধ্বংসাবশেষ। তাঁদের দাবি, এই মাটি-পাথর-কাঠ-লোহার মিশ্রিত বর্জ্যের অধিকাংশই মজুত করা হয়েছে গঙ্গা ও যমুনা এবং তাদের শাখানদীগুলির তীর ধরে, যা নেমে আসছে নদীতে। এর ফলে বহুস্থানে নদী তার গতিপথ বদলে ফেলছে। রুদ্রপ্রয়াগের কাছে এই মহাসড়কের দৌলতে পাহাড় সম্পূর্ণ ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে। শুধু কি তাই? পরিবেশবিদরা বলছেন এই মহাসড়ক প্রকল্পের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিমালয়ের বিশেষ উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল। এই প্রকল্পের জন্য ৬০০ হেক্ট্রর বনভূমি সাফ করার অনুমতি মিলেছে। যার বড় অংশটিই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ঘটনা হল মহাসড়কের বহু অংশই গিয়েছে পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। যেমন, রাজাজি জাতীয় উদ্যান, ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স জাতীয় উদ্যান, কেদারনাথ অভয়ারণ্য, ভাগীরথী সংবেদনশীল পরিবেশ এলাকা (ইকো-সেনসেটিভ জোন) এবং এরকম আরও এলাকা। এবং এই অঞ্চলের ৫৬ হাজার গাছকে হত্যা করার পর এখন বিচ্ছিন্ন খণ্ড খণ্ড বন এবং ব্যাপকহারে কমে আসা সবুজ আচ্ছাদন উত্তরাখণ্ডের সামগ্রিক বনভূমিরই ক্ষতি করেছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কয়েক বছর ধরে এই সীমাহীন বনভূমি কাটার ফলে ব্যাপক হারে ধসপ্রবণ এলাকা তৈরি হয়েছে। পরিবেশবিদ বিমলেন্দু ঝা বলছেন, মনে রাখতে হবে, এই প্রকল্পের জন্য যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে তা প্রকৃত অনুমোদিত সংখ্যার দ্বিগুণ। কেননা নির্মাণকালে এবং পাহাড়ের ঢাল কাটার সময় ধসের সময় উপড়ে যাওয়া গাছকেও এই হিসাবে ধরতে হবে। তিনি আরও বলছেন, প্রায় ৯০০ কিলোমিটার ব্যপ্ত রাস্তায় বনসৃজনের কোনও চারাই আর দেবদারু, চির পাইন, খয়ের, বেল এবং অন্যান্য গাছের রাজকীয় বনকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
কোন আইনের বলে এমনটা হল? দেশে কি আইন-আদালত নেই? আইনকে কীভাবে বুড়ো আঙুল দেখানো যায়, দেশের শীর্ষ আদালতকেও কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, বাবরি মসজিদ, ৩৭০ ধারার পর এও আর এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এত বড় প্রকল্প অথচ তার কোনও এনভায়রনমেন্ট ই্মপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) হয়নি। বা বলা যায় বেহুলার বাসর ঘরের ছিদ্রের মতোই, আইনের লোহার ঘরের ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়েছিল এই কালনাগিনী মহাসড়ক-সর্প। রাজ্যসভাতে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সাংসদ এডি সিংহ— চার ধাম প্রকল্পে কেন ইআইএ করা হল না? উত্তরে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়কের মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি বলেছিলেন, “প্রতেকটি প্রকল্প স্বাধীন। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এর নির্দিষ্ট শুরু ও শেষ রয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের কোনও প্রয়োজন নেই।”
আর এখানেই হল আইনের ছিদ্রটি। ১০০ কিলোমিটারের বেশি এ জাতীয় প্রকল্পের জন্য ইআইএ বাধ্যতামূলক। পরিবেশের উপর এমন প্রকল্প কীরকম প্রভাব ফেলবে, তার হিসাব-নিকাশ এবং প্রয়োজনে পরিকল্পনা বদল বা সংশোধন, কোনও অংশ বাতিল, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থার নির্দেশ ও পরামর্শ দেওয়ার জন্যই পরিবেশ মূল্যায়ন করা। এই ১০০ কিলোমিটারের আওতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই ৮৮৯ কিলোমিটার প্রকল্পকে ১০০ কিলোমিটারের কম ৫৩টি আলাদা আলাদা প্রকল্পে ভাগ করে দেওয়া হল। মন্ত্রীর কথায় যার নির্দিষ্ট শুরু ও শেষ রয়েছে।
এমন তথাকথিত উন্নয়ন লাদাখের প্রাণপ্রকৃতি, লাদাখের বাস্তুতন্ত্র, লাদাখের হিমবাহ— যা প্রাণের প্রকৃত প্রধান উৎস এবং লাদাখের বহুবর্ণ ৯০ শতাংশ জনজাতির সংস্কৃতির কী চরম ক্ষতি করতে পারে, তা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন লাদাখবাসীরা। আজ যে সাবজিরো তাপমাত্রায় লাদাখের লিজেন্ডারি পরিবেশবিদ সোনাম ওয়াংচুক ২১ দিনের অনশন সত্যাগ্রহে বসলেন, সেতো এমনি এমনি নয়। তা হল কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক পরিবেশ আইন আর সেই আইনের বলে কেন্দ্রশাসিত লাদাখকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার মতো বিপদ থেকে রক্ষা করতে। যদিও ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় নীতির ফলেই খনিজের খোঁজ শুরু হয়েছে চাংথুঙ উপত্যকায় ২০,০০০ একর জুড়ে মেগা-সোলার প্রকল্পের প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। যা বিরল প্রাণী ও চারণভূমি। পর্যটনশিল্পের উন্নতির জন্য এমন এক বিমানবন্দর তৈরির কথা ভাবা হয়েছে যা ২০ লক্ষ, অর্থাৎ লাদাখের জনসংখ্যার ৬ গুণ পর্যটকের আসা-যাওয়া সামলাতে পারে। সোনম ওয়াংচুকদের বক্তব্য এই সব ‘উন্নয়ন’, এই উন্নয়নের হাত ধরে পর্যটক ও কর্পোরেট, হোটেল, পরিবহণ ও অন্যান্য বহিরাগত ব্যবসায়ীদের আরও আরও চাহিদা তৈরি ও তা পূরণের জন্য, আরও ‘উন্নয়ন’— লাদাখের অপূরণীয় ক্ষতি করবে, যা আর পূরণ করা যাবে না। ওয়াংচুকরা যোশীমঠ ও হিমালয়ের অন্যান্য অঞ্চলের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে কী ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তারও উদাহরণ টেনে এনেছেন।
তাই লাদাখবাসীরা ষষ্ঠ তফসিল চান, চান স্বশাসন, নিজস্ব আইনসভা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। ২০১৯ সালে যখন ৩৭০ ধারা বিলোপ করে জন্মু-কাশ্মীরের মানুষের স্বশাসন, আইনসভা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হল, তখন কেন্দ্র বলেছিল, জনজাতি প্রধান লাদাখকে একটি সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত একটি রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে। কোথায় কী! আজ তাপমাত্রা যখন হিমাঙ্কের নীচে ওয়াংচু ও তাঁর সঙ্গীরা সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনশনে বসেছেন।
বনভূমি ও প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াই চলছে সারা দেশ জুড়েই। আর এই লড়াইটা চালাচ্ছেন আদিবাসী ও বনবাসীরা। কেননা উন্নয়নের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা আসলে বন ও বনবাসী উচ্ছেদের পরিকল্পনা। এমনটাই হয়ে এসেছে বিগত ৭৬ বছর ধরে। তবুও, আদিবাসী ও জনজাতিদের লড়াই অনেকটাই মর্যাদা আদায় করে নিতে পেরেছিল “বনবাসী তফসিলি জনজাতি এবং অন্যান্য পারম্পরিক বনবাসীদের বনাধিকার স্বীকার আইন, ২০০৬” বা সংক্ষেপে “বনাধিকার আইন”র মাধ্যমে। বনাধিকার আইনে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, “জঙ্গল হল গ্রামসভার সাধারণ সম্পত্তি।“ গ্রামসভা মানে বনগ্রামের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের নিয়ে তৈরি হওয়া সাধারণ সভা। স্বীকার করা হল, জঙ্গলকে গ্রামবাসীরা কীভাবে ব্যবহার করবেন তা স্থির করবে এই গ্রামসভা, গ্রামের মানুষরা। অর্থাৎ, স্থির করবে না লোকসভা বা বিধানসভা। তাই তো বনগ্রামবাসীদের প্রিয় স্লোগান “লোকসভা না, বিধানসভা না, সবচেয়ে বড় গ্রামসভা।“ বনাধিকার আইন আরও স্বীকার করল, গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া সরকার কিংবা প্রশাসন কেউই জঙ্গল ধ্বংস করে কোনও প্রকল্প, নির্মাণ বা খনন করতে পারবে না। এও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান, সংরক্ষিত অরণ্যের পাশাপাশি অচিহ্নিত, অনির্দেশিত সমস্ত বনভূমিই গ্রামসভার সম্পত্তি।
আর আজ এখানেই আঘাত হেনেছে “বনসংরক্ষণ সংশোধনী আইন, ২০২৩।” বিগত ১০ বছরে বন, পরিবেশ, বন্যজন্তু সংরক্ষণের যত আইন ছিল, যত রক্ষাকবচ ছিল, কোর্ট, কমিটি, ট্রাইব্যুনাল ছিল তার সবই নখদাঁতহীন রবার স্ট্যাম্পে পরিণত করে ছেড়েছে মোদি-শাহ সরকার। শুধুমাত্র ২০১৫-২০২০ সালের মধ্যে বনভূমির সংজ্ঞা বদলে, আইনের মারপ্যাঁচে, গ্রামসভাকে স্বীকৃতি না দিয়ে কিংবা তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, গাজোয়ারি করে জমি দখল করে খনি, হাইওয়ে, রেলপথ, সেতু, জলবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য “উন্নয়নমূলক” কাজের দেশের ৬,৭০০ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এই “উন্নয়ন ও অধিগ্রহণ”র মাধ্যমে ২০২১ সালে উচ্ছেদ হয়েছেন ১,১৭,০০০ আদিবাসী ও বনবাসী।
গ্রামসভার সঙ্ঘবদ্ধ দীর্ঘ লড়াই এবং বনাধিকার আইনকে স্বীকৃতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের গ্রামসভার সিদ্ধান্তকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিল বলেই তো কোন্ধ ডোঙরিয়ারা নিয়মগিরির লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিল। নাহলে বেদান্তের মতো দানবীয় কর্পোরেট, ওড়িশা সরকার আর তার সশস্ত্র বাহিনী তো কম জুলুম করেনি। পঞ্চম তফসিলির অন্তর্ভুক্ত আদিবাসী অঞ্চল ও বনাধিকার আইন এখনও হাসদেওর প্রাচীন জঙ্গল, জমিকে দখল করতে পারেনি আদানি গোষ্ঠী। এই আইনের জোরে গ্রামসভা গড়ে পুরুলিয়ার ঠুড়্গা পাম্প স্টোরেজ প্রকল্পের কাজ আটকে রেখেছেন অযোধ্যার আদিবাসী মানুষ। না হলে কবেই প্রথম প্রকল্পের মতোই আরও কত বনভূমি জলের তলায় তলিয়ে যেত। ওড়িশার নিয়মগিরি, ঢেনকানল, ছত্তীশগঢ়ের হাসদেও, মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি, ঝাড়খণ্ডের গোন্ডলপুরা, পশ্চিমবঙ্গের চিলাপাতা, বক্সা, ঠুড়্গা, দেউচা-পাচামি, কালিম্পং— এমন কত স্থানে এই জল-জঙ্গল-জমি বাঁচানোর লড়াই লড়ছেন এ রাজ্যের আদিবাসী ও জনজাতির মানুষ।
আর সেই লড়াইকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন দিয়ে দমাতে না-পেরে, বনাধিকার আইনের মতো এক ঐতিহাসিক আইনকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করতে “বন সংরক্ষণ (সংশোধনী) আইন, ২০২৩” নিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য বনাধিকার আইন, পেসা, গ্রামসভার ক্ষমতা খর্ব করা। তাকে কাগুজে বাঘে পরিণত করা। কেননা, যেখানে কোনও প্রকল্পের প্রাথমিক ছাড়পত্রের আগেই গ্রামসভার অনুমতি নেওয়া আবশ্যিক; সেখানে নয়া আইনে বলা হয়েছে, গ্রামসভাকে জানানোর আগেই কেন্দ্রীয় সরকার চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিয়ে দেবে। এর পর রাজ্য সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে গ্রামসভার ওই চূড়ান্ত ছাড়পত্র অনুযায়ী গ্রামসভার সম্মতি আদায় করার। সেখানে গ্রামসভা অসম্মতি জানালেও যেহেতু প্রকল্পটি চূড়ান্ত ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে, সেহেতু কাজ শুরু করার কোনও আইনি বিধিনিষেধ রইল না। নয়া আইন বলছে, আন্তর্জাতিক সীমানার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা বনভূমিকে অ-বনভূমিতে পরিণত করতে বনাধিকার আইন কিংবা পেসা আইন অনুযায়ী গ্রামসভার অনুমতি লাগবে না। উত্তর-পূর্ব ভারত, লাদাখ, জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের নয় নয় করে আটটি জেলা এই আইনের মধ্যে আসবে।
দেশের জঙ্গলমহলের আদিবাসী-জনজাতি মানুষের কাছে এ এক জীবনমরণ লড়াই। বন সংরক্ষণ (সংশোধনী) আইন বাতিলের দাবিতে এবং বনাধিকার আইন ২০০৬-এর যথাযথ বাস্তবায়নের দাবিতে ক্রমে জোটবদ্ধ হচ্ছেন তাঁরা। এমনই এক জোটবদ্ধ লড়াইয়ের মরণপণ ডাক শোনা গেল ৬ মার্চ ২০২৪-এ কলকাতার মহাজাতি সদনে। স্লোগান উঠল, “গ্রামসভার শত্রু যারা লোকসভা থেকে তাদের তাড়াও।“ তাঁদের বার্তায় স্পষ্ট, “যে কেন্দ্রীয় সরকার গ্রামসভাকে স্বীকৃতি দেবে না, সেই সরকার তাঁরা চান না।“ উত্তরবঙ্গ, রাজ্যের জঙ্গলমহল ও সুন্দরবন এলাকা থেকে অন্তত ১২০০ আদিবাসী ও জনজাতি মানুষ সেদিন এই সভায় হাজির ছিলেন। মহিলাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। দীর্ঘ সভায় তাঁদেরও দেখা গিয়েছে সভা পরিচালনার কাজে। হাসদেও, গড়চিরৌলির মতো আন্দোলনভূমি থেকে আসা প্রতিনিধিরা এসেছেন সংহতি জানাতে। দেশব্যাপী জোটবদ্ধ আন্দোলনের ডাকও দিয়ে গিয়েছেন তাঁরা।
তাঁরা স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন, “উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি এই নিসর্গ, বন, বন্যপ্রাণী সকলে মিলে একসঙ্গে আরও ভাল থাকাকে। আমাদের গ্রামসভাগুলোয় তারই চাষ হয়ে থাকে। তাঁরা আরও জানিয়ে গিয়েছেন, উন্নয়নের নামে পাহাড়-জঙ্গল ধ্বংস করে, বন্যপ্রাণীদের বাস্তুচ্যুত করে জলবিদ্যুৎ তাঁরা চান না। হাইওয়ে চান না। খনি চান না। এত এত মুনাফা এবং আরও আরও উন্নত ঝাঁ চকচকে জীবনের চাইতে নির্মল, মুক্ত প্রকৃতিতে বাঁচা অনেক সুন্দর বলেই তাঁরা মনে করেন।