বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

জাতিভিত্তিক জনগণনা: পশ্চাৎপদ জাতির ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ন্যায়

জাতিভিত্তিক জনগণনা: পশ্চাৎপদ জাতির ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ন্যায়

রতন গায়েন

photo

রাহুল গান্ধীর ২০২৪ এর নির্বাচনের আগের দু’বছর “ভারত জোড়ো” অভিযানে সারা ভারতের মানুষের কাছে দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ পশ্চাৎপদ জাতের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়নের জন্য জাতিভিত্তিক জনগণনার জোরালো দাবি লাগাতারভাবে পেশ করেছেন। সারাদেশে বিপুল সাড়াও পেয়েছেন। এই প্রচারের মধ্যেই বিহার সরকার জাতি ভিত্তিক সমীক্ষা করে এবং ২০২৩ সালে তা প্রকাশ করে। তেলেঙ্গানা সরকারও অনুরূপ সমীক্ষা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কর্ণাটক সরকার সমীক্ষা শেষ করলেও তা আবার পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মোট কথা হল, জাতি ভিত্তিক গণনার দাবি দেশজুড়ে একটি গণদাবি হয়ে উঠছে। দেশের শাসক ও তাদের রাজনৈতিক দল এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক আরএসএস লাগাতার জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রবল বিরোধিতা জানিয়েছিলেন। ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি ও ২০২৪ এর জুলাই মাসে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্টে জানান যে, পরবর্তী জনগণনায় জাতি ভিত্তিক গণনার কোনও পরিকল্পনা সরকারের নেই। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি ২০২১ সালে সরকার সুপ্রিম কোর্টে জানান যে “জাতি ভিত্তিক জনগণনা ১৯৫১ সাল থেকেই সরকার নীতিগত ভাবে পরিত্যাগ করেছে।” স্মরণ করা যায় যে ১৯৮৯ সালে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার পরবর্তী সময়ে বর্তমান শাসকদল সংরক্ষণ বিরোধী ‘কমণ্ডলু’ রাজনৈতিক কর্মসূচি ও রামজন্মভূমি আন্দোলন সংগঠিত করে জাতি ভিত্তিক সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিলেন।
সেই সরকার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ সিদ্ধান্ত নেয় যে, আগামী জাতীয় জনগণনায় জাতি ভিত্তিক গণনা করা হবে। ৪ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এক বিবৃতিতে জানায় যে, ১৬ জুন এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। সেই মতো যে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে, তাতে জাতি ভিত্তিক জনগণনার সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় পূর্ব ঘোষণা মতো জনগণনার বিষয়ে প্রশ্ন ওঠায়, সমাজ মাধ্যমে সরকারি তরফে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, জনগণনায় জাতি ভিত্তিক তথ্য থাকবে। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে এর উল্লেখ না থাকার রহস্য অজ্ঞাত থেকে গেল। জাতি ভিত্তিক জনগণনার তীব্র বিরোধী শাসকদল কোন অঙ্কে এমন একটা ‘ঐতিহাসিক’ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন সেই বিষয়টি যেমন আলোচিত হবে; সেই সঙ্গে এই গণনার ফলে পশ্চাৎপদ জাতির সামাজিক ন্যায় ও আর্থিক সক্ষমতা কিভাবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে সেই বিষয়টিও তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আমাদের রাজ্যের ওবিসি তালিকা নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে সেই বিষয়ে কিছু আলোচনা হওয়া দরকার।
সেই আলোচনার আগে জাতিগণনা নিয়ে জনমানসে কিছু ধারণা বিদ্যমান সে বিষয়ে দু’ একটি কথা বলা জরুরি।
১৯৩১ এর আদম সুমারির পরে কোনও পূর্ণাঙ্গ জাতি ভিত্তিক জনগণনা হয়নি সত্য। কিন্তু তপশিলি জাতি ও তপশিলি জনজাতি মানুষের গণনা প্রতিটি জনগণনায় সংগঠিত হয়েছে। বস্তুত ১৯৩২ এর ১৬ আগস্ট পশ্চাৎপদ জাতির পৃথক নির্বাচন ক্ষেত্রের সাম্প্রদায়িক রায়ের বিরুদ্ধে গান্ধীজির আমরণ অনশন এবং কিছু নির্বাচন ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ জাতির জন্য আসন সংরক্ষণের প্রেক্ষিতে বাবা সাহেব আম্বেদকারের সঙ্গে গান্ধীজির ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পুনা চুক্তির পরেই গান্ধীজি অনশন প্রত্যাহার করেন। ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনে এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। সেই সময়কাল থেকে তপশিলি জাতির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা বহাল আছে। স্বাধীন ভারতের সংবিধান সামাজিক ও আর্থিক ন্যায়ের লক্ষ্যে তপশিলি জনজাতিদের জন্যও শিক্ষা, চাকুরি ও আইনসভাতে সংরক্ষণের বিধান আছে।
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের দীর্ঘ লড়াইয়ে নেতৃত্বে ছিলেন কেরলের শ্রী নারায়ণ গুরু, তামিলনাড়ুর পেরিয়ার, মহারাষ্ট্রের জোতিবা ফুলে, ড. আম্বেদকার এবং আরও অনেক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাঁদের এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকারে সৃষ্ট ভারতের সংবিধান পশ্চাৎপদ জাতিগুলির অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনি বিধান দিয়েছে, সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মানুষের লড়াই অব্যাহত থেকেছে। সংবিধানে ন্যাশনাল কমিশন ফর সিডিউলড কাস্টস/ সিডিউলড ট্রাইবস এর সঙ্গে ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস কমিশন গঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাকওয়ার্ড কমিশন যা মণ্ডল কমিশন নামে পরিচিত সেই কমিশন, দেশের জনসংখ্যার ৫২ শতাংশকে ওবিসি হিসাবে চিহ্নিত করেন। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ১৫(৪) ও ১৬(৪) ধারার ব্যাখ্যায় ৫৫ শতাংশ সংরক্ষণের সীমা বেঁধে দেওয়ায় কমিশন ওবিসিদের জন্য ২৭ শতাংশ সরকারি চাকুরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের সুপারিশ করেন। এই সুপারিশ ১৯৮০ সালে জমা পড়লেও তৎকালীন সরকারের অনীহার কারণে পরবর্তী সরকার ১৯৮৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর কার্যকর হয়।
এইসব তথ্য থেকে স্পষ্ট, ১৯৩১ এর পর পূর্ণাঙ্গ জাতি ভিত্তিক জনগণনা না হলেও পশ্চাৎপদ জাতের সামাজিক ও আর্থিক ন্যায়ের পক্ষে কর্মসূচি অব্যাহত থেকেছে। কিন্তু সেই গণনা হলে পিছিয়ে থাকা জাতি ও জনগোষ্ঠীর সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ অনেক এগিয়ে যেত। জাতি ভিত্তিক জনগণনা শুধু দেশের জনসংখ্যার হিসাব নয়, এই গণনায় উঠে আসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পেশা, জাতিগত বিন্যাস ও তাদের আর্থিক স্থিতি, আঞ্চলিক বিভিন্নতা, বিকাশের অসমতা প্রভৃতি নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এইসব তথ্যের অভাবে সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও রূপায়ন সম্ভব হয় না। জাতি ভিত্তিক জনগণনা হলে যাঁরা সামাজিক বিভেদ সম্প্রীতি নষ্টের জিগির তোলেন তাঁরা আসলে বিভেদ ও বৈষম্যের প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন ও তার নির্মূল করার উদ্দেশ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বিরোধী। তাঁরা তাঁদের শ্রেণী স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়।
দেশের শাসকদের দিকনির্দেশক আরএসএস জাতি ভিত্তিক গণনার আগাগোড়া বিরোধী হয়েও কেন এই গণনাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়েছে তা বোঝার জন্য দুটি তথ্যের দিকে তাকালে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
এক, লোকনীতি-সিএসডিএস এর তথ্য শাসক দল সামাজিক কৃতকৌশলের (social engineering) নৈপুণ্যে ওবিসি, দলিত, আদিবাসী ও পসমন্দা মুসলিমদের মধ্যে প্রাধান্যের জায়গায় অবস্থান করছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে দলের সমথর্ন ভিত্তি এদের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলনেতার জাতি ভিত্তিক জনগণনার পক্ষে জোরালো সওয়াল এবং বিহারের জাতি সমীক্ষায় ৬৩.১৩ পিছিয়ে থাকা জাতির তথ্য উঠে আসায় শাসক দল ও তাদের দিকদিশারিকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। তদুপরি ২০২৪ এর নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে খারাপ ফল এবং সামনে বিহারের নির্বাচনে ও ২০২৯ এর লোকসভা ভোটে জাতিগত ভোটের প্রাধান্য যাতে কোনওভাবে হেরফের না ঘটে সেই লক্ষ্যেই শাসক দলের এই সিদ্ধান্ত। বিরোধী দলনেতার অস্ত্রকে ভোঁতা করার লক্ষ্যও পূরণ হওয়ার আশা করে শাসক দল।
দুই, দেশে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে অপরিহার্য হল সংখ্যা গরিষ্ঠ পশ্চাৎপদ জাতের সমর্থন। জাতি ভিত্তিক জনগণনায় সায় তাদের দিকে এক বড় বার্তা।
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের ওবিসি তালিকার উপর কলকাতা হাইকোর্টের ১৭ জুনের স্থগিতাদেশ রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণীর ছাত্র এবং কর্মপ্রার্থীদের উপর এক বড় ধাক্কা। লজ্জাহীন বিরোধী দল এই স্থগিতাদেশে উল্লসিত। দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজ্য সরকার হাইকোর্টে আগে ধাক্কা খেয়ে এবং সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম মেনে সমীক্ষা অনুযায়ী তালিকা সংশোধনের অঙ্গীকার করেও সঠিক তালিকা প্রস্তুতিতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন তালিকায় ১১৩টি চিহ্নিত অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মধ্যে ৭৭টি মুসলিম ও ৩৬টি অন্যান্য। কোর্টের পর্যবেক্ষণ হল সমীক্ষা কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী হয়নি। সরকার পুনরায় সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে। কোর্টকে দোষারোপ করে সরকার গা বাঁচাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকার যথাশীঘ্র এর আইন সম্মত প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভুক্তভোগীদের দুঃসহ অবস্থার অবসান হবে না।
ঘোষিত জাতি ভিত্তিক জনগণনার প্রক্রিয়া ১৬ জুন শুরু হয়েছে। জনগণনার বাড়ির তালিকার কাজ হবে ২০২৬ এর ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। ২০২৭ এর ফেব্রুয়ারি মাসে চূড়ান্ত পর্বের গণনা শুরু। শেষ হবে ২০২৭ এর ১ মার্চের মধ্যে। অবশ্য লাদাখ, জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে প্রাকৃতিক কারণে ২০২৬ এর ১ অক্টোবর জনগণনা শুরু হবে।
জাতি জনগণনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সমস্ত মানুষের বিশেষ করে পশ্চাৎপদ জাতিদের নিজ নিজ জাতি পরিচয় ও অর্থনৈতিক অবস্থার সঠিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করার সক্রিয় ভূমিকা পালন করা দরকার। চূড়ান্ত রিপোর্টে দেশের সমস্ত মানুষের প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হলে এক বড় সামাজিক আলোড়ন তৈরি হবে। পশ্চাৎপদ জাতিগুলির মধ্যে সংরক্ষণের অংশীদারিত্বের প্রশ্নে সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা হবে। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পক্ষের রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে এবিষয়ে আগাম সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সমস্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাতে সংরক্ষণ সম্প্রসারিত হয় সেই আন্দোলন জরুরি। মনে রাখা দরকার যে সংরক্ষণ সর্বরোগ নিরাময় করে দেবে না। সংরক্ষণ এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। কিন্তু বাবা সাহেব আম্বেদকারের “জাতি নির্মূলের” স্বপ্ন সফল করতে দেশের এই বৃহৎ অংশের মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.