বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ধান্দাপুঁজি ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

ধান্দাপুঁজি ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

নির্মলেন্দু নাথ

photo

১০ মে ২০২৫ সন্ধ্যা ৫ টায় ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। জন্মলগ্ন থেকে দুটি দেশের মধ্যে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন এই যুদ্ধ হল তারই বহিপ্রকাশ। এই নিয়ে এটা ষষ্ঠবার হল। তবে অন্যান্য বারের সঙ্গে এবারের যুদ্ধের একটা পার্থক্য আছে। এবারের যুদ্ধ হল আকাশযুদ্ধ। পদাতিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ নয়। উভয়পক্ষেই এই আকাশযুদ্ধে তাদের বিদেশ থেকে ক্রয় করা মহার্ঘ ক্ষেপণাস্ত্র ভিত্তিক যুদ্ধ করেছে। আকাশ যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়ের একটা বৈশিষ্ট্য। যুদ্ধ ও রাজনীতির তথা অর্থনীতির মধ্যেকার সম্পর্কটি তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনীতি হচ্ছে রক্তপাতহীন যুদ্ধ আর যুদ্ধ হচ্ছে রক্তপাতময় রাজনীতি। আর এটাও বলা হয় রাজনীতি হচ্ছে অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ। এর থেকে যুদ্ধের সঙ্গে অর্থনীতির একটা সম্পর্ক অনুধাবন করা যায়। বর্তমান নিবন্ধে এই পটভূমিতে ভারত ও পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনীতি অনুধাবন করার চেষ্টা করা হবে।

ভারত কথা

১৯৪৭ সালে ভারতের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। হস্তান্তরিত ক্ষমতা শ্রমিক কৃষকের অনুকূলে আসেনি। ক্ষমতা এদেশের বড় বুর্জোয়া ও বড় ভূস্বামীদের অনুকূলে হস্তান্তরিত হয়। নতুন ভারতের শিল্প ও কৃষি অর্থনীতির দিশা বুর্জোয়া-ভূস্বামীর জোটের স্বার্থেই ঠিক হয়। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার এই বুর্জোয়ারা আকারের দিক থেকে জাপানের জাইবাৎসুর মত বৃহৎ বুর্জোয়ার পর্যায় পড়ে। তবে প্রকারের দিক থেকেই এরা পরনির্ভর থেকেই যায়। এই পরনির্ভরতার দুটো দিক আছে। একদিকে এই বৃহৎ বুর্জোয়া আন্তর্জাতিক বড় পুঁজির সঙ্গে টিকে থাকতে চায়। ঠিক যেভাবে প্রাক স্বাধীনতা পর্বে এই পুঁজি ব্রিটিশ পুঁজির সঙ্গে আপোষ করে টিকে থাকতো, অনেকটা সেভাবেই। পরনির্ভরতার অপর দিকটি হল নিজ বিকাশের জন্য এই পুঁজি রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকল। নেহেরু-ইন্দিরা যুগের ভারত রাষ্ট্র ভারতীয় বৃহৎ বুর্জোয়ার এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ছিল। ১৯৫৬ সালের শিল্প আইন তৈরি করা হয় এদের সুবিধার দিকটা মাথায় রেখে। যে ভারী শিল্প এই বৃহৎ বুর্জোয়া গড়তে অপারগ, ১৯৫৬ সালের শিল্প আইন অনুসারে সেটা গড়বার দায় ভারত রাষ্ট্র বহন করে। এদেশের বৃহৎ বুর্জোয়া সামাজিক সঞ্চয়ে আহরণ করে নিজেরাই ভারী শিল্প গড়ে এ দেশে শিল্প ভিত্তি মজবুত করবে, এই ভরসা বা চিন্তা ভাবনা এই সময়ের ভারত রাষ্ট্রের ছিল না। বিদেশি পুঁজির উপর নির্ভরশীলতার কারণে এদেশে দেশি প্রযুক্তির পর্যাপ্ত বিকাশ হল না। রাষ্ট্র যথাসাধ্য বিনিয়োগ করে এদেশের শিল্পভিত্তি মজবুত করার চেষ্টা চালিয়ে গেল। সেটা কিন্তু পর্যাপ্ত ছিল না। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এদেশের জিডিপিতে কারখানা উৎপাদনের শেয়ার যে মাত্র ১৭ শতাংশ তার মূল কারণ এটাই। চীনে তুলনীয় শতাংশ ৩০।
লাইসেন্স পারমিট রাজের যুগে এই বুর্জোয়ার একাংশের মধ্যে আর একটা প্রবণতার উদ্ভব ঘটে। রাষ্ট্রে যারা প্রশাসন ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতায় থাকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু অতিরিক্ত সুবিধে পাওয়ার প্রবণতা। এই প্রবণতাই ফুলে ফলে বিকশিত হয়ে ধান্দাপুঁজিতে পরিণত হয়েছে পরবর্তীকালে। বিগত এক দশকে ভারতে এই ধান্দাপুঁজির পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ধান্দাপুঁজি পাম তেল, কাঠের ব্যবসা, পরিকাঠামো, স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় ও নির্মাণ, খনন ও অন্যান্য কাঁচামাল জাতীয় দ্রব্য ক্রয় বিক্রয় ইত্যাদিতে বিচরণ করত। পরবর্তী পর্যায়ে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনকি প্রতিরক্ষাজনিত ক্রয় প্রভৃতি ব্যবসাতে লিপ্ত। ২৬ জুলাই ২০২১ এর সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ভারতে প্রতিরক্ষা বিভাগের অস্ত্র সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে ৩৩৬টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের কমবেশি ৫৩৯ টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। যে সমস্ত বেসরকারি সংস্থা এই কাজের মধ্যে লিপ্ত আছে তাদের মধ্যে পুরনো ও নতুন উভয়ই আছে। পুরনো হল টাটা ও মাহিন্দ্রা আর নতুনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “পরশ ডিফেন্স”। অপারেশন সিঁদুর চালু হবার পর কয়েক দিনেই এই নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের স্টকের মূল্য গড়ে ৪ শতাংশ বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে পরশ ডিফেন্সর স্টকের দাম বেড়েছে ৫.৫৩ শতাংশ। এই সংস্থাটি “মেক ইন ইন্ডিয়ার” দৌলতে ড্রোন এবং অপটিক্যাল ব্যবস্থা বেড়ে উঠেছে যা ড্রোন এবং মাঝারি পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্রের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন করে। পরশ ডিফেন্স এর মতো আরও যেসব কোম্পানি রয়েছে তারা হল কৃষ্ণা ডিফেন্স, তানেজা এয়ারোস্পেস ইত্যাদি। এখানে যা বলা দরকার তা হল ২০২৫-২৬ সালের ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ মোট অর্থের পরিমাণ ৬.৮ লক্ষ কোটি টাকা যার ১.৮ লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ ২৬.৪৭ শতাংশ ব্যয় করা হবে সামরিক ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণের জন্য। এই অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দের সিংহভাগ যাবে ক্রনি ক্যাপিটালিস্টদের হাতে; যাদের কাছে “যুদ্ধ পৌষ মাসের সমতুল্য”। সংক্ষেপে বললে যুদ্ধের যৌক্তিকতা আনার জন্য আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, দেশভক্তি ইত্যাদির আবরণ আনা হচ্ছে। অপর দিকে এর সুবাদে ক্রনি-পুঁজি আরো বিকশিত হচ্ছে। এটাই হল বিকশিত ভারত।

পাকিস্তান কথা

পাকিস্তানের বিষয়টা ভারতের থেকে একটু আলাদা। ভারতে কখনোই সামরিক শাসন হয়নি। বিপরীতে, পাকিস্তান অর্থনীতি সামরিক ও অসামরিক উভয় ধরনের শাসনের মধ্যে দিয়ে গেছে। যদি ১৯৬৪ থেকে ২০২৪ ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে বিগত ৬০ বছরের মধ্যে, সামরিক শাসন ছিল ২৬ বছর আর অসামরিক শাসন ৩৪ বছর। তবে সামরিক শাসন বা অসামরিক শাসন কখনো একটানা ছিল না, আর অসামরিক শাসনের স্বাধীনসত্ত্বা ছিল না। সামরিক শাসনের পর্যায়ে ছিল নিম্নরূপ; আইয়ুব খান (১৯৬৪-১৯৬৯), ইয়াইয়া খান (১৯৬৯-৭১), জিয়াউল হক (১৯৭৭-১৯৮৮) ও মুশারফ আনসারী (১৯৯০-২০০৮)। বিপরীতে অসামরিক শাসনের সময়কাল ছিল নিম্নরূপ; পিপলস পার্টি অফ পাকিস্তান, পিপিপি (১৯৭১-৭৭, ১৯৮৮-৯০, ১৯৯৩-৯৬ ও ২০০৮-১৩), পাকিস্তান মুসলিম লীগ (১৯৯০-৯৩, ১৯৯৬-৯৯), পাকিস্তান মুসলিম লীগ, নওয়াজ শরীফ (২০১৩-১৮, ২০২২-২৪) এবং পাকিস্তান তেহারিক-ই-ইনসাফ, ইমরান খান (২০১৮-২২)। মোট ৩৪ বছর অসামরিক শাসনের মধ্যে পিপিপি মোট ১৬ বছর পাকিস্তানের সমাজ ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। পিপিপি রাজনৈতিক দর্শন হল ইউরোপীয় সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের মতো আর এই দলের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো ও তার কন্যা বেনজির ভুট্টো। যে চারটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেছে তারা কখনো তাদের পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। তার আগেই তাদের অপসারিত হতে হয়েছে। এটাই হল পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক শাসনের ইতিবৃত্ত।
এই ইতিবৃত্তে পাকিস্তান গোড়ায় ছিল কৃষি নির্ভরদেশ। মোট জনসংখ্যা ছিল ৩.৫ কোটি আর এই জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত ছিল। ধান, গম ছাড়া প্রধান বাণিজ্য ফসল ছিল উৎকৃষ্টমানের তুলা। অধুনা পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৫ কোটি এবং সারা পৃথিবীর ৩.১০ শতাংশ মানুষের এখানে বসবাস করে। বর্তমানে শ্রম নিযুক্তির হার ৫৮.৫ শতাংশ যা ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর তুলনা কম।
বিগত ৬০ বছরে পাক অর্থনীতিতে একটা সুস্পষ্ট কাঠামো পরিবর্তন ঘটেছে। তবে তা সাইমন কুজনেটস বর্ণিত পথে হয়নি। উন্নয়নের গতিপথে কৃষিক্ষেত্র থেকে উদ্বৃত্ত শ্রমিক শিল্পক্ষেত্রের তুলনায় সেবাক্ষেত্রে বেশি পরিমাণে স্থানান্তরিত হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে ১৯৫১ সালে কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকের পরিমাণ ছিল ৬৫%, ২০২৩ সালে তার হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশ। উদ্বৃত্ত শ্রমিক সেবাক্ষেত্রে নিয়োজিত হয়েছে। ফলে সেবাক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকের অংশ হয়েছে ৩৪ শতাংশ। অর্থনীতি দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ শিল্পক্ষেত্রে শ্রম নিযুক্তির হার ২১ শতাংশ হয়েছে। অধুনা পাকিস্তানের অর্থনীতির ভরকেন্দ্র তৃতীয়ক্ষেত্র বা পরিষেবা ক্ষেত্র। ২০২২ সালের এক হিসেবে দেখা যায় তৃতীয় ক্ষেত্র থেকে মোট জাতীয় উৎপাদনের আয় ৫৮% উৎপাদিত হচ্ছে।
পাক অর্থনীতিতে এই রূপান্তরের পাশাপাশি আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়। এটা হল অর্থনীতিতে সামরিক বাহিনীর লোকজনদের উত্তরোত্তর দাপট বৃদ্ধি যা ‘মিলবাস’ নামে পরিচিত। এর উত্থানের ইতিবৃত্ত নিম্নরূপ। স্বাধীনতার প্রাক্কালে পাকিস্তানের সমাজ ও রাষ্ট্র দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। সমাজের অনুশাসন ছিল ইসলামিক নিয়মকানুনের মধ্যে গ্রথিত আর রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল পাশ্চত্য দর্শনের মধ্যে। ১৯৪৮ সালে মহম্মদ আলী জিন্নাহ-র অকাল মৃত্যু ও ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা পাকিস্তানের নাগরিক সমাজে এক শূন্যতার সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের সমাজ একই জায়গায় আটকে থাকে এবং স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ ব্যাহত হয়। বিশিষ্ট গবেষক সানিয়া মুনিয়ার মনে করেন সমাজের এই বন্ধ্যা অবস্থার কারণে রাষ্ট্রকে রক্ষা করার তাগিদে সামরিক শাসনের ন্যায্যতা জনমানসে প্রোথিত হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্র গঠনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অভাব বরাবর লক্ষ্য করা যায়। মুনিয়ার আরও মনে করেন পরবর্তীকালে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অত্যাধিক ব্যবসা-বাণিজ্য, রিয়েল এস্টেট, স্টেট বীমা ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির মধ্যে অসামরিক সরকার স্থিতিশীলতা এবং সমর্থনের জন্য ক্ষমতার লোভী সামরিক বাহিনীর উপর আরো বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
অসামরিক সরকার ও ক্ষমতালোভী সামরিক বাহিনীর মধ্যে এইরকম একটা নির্ভরশীলতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার জন্য দুটি বিষয় ঘটে। (ক) প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি; (খ) সামরিক বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত একটা অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক এর সমৃদ্ধি অর্থাৎ সামরিক কর্তাদের জন্য ব্যবসার বৃদ্ধি।
স্টকহলম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে পাকিস্তানের সামরিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ ছিল ১০০২ কোটি ডলার যা পাকিস্তানের জিডিপি ২.৮%। এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন ও ড্রেজ দেখিয়েছেন ১৯৯০ থেকে ২০১০ এর পরিসরে যখন সারা বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে তখনও পাকিস্তান সামরিক খাতে ব্যায় বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে। অপর একজন আয়েশা সিদ্দীকা, ১৯৮০ থেকে ২০০৫ এর পরিসরে এক হিসাব করে দেখিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ৫.৭ শতাংশ থেকে ৩.২% এর মধ্যে ছিল। বিপরীতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাবরই জিডিপির ১ শতাংশের কম ছিল আর শিক্ষাখাতে ২.১ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এককথায় অত্যাধিক প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য উপেক্ষিত ছিল।
অসামরিক সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে এই ধরনের নির্ভরশীলতার বিষময় ফল হচ্ছে সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত একটা অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক যা সামরিক কর্তাদের জন্য লাভজনক ব্যবসা তৈরি করে। এটাই হল পাকিস্তানের ক্রনি ক্যাপিটাল বা ধান্দাপুঁজি। প্রখ্যাত গবেষক আয়েশা সিদ্দিকা “মিলিটারি ইন কর্পোরেটেট” বইতে পাকিস্তানের সামরিক কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য ব্যবহৃত গোপন অর্থনীতির বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন। এটাকে তিনি “মিলবাস” বলেছেন। এই মিলবাসের উদাহরণ হল ফৌজি ফেডারেশন, আর্মি ওয়েলফেয়ার্স ট্রাস্ট, ডিফেন্স হাউজিং অথরিটি ইত্যাদি। এইসব প্রতিষ্ঠানগুলি পাকিস্তানের কৃষি, উৎপাদন, রিয়েল এস্টেট এবং ব্যাঙ্কিং সর্বত্র বিস্তৃত ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। এই উদ্যোগগুলি কর ছাড়ের মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। “দি সানডে গার্ডিয়ান” এর মতে মিলবাস পাকিস্তানের ১২ শতাংশ ভূমির মালিকানা ভোগ করে। পত্রিকাটির মতে ‘মিলবাস’ হল পাকিস্তানের ‘বৈষম্যের ইঞ্জিন’ ।
এই বৈষম্যের ইঞ্জিন অর্থনীতিকে সংকটগ্রস্ত করে তুলেছে। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার ৩০ শতাংশ, দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যা ৩৫ শতাংশ। ঋণের ৪০ শতাংশ খরচ পরিশোধের জন্য ব্যয় হচ্ছে। অর্থনীতির এই ভয়াবহ অবস্থা সুরাহার জন্য কোন ইতিবাচক পদক্ষেপের বদলে ‘বিপন্নরাষ্ট্র’, ‘বিপন্ন ইসলাম’ ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে ও যুদ্ধের সমর্থনে দাঁড় করানো হচ্ছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.