বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

আমেদাবাদে টাটার বোয়িং বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুমিছিল

আমেদাবাদে টাটার বোয়িং বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুমিছিল

নিলয় ঘোষাল

photo


আমেরিকার বোয়িং সংস্থার তৈরি ড্রিমলাইনার বি-৭৮৭-৮ টাটার এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ভেঙে পড়ে আমেদাবাদ থেকে আকাশে ওড়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভেঙে পড়ে বিমানবন্দর লাগোয়া বহুতল হস্টেলে। পাইলট, কো-পাইলট, দশজন ক্রু মেম্বার ও ২৪২ জন যাত্রীর মধ্যে একজন মাত্র বেঁচে ফিরেছেন। প্লেনের যাত্রী ছাড়াও বলি হয়েছেন বেশ কয়জন ডাক্তারি ছাত্র, আহতও অনেক। মোট মৃতের সংখ্যা এখনো ২৭৪ জন।
সরকারের হাত থেকে বেসরকারি হাতে গেলে পরিসেবা উন্নত ও সুরক্ষিত হবে, সেই ধারণা ভেঙে দিল আমেদাবাদের বিমান বিপর্যয়। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, রেল থেকে বিমান, বেসরকারি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটলেও যাত্রী সুরক্ষা ও স্বাচ্ছন্দ্য উন্নতি হচ্ছে না।
এয়ারপোর্ট থেকে টেকঅফ করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, সবে তখন ৮২৫ ফুট উঠেছে, পাইলট বাধ্য হলেন গ্রাউন্ড কন্ট্রোলে বিপদ সংকেত পাঠাতে। এটা তাঁর দক্ষতার অন্যতম প্রমাণ। যে কোনও প্লেন দুর্ঘটনার পেছনে নাশকতা বাদে দু’ধরনের কারণ থাকতে পারে। ১) টেকনিক্যাল ফল্ট, যার মধ্যে পরে প্লেন সহ এয়ারপোর্ট গ্রাউন্ড লেভেল রক্ষণাবেক্ষণ, প্লেনের নির্মাণ সংক্রান্ত ত্রুটিবিচ্যুতি এবং ২) হিউম্যান ফল্ট বা চালকের ত্রুটি।
দশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোম্পানিকে বাদ দিয়ে মাত্র এক বছর আগে জন্মানো আদানির কোম্পানিকে সাত সাতটা এয়ারপোর্ট বরাত দেওয়া হল। যেখানে অভিজ্ঞ কোম্পানি প্যাসেঞ্জার প্রতি দর দিয়েছে ৬৩ টাকা, সেখানে আদানির কোম্পানি দিয়েছে ১৬৮ টাকা। বড় আশ্চর্যজনক। আদানির কোম্পানিরত বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণের মতো গুরুত্বপু্র্ণ কাজের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
দেশে-বিদেশে বিমান বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হল বিমানের ইঞ্জিন বিকল হওয়া। বিমান ওঠা কিংবা নামার সময় অল্প উচ্চতায় পাখির ধাক্কায় ইঞ্জিন বিকল হওয়া বিমান দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এদেশের জনবহুল শহরের কাছে বিমানবন্দরগুলিতে এমন বিপদ বেশি। আমেদাবাদ বিমান বন্দর খুবই জনবহুল এলাকায়।
এয়ারপোর্টের আশপাশে কিছু জায়গা রাখা হয়, বাফার জোন হিসাবে। আমেদাবাদ বিমান বন্দরে সেটা ছিলই না। রানওয়ের শেষে বা আশপাশের জমি গর্ত ও আবর্জনা। তাছাড়া জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে সেখানে বাড়ছে দোকান বাজার আর জঞ্জালের স্তূপ, যেগুলি পাখিদের বেড়ে ওঠার অন্যতম কারণ। যার ফলে প্লেনের টেকঅফ ও ল্যান্ডিংএর সময় স্বাভাবিক বিপদের সম্ভাবনা বাড়ছে।
২০১৮ সালে আমেদাবাদ এয়ারপোর্ট অথরিটি গুজরাট সরকারের কাছে ২৯.৭৯ একর জমির আবেদন করে এবং সরকার তা মঞ্জুর করে। কিন্তু তা কার্যকর হয় না কারণ সেটা করতে ৩৫০টি পরিবারকে উপযুক্ত পুনর্বাসন দিতে হতো।
বোয়িং একটি আমেরিকান কোম্পানি। এই কোম্পানিতে ৩২ বছর ধরে কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছিলেন জন বার্নেট। ইনি ২০১৭ সালে বোয়িং ড্রিমলাইনার ৭৮৭ প্রজেক্টে কাজ করার সময় ভয়াবহ অনিয়ম দেখতে পান এবং তা চেপে না রেখে সাহসিকতার সঙ্গে ফাঁস করেন। এই কাজের জন্য উনি ‘হুইসেলব্লোয়ার’ হিসেবে পরিচিত। তিনি বোয়িং ৭৮৭ বিমানে ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ, অক্সিজেন সরাবরাহের সমস্যা এবং অন্যান্য কিছু সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডেরাল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FAA) এবং অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (OSHA) এর কাছে লিখিত অভিযোগ জানান। কোর্টেও যান। তদন্ত হয়। জন বার্নেটের অভিযোগ সঠিক প্রমাণ হয়। FAA বোয়িং কোম্পানিকে সংশোধনের নির্দেশ দেয়। কিন্তু কোম্পানি লোকসান মেনে নেবে? অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে বার্নেটের মৃত্যু হয়। পুঁজির দাপটে প্রযুক্তির সঙ্গে আপস করে বোয়িং, বার্নটের তোলা বহু অভিযোগ উপেক্ষা করে অভিজাত ড্রিমলাইনার মডেল বাজারে ছেড়েছিল।
আহমেদাবাদ দুর্ঘটনার বিমানটিও ছিল ড্রিমলাইনার বি-৭৮৭-৮। হয়ত প্রযুক্তিগত ত্রুটি সহই ওই প্লেন চলেছে। কে বলতে পারে, সেদিন প্রযুক্তিগত ত্রুটি কাজ করেছিল কিনা।
বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রে বিমানের যান্ত্রিক সুরক্ষা যাচাই সবচেয়ে জরুরি। উন্নত প্রযুক্তির অভিজাত গাড়ি, ট্রেন কিংবা বিমান সবেরই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ কর্মী বাহিনী ও উপযুক্ত প্রযুক্তি পরিকাঠামো — যার জন্য প্রয়োজন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিনিয়োগ। ব্যবসার লাভ আনতে চড়া দামে কেনা ড্রিমলাইনার বিমানগুলিকে দিনে কম করে ১৭-১৮ ঘণ্টা উড়তে হয় যাত্রী নিয়ে। সারাদিনে যে সময় মেলে তাতেই করতে হয় বিমানের সবচেয়ে জরুরি সুরক্ষা যাচাইয়ের কাজ। এমন রুটিনে বিমানের সুরক্ষা যাচাইয়ের মান নিয়েই প্রশ্ন থাকে। যেমনটা উঠে বন্দেভারত কিংবা শতাব্দী এক্সপ্রেস জাতীয় ট্রেনগুলির রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রেও।
প্রসঙ্গত, এয়ার ইন্ডিয়ার হাতে যে বোয়িং ৭৮৭ বিমানগুলো আছে তার অধিকাংশই টাটাকে হস্তান্তরের আগেই কেনা। যদিও টাটা এয়ার ইন্ডিয়া বোয়িং কোম্পানির কাছ থেকে আরো কিছু এয়ারবাস ইত্যাদি কিনতে যাচ্ছে, পুনর্বিবেচনা জরুরি।
১৭ জুন পাইলটের তৎপরতায় এয়ার ইন্ডিয়ার একটি প্লেন দুর্ঘটনার থেকে বাঁচে, সানফ্রান্সিস্কো থেকে ভায়া কলকাতা মুম্বাইগামী এআই ১৮০ প্লেনের বাঁ দিকের এঞ্জিনে গোলযোগ দেখা দেয়। ভোর ৫টা ২০মিনিটে দমদম এয়ারপোর্টে নেমে পাইলট সব যাত্রীকে আগে নামিয়ে ইঞ্জিন ঠিক করান।
আমাদের দেশে পথ দুর্ঘটনায় প্রতি ৪ মিনিটে একজন করে মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রতি ১০ লক্ষ উড়ানের একটি যদি দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে সেটি হয়ে ওঠে আতঙ্কের বিষয়।
এখন এই বিমান র্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সবাই চেয়ে রয়েছেন বিমানের ব্ল্যাকবক্সের দিকে। ব্ল্যাকবক্স হল সেই সুরক্ষিত প্রযুক্তিনির্ভর কাঠামো যার মধ্যে বিমান চালনা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য এমনকি বিপর্যয়ের আগে ককপিটে চালক, সহচালকের কথোপকথন নথিভুক্ত করা থাকে। এই প্রেক্ষিতে দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমান ব্ল্যাকবক্স থেকে যেমন বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান জরুরি। তেমন জরুরি ড্রিমলাইনারের যান্ত্রিক সুরক্ষা।
ইতিমধ্যে ডিরেক্টর জেনারেল অব সিভিল এভিয়েশন পাখির ধাক্কায় বিমানের ইঞ্জিন বিকলের সম্ভাবনা খারিজ করেছেন। ফলে ইঞ্জিন বিকলের ক্ষেত্রে বিমানের অভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক গোলযোগের পাল্লাই ভারী এই মুহূর্তে। কারণ দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমান চালক যথেষ্ট দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ছিলেন। ফলে সেক্ষেত্রে চালকের বিমান চালনার ত্রুটির সম্ভাবনা যথেষ্টই কম। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় প্রকাশিত যে, এদেশে বিমান চালানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে বিমানের ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা, সুরক্ষা এবং যন্ত্রাংশের জোগান। সাম্প্রতিক কালে, বিমানের ইঞ্জিন খারাপের কারণে বিমান সংস্থাগুলিকে উড়ানের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়েছে। উত্তরোত্তর অলাভজনক হয়ে উঠেছে সেই পরিষেবা। পরিষেবার মান কমছে। বিপদ বাড়ছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.