বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার ঘোষণা করছেন ৩১ মার্চ ২০২৬ এর মধ্যে দেশকে ‘মাওবাদী’ মুক্ত করা হবে। একই কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই লক্ষ্যেই দেশজুড়ে সিপিআই (মাওবাদী) দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সমর্থক-দরদীদের হত্যা করার জন্য লাগু করা হয়েছে ‘অপারেশন কাগার’। ‘কাগার’ শব্দের অর্থ ‘শেষ যুদ্ধ’। সারা দেশের বিভিন্ন স্তরের মাওবাদী নেতৃত্বের মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছে অর্থাৎ মাওবাদীদের ধরিয়ে দিতে পারলে, গ্রেপ্তার বা হত্যা করতে পারলে টাকা দেওয়া হবে। টাকার পরিমাণ লক্ষ থেকে কোটি টাকা। সংবিধান শাসিত কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি এ ভাবে তার নাগরিকদের মাথার দাম ঘোষণা করতে পারে? বিভিন্ন রাজ্যে অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বারবার এই প্রশ্ন তুললেও রাষ্ট্র পরোয়াই করছে না। পশ্চিমবঙ্গেও কিসেনজি হত্যার পরে এই প্রশ্ন উঠেছিল। মানবাধিকার কমিশন এবং সর্বোচ্চ আদালতেও এই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এবং মানবাধিকার কমিশন বলেছে, ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা করা হয়নি এটা নিশ্চিত হওয়ার আগে কাউকে পুরস্কার দেওয়া যাবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং ছত্রিশগড় ও অন্যান্য রাজ্য সরকার টাকার লোভ দেখিয়ে মাওবাদীদের হত্যা করার জন্য আদিবাসী জনতা এবং পুলিশ ও আধা সেনা কর্মীদের প্রলুব্ধ করছে।
সরকার সিপিআই (মাওবাদী) দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কেউ আইন বহির্ভূত কাজ করলে সরকার আইন অনুযায়ী বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করবে বা সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাবে বারবার মাওবাদীদের নিকেশ (এলিমিনেট) অর্থাৎ হত্যা করার কথা বলছেন, তা কি কোনও সভ্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? নিকেশ দু’ভাবে হতে পারে। এক, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে, বা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে। গৃহযুদ্ধ ঘোষণা করলে সরকারকে জেনেভা কনভেনশনের নিয়ম মেনে যুদ্ধ পরিচালনা ও বন্দিদের রক্ষা করতে হবে। মানবাধিকার কর্মীরা বারবার দাবি করলেও সরকার জেনেভা কনভেনশনের নিয়মাবলিও মানতে রাজি নয়। গৃহযুদ্ধ চলছে এটা মানতে রাজি নয়। সম্প্রতি সিপিআই (মাওবাদী) দলের সাধারণ সম্পাদক বাসবরাজকে হত্যা করার পরে হত্যাকারীদের দিল্লিতে ডেকে লাড্ডু খাইয়ে অভিনন্দন জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং যে ভাবে উল্লাস প্রকাশ করেছেন তা চূড়ান্ত অশ্লীলতার পর্যায়ে চলে গেছে।
‘অপারেশন কাগার’ ঘোষণা করার পর গত এক বছরে ছত্রিশগড় সহ বিভিন্ন রাজ্যে অন্তত ৫০০ জন মাওবাদীকে হত্যা করা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক বাসবরাজ সহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, রাজ্য কমিটির সম্পাদকসহ বিভিন্ন রাজ্য কমিটির সদস্য, জোনাল কমিটি ও স্থানীয় পার্টি সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। ছত্তিশগড়ে এক এক দিন ২৫-৩০ জন করে হত্যা করা হচ্ছে। বিশাল বাহিনী নামিয়ে এলাকা ঘিরে চিরুনি তল্লাশি করে ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে। এই হত্যালীলা ছত্রিশগড়, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খন্ডে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বহু সাধারণ আদিবাসীকেও হত্যা করা হয়েছে। শুধুমাত্র সশস্ত্র মাওবাদীরাই নয় মাওবাদীদের তাত্ত্বিক নেতা, মাওবাদী পার্টি স্কুলের শিক্ষক, পত্র-পত্র পত্রিকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী, লেখক, সম্পাদক, যাকে পাচ্ছে তাকেই হত্যা করা হচ্ছে। এঁদের একটা বড় অংশই মহিলা। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা উৎখাত করা হয়েছে হাজার হাজার সাধারণ আদিবাসী নাগরিককেও। কোথাও কোনও বিচার নেই। ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় জীবনের অধিকারের কথা বলা আছে। বিনা বিচারে কাউকে সাজা দেওয়া বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না, সংবিধানে বলা আছে। সে সব শুধু কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘প্রজাতন্ত্র নিজের সন্তানকে হত্যা করতে পারে না’। আরও বলেছে, ‘এনকাউন্টার হল হত্যা’। এ সবকে আজ পরিহাস বলে মনে হয়। ভূয়ো সংঘর্ষে হত্যার ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সুপ্রিম কোর্ট অতীতে বারবার নির্দেশিকা জারি করেছে। কিন্তু আজ কেউ কোনও প্রশ্নই তুলছে না। সম্প্রতি আসামে ১৮৭টি ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার অভিযোগ নিয়ে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। যে কমিশনগুলো ইতিমধ্যেই কার্যত সরকারি দপ্তরে পরিণত হয়েছে, তারা করবে সরকারের বিরুদ্ধে তদন্ত! ছত্রিশগড় বা অন্যত্র মাওবাদীদের হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট বা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনগুলো স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ নিতে পারত। আইনের শাসন রক্ষায় তারা অদ্ভুত এক নীরবতা রক্ষা করে চলেছে।
বাসবরাজ-সহ বেশ কয়েকজন মাওবাদী নেতার মৃতদেহও তার পরিবারকে হস্তান্তর করেনি ছত্রিশগড় সরকার। পরিবারের আবেদন অস্বীকার করে, হাইকোর্টের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে পুলিশ ও আধা সেনা নিজেরাই সে সব দেহ পুড়িয়ে দিয়েছে। অথচ দেশের আইনে এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বলা হয়েছে পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে সৎকারের জন্য মৃতদেহকে পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে। এমনকি রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু হলেও পরিবারকে দেহ দিতে হবে। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী জীবনের অধিকারের মধ্যে মর্যাদার সঙ্গে সৎকারের অধিকারও নিহিত আছে। সে সব মানল না সরকার। নীরব রইলো আদালত, মানবাধিকার কমিশন।
এটা ঠিক যে মাওবাদীরা যে ভাবে সেনাবাহিনী বানিয়েছে, সেনার ব্যাটেলিয়ান-প্লেটুন কোম্পানি তৈরি করেছে, একটা পরিপূর্ণ স্ট্রাকচারড সেনাবাহিনী যে ভাবে নিজেদের অস্ত্র সজ্জিত করেছে, দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে ‘মাওবাদী করিডর’ বানিয়েছে এবং ছত্রিশগড়ের অবুঝমাঢ়ে ‘জনতার সরকার’ নাম দিয়ে বিকল্প সরকার তৈরি করেছে, তা এ দেশের আন্দোলনে অভূতপূর্ব। ১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে তেলেঙ্গানার সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে সূচনা হয়েছিল তাকেই যেন অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে এই সিপিআই (মাওবাদী) দল। কোনও সরকারের পক্ষেই তাকে আর অবহেলা করা সম্ভব ছিল না। সংঘর্ষ তীব্র হতোই। কিন্তু দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির খনিজ সম্পদের দখল নেওয়ার চাপ এই সংঘর্ষকে ত্বরান্বিত করেছে, অনিবার্য করেছে। বস্তার-সহ দণ্ডকারণ্যের বিস্তৃত অঞ্চল, মহারাষ্ট্রের গাড়চোরেলি, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর সর্বত্র মাটির নিচে রয়েছে মূল্যবান খনিজ সম্পদ। এই সম্পদগুলি দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলোর চাই-ই। বস্তারের হাজার হাজার বর্গ মাইল জমি, যেগুলো জরিপ পর্যন্ত করতে পারেনি কোনও সরকার, তার দখল চাই। আদানি, আম্বানি জিন্দাল, টাটা-সহ বিদেশি বহু সংস্থার
সঙ্গে অজস্র ‘মৌ’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ছত্রিশগড় সরকারপৃথিবীর মাটির নিচে বা সমুদ্রের নিচে বা পাহাড়ের গভীরে খনিজ সম্পদ আছে, সে সব আজ বহুজাতিক শিল্প সংস্থাগুলোর দখলে আনার পালা চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই এই খনিজ সম্পদগুলোর দখল নিতেই হবে পুঁজিপতিদের। সে কারণে পৃথিবীজুড়েই আদিবাসীদের উৎখাত চলছে। যারাই এই উৎখাত এবং দখলদারির বিরোধিতা করছে, তাদেরই নিকেশ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রতন্ত্র।
এই হত্যালীলা এখানেই থামবে কি? বোধহয় না। বিশ্বে কমিউনিস্ট নিধনের দু’টি বৃহৎ ঐতিহাসিক ঘটনা যদি মন দিয়ে দেখা যায়, তবে আজ যারা মাওবাদী নিধনে নীরব আছেন, বা ভাবছেন ‘যা শত্রু পরে পরে’ - তারাও উদ্বিগ্ন হবেন। ইন্দোনেশিয়া এবং চিলিতে কমিউনিস্টদের হত্যা শেষ করে কিন্তু শুরু হয়েছিল অন্যদের হত্যা। যারাই সরকারের বিরোধিতা করেছিল প্রশ্ন তুলেছিল সেই সব বুদ্ধিজীবী লেখক শিল্পী ছাত্রনেতা অধ্যাপক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা — বিপুল সংখ্যক প্রতিবাদী মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বলেছেন, এখন দেশে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ চলছে। অর্থাৎ প্রশ্ন তোলা নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এদেরই বলেছেন কলমধারী নকশাল। বলেছেন, এরা বন্দুকধারী নকশালদের থেকেও মারাত্মক। মাওবাদীদের শেষ করে শহুরে নকশালদের দিকে নজর দেবে সরকার, বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
মাওবাদীদের রাজনৈতিক লাইন কতটা ঠিক বা কতটা বেঠিক, সেটার বিচার নিশ্চয়ই রাজনীতিকরা করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রের এই ভয়ঙ্কর হত্যালীলার বিরুদ্ধে সরব না হওয়া আসলে নিজেদেরই মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করা। নাগরিক সমাজ কবে এটা বুঝবেন এটাই আসল প্রশ্ন।