বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ভারতে পরিবেশ ধ্বংস: ঔপনিবেশিক শিকড় ও উত্তরাধিকার

ভারতে পরিবেশ ধ্বংস: ঔপনিবেশিক শিকড় ও উত্তরাধিকার

বঙ্কিম দত্ত

photo

রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করা হতো। স্থানীয় শাসকরা বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় কিছু নিয়ম প্রয়োগ করতেন, যেমন মৌর্য ও মুঘল আমলে বন সংরক্ষণের উদ্যোগ দেখা যায়। নগরায়ণের গতি ছিল স্তিমিত। উল্লেখ্য যে ব্রিটিশ আগমনের আগে এদেশে জমির ব্যক্তিগত মালিকানাও ছিল না।
প্রকৃতিকে ‘পণ্য’ হিসেবে দেখার মানসিকতা আজও রাষ্ট্র ও কর্পোরেট নীতিতে স্পষ্ট। তার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনকালে।

ঔপনিবেশিক শাসনে পরিবেশ–নীতির প্রকৃতি

১৭৫৭ সালের পলাশি যুদ্ধের পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পায়। তাদের নীতি ছিল স্পষ্ট — স্থানীয় পরিবেশ ও জনগণের চাহিদা উপেক্ষা করে প্রাকৃতিক সম্পদকে বাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্যে রূপান্তর করা।
১৭৯২–১৮০০ এই দশক জুড়ে মূলত ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ নির্মাণের জন্য মালাবার উপকূলে (বর্তমান কেরল) কাঠের জন্য ব্যাপকভাবে সেগুন গাছ কাটা শুরু হয়, সুন্দরবনে ১৮৩০-এর দশক থেকে গরান ও সুন্দরী গাছ কেটে রেল স্লিপার ও জাহাজ কাঠ সরবরাহ করা হতে থাকে। ১৮৫৩ থেকে ১৯০০, এই পঞ্চাশ বছরে রেলপথ নির্মাণে সারা ভারতে আনুমানিক ২.৫ কোটি গাছ কাটা হয় (Mike Davis, Late Victorian Holocausts, 2001)।
১৭৭৭ সাল নাগাদ নদিয়া ও যশোরে বৃহৎ আকারে নীল চাষ শুরু হয়। নীল চাষ মাটির জৈবগুণ নষ্ট এবং জলকে দূষিত করত।
প্রাকৃতিক সম্বল এদেশে ছিল প্রচুর পরিমাণে এবং প্রধানত ব্যবহার মূল্যেই তা আবদ্ধ ছিল। জমির ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় পুঁজিতে রূপান্তর সম্ভব ছিল না। প্রকৃতি ধ্বংসের হারও সেকারণে ছিল নিয়ন্ত্রিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডে এই ব্যবহারিক মূল্যকে বিনিময় মূল্যে রূপান্তর ঘটায়। তৈরি হয় পুঁজি। শিল্প-বিপ্লব সম্ভব হয় দেশে দেশে লুঠপাঠের এই অর্থনীতির মধ্য দিয়েই।
এদেশে ব্রিটিশরা বনকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে (বন আইন ১৮৬৫, ১৮৯৪) যা স্থানীয় জনগণের অধিকার যেমন খর্ব করে, ধ্বংস করে বননির্ভর আদিবাসী ও গ্রামীণ মানুষের জীবনধারা। গাছ কাটলে কাঠ হয়ে ওঠে মূল্যবান সম্পদ।
১৮১৪ সালে রানিগঞ্জে এদেশের প্রথম কয়লা খনি ও বিপুল বন উজাড় ও স্থানীয় সমাজের উচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে ১৯০৭ সালে জামশেদপুরে টাটা স্টিল প্লান্ট প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৭৭০ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষে প্রায় ১ কোটি মানুষ মারা যায় — এর অন্যতম কারণ ছিল খাদ্যশস্যের পরিবর্তে অর্থকরী ফসল চাষে জোর। লর্ড কর্নওয়ালিস বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে (১৭৯৩)। ভারতে জমিকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন করে পুঁজি-বিকাশের এই চেষ্টার জন্য কাল মার্কস তাঁর লেখায় কর্নওয়ালিসকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। জমি ব্যক্তি-পুঁজির আওতায় আসার পর পরিবেশ ধ্বংসের প্রক্রিয়া গতি পায়। জমিদারদের রাজস্ব আদায়ের ভার দেওয়া হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণের জোরে ভারত থেকে সস্তায় কাঁচামাল (পাট, তুলা, রেশম, নীল) কিনে ব্রিটিশ শিল্পে ব্যবহার শুরু করে। এভাবে ভারতের কৃষিজ সম্পদের সঙ্গে মাটির উর্বরা শক্তি চালান হয়ে রিক্ত নিঃস্ব হতে থাকে দেশের প্রাকৃতিক সম্বল। ব্রিটিশ শিল্পপণ্য (কাপড়, লবণ, চিনি) ভারতে চড়া দামে বিক্রি করে ‘বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত’ আদায় করার কাজও চালাতে থাকে কোম্পানি। ভারতের রেশম, মসলিন ইত্যাদি সূক্ষ্ম তাঁত-বস্ত্র উৎপাদন ধ্বংস করে ব্রিটিশরা ম্যানচেস্টারের কাপড় ভারতের বাজারে চালান করে। ব্রিটিশ শিল্পপুঁজি বাড়তে থাকে। আরও উদ্বৃত্তের সন্ধানে তখন উপনিবেশেই পুঁজি রপ্তানি করে শিল্পস্থাপন শুরু হয়। দেশিয় কর্মকার-চর্মকারদের কর্মসংস্থান ও উৎপন্ন দ্রব্যের বাজার সংকুচিত হয়। প্রাকৃতিক সম্বল প্রবলভাবে সম্পদের রূপ নেয়।

স্বাধীনতার পর (১৯৪৭–১৯৯১)

ব্রিটিশ আমলের খনিজ-নির্ভর অর্থনীতি ও সম্পদ শোষণের ধারা নতুন রাষ্ট্রে নতুন আকারে বজায় রইল। ঔপনিবেশিক শাসন ভারতের পরিবেশ ধ্বংসের যে কাঠামো তৈরি করেছিল, স্বাধীনতার পর সেটি বদলায়নি — শুধু শাসকের চেহারা বদলেছে। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর আমলে (১৯৪৭–১৯৬৪) ভারতে রাষ্ট্রনির্মাণ, আধুনিকীকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ভাকরা-নাঙ্গাল, হিরাকুদ, দামোদর ভ্যালি প্রকল্প ইত্যাদি বাঁধগুলোকে নেহরু ‘আধুনিক ভারতের মন্দির’ বলেছিলেন। ‘স্বনির্ভর অর্থনীতি’ গড়ে তুলতে নেহরুর জোর ছিল ভারী শিল্পে। পরিকল্পিত অর্থনীতির দ্বিতীয় পরিকল্পনা (১৯৫৬) বিশেষভাবে শিল্পায়নমুখী ছিল। ভিলাই, রৌরকেলা, দুর্গাপুর ইত্যাদি ইস্পাত কারখানা, জাদুগোড়ার ইউরেনিয়াম খনি গড়ে ওঠে এই পর্বে। রাষ্ট্রীয় পুঁজির পাশাপাশি টাটা, বিড়লার তৈরি বোম্বে প্ল্যানের (১৯৪৪) প্রস্তাবমাফিক ব্যক্তি-পুঁজিকেও বিশেষ জায়গা করে দেওয়া হয়। দেশে মিশ্র-অর্থনীতির শাসন কায়েম হয়। বুনিয়াদী শিল্প ছাড়া উৎপাদনের সমস্ত ক্ষেত্র দখল নেয় ব্যক্তি-পুঁজি। বিশাল বিশাল বনভূমি ও কৃষিজমি হারিয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় (বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়)। বাঁধের কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়, মাছ ও জলজ প্রাণীর প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কৃষি ও শিল্পের জন্য ব্যাপক বন কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়। তরাইয়ের প্রাচীন গাছগুলো কেটে অর্থকরী ফসল চা উৎপাদনের জমি তৈরি করা হয়। হিমালয়ের জীব-বৈচিত্র নষ্ট হতে থাকে সে সময় থেকেই।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আন্দোলন তখনও শক্তিশালী হয়নি (১৯৭০-এর দশক থেকে পরিবেশবাদ গুরুত্ব পায়)। ফলে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় পরিবেশ ভাবনা প্রায় অনুপস্থিত ছিল। ডান-বাম সব মহলে এসব কর্মকাণ্ডকে দেশের উন্নয়ন হিসাবেই দেখা হতো।
ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লব হাজির করে পরিবেশ ও খাদ্য স্বয়ম্ভরতার দ্বন্দ্বটি। ১৯৬৫ সালে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে উচ্চফলনশীল জাতের গম বপন করা হয়। এই রাজ্যগুলোই ছিল সবুজ বিপ্লবের মূল কেন্দ্র। সামাজিক ও পরিবেশগত দিক থেকে একাধিক সংকটের জন্ম দিয়েছে সবুজ বিপ্লব যা এর প্রবক্তারাই আজ স্বীকার করেন। পঞ্জাবের বড় একটা এলাকা ক্যানসার বেল্ট (Cancer Belt) নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জীবাশ্ম জ্বালানী তেলকে অটোমোবাইল ও সংশ্লেষণী রাসায়নিক শিল্পে বিনিয়োগ উদ্বৃত্ত-মূল্য তৈরি করে। ১৯৮৪ সালে ভূপালে ঘটে ইউনিয়ন কার্বাইড-এর কারখানার দুর্ঘটনা, যা বিশ্বের বৃহত্তম রাসায়নিক-শিল্প দুর্ঘটনা। এখানে রাসায়নিক কীটনাশক সেভিন উৎপন্ন হতো। পুঁজি তথা বাজারের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তখনও কিছুটা রয়েছে। তবু বহুজাতিক কোম্পানির হাত যে কতটা শক্তিশালী ভূপাল দুর্ঘটনা তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। দেশের অর্থনীতিতে বিদেশি পুঁজির সরাসরি অনুপ্রবেশ শর্তসাপেক্ষ থাকায় বিদেশি বহুজাতিকের অবাধ লুণ্ঠন অবশ্য তখনও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল, যদিও তার প্রস্তুতি তখন শুরু হয়েছে।
১৯৮৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বহু বিতর্কিত, পরিবেশ ও আদিবাসী জীবন ধংসকারী, নর্মদা বাঁধ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চালু করেন প্রকল্পটি।

অর্থনৈতিক উদারিকরণের পর

যে প্রবণতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাঠের জাহাজ তৈরির জন্য বন উজাড় দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেটিই আজ সমুদ্র ও বিমান বন্দর, মেট্রো রেল, এক্সপ্রেসওয়ে বা খনি সম্প্রসারণের নামে অব্যাহত। সাগর থেকে হিমালয়ে বিস্তৃত বর্তমান কোম্পানি মালিকদের প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষুধা। বর্তমান কর্পোরেট–রাষ্ট্র জোট সেই একই শোষণকে সূচকীয় (এক্সপোনেনশিয়াল) হারে ত্বরান্বিত করেছে। ২০১৩ সালের কেদারনাথ বন্যা বা ২০২২ সালের জোশিমঠ ধস সরাসরি পাহাড়ি অঞ্চলে পরিকাঠামো পরিবর্তনের চাপের সঙ্গে যুক্ত (Ministry of Earth Sciences Report, 2023)। ভূবিশেষজ্ঞদের সুপারিশ উপেক্ষা করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের হিমালয় চারধাম প্রকল্প, হিমালয় অঞ্চলের ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর ও বিপন্ন পরিবেশ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে। ঘন ঘন তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ‘উন্নয়ন’-এর তাপে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধিতে ডুবছে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়ছে। সুন্দরবন অঞ্চল তার প্রমাণ।

শেষ নাহি যার....

ভারতে যা চলছে সেই ধারায় ‘উন্নয়ন’ শব্দটি এক ধরনের নৈতিক ঢাল, যা পরিবেশ ধ্বংসকে বৈধতা দেবার জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে। কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায়, “রাস্তাজুড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন”।
প্রাণিজগতের অংশ হওয়া সত্ত্বেও, সভ্যতার পথে মানুষের বিবর্তন তাকে প্রকৃতির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে গেছে। বর্তমানে এই বিচ্ছিন্নতা এমন এক স্থায়ী রূপ নিয়েছে যে প্রকৃতি ধ্বংস সাধারণ মানুষের চিন্তায় কোনও রকম ছাপ রাখতে ব্যর্থ হয়।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই বিচ্ছিন্নতা চলমান জীববৈচিত্রের ক্ষতির একটি কারণ। মানব সমাজ যখন সম্প্রসারিত হয়ে জাতি হিসেবে সংগঠিত হয়েছে, তখন বিশ্বব্যাপী এক প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে। জাতিসমূহ শুধুমাত্র বর্তমান চাহিদা মেটানোর জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি-সম্পদের নিরাপত্তার লক্ষ্যে প্রকৃতিকে শোষণ শুরু করেছে। মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের এই বিচ্ছিন্নতা প্রায় অসেতুসম্ভব দূরত্ব তৈরি করেছে। মানুষ নিজে প্রকৃতির অংশ হওয়া সত্ত্বেও এই ক্ষতির ব্যাপারে অদ্ভুত নিরাসক্ত। এই নিরাসক্ততার অন্যতম কারণ কি এদেশের মননের গভীরে প্রাচীনকাল থেকে প্রোথিত অদৃষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তথা নিয়তিবাদ অথবা পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক আধিপত্য!

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.