বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

অরণ্যের বিনাশ ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কথা

অরণ্যের বিনাশ ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কথা

অনিতা অগ্নিহোত্রী

photo

বনের সবুজ উপড়ে তুলে ফেলে যন্ত্রে পাথর মাটি বার করে উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাগ। যেন হিংস্র দানবের নখের আঁচড়। গত বছর ডিসেম্বরে সামাজিক মাধ্যমে বার বার আসছিল আক্রান্ত বিনষ্ট এক প্রাচীন অরণ্যের ছবি। ছত্তিশগড়ের তিনটি জেলায় ছড়ানো অতি প্রাচীন, জীব বৈচিত্র্য ভরপুর হাসদেও অরণ্যের ৯১ একর জমিতে ছড়ানো ১৫০০০ হাজার গাছ কাটা হল পুলিশ ও আধিকারিকদের প্রহরায়, শ্রমিকদের দিয়ে, বৈদ্যুতিক করাতে। স্থানীয় জনজাতিদের দ্বারা পূজিত শতাধিক বছর প্রাচীন এই সব গাছ উপড়ে ফেলা কি সহজ কথা!
এই জঙ্গলের মধ্যে আছে পারসা ইস্ট ও কান্তা বাসন কোল ব্লক, যার সংক্ষিপ্ত নাম পিইকেবি। এই ব্লকের কয়লা বরাদ্দ করা হয়েছিল রাজস্থানের রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিকে। এটা তো এক নিছক সমাপতন যে, ভারতের অন্যতম ধনী শিল্পপতির কোম্পানি এর মাইন অপারেটর ও ডেভেলপার।
প্রথম ফেজে ২০১২ পর্যন্ত ৯০ হাজার গাছ কাটা হয়েছিল, অরণ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, সেই স্বেচ্ছাসেবীদের মতে এই সংখ্যা প্রকৃত পক্ষে পাঁচগুণ বেশি। দ্বিতীয় ফেজ চালু করার নামে বনের মধ্যে এত জমির উপর বৃক্ষছেদন জরুরি ছিল কি? এই অরণ্য সংহারের পর হাতীদের চলার পথ নষ্ট হওয়ায় ক্রুদ্ধ হাতীদের আক্রমণে ঘর ভেঙেছে, প্রাণ গেছে মানুষের। আদিবাসী সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ। তাদের প্রতিবাদের কোনও ফল হয়নি। তাঁরা মনে করেন আগের ও এখনকার দুই সরকারই, যথাক্রমে রাজস্থান সরকার এবং শিল্পগোষ্ঠীকে খুশি করতে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। হাসদেও অরণ্যে কয়লা উত্তোলনের জন্য বর্তমান খনি অঞ্চলগুলি নিয়েই শিল্পের কাজ চলত, অরণ্যের বৃহদংশ রেখে দেওয়া যেত ধ্বংসের নাগালের বাইরে। এই নিরন্তর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে জনজাতি জীবন, উচ্ছিন্ন হয়েছে মানুষ। জীববৈচিত্র্য ও মানব জীবন ধারার বিপুল ক্ষতির প্রশ্ন মুছে গেছে শিল্পোদ্যোগী, শাসক রাজনীতিক ও ঠিকাদার গোষ্ঠীর লোভের সামনে।
স্বাধীন দেশে যেন ফিরে এসেছে একদা উপনিবেশ সংস্কৃতি। এ দেশের যাবতীয় প্রাকৃতিক ও ভূ সম্পদ বিদেশে রফতানি করে শোষণের যে নীতি গ্রহণ করেছিল ঔপনিবেশিক শক্তি, স্বাধীন দেশে স্বাধীন জনসমাজের চোখের সামনে সেই প্রাকৃতিক সম্পদকে একই ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। লক্ষ্য অবশ্যই উন্নয়ন। ভারতের উন্নয়ন। কিন্তু এই হ্রস্বমেয়াদী চিন্তার ফলে দেশের যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হচ্ছে, তার বিশ্লেষণ তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। বহুদিন ধরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠে এক অরণ্যভূমি। যা কেবল বহু বৃক্ষেরই সমাহার নয়, বৃক্ষ লতা গুল্ম প্রাণী পাখি প্রজাপতির পারস্পরিক সম্বন্ধে নির্মিত এক পরিবেশ ব্যবস্থা। গত তিন দশকে সেই রকম অরণ্যের ১৪ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার ধ্বংস হয়েছে নানা শিল্প উদ্যোগের জন্য। খনি, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে এর ৪০ শতাংশের বেশি। ১৫০০০ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য এলাকা চলে গেছে জবর দখলের হাতে। এছাড়া ২৫০ বর্গ কিলোমিটারের মতো জঙ্গল এলাকা প্রতি বছর ব্যবহার হতে দেওয়া হচ্ছে অরণ্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন কাজের জন্য। প্রকৃত অরণ্য ভূমি ছাড়াও পরিকাঠামো নির্মাণের দোহাই দিয়ে হয়ে চলেছে বৃক্ষচ্ছেদন। পথের দু’ধারে বহু বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব এই সব গাছ মানুষের সবচেয়ে বড় আক্রমণের শিকার। কোনও রাস্তা কেন চওড়া করা হবে, সে বিষয়ে কোনও পরামর্শ প্রয়োজনীয় নয়। নির্মাণকারী সংস্থা আর তাদের ঠিকেদারদের সব নেতাই পছন্দ করেন। ডাবল লেন হয়ে যায় ফোর লেন আর ফোর লেন হয়ে ওঠে সিক্স লেন। রাস্তার একটাই বৈশিষ্ট্য। তার মসৃণ গতিময়তা। ট্রাক ওভার টেক করবে, ছোট গাড়িকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবে, এসইউভি ছুটবে একশো কিলোমিটার স্পীডে। তা বোলপুর হোক বা তিরুঅনন্তপুরম। রাস্তা বাড়াতে নির্বিচারে কাটা পড়বে গাছ।
পরিকাঠামো নির্মাণ একটি জনমোহিনী ব্যাপার। এর প্রচার করা যায়, টেলিভিশনে দেখানো যায়, ছবি তুলে বিজ্ঞাপন করা যায়, সেখানে কোথায় লাগে অপুষ্টি আর প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ আর মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বাড়ানো? আমাদের নদী পর্বত অরণ্য সবই পরস্পরে অন্বিত এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের জীবনের সঙ্গে মিলে তারাই নির্মাণ করে জীবন যাপনের উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু পরিবেশ এর জন্য একটি মন্ত্রক থাকলেও তাদের দিক থেকে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য কোনও আগ্রহ দেখা যায়না। বরং শিল্প খনি বাঁধ ইত্যাদি বৃহৎ প্রকল্পকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেবার কাজটি তারা যেন সংগোপনেই সারতে চায়। এ প্রবণতার আরম্ভ গত কুড়ি বাইশ বছর ধরে, বিশ্বায়নের পর্বে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের গতি পরিবর্তনের অনুসরণ করেই, গত এক দশকে এই প্রবণতা আরও তীব্র হয়েছে। তার কারণ মুষ্টিমেয় শিল্প গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের পক্ষপাত এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব। চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে সাম্প্রতিক দুটি ব্যাপার। অরণ্য সুমারি করে সরকার জানাচ্ছেন দেশে অরণ্যের আওতায় এলাকা বেড়েছে। কার্যত এর মধ্যে আছে অনেক সংজ্ঞার জোড়াতালি। শহরাঞ্চলের গাছে ছাওয়া অঞ্চলকে অরণ্য বলে দেখানো হয়েছে। প্লানটেশনকে অরণ্যের আওতায় ধরলে তা প্রকৃত বিচারে ঠিক হয় না। অথচ একই সঙ্গে দেশের প্রাচীন অরণ্য ভূমির আয়তন কমেছে, শিল্প ও খনির জন্য নির্বিচারে অরণ্য এলাকা হস্তান্তরিত করার ফল। অন্যদিকে, যে অরণ্য রক্ষা আইন ১৯৮০ থেকে কিছু দুর্নীতি সত্ত্বেও মোটামুটি একটি মজবুত আইন হিসেবে কাজ করে এসেছে, তাকে সংশোধিত করে নতুন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খসড়া আইনটি এখন সংসদের জয়েন্ট কমিটির কাছে। জনসাধারণের মতামত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বনের সুরক্ষার থেকে বৃক্ষরোপনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিপদ লুকিয়ে আছে এই সংশোধনে। ১৯৮০ ও তারপর যে সব অরণ্য নথিভুক্ত হবে, তারা ছাড়া বহু অনথিভুক্ত অরণ্য শিল্প ও অন্য কাজের জন্য ব্যবহৃত হতে পারবে। এই সংশোধনের কি প্রয়োজন ছিল স্পষ্ট নয়। ধনতন্ত্র যখন উন্নয়ন সংক্রান্ত ব্যাপারে সরকারের প্রধান পরামর্শদাতা হয়ে ওঠে, জনগণের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা বদলে গিয়ে ব্যক্তিগত বা মুষ্টিমেয়ের দখলে চলে যায়। দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে তা ভাল নয়।
পরিশেষে, আরো একবার মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ নামের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যারা উপগ্রহের সাহায্যে অরণ্য অঞ্চলের পরিবর্তন মাপে, জানিয়েছে, গত ২৪ বছরে, ভারত ২০ লক্ষ হেক্টর অরণ্য আচ্ছাদন হারিয়েছে। এই আচ্ছাদন কেবল মানুষের হাতে বনের বিনাশের কারণে নয়, প্রাকৃতিক কারণ যথা দাবানলের জন্যও হতে পারে। কিন্তু চিন্তার কথা, গত ১০ বছরে, ৯০ শতাংশ আচ্ছাদন নষ্ট হয়েছে, প্রাকৃতিক অরণ্য অঞ্চলের ভিতরেই। জঙ্গল সুরক্ষার কাজে এই ধরনের অবহেলা বা দক্ষতার অভাব আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন গ্রাম ও শহরে জনজাতি সম্প্রদায়, যাঁরা বনের উপর নির্ভরশীল এবং সাধারণ মানুষ, যাঁরা উষ্ণায়নের জন্য জীবিকা ও জীবন দুইই হারাতে পারেন। কিন্তু এঁদের জন্য ভাবার সময় কই রাজনীতিক ও নীতি নির্ধারকদের?

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.