বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

জাতি গণনা কেন চাই?

জাতি গণনা কেন চাই?

দেবী চ্যাটার্জী

photo

ভারতে জাতি গণনা বা বর্ণ শুমারি বিষয়টি আজ অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। একে কেন্দ্র করে সারা দেশে ক্রমেই রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে। চায়ের টেবিল থেকে নির্বাচনী প্রচারে সর্বত্রই বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসছে। ২০২৪এর লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকে বিষয়টি বিরোধী শিবিরের বড় অংশের মূল দাবি হয়ে ওঠেছিল। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে সঠিক ভাবে সংরক্ষণ সহ নানা সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়া এর ঘোষিত লক্ষ্য। বিপরীতে, শাসক শিবির খলাখুলি ভাবে জাতি গণনার বিপক্ষে না দাড়ালেও, তার অনীহা স্পষ্ট।

জাতি (Caste) গণনা কী?



প্রথমেই বলা দরকার জাতি গণনা বলতে আমরা কি বুঝি? এর অর্থ হল জন গণনায় জাতিগত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা। কোন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার হার কত, কর্মসংস্থানে জাতিগত প্রতিনিধিত্বের হার, ভূমির মালিকানার জাতিগত পরিসংখ্যান, ইত্যাদি নানা তথ্য নথিভুক্ত করা।
ভারতে দীর্ঘকাল ধরে ধাপে ধাপে সাজানো ক্রমোচ্চ জাতি-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এরই ভিত্তিতে, জাতি অবস্থানের নিরিখে, নির্ধারিত হয়ে এসেছে কে ক্ষমতা ভোগ করবে, কে তা করতে পারবে না, কার বরাদ্দে থাকবে কি সুযোগ সুবিধে। আজও জাতি কাঠামোয় নীচের স্তরে সমাজের যে প্রান্তিক মানুষেরা অবস্থান করেন, তারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও পরিষেবা থেকে বঞ্চিত থাকেন। বলা বাহুল্য, প্রান্তিক হওয়া সুপরিকল্পিত প্রান্তিকীকরণের ফল — কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়।
ভারতে এই জাতি-ভিত্তিক বৈষম্য এবং প্রান্তিকতার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। মনে করা হয়, একটি বর্ণ আদমশুমারি বিদ্যমান বৈষম্যের অভিজ্ঞতামূলক তথ্য প্রমাণ প্রদান করে। সেই তথ্য প্রমাণ সরকার ও সুশীল সমাজকে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতাকে উন্নীত করার লক্ষ্যে হস্তক্ষেপ ও পরিকল্পনা রচনা করতে সক্ষম করে।
ব্

রিটিশ শাসনকালে জাতি গণনা



ব্রিটিশ শাসন কালে ১৮৮১ সালে ভারতে জনগণনা শুরু হয়েছিল। অচেনা এই দেশের মানুষজন সম্পর্কে নানা দিক থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করার ব্যাপারে বিদেশি শাসকদের প্রশাসনিক তাগিদ ছিল। সেই সময়ে জনগণনা ব্রিটিশ শাসকদের অচেনা জনগোষ্ঠীকে চেনার প্রচেষ্টার অন্যতম প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত জনগণনায় জাতিসংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হতো। তারপর থেকে আর জনগণনায় জাতিগত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ১৯৩১ সালের জনগণনায় ভারতে ডিপ্রেসড কাস্ট বাদে ৪,১৪৭ জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব চিহ্নিত হয়েছিল। ১৯৪১-এ ব্রিটিশ শাসনকালে শেষ জনগণনা হয়। তবে সেই সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার ফলে তা অনেকটাই সংক্ষিপ্ত আকারে করা হয়। সেখানে ভিন্নভিন্ন জাতিগুলির তথ্য পৃথক ভাবে প্রকাশিত হয়নি। সব জাতিগুলি ‘হিন্দু’ পরিচিতির আওতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর যে জনগণনা হয় তা হয় স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে। তাতে, তফশিলি জাতি বাদে, অন্যান্য জাতিদের পৃথক তথ্য সংগৃহিত হয় না।

স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতি গণনা



স্বাধীনতা-উত্তর কালে জাতিগণনার বিষয়টি এক অন্য মাত্রা লাভ করে। গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামোয় তা যে যৌক্তিকতা পায়, রাজনৈতিক কার্য্যকারিতার বিচারে তা হয় ভিন্ন। ক্রমেই দেখা যায়, নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতি পরিচিতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলি জাতির নিরিখে হিসাব করলেও, জাতি গণনা প্রসঙ্গে তারা নিজনিজ রণকৌশলের নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে। বলা বাহুল্য, সেই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের পিছনে থাকে নানা ধরনের রাজনৈতিক সমীকরণ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে মন্ডল কমিশনের পটভূমিতে জাতি-ভিত্তিক জনগণনার বিষয়টি সামনে আসতে থাকে। বিশেষ করে, হিন্দি বলয়ে প্রান্তিক ও মধ্য জাতি-কেন্দ্রিক রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এই তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে জোরালো সওয়াল উঠতে থাকে। আবার, অন্য দিকে দেখা যায়, মন্ডল রাজনীতির বিপরীতে বিজেপি সহ অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলগুলি নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্যে হিন্দুত্বের এজেন্ডাকে তুলে ধরার পথে অগ্রসর হয়। রামজন্মভূমি কেন্দ্রিক উন্মাদনা তৈরির উদ্দেশ্যে তাদের দিক থেকে হিন্দু পরিচিতির উপর জোর দেওয়া হয়। আবেদন করা হয়, জাতিগত আবেগকে অতিক্রম করে ধর্মীয় আবেগের কাছে। এটা ছিল একই সঙ্গে বিজেপি সহ অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলগুলির বহুমুখী স্ট্র্যাটেজি। এতে ছিল বিজেপি-র সংখ্যালঘুদের, বিশেষত মুসল্মানদের আঘাত করা, নিম্ন ও মধ্য জাতি-ভিত্তিক রাজনীতি করা দলগুলির বিরোধিতা করা ও নিজেদের সপক্ষে হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ককে ঐক্যবদ্ধ করার স্ট্র্যাটেজি। জাতি গণনা এই স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে খাপ খেতো না শুধু নয়, এই রাজনীতির মোড় হিন্দুমুখী ধারা থেকে বিপরীতে ঘুড়িয়ে দিতে পারতো। ফলে বিজেপি এর বিপক্ষেই থাকে।
ভারতের ২০১১ সালে সামাজিক অর্থনৈতিক ও জাতি শুমারি (SECC) পরিচালিত হয়েছিল। সেই সময়ে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে সংসদের উভয় কক্ষে আলোচনা করার পর আর্থ-সামাজিক ও জাতি শুমারি ২০১১ অনুমোদন দেয়। এটি গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রকের উদ্যোগে করা হয়, ১৯৪৮এর সেন্সাস আইন অনুসারে নয়। এই জাতি শুমারি পরিচালিত হলেও তথ্যে ত্রুটি থাকার কথা বলে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশিত হয় না। একটি কমিটি গড়ে তার হাতে বিবেচনার জন্য দেওয়া হয়, এবং বিষয়টি আর এগোয় না। জাতি-ভিত্তিক সমীক্ষার প্রশ্নটি তখনকার মত কিছুটা ধামা ছাপা পড়লেও,পরবর্তী সময়ে আবার উঠে আসে।
২০২১ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার লোকসভায় জানায় তারা জনগণনাতে তফশিলি জাতি, জনজাতি বাদে অন্যান্য জাতির তথ্য সংগ্রহ করতে আগ্রহী নয়। উল্লেখ্য, ২০২৩এ বিহার ছিল প্রথম রাজ্য যেখানে রাজ্য স্তরে জাতি-ভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

বর্তমান বিতর্কের ভিত্তি ও জাতি গণনার যৌক্তিকতা



২০১১র জাতি-ভিত্তিক জনগণনার পটভূমিতে তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তীব্র মতপার্থক্য ও বিতর্ক ছিল। জাতি-ভিত্তিক জনগণনার পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। খ্যাতনামা আইনের অধ্যাপক উপেন্দ্র বক্সী বলেন, যাঁরা বিপক্ষের অবস্থান গ্রহণ করেন তাঁরা জাতি গণনাকে সুবিধাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে একটি প্রক্রিয়া হিসাবে দেখেন, সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টিতে গৃহীত প্রক্রিয়া হিসাবে নয়। তাঁদের চোখে রাজনৈতিক কার্যকারিতার প্রেক্ষিতে বিষয়টি বিচার্য্য। আবার, জাতি-ভিত্তিক জনগণনার পক্ষের অবস্থান যাঁরা গ্রহণ করেন তাঁরা এটিকে নৈতিক সামাজিক পরিবর্তনের মূল্যবান হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করেন। [BAXI, UPENDRA. “Caste Census and Constitutional Justice.” Economic and Political Weekly, vol. 45, no. 37, 2010, pp. 25–29. JSTOR, http:// www. Jstor. Org/stable/25742065. Accessed 29 Nov. 2024]।
দেখা যায় একদিকে, প্রতাপ ভানু মেহতা [The Indian Express, 2010] জাতি গণনার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এবং তাকে ‘monumental travesty’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। অন্য দিকে, জাতি-ভিত্তিক জনগণনার সমর্থনে দাঁড়ান সতীশ দেশপান্ডে ও মেরি জন-এর মত তাত্ত্বিকরা [Economic and Political Weekly, 19 June 2010]। বিতর্ক আজও সমান ভাবেই বর্তমান।
বাস্তব ক্ষেত্রে জাতি গণনা নানা ধরনের সমস্যর সন্মুখীন হতে পারে। সেগুলির মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল, সঠিক তথ্য সংগ্রহ করার জটিলতা। ব্যক্তির জাতিগত পরিচিতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা আছে। ব্যক্তির ঘোষিত পরিচিতি অনেক সময়, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কারণে, সঠিক হয় না। এ ছাড়াও, তথ্য সংগ্রহকারীর পক্ষপাত তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। অনেকের মনে আশঙ্কা থাকে জাতিগত তথ্য সংগ্রহ ব্যক্তির গোপনীয়তা উপর আঘাত আনবে ও জাতিগত বৈষম্য বাড়িয়ে তুলবে। এও মনে করা হয়, সঠিক ভাবে তথ্য সংগৃহীত হলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণের পরিমাণ বাড়ানোর দাবি উঠতে পারে এবং তা জাতি অশান্তি সৃষ্টি করবে।
বহুবিধ সমস্যা সত্ত্বেও অস্বীকার করা যায় না, জাতিগণনার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির আর্থসামাজিক অবস্থা নির্ণয় করা কিছুটা হলেও সম্ভব হবে, এবং নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে সে তথ্য অতি প্রয়োজনীয়। সেই তথ্য ভিত্তি করে, বিষেশভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীগুলির অগ্রগতির জন্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় আগামী দিনে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা যাবে। ফলে, অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে এবং অনগ্রসর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ প্রদানের জন্য একটি বর্ণ শুমারি পরিচালনা উন্নয়নের বিকল্প মডেল রচনায় আবশ্যক। জাতিগণনার নানা সমস্যা আছে। তার মধ্যে কিছু সমস্যা অবশ্যই জটিল। এ সত্ত্বেও জাতি গণনার গুরুত্ব মানতে হয়। দীর্ঘ দিন সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে জাতি তথ্য সংগৃহীত হয় নি। এই তথ্য ছাড়া বিভিন্ন জাতিভুক্ত মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থানের সঠিক চিত্র ফুটে ওঠে না। অথচ বাস্তবে অনেকাংশেই জাতি অবস্থানই একজন মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থানের নির্ণায়ক। ফলে মানতে হবে বর্ণ শুমারি আবশ্যক। এটি পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা সমস্যাও থাকবে। সমস্যাগুলির সমাধান অনেকটাই নির্ভর করবে প্রশাসনিক তৎপরতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর। বলা বাহুল্য, জনগণের সংগঠিত চাপ ছাড়া এটা সম্ভব নয়।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.