বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১— একটি বাস্তব ঘটনা হাজার রটনার চেয়েও হাজার গুণ শক্তিশালী। যুগের পর যুগ লাগাতার প্রচারের ধাক্কায় রাষ্ট্র সবসময়েই আমাদের মগজে গেঁথে দিতে চায় - "আইনের চোখে সবাই সমান।" কিন্তু বাস্তব ঘটনাবলী সেই প্রচারকে বারবার শুধু উপহাসই করে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে তেমনি দুটো ঘটনা ঘটে গেল ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে, যা এই প্রচারকে একেবারে ধুলিসাৎ করে দিল জনগণের। প্রথম ঘটনা উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ডে। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ৩,৬৯৬ কিলোমিটার দূরে, দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে।
নাগাল্যান্ডে, কনিয়াক নাগা অধ্যুষিত মন জেলায় ওটিঙ গ্রামের ১৩ জন নিরীহ কয়লা খনির শ্রমিককে গুলি করে মারে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ৪ ডিসেম্বর। কোনও দোষই করেনি খনিতে কাজ সেরে ঘরমুখো এই নিরীহ শ্রমজীবী মানুষগুলো। সেনাদের নাকি গোপন সূত্রে ''নির্দিষ্ট খবর'' ছিল, সন্ত্রাসবাদী হামলার! নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মনিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, অসম, এবং মায়ানমারের বিস্তির্ণ অঞ্চল জুড়ে 'নাগালিম' (স্বাধীন নাগাভূমি)-র দাবিতে দশকের পর দশক ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন নাগা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জনগণ।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্রথম দিকে নাগা অধ্যুষিত দূর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীও পা রাখেনি। এই অঞ্চলের মানুষগুলো প্রথম 'বহিরাগত' সাদা চামড়ার মানুষ দেখে ১৮৭৬ সালে, যখন ব্রিটিশরা সৈন্যসামন্ত নিয়ে কোহিমাতে ঘাঁটি গাড়ে। কিন্তু ব্রিটিশের হাত থেকে 'স্বাধীনতা' পাবার পর, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপ্রভুরা ঠিক করলেন, 'ওই অঞ্চলটা আমাদের'! কিন্তু কোন যুক্তিতে? কী কারণে? কবে থেকে? এবং, কী ভাবে শত-সহস্র বছর যাবৎ স্বাধীন আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর এই পাহাড়ী বাসভূমি হঠাৎ ক'রে 'ভারতভুক্ত' হয়ে পড়লো? এসব কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর আজও পাওয়া যায় না! কংগ্রেস, বিজেপি, বা অন্য কোনও কেন্দ্রীয় শাসক দল, কেউই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে কোনও দিনই আগ্রহী নয়। "সবাই জানে, নাগাল্যান্ড ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।" ব্যাস, আর কোনও কথা হবেনা!
ছয় দশকেরও বেশি সময় যাবৎ স্বাধীনচেতা আও, আঙ্গামী, কনিয়াক, সেমা, চিরু, চাখেসাং, লোথা ইত্যাদি ১৬-টি নাগা-ভাষাভাষি আদিবাসী মানুষ অবর্ণনীয় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন-অত্যাচারে পিষ্ট হচ্ছে! মনে হয়, 'সভ্যতা'-র আধুনিক ঠিকাদারেরা কেউই তাঁদের 'মানুষ' হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে রাজি নয়! মানুষগুলোর বোধ ও আকাঙ্ক্ষাকে বিন্দুমাত্র সম্মান করার প্রয়োজনীয়তাও কোনও দিন এরা অনুভব করেনি। তাই বিমান থেকে যথেচ্ছ বোমাবর্ষণ ক'রে গ্রামের পর গ্রাম মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া; শতশত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা; যখন ও যেমন খুশি অত্যাচার চালানো; সামরিক বাহিনীর দাপটে অসহায় জনগণকে সর্বদা সন্ত্রস্ত ক'রে রাখা— সবই 'নাগাল্যান্ড'-এর দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা!
'গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ'(!)মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রের তাঁবেদারিতেই আগ্রহী; নাগাদের উপর এই বর্বর আচরণ সম্পর্কে নীরব থাকাই তারা পছন্দ করে। রাষ্ট্রের আনুকূল্য পেতে আগ্রহী বিদ্বজ্জনেরাও এসব ব্যাপারে চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন। তাই, দেশের ব্যাপক জনগণ যুগযুগ ধরে চলা এইসব বর্বরতার কথা সাধারণত জানতেই পারেন না। যেসব গবেষক নাগাদের দৈহিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আন্তরিক, গভীর ও কষ্টকর গবেষণা চালিয়েছেন; তাঁদের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তগুলি রাষ্ট্রের এই জনবিরোধী মানসিকতাকে আদৌ প্রভাবিত করতে পারেনি।
পুরো অসম, অরুণাচল প্রদেশের তিনটি জেলা এবং দুটি থানা, ইম্ফল মিউনিসিপ্যাল অঞ্চল বাদে পুরো মনিপুর, এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মতো, পুরো নাগাল্যান্ডেও বর্বরতম 'আফস্পা' (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট) জারি রয়েছে দশকের পর দশক। ''সংসদের অনুমোদন" নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরেও এই আইন লাগু হয়েছে ১৯৯০ সালে। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ তাদের উপর উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা ভারতীয় শাসকদের মোড়লি কোনওদিনই মানতে পারেননি। তাই সবসময়েই তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন এবং করেই চলেছেন। তাঁদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দমনের জন্য ১৯৫৮ সালেই ভারতবর্ষের 'গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট' এই বর্বর 'আফস্পা' আইন পাশ করেছিল। এই আইনে খুশিমতো হত্যা, অত্যাচার, তল্লাশি ইত্যাদি সবরকম অমানবিক কাজেরই অধিকার দেওয়া রয়েছে সেনাবাহিনীকে। মিজোরামের মতো যে অঞ্চল এখন আর 'আফস্পা'-র আওতায় নেই, এই আইনের আওতায় থাকার সময়ে একই বিভৎসতার শরিক ছিল তাঁরাও। অন্যান্য যেসব অঞ্চলে এখনও জারি আছে, তাঁরা সকলেই কমবেশি একই যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার শরিক। এই আইনের ঢাল থাকার সুযোগেই, ৪ ডিসেম্বর নির্বিচার হত্যাকান্ডে খুন হওয়া নিরীহ কনিয়াক নাগা শ্রমিকদের হাতে রাইফেল গুঁজে দেবার চেষ্টা; তাদের পোষাক পাল্টে দেওয়া; লাশ নিয়ে চলে যাওয়া; প্রতিবাদী স্থানীয় মানুষদের গুলি করে হত্যা— ইত্যাদি যা-ইচ্ছে তা-ই তান্ডব চালিয়েছে তারা।
উল্লেখযোগ্য বিষয়, নাগাল্যান্ড-পুলিশের তরফ থেকেও "ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকাণ্ড" ঘটানোর জন্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। রাজ্য-বিজেপির সভাপতি তেমজান আমমা আলঙ-ও এই ঘটনাকে গণহত্যা বলে নিন্দা করেছেন।
ভারতবর্ষের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রবলপ্রতাপশালী বিজেপি নেতা অমিত শাহ বলেছেন, "এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য গভীর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি।" বর্বর এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের জন্য দায়ী সেনাদের শাস্তি, কিম্বা দানবীয় 'আফস্পা' প্রত্যাহারের জন্য জনগণের তরফ থেকে উত্থাপিত দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক দাবির বিষয়ে অবশ্য তাঁর উদ্বেগের কোনও প্রকাশ ঘটেনি!
নাগাল্যান্ডে শ্রমিক-হত্যার এই ঘটনার চারদিন পরে ৮ ডিসেম্বর, তামিলনাড়ুর কুন্নুরে ভেঙে পড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি অত্যাধুনিক, একশো তেইশ কোটি টাকা দামের রাশিয়ান হেলিকপ্টার। এই ঘটনাতেও কাকতালীয় ভাবে মারা যান ১৩ জন সেনা অধিকর্তা। এঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর প্রথম সর্বাধিনায়ক বিপিন সিং রাওয়াত। ২০১৫ সালে, মায়ানমারে ঢুকে নাগা জঙ্গীদের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনী যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং রাওয়াত।
সেনাবাহিনীর হাতে দেশের সম্পদ সৃষ্টিকারী ১৩ জন শ্রমিকের বর্বর হত্যাকান্ডেও যাঁদের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি, এবারে তাঁদের বিবৃতির জোয়ার শুরু হল। রাষ্ট্রপতি ট্যুইট করে বললেন, "দেশ হারালো এক সাহসী সন্তানকে।" প্রধানমন্ত্রী ট্যুইটে লিখলেন, "দেশ হারালো সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, সাহসী সন্তানকে। ওঁর অকালমৃত্যু আমার কাছে এক বিরাট ক্ষতি।" প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ট্যুইট ক'রে জানালেন, "বিপিন সিং রাওয়াতের অকাল মৃত্যু আমাদের বাহিনী ও দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি।" কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবারে বললেন, "দেশের জন্য আজ বড়ই শোকের দিন।"
নিজেদের মেহনতে দেশের সম্পদ সৃষ্টিকারী নিহত শ্রমিকরা "দেশের সাহসী সন্তান'' ছিলেন কিনা, বা তাঁদের ''সত্যিকারের দেশপ্রেমিক'' বলা যায় কিনা, কিম্বা তাঁদের মৃত্যু ''দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি'' কিনা, অথবা তাঁদের খুন হবার ঘটনা ''দেশের জন্য বড়ই শোকের দিন'' কিনা, - এই কেন্দ্রীয় নেতারা তা অবশ্য বলেননি!
মায়ানমার লাগোয়া মন জেলায় আসাম রাইফেলসকে দিয়ে নাগাল্যান্ডের শ্রমিকদের খুন করায়, কেমন যেন জাতিতে-জাতিতে দ্বন্দ্ব-ঘৃণা-সংঘাত-সংঘর্ষ বাধাবার এক গভীর ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে মনে হয়! অসমিয়া শব্দ 'নোগা' (যার অর্থ পাহাড়ের অধিবাসী) থেকেই 'নাগা' নামের উৎপত্তি বলে গবেষকদের অনেকের অনুমান। সেই অসমিয়া ও নাগাদের মধ্যে বৈরিতা বৃদ্ধির কোনও ধুরন্ধর কৌশল হিসাবেই 'আসাম রাইফেলস'-কে দিয়েও এই হত্যাকান্ড ঘটানো হল কিনা, তার উত্তর হয়তো ভবিষৎ দেবে! তাছাড়া, প্রায় কুড়ি লক্ষ জনসংখ্যার রাজ্য নাগাল্যান্ডে ৯০% মানুষই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী, যাঁরা 'হিন্দুত্ব'-র দর্শনে গভীরভাবে আস্থাশীল আরএসএস-এর বিচারে 'শত্রু' হিসাবে চিহ্নিত। এই হত্যাকান্ডে সেই 'দর্শন'-এর কোনও প্রভাব আছে কিনা, সেটাও বিচার্য। তবে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় যাবৎ নাগা-পাহাড়ের আদিবাসী সমাজ হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছে: "সবকা সাথে, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্ওয়াস"-এর বাণী আওড়ালেও, ভারত-রাষ্ট্র তাঁদের 'সাথ'-এও নেই; তাঁদের 'বিকাশ'-ও চায় না; তাঁদের 'বিশ্ওয়াস' অর্জনের জন্যে কোনও মাথাব্যথাও রাষ্ট্রপ্রভুদের নেই। কনিয়াক আদিবাসী সংগঠনের সহ-সভাপতি হোনাঙ কনিয়াক বলেছেন, "আমাদের সহানুভূতির দরকার নেই। সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিবৃতিতে ভুল তথ্য বিশ্বকে বিভ্রান্ত করবে। তাঁর বিবৃতি অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। আমাদের দাবি, তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করুন। ১৩ জন কনিয়াক যুবককে যারা খুন করেছে, তাদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।" ('সুখবর', কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর ২০২১, পৃ: ৫) কনিয়াক সংগঠনের মূল দাবি, "আফস্পা প্রত্যাহার করতে হবে।" একই দাবি তুলেছেন নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিও এবং মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা, দু'জনেই।
প্রতিমুহূর্তে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার নাগাদের কাছে ভোট কিম্বা পার্লামেন্ট কখনোই 'গণতন্ত্র'-র সুবাতাস পৌঁছে দেয় না। তাঁদের কাছে বংশানুক্রমিক ভাবে নিজেদের জন্মভূমিতে স্বাধীনভাবে, অত্যাচারহীন, মর্যাদাপূর্ণ পাহাড়ী মুক্ত-জীবনই কাম্য; যা "বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ"-এ অধরাই থেকে যাচ্ছে!
"বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র"-র আওতায় থাকা নাগাল্যান্ডে আজও দেখা যায়, শিশু জন্মালে এমন নাম রাখা হয়েছে যার মানে, "যে স্বাধীনতা চায়"। সেনাবাহিনীর হাতে নাগাল্যান্ডে শ্রমিক হত্যা এবং তার পরপরই দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ সেনাধ্যক্ষের মৃত্যু, এ'প্রসঙ্গে সমাজমাধ্যমে নানা মন্তব্যের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়লো "Divine Justice"-এর মতো বিতর্কিত শব্দটাও! নাগাল্যান্ডে মানবাধিকার হরণকারী সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ আধিকারিকের শেষকৃত্য যেদিন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হ'লো (১০ ডিসেম্বর), সেই দিনটাও আবার ছিলো 'বিশ্ব মানবাধিকার দিবস'!
কী অদ্ভুত সমাপতন! 'ইতিহাস' সত্যিই বড় রসিক!