বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
[কমিউনিস্ট এবং কমিউনিস্ট-বিরোধীদের মধ্যে যে ধারাবাহিক সংগ্রাম চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে, চরিত্রগতভাবে তা আসলে শ্রেণীসংগ্রাম। শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণীর, প্রগতির সঙ্গে স্থিতাবস্থার যুদ্ধ। মূলত আদর্শগত লড়াই। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষ সহ সারা পৃথিবী জুড়েই এ'কথা সত্য। এ'লড়াই কখনও চলে ব্যারিকেডে গোলাগুলির মাধ্যমে; কখনও হয়তো ছোটখাটো সংঘর্ষের পথে; কখনও আবার লৈখিক বা মৌখিক প্রচারের মাধ্যমে। সরাসরি সংঘর্ষ ঘটে বিভিন্ন সময়ে; কিন্তু প্রচারের লড়াই কখনও হয় খুব জোরদার কখনও একটু ধীরগতি, তবে তা চলে অবিরাম।]
ভারতবর্ষের বুকে কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচার যুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অগাস্ট মাস। কখনও এই আক্রমণের উপলক্ষ্য ১৯৪২ সালের 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন' বা 'অগাস্ট বিপ্লব', কখনও আবার ১৯৪৭ সালের 'স্বাধীনতা দিবস'। কমিউনিস্ট-বিরোধীদের অভিযোগ, কমিউনিস্টরা নাকি সবসময়ে কার্যত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদেরই সেবা করেছে! হাজার হাজার কমিউনিস্ট কর্মীর রক্তে ও স্বার্থত্যাগে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চিররঞ্জিত হয়ে আছে। অথচ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে 'দেশদ্রোহিতা'-র অভিযোগে সোচ্চার প্রধানত সেই শক্তি, যারা জন্মলগ্ন থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট, সহযোগী এবং দালাল।
দু'একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন ও আরএসএস
বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের হাবভাব বলছে, ভারতবর্ষে এখন কার্যত একমাত্র 'দেশভক্ত' দলের নাম ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। এই রাজনৈতিক দলটি নিঃসন্দেহেই বর্তমানে ভারতবর্ষের নির্বাচনী রাজনীতির আঙিনায় সবচেয়ে বড় দল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৩০১ আসনে জয়ের সুবাদে এদের হাতেই এখন ভারত-শাসনের ভার। যে সংগঠনটির উদ্যোগে ও নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক দলটির জন্ম এবং যাদের মতাদর্শ নিয়েই এরা চলে, তার নাম রাষ্ট্রীয় সয়ংসেবক সঙ্ঘ, সংক্ষেপে আরএসএস। এই আরএসএস সংগঠনটির সর্বোচ্চ পদের নাম 'সরসঙ্ঘচালক'। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস-এর প্রথম সরসঙ্ঘচালক তথা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার-এর (১৯৪০ সালে) মৃত্যুর পর, দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক হয়েছিলেন মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর বা 'গুরুজি'। পরবর্তীকালের কোনও নেতৃত্ব কিম্বা চুনোপুঁটিদের কথা বাদ দিয়ে, এই দুই প্রধান নেতার মতামত - যা আজও বিজেপি'র মূলমন্ত্র - থেকেই বোঝা যেতে পারে এদের 'দেশভক্তি'-র নমুনা।
'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের সময়ে (১৯৪২), আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক ছিলেন গোলওয়ালকর। সঙ্ঘের প্রকাশিত বই থেকেই আমরা জানতে পারি, "শ্রী গুরুজি নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেছিলেন যে, এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা উচিত কি না।" এবং তাঁর "স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টি" অনুযায়ী "সংগঠন হিসাবে সঙ্ঘ, এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে না-পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।" (Shri Guruji: Pioneer of A New Era; C.P. Bhishikar, Sahitya Sindhu Prakashana, Bangalore - 560 001, 1999, pp: 52-53) বিজেপি দলের অন্যতম নেতা, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাংসদ শ্রী অরুণ শৌরি মশাই একসময়ে কলম ধরেছিলেন, 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে কমিউনিস্টদের 'সেরা বিশ্বাসঘাতকতা' প্রমাণ করার তাড়নায়। ('The Great Betreyal', in The Illustrated Weekly of India, March 28-24, 25-31, and April 1-7, 1984 দ্রষ্টব্য।) ১৯৪২ সালে তিনি ছিলেন ১ বছরের শিশু। পরবর্তীকালে কট্টর কমিউনিস্ট-বিরোধী। নানা তথ্য সহযোগে তিনি এই কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচার চালিয়েছিলেন। হয়তো তখনও বুঝতে পারেন নি, পনেরো বছর পরে তাঁরই অতি শ্রদ্ধেয় 'সঙ্ঘ' প্রকাশিত পুস্তক মারফত খোদ 'শ্রী গুরুজি'-র এই চরম বিশ্বাসঘাতকতা এ'ভাবে জনগণের সামনে নগ্ন হয়ে পড়বে।
'ভারত ছাড়ো আন্দোলন' যখন শুরু হয়, তখন পুরোদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধের একদিকে ছিল প্রধানত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, গ্রেট ব্রিটেন ও আমেরিকার মিলিত 'মিত্রশক্তি'। বিপরীত দিকে ফ্যাসিবাদী জার্মানি, ইটালি ও জাপানের মিলিত 'অক্ষশক্তি'। এই যুদ্ধে যোশেফ স্তালিনের নেতৃত্বে পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অকল্পনীয় ও অভূতপূর্ব বীরত্ব, ত্যাগ ও ধ্বংসযজ্ঞের বিনিময়েই সে'দিন ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন ও তান্ডবের হাত থেকে মানবসভ্যতা রক্ষা পেয়েছিল। কমিউনিস্ট-বিরোধীদের হাজারো মিথ্যাচার ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রচার সত্ত্বেও, সমাজতন্ত্রের কপালে আগামী ইতিহাসের জন্য শ্রমজীবী মানুষের আশীর্বাদধন্য জয়টিকা আঁকা হয়ে গেছে।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী গ্রেট ব্রিটেন ও আমেরিকার এই যুদ্ধ-কেন্দ্রিক জোট নিয়ে অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের বন্যা শুরু হয়েছিল তখনই। বাস্তবতা-বোধহীন 'প্রগতিশীল' এবং সচেতন-শয়তান 'পণ্ডিত'-দের সেই প্রচার-যুদ্ধ আজও চলছে। মানবসভ্যতার কমিউনিস্ট রক্ষক কমরেড স্তালিন ঠিক সেই ১৯৪২ সালেই বলেছিলেন:
মতাদর্শের এবং সমাজ ব্যবস্থার বিচারে অ্যাংলো-সোভিয়েত-আমেরিকান দেশগুলোর পার্থক্য অস্বীকার করতে যাওয়াটা হাস্যকর। কিন্তু এই পার্থক্য কী সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে, যে শত্রু সকলকেই পরাজিত ও পদানত করতে চায়, শরিক দেশগুলির জোটবদ্ধ লড়াইয়ের সম্ভাবনার ও উপযোগিতার সামনে কোনও বাধা? অবশ্যই না। বরং এই হুমকির সামনে তাদের যৌথ কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তাকেই তা নির্দেশ করে। আদিমতা ও মধ্যযুগীয় বর্বরতার যুগে ফিরে যাওয়া থেকে মানুষকে তা রক্ষা করবে। হিটলারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং তাকে পরাজিত করার জন্য এই কোয়ালিশনই যথেষ্ট। (Speech on the Twenty-Fifth Anniversary of the October Revolution, to the Moscow Soviet and Representatives of Moscow Party and Public Organization's, November 6, 1942. Quoted in A Documentary History of Communism, Vol. 2, [Communism and the World]; Ed. by Robert V. Daniels, L. B. Tauris & Co. Ltd., London, 1985, p: 123.)
কমরেড স্তালিনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের ঐতিহাসিক মহাপরাজয়ের পর থেকে, হিটলারের গুণমুগ্ধ এবং ফ্যাসিষ্ট মানসিকতাসম্পন্ন শিষ্যগণ যে হিতাহীতজ্ঞানশূণ্য হয়ে দুনিয়াজুড়েই কমিউনিস্ট বিরোধিতায় তীব্রভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে, সেটা খুবই স্বাভাবিক।
'শ্রী গুরুজি'র "স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টি"-তে অনুপ্রাণিত 'দেশভক্ত' সঙ্ঘী'রা যখন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের কাছে সুবোধ বালক হয়ে, আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে গরু-গোবর-গোমূত্র নিয়ে চর্চায় ব্যস্ত, তখন 'দেশদ্রোহী' কমিউনিস্ট কর্মীরা কী করছেন?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ভারতবর্ষের কমিউনিস্টদের সামনে একই সঙ্গে দু'টো কর্তব্য হাজির করেছিল। ১) দেশের মাটিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। এবং ২) আগ্রাসী ও সভ্যতাবিরোধী হিটলারী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে, (সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ) 'মিত্রশক্তি'-কে সমর্থন যোগানো। কারণ অসভ্য ও বর্বর ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করাই ছিল তখন মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার উপায়। দেশের জনগণের উপর শোষণ-অত্যাচারকারী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, কমিউনিস্টরা কখনোই তাঁদের আন্তর্জাতিক কর্তব্যকে ছোট করে দেখতে পারেন না। কারণ, যে কোনও দেশের স্বাধীনতাকামী কমিউনিস্টরা একইসঙ্গে পৃথিবী জুড়ে মানবমুক্তির লক্ষ্যে অবিচল ভাবে সংগ্রামরত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সেনাবাহিনীর একজন সদস্যও বটে। তার জন্য তাঁরা গর্বিত; সেটাই তাঁদের গভীর অনুপ্রেরণা। তাই, ভারতের কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থে লাগাতার আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও, একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষা করার স্বার্থে, সে'সময়ের যুদ্ধকে "জনযুদ্ধ" ঘোষণা করতেও তাঁরা এতটুকুও কুন্ঠিত হননি। একদিকে বিশ্ব-সমাজতন্ত্রের স্বার্থে 'জনযুদ্ধ'-র প্রচার, পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া - এই ছিল ভারতবর্ষে তখনকার কমিউনিস্টদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের দু'বছর আগেই (১৯৪০) বাংলার গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে 'তেভাগা' আন্দোলন শুরু হয়। যেমন, খুলনা জেলার মৌভোগ-ঘাটভোগ অঞ্চলে। "বাঙলার আর কোথাও-ই তখনও 'তেভাগা' হয় নি। ওখানে আঞ্চলিক ভিত্তিতে চুক্তি হয় জোতদারদের সঙ্গে। প্রধানত চুক্তি হল - যে বিধবাদের তিন বিঘে জমি, চাষিরা তাদের অর্ধেক দেবে; তার উপরে যাদের জমি আছে, তাদের দেবে তিন ভাগের একভাগ।" (১৯৩৭ সালের পার্টি সদস্য কমরেড সুবল মিত্র-র স্মৃতিচারণ।) কোথাও চলছিল 'ফসল বাড়াও' আন্দোলন; কোথাও জমিদারদের বে-দখলে থাকা পতিত জমি উদ্ধার করে 'খালকাটার আন্দোলন', ইত্যাদি। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বাংলার ব্যাপক অঞ্চলে এইসব আন্দোলন-সংগ্রামকে মোকাবিলা করতে ব্রিটিশ সরকারের তৎপরতাও তুঙ্গে ওঠে। ঢাকায় বিপ্লবীদের গুলি খেয়েও বেঁচে যাওয়া কুখ্যাত পুলিশ সুপার হাডসনের ব্যক্তিগত নেতৃত্বে খুলনায় কমিউনিস্টদের ওপরে চলে খানাতল্লাসি, গ্রেপ্তার, অত্যাচার, বহিস্কার, অন্তরীণ ইত্যাদীর দাপট। (১৯৩৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কমরেড সন্তোষ দত্ত-র স্মৃতিচারণ।) কৃষক আন্দোলনের সেই পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ, গোয়েন্দা, জমিদার-জোতদারদের স্তাবক বাহিনী, এবং "… 'ভদ্রলোক' সমাজের সাধারণ বিরোধিতার মুখে কৃষিবিপ্লবের স্বপ্নকে রূপায়িত করার লক্ষ্যে" কমিউনিস্টদের অদম্য প্রয়াস পুরোপুরি জারি ছিল (১৯৩৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কমরেড সুনীল ঘোষের স্মৃতিচারণ।)
'জনযুদ্ধ'-র লাইন এবং কমিউনিস্ট-বিরোধীদের প্রচার, এই দু'য়ে মিলে জনগণের মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রভাব বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পার্টির তখন "অবস্থা জটিল - প্রায় নিঃসঙ্গ" (কমরেড কমল চ্যাটার্জির ভাষা)। জাতীয় কর্তব্য এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব হাজির হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সামনে, তা এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ী তখন লিখেছিলেন, "কথা নয়, প্রত্যক্ষ কাজের মধ্য দিয়া দেখাও, ইউরোপ-আমেরিকার ফ্যাসিস্ট-বিরোধী জনগণের যুদ্ধ তুমিও লড়িতেছ - তাহা হইলে তোমার দাবীর পিছনে তাহাদের ক্রম-বর্দ্ধমান সমর্থন নিশ্চয়ই লাভ করিবে।" (উত্তাল চল্লিশ - অসমাপ্ত বিপ্লব; অমলেন্দু সেনগুপ্ত, পার্ল পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৯৮৯, পৃ: ৯ দ্রষ্টব্য।) কমিউনিস্ট-বিরোধীদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও, জনগণের মধ্যে কমিউনিস্টরা ধারাবাহিকভাবে মাটিকামড়ে পড়ে থেকে শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এবং, "দুর্ভিক্ষ ও জিনিসপত্রের আকালের সময় কমিউনিস্টরাই একমাত্র শক্তি যারা মানুষের জন্য লড়াই করেছে।" বিপুল সংখ্যায় আত্মবলিদান দিয়েছেন। তথ্য থেকে জানা যায়, "গড়ে তিনদিন অন্তর একজন করিয়া পার্টি কমরেড মরিতেছে। কলেরা ও বসন্তরোগেই সব চেয়ে বেশি কমরেড মারা গিয়াছেন।"
যে কোনও রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির তুলনায়, জনগণের স্বার্থে সেদিন কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগ ছিল তুলনাহীনভাবে বেশি। ফলে, সাময়িক অসুবিধা কাটিয়ে উঠে, কৃষক সমাজ এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে তাঁদের দেশপ্রেমিক শিকড় অক্ষতই থেকেছে।
স্বাধীনতার জন্য 'দেশভক্ত'-দের ভূমিকা!
'দেশভক্ত' বিজেপি দলের দেশপ্রেমের নমুনা ভারতবাসী হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছে। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক ভিত্তিতে তীব্র সাম্প্রদায়িক সন্দেহ, ঘৃণা ও হানাহানির বৃদ্ধি; যুগযুগ ধরে জনগণের অর্থে গড়ে ওঠা বিশাল বিশাল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগগুলোকে কিছু উমেদার ব্যক্তির হাতে জলের দরে বেচে দেওয়া; কর্মহীন ও বাস্তুহারা মানুষের স্ংখ্যায় বিপুল বৃদ্ধি; একদিকে দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ কমিয়ে দেওয়া এবং অপরদিকে আত্মহত্যার আতঙ্কজনক বৃদ্ধি; খাদ্যহীনতা, চিকিৎসাহীনতা, শিক্ষাহীনতার বাড়বাড়ন্ত… সবই এদের সঙ্ঘীয় দেশপ্রেমের ফসল! লক্ষ্যণীয়, ভারতজুড়ে জনসাধারণের এই দুরবস্থা বৃদ্ধির সঙ্গে সমানতালে বেড়ে উঠছে 'গো-মাতা'র সন্তানদের উদ্যোগে গরু-গোবর-গোমূত্রের মাহাত্ম্য প্রচার।
হেডগেওয়ার-এর একটি চরম ধোঁকাবাজি পূর্ণ বক্তব্য হল, "আমার সামনে একটিই চূড়ান্ত লক্ষ্য- ব্রিটিশদের তাড়ানো।" 'সঙ্ঘ' এই বক্তব্যকে মহা উল্লাসে প্রচার করে তাঁর "সংগ্রাম"-এর নমুনা হিসাবে। কিন্তু, একজন 'হিন্দু ভদ্রলোক'-এর প্রশ্নের জবাবে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান, "জঙ্গল সত্যাগ্রহ এবং গরু বাঁচানোর জন্য সত্যাগ্রহ, দুটোই আমার কাছে সমান পবিত্র কর্তব।" (Dr. Hedgewar The Epoch-Maker: A Biography; Sahitya Sindhu Prakashana, Bangalore, 2012, p: 114 দ্রষ্টব্য।) এঁরই ভাবশিষ্যগণ আজকের 'দেশভক্ত' বাহিনী।
কয়েক বছর ধরে অনেক হিসেবনিকেশ করার পর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাংলাকে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভাগ করতে চেষ্টা করেছিল ১৯০৫ সালে। কিন্তু বাঙালির গভীর আবেগ এবং তীব্র আন্দোলনের ফলে তাদের সেই বাংলাভাগের ধূর্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয। পরে যখন মহম্মদ আলি জিন্নাহ্'র নেতৃত্বে উগ্র মুসলমান-শক্তির এবং জওহরলাল নেহরু-বল্লভভাই প্যাটেল-শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীদের নেতৃত্বে উগ্র হিন্দু-শক্তিগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতার গ্যারান্টি পাওয়া গেল, তখনই (অগাস্ট ১৯৪৭) 'ভারতভাগ'-এর নামে বাঙালি ও পাঞ্জাবি জাতি দু'টিকে ভাগ করতে পারলো ব্রিটিশ শাসকরা। কিন্তু 'দেশভাগ'-এর জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্তাবক 'দেশভক্ত' বাহিনী আজও শাসকদের দায়ী করে না। 'দেশভাগ'-এর সাম্রাজ্যবাদী সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্য, "Events beyond the control of Britain had compelled her to take that course." (The Tragic Story of Partition; H.V.Seshadri, Sahitya Sindhu Prakashana, Bangalore, 2013, p: 227 দ্রষ্টব্য।)
৪২ বছর ধরে বাঙালি জাতির সর্বনাশ করতে যারা তৎপর ছিল, সেই লক্ষ্যে ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে গেছিল যে ব্রিটিশরা, তাদের নাকি কিছুই করার ছিল না! বাঙালির সর্বনাশকারী 'হিন্দু'-দের তো কোনও দোষ থাকতেই পারে না! অর্থাৎ, একমাত্র দায়ী মুসলমানরা!
ব্রিটিশের বিদায়লগ্নে কমিউনিস্ট পার্টি আওয়াজ তুলেছিল - "ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়।" অর্থাৎ, মানুষ স্বাধীনতা পায়নি। সে শ্লোগান ঠিক ছিল না ভুল, তা নিয়ে আজও বিতর্ক চলে। কিন্তু বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধার খেদোক্তি, "ইংরেজ আমলেই ভালো ছিলাম!" - ৭৪ বছরের স্বাধীনতাকে গৌরবান্বিত করে তো!
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার লিখেছেন:
কোনও ঐতিহাসিক রচনা পড়ার সময়ে [ঐতিহাসিকের] মনের মধ্যেকার গুঞ্জন শোনার জন্য সবসময়েই কান খাড়া রাখুন।… তথ্যগুলো বিশাল এবং কখনও কখনও অনধিগম্য এক মহাসাগরে সাঁতরে বেড়ানো সব মাছের মতো। ঐতিহাসিক সেখান থেকে কী ধরবেন… তা ঠিক হয় তিনি কী ধরনের মাছ ধরতে চান তা দিয়ে। যে ধরনের তথ্য তিনি চান, কমবেশি সে ধরনেরই তথ্য তিনি পাবেন। ইতিহাস মানেই হ'ল [সংগৃহীত তথ্যের] ব্যাখ্যা।" (What is History; E.H.Carr, Penguin Books, 1985, p: 23 দ্রষ্টব্য।)
"সেরা বিশ্বাসঘাতকতা"-র লেখক, গোঁড়া কমিউনিস্ট-বিরোধী শ্রীযুক্ত শৌরি মশাই সম্পর্কে এ'কথা চমৎকার ভাবে প্রযোজ্য।