ডা. আশিস মিত্তালের সঙ্গে কথোপকথন
ডা. আশিস মিত্তালের সঙ্গে কথোপকথন
শ্রমজীবী ভাষা
শ্রমজীবী ভাষা ১ জানুয়ারি, ২০২২— মোদি সরকার তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করলে কৃষক আন্দোলনের প্রাথমিক জয়ের পর ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ শ্রমজীবী ভাষার পক্ষ থেকে সারা ভারত কিসান মজদুর সভার সাধারণ সম্পাদক ডা. আশিস মিত্তালের সঙ্গে অনলাইনে নানা বিষয়ে প্রশ্ন ও আলোচনা করা হয়। তার নির্যাস এখানে প্রকাশ করা হল।
কৃষক আন্দোলনের পটভূমি
নয়া অর্থনীতির সময়পর্বে কৃষকরা গভীর সঙ্কটে পড়ে— ঋণগ্রস্ততার সমস্যা, কৃষি উপকরণের দামবৃদ্ধির সমস্যা, এমএসপি না পাওয়ার সমস্যা, আত্মহত্যার সমস্যা কৃষকদের গভীর সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ছিল না। কৃষি উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। তার থেকে বের হতে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের রাস্তা নেয় সরকার। যা কৃষি উৎপাদনের খরচ আরও বাড়িয়ে দেয় এবং কৃষকদের আরও গভীর সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেয়। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দেশের কৃষি ব্যবস্থার সঙ্কট মেটানো হবে বলে দেশজুড়ে একটা প্রত্যাশা তৈরি করেছিল। কিন্তু মোদি ক্ষমতায় বসার পর স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মতো এমএসপি দিতে অস্বীকার করে। ২০১৭ সালে এসে দেখা গেল মধ্যপ্রদেশের মান্দসৌর বা মহারাষ্ট্রে এমএসপি নিয়ে বড় আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পাঞ্জাবেও খুব বড় ধরনের আন্দোলন হয়েছিল কৃষি ঋণ মকুবের দাবিতে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাবে ১০-১২টি কৃষক সংগঠনকে নিয়ে একটা বড় ধরনের ঐক্য গড়ে ওঠে। এছাড়া জমির দাবিতে পাঞ্জাবে দলিত, ভূমিহীনদের মধ্যেও আন্দোলন গড়ে ওঠে। সব মিলিয়ে গ্রাম ভারতের পরিস্থিতি ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছিল। মনরেগা কর্মসূচি দিয়ে গ্রামীণ গরিবদের কর্মসঙ্কট সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। ৩ থেকে ৪ কোটি নির্মাণ কর্মী স্থিতাবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন। এসবগুলোকে জুড়লে দেশের গ্রামাঞ্চলগুলিতে নানা পেশার মানুষের ক্রোধ ফেটে পড়ার একটা পশ্চাৎভূমি নজরে আসে।
আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয় পাঞ্জাবে
পাঞ্জাবে কৃষক সমাজ আগে থেকেই সক্রিয় ছিল। এই সক্রিয়তা কৃষক আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেছিল। কৃষকেরা রাস্তায় নামায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল গুরুদোয়ারাগুলিও। কৃষকেরা বুঝেছিলেন যা দিন আসছে তাতে জমি, মান্ডি, তাঁদের আয়—সবকিছুই চলে যাবে কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে। ইতিমধ্যেই জমি দখল করে শস্যভাণ্ডার তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছিল কর্পোরেট গোষ্ঠী। এসব দেখে পাঞ্জাবে ক্রমশই এই মনোভাব তৈরি হচ্ছিল যে কোনও ভাবেই কর্পোরেটকে জমি ছাড়া যাবে না। ২০২০ সালের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঞ্জাবে চলেছিল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব। শেষ পর্যন্ত ২০ নভেম্বর ২০২০ তারিখে দিল্লির সীমানায় এসে ঘাঁটি গাড়েন কৃষকেরা।
কৃষকদের অনমনীয় মনোভাব ও আন্দোলনের ব্যাপ্তি
মোদির তিন কৃষি আইন ছিল এই আন্দোলনের ওপর একটা ধাক্কা। সরকার চেয়েছিল এক ধাক্কায় পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দিতে। কিন্তু ধীরে ধীরে সর্বভারতীয় সমর্থন চলে আসে পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের পক্ষে। একে একে অন্য রাজ্যের কৃষকেরাও আন্দোলনে যোগ দেন। ফলে আন্দোলনের চরিত্র হয়ে পড়ে সর্বভারতীয়। শুরু থেকেই আন্দোলনকারীরা ছিল শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলনের পক্ষে। তবে তারা ছিল অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমনকি করোনাকেও ভয় পায়নি এই আন্দোলন। উল্টে ক্রমশ ধীরে ধীরে আরও শক্তি সঞ্চয় করে। কারণ তাদের দেখে সমাজের অন্য নিপীড়িত অংশও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। শুরুতে আন্দোলনের শক্তি ছিলেন শিখ কৃষকেরা। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের তরাই এলাকা, রাজস্থানের গঙ্গানগর— এসব এলাকার শিখ কৃষকেরা আন্দোলনে যোগ দেন। ফলে আন্দোলন ছড়াতে থাকে। পরে যোগ দেন হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা। কৃষক আন্দোলনের মতো এত সক্রিয়তা কিন্তু শ্রমিক কিংবা ছাত্র আন্দোলনে দেখা যায়নি।
আন্দোলনের শক্তি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা
সরকার বলতে চেষ্টা করছে এটা ধনী চাষিদের আন্দোলন। কিন্তু মনে রাখতে হবে পাঞ্জাবে ৮৬ শতাংশ কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। এই আন্দোলনে এত বেশি অংশগ্রহণ এবং এত বেশি বিস্তার সম্ভব হত না যদি এটা শুধুই ধনী চাষিদের আন্দোলন হত। ধনী চাষিরাও এই আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে। তবে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলির ভিত্তি কিন্তু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা। নেতৃত্বে এঁদের প্রতিনিধিরাও ভাল রকম রয়েছেন। এই জন্য এত সহজে এই আন্দোলন সমঝোতার পথে যেতে পারেনি। কী দাবি হবে, কীভাবে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হবে, আন্দোলনের পথ কী হবে— এই সব বিষয়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জোরালো মতামত ছিল আন্দোলনের নেতৃত্বের পর্যায়ে। সরকারও ক্রমশ বুঝতে পারে এই অংশের চাপ এতই বেশি যে সমঝোতা করে আন্দোলন তুলে দেওয়ার কোনও পথ নেই। এরপরেও আন্দোলন চললে তা অন্য চেহারা নিতে পারে। সেকারণেই পুরোপুরি আইন প্রত্যাহারের পথে গেছে সরকার। কিছু ধনী চাষির আন্দোলনে এটা সম্ভব নয়। এই আন্দোলন কৃষক সমাজের একটা জাগরণ। এতটাই যে পরে পাঞ্জাবের কংগ্রেস ও অকালি সরকার কৃষকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। আম আদমি পার্টি, সমাজাবাদী পার্টি, আরএলডি— পরে পরে এরা আন্দোলনকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে।
আইন প্রত্যাহারের তিন কারণ
কৃষকদের দৃঢ়তা
কেন সরকার কৃষি আইন প্রত্যাহার করল? আমি মনে করি তিনটি কারণে। এক, আন্দোলনকারীদের কঠিন অবস্থান। এমনকি করোনার প্রকোপ যখন সর্বোচ্চ তখন দিল্লি সীমানায় অবস্থানে লোক কমে যায়নি। এমনকি প্রবল গরমে লুএর সময়েও নয়। এছাড়া বিভিন্ন রাজ্যে নীচের দিকেও আন্দোলন জারি ছিল। হরিয়ানায় তিন বার মুখ্যমন্ত্রীর কপ্টার নামতে দেয়নি কৃষকেরা। একবার হেলিপ্যাড ভেঙে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশে বালিয়ানে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। গ্রামে গ্রামে আন্দোলন হয়েছে। টোল প্লাজা অবরোধ হয়েছে। রিলায়েন্সের পেট্রোল পাম্পে অবরোধ হয়েছে। ফিউচার—এর মলেও বিক্ষোভ চলেছে। সব মিলিয়ে আন্দোলনকারীদের কঠোর অবস্থান নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না।
সরকার বিভিন্ন সময়ে কোনও কোনও নেতার মাধ্যমে প্রকাশ্যে বা আড়ালে সমঝোতার চেষ্টা করেছে। কোনও কোনও নেতা বলেছেন তিন আইন বাতিল সম্ভব হবে না। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পথে যেতে হবে। সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে যেতে হবে। কৃষকেরা এত সচেতন হলে কোনও চুক্তিই সম্ভব হবে না— এমন খবরও সংবাদ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু এসবে কাজ হয়নি। নীচুতলার লোকেরা সমঝোতার পথে হাঁটেননি।
প্রথমে অবস্থান শুরু হয় হরিয়ানায়। পরে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যুবকেরা জোর করে অবস্থানকে দিল্লি সীমানায় নিয়ে যেতে বাধ্য করেন। অনেক নেতা সরকারি প্রস্তাব মেনে অবস্থান বুরারি ময়দানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৃষকেরাই বলেছিলেন যে বুরারি আসলে কৃষকদের জেলে পরিণত হবে। তাই তাঁরা সেখানে অবস্থান নিয়ে যেতে দেননি। ফলে অনেক নেতাকে পিছু হটতে হয়। এটাই ছিল আন্দোলনের জয়। কারণ কৃষকেরা বুঝেছিলেন, সমঝোতা করে একটা আইনও চালু হলে তার ফাঁক দিয়ে কর্পোরেট ঢুকে পড়বে। তাই নীচুতলার মত ছিল, তিনটি আইনই যেতে হবে। অবস্থানে যাওয়ার আগে কৃষকেরা সংসার ও চাষের খরচ চালানোর জন্য ঋণ করেছিলেন। এবং বলেছিলেন, দিল্লি থেকে ফিরে এসে ঋণ শোধ করবেন। এবং দাবি আদায় না করে ফিরবেন না। এমনই ছিল মনোভাব।
আশঙ্কিত কর্পোরেট লবি
দ্বিতীয় কারণ, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোট। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি হেরেছে। উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি খারাপ করেছে। বিধানসভা বিজেপি প্রচার করছে, পুঁজি বিনিয়োগ করে হাইওয়ে ভিত্তিক উন্নয়নই হবে তাদের মডেল। কিন্তু লোকের মনে এই প্রচার দাগ কাটতে পারছে না। বিজেপিও দেখল, বিরোধী দলের সভায় ভিড় বাড়ছে। ছোট ছোট দল বিরোধীদের দিকে চলে যাচ্ছে। আবার কর্পোরেটও দেখল কৃষি বিল নিয়ে সংঘাতে গিয়ে বিজেপি যদি নির্বাচনে হারে, তাহলে নতুন কোনও সরকারকে দিয়ে কর্পোরেট মুখী যে কোনও সংস্কার চালু করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আপাতত সরকার ও কর্পোরেট পিছু হঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ
তৃতীয় কারণ বলে আমার মনে হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। আগস্ট মাসের পর মার্কিন মদতপুষ্ট আফগান সেনা ও পুলিশ ক্ষমতা হারায়। আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসে মার্কিন বিরোধী তালিবান। এতে আমেরিকার অবস্থান দুর্বল হয়। মোদি সরকার আবার আমেরিকার সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। ভারত চায় মার্কিন মদতে এই অঞ্চলে বড় শক্তি হতে এবং আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সামরিক মৈত্রীও রয়েছে। আফগানিস্তানে পালাবদলের পর সরকারের মনে হয়েছে যে তারা এখন পরাজিত পক্ষে। দিল্লিতে এনএসএস–এর ডাকা বৈঠকে পাকিস্তান আসেনি। রাশিয়া এলেও পরে আলাদা করে বিবৃতি দিয়েছে। সেটা ভারতের পক্ষে নয়। এখন পাকিস্তানের ওপর আমেরিকার নির্ভরশীলতা বাড়বে, কারণ আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব বেশি। চীনের সঙ্গেও সংঘাত চলছে। সরকার জানে, এই পরিস্থিতির মধ্যেই কাশ্মীর অশান্ত। এরপর যদি কৃষক আন্দোলন নিয়ে পাঞ্জাব অশান্ত হয় তার সুযোগ নেবে অনেকে। আমার মনে হয়, কৃষক আন্দোলন নিয়ে সরকারের পিছু হঠার এটাও কারণ। কারণ মনে রাখতে হবে , ১৯ নভেম্বর মোদি বলেছিলেন জাতীয় স্বার্থে এই আইন তুলে নিচ্ছেন, কৃষকস্বার্থে নয়।
সাম্প্রদায়িকতা রুখে ভাইচারার বার্তা
গোড়ায় শিখ কৃষকেরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। একটা সময়ে এসে হিন্দু–শিখ, শিখ–জাঠ বিরোধ বাধানের চেষ্টা করে বিজেপি। তবে সেই সব প্রয়াস ব্যর্থ করে সংগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে হিন্দু–শিখ, শিখ–জাঠ ঐক্য। উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বড় কেন্দ্র পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ। সেখানকার মুজফফর নগরে একসময় বিজেপি জাঠ–মুসলিম দাঙ্গা বাধাতে পেরেছিল। এই আন্দোলন জাঠ–মুসলিম ঐক্য গড়ে তুলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। আমাদের দেশে কমিউনাল গেমপ্ল্যান বহুদিনের পুরোনো। তাছাড়া রাজ্য প্রশাসনও দাঙ্গার রাজনীতিতে ভাল রকম মদত দেয়। তবে মনে হয় এবার সেটা তত কাজে লাগবে না। কারণ আন্দোলনের ঐক্য আছে। ইতিবাচক নানা ইস্যু আছে। সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে কৃষকদের আয়ের প্রশ্ন।
বড় হয়ে উঠেছে এমএসপির দাবি
এই আন্দোলনে এমএসপির দাবি খুবই লাভ দিয়েছে। অনেক কৃষক মনে করতেন এমএসপি বুঝি নতুন একটা ফসলের নাম। তারা জানতেনই না যে সরকারি দামে ফসল কেনা হলে তাদের লাভ। তারা ভাবতেন ফসল যদি ভাল দামে বিক্রি না হয় সেটা তাদের ক্ষতি।
এই আন্দোলনে প্রতিদিনকার চর্চার মধ্যে দিয়ে কৃষক বুঝেছেন কৃষকের আয় নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের একটা ভূমিকা আছে। সেটাই যে এমএসপি তাও অনেক দূর পর্যন্ত কৃষকেরা বুঝে গেছেন। তারা বুঝেছেন এমএসপি থাকলে তাঁরা বাঁচবেন, কৃষি সঙ্কট থেকে একভাবে তাঁরা রেহাই পাবেন, এখানে সরকারের ভূমিকাই সবচেয়ে বড়। সরকারি নীতি এখন এমন করার পরিকল্পনা রয়েছে যাতে কৃষির লাভ পুরোটাই চলে যায় কর্পোরেটের কাছে। বিপরীতে এমএসপি চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশজুড়ে।
বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষিপরিকাঠামো, পাম্প, বিদ্যুৎ—এসবই কর্পোরেট প্রডাক্ট। এগুলোর দাম বাড়ার ফলেই কৃষি অলাভজনক হয়ে পড়েছে। এটা লোকে আগেই বুঝেছিল। এখন যেটা বুঝেছে তা হল, এগুলোর দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সুবিধা হবে কৃষকদের। তাছাড়া সরকারি করের বোঝা বেড়েই চলেছে। ইনপুটের দাম জনমুখী হোক, এটাই কৃষকদের দাবি। যদি শিল্পের জন্য সরকার পরিকাঠামো গড়ে দিতে পারে, তাহলে কেন গড়বে না কৃষির জন্য। তাহলে তো চাষের খরচ কমে। এই আলোচনাই ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
মান্ডির যে পরিকাঠামো সরকার বেসরকারি হাতে দিতে চায় এবং সেটা হলে চাষির আয় যে কমবে, এটা লোকে বুঝতে পেরেছে। তাই দাবি উঠেছে, সরকার কৃষির উপকরণের দাম নিয়ন্ত্রণ করে চাষির জন্য লাভজনক দামের ব্যবস্থা করুক। গত এক বছরে এই চর্চা গভীরতর হয়েছে।
এর আগে শান্তাকুমার কমিটি বলেছিল এমএসপি পায় মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক। তাই এমএসপি তুলে দেওয়া হোক। আর এখন সরকার কৃষকদের নিয়ে যে কমিটি গড়েছে তাতে আলোচনা হবে সারা দেশের কৃষক যাতে এমএসপি পায় তার ব্যবস্থা করা। আন্দোলনের চাপে উল্টে গেছে বিষয়টা। এটা পুরো নতুন বিষয়। এখন এটা নিয়ে আন্দোলন শুরু করতে হবে। এনিয়ে উদ্যোগ নেবে এসকেএম।
ট্রেড ইউনিয়নের আরও সক্রিয়তা দরকার
দেশব্যাপী আন্দোলনের ভিত তৈরি করে দিয়েছেন কৃষকেরা। পিপলস ডেমোক্রেটিক আন্দোলন ছড়াতে হলে তা নির্ভর করছে শ্রমিকেরা কতটা লড়বেন। এতদিন যে কৃষক আন্দোলন হল, বড় বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলো ধর্মঘট করেছেন। তবে ধর্মঘট তো একদিনের কর্মসূচি। যদি লাগাতার গণ জমায়েত করা না যায়
তাহলে সমস্যা। কৃষক আন্দোলন কোনও একদিনের লড়াই ছিল না। তা ছিল লক্ষ কৃষকের লাগাতার সমাবেশ। ট্রেড ইউনিয়নকেও এরকম কোনও সংগ্রামের রূপ বের করতে হবে। হরতালের প্রভাব একটা বৃত্তে আটকা থাকে। লাগাতার গণজমায়েত দরকার। তা না হলে পিপলস ডেমোক্রেটিক লড়াই জোরদার হবে না।
নীতি বদলাতে বাধ্য করতে হবে সরকারকে
কর্পোরেট লবি ও মোদি নানা ভাবে তাদের পরিকল্পনা সফল করার চেষ্টা চালাবে। কারণ বিজেপির ওপর কর্পোরেটের আস্থা রয়েছে। অন্যদিকে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়েছে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু বা তেলেঙ্গানাতেও। এখন দেশজুড়ে নতুন একটা ফোকাল পয়েন্টে এই আন্দোলনগুলোকে ফের জুড়তে হবে, সেটা হতে পারে এমএসপির জন্য লড়াই। পাঞ্জাবে এখন দুটো ফসলে সরকার এমএসপি দেয়। দাবি উঠেছে আরও ফসলে এমএসপি চালুর জন্য। ফলে এই দাবিতে ফের আন্দোলন জোরদার হতে পারে।
এমএসপি আইনসিদ্ধ হবে কিনা সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল এমএসপির গ্যারান্টি দিতে হবে। গ্যারান্টি তখনই কার্যকর হবে সরকার যদি ফসল সংগ্রহ করে। শুধু আইন করলে কৃষকের লাভ হবে না। সরকারের সংগ্রহ নীতি থাকা দরকার। না হলে শস্য ব্যবসায়ীদের লাভ হবে। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় প্রসঙ্গটা উঠবে। এজন্য সরকারি নীতি বদলাতে হবে। সরকার বিনিয়োগচালিত উন্নয়নের পথ নিয়েছে। এতে দেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটের হাতে। এমনকী সস্তায় শ্রম কেনার ব্যবস্থাও হচ্ছে। যদি সরকারকে কৃষকেদের আয়ের গ্যারান্টি দিতে হয় তাহলে সরকারি নীতির বদল ঘটাতে হবে। সেটাই বিপন্ন ভারতের দাবি।
রাজ্যে রাজ্যে এসকেএম-কে আরও সংগঠিত করতে হবে। এতে দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলন জোরদার হবে। একইসঙ্গে শ্রমিকদের সঙ্গে মিলে সাধারণ দাবি নিয়ে লড়াইয়ে নামতে পারে কৃষকেরা। তবে সবাই এটা বুঝেছে যে, কোনও নেতা বা সংগঠন যদি ঐক্য ভাঙে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন কৃষকেরা।
উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন খুবই আগ্রহ জাগানোর মতো বিষয়। এখন ইস্যু অজয় মিশ্রের পদত্যাগ ও গ্রেপ্তার নিয়ে এসকেএম লাগাতার দাবি তুলবে ও জমায়েত করবে। এর প্রভাব পড়তে পারে নির্বাচনে। এই দাবি যত উঠবে তত বেশি বিজেপি চাপে পড়বে। যদি রাজনৈতিক দলগুলি আন্দোলনের সাফল্য ভোট রাজনীতিতে আটকে রাখতে চায় তাহলে কৃষকদের খুব বেশি লাভ হবে না। কৃষকদের স্থানীয় ইস্যুগুলিতে, ঋণের বোঝার ইস্যুতে গণসমাবেশের পথে যেতে হবে। এসব ইস্যু উঠলে পরবর্তী সরকারের ওপর এসবের সমাধানের জন্য চাপ বাড়বে।
শেষ কথা হল, কৃষক আন্দোলন দেশে বড় একটা জাগরণ এনেছে। এই আন্দোলন হারিয়েছে দেশি কর্পোরেটদের, সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেটদের। এই আন্দোলন তরুণদের পরিসর বাড়িয়েছে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধার কিছুটা কমিয়েছে, পুলিশি সন্ত্রাসের ভয় কমিয়েছে, ত্যাগের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করেছে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভ্রাতৃত্ব বাড়িয়েছে। এভাবে জেগে উঠছে এক নতুন ভারত। এটাই কৃষক আন্দোলনের বড় প্রাপ্তি।