বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

আসামের ডলু চা বাগান— উন্নয়নের বলি

আসামের ডলু চা বাগান— উন্নয়নের বলি

প্রদীপ রায়

photo

দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক স্বপ্নের মধ্যে একটি স্বপ্নের প্রকল্প হল “উড়ে দেশকে আম নাগরিক”। এই গ্রীনফিল্ড প্রকল্পে এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৩০টি বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। গ্রীনফিল্ড প্রকল্পের প্রধান শর্ত হল, এমন জায়গায় এই প্রকল্পের রূপায়ন করা হবে, যেখানে এই মুহূর্তে কোনও আর্থিক কর্মকান্ড নেই। এছাড়া প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য সংলগ্ন এলাকার মানুষের মতামত জানতে গণশুনানি করতে হবে। প্রকল্পের জন্য পরিবেশ ও সামাজিক অভিঘাত মূল্যায়ন করতে হবে। উৎখাত হওয়া মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন সহ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বনদপ্তরের ওয়াইল্ড লাইফ সুরক্ষার জন্য ছাড়পত্র নেওয়া আবশ্যক। পরিবেশগত অভিঘাত মূল্যায়ন বা এনভারমেন্টাল ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট করতে হলে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তৈরি করা সার্ভে রিপোর্ট প্রস্তুত করে তা জনপরিসরে দিয়ে জনসাধারণের মতামত আহ্বান করতে হবে।। তারপর গণশুনানি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এই প্রকল্পে একটি বিমানবন্দর তৈরি করার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয় আসামের কাছাড় জেলার ময়নাগড় ও লালবাগ ডিভিশনের ডলু চা বাগান। ২০২২ সালের ৩১ মার্চ শেষ হওয়া আর্থিক বছরে যে চা বাগানের মুনাফার পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬ কোটি টাকা।

জেলা প্রশাসনের আয়োজিত গণশুনানিতে চা বাগানের শ্রমিকদের মতামত অগ্রাহ্য করে, জমি অধিগ্রহণের নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, পরিবেশ দপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই ১২ মে, ২০২২ পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী এবং শতাধিক বুলডোজারের সাহায্যে ৪২ লক্ষ চা গাছ এবং ১০ হাজারেরও বেশি ছায়াদায়ী বড় গাছ উপড়ে ফেলা হয়। মজার কথা হল, এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত ডলু চা বাগানের উপর পরিবেশগত অভিঘাত সার্ভে করার জন্য যে টেন্ডার ডেকেছিল তা আজও সংস্থা ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে। যার অর্থ সেই টেন্ডার এখনও দেওয়া হয়নি। ডলু চা বাগানের ২৫০০ বিঘা জমি অধিগ্রহণের পরও অতিরিক্ত জমির প্রয়োজন হওয়ায় আরো বহুফসলি জমি ধ্বংস করার আয়োজন চলছিল।

এই প্রকল্পের ফলে হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন-জীবিকা বিপন্ন শুধু নয়; পরিবেশের উপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চা বাগান ছাড়াও এই প্রকল্পের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে ডলু লেক ও বড়াইল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পার্ক। বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে ও জীববৈচিত্র রক্ষায় চা বাগানের সদর্থক ভূমিকা দেশে বিদেশে নানান গবেষণাপত্রে আলোচিত হয়েছে। চা বাগান ধ্বংস করে অসংখ্য শ্রমিকের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে বিমানবন্দর গড়ে তোলার বিরুদ্ধে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে চা শ্রমিকরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিভিন্ন সামাজিক মঞ্চ এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকদের দাবি, ফলনশীল ও লাভজনক ডলু চা বাগানের পরিবর্তে বরাক উপত্যকার অন্যত্র কোনও পরিত্যক্ত বা অব্যবহৃত এলাকায় বিমানবন্দর তৈরি করা হোক। জবরদস্তি করে যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তা ফিরিয়ে দেওয়া হোক এবং উপড়ে ফেলা চা গাছের পরিবর্তে সমসংখ্যক হোক চা গাছ পুনরায় রোপন করা হোক। আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর পুলিশে নির্যাতন তথা অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করে হিংসার বাতাবরণ তৈরি করে সংগ্রামরত শ্রমিকদের মনোবল ভাঙা যায়নি।উন্নয়নের এই পুঁজিবাদী মডেলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ডলু চা বাগানের শ্রমিকদের সংগ্রামের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রতিবাদী সংগঠন। গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর ডলু চা-বাগানের শ্রমিক সহ কয়েকশো মানুষ মিছিল করে আসাম ভবনে ডেপুটেশন দেন। তাতে অংশগ্রহণ করে এন.টি.ইউ.আই, আই.এফ.টি.ইউ, এ.ডব্লিউ.বি.এস.আর.ইউ, এস.ডব্লিউ.সি.সি, এল.জে.এম.ইউ, এস.এস.সি (ডব্লিউ. আই), এইচ.ডব্লিউ.ইউ.সি, এস.জি.এস.এম, ১৬ বিঘা বস্তি বাঁচাও কমিটি, সমাজ বিজ্ঞান ও প্রকৃতি পরিচয়ের মতো বিভিন্ন সংগঠন।

অন্যদিকে তিনটি সংগঠন— শান্তি গণতন্ত্র সংহতি মঞ্চ সমাজবিজ্ঞান ও প্রকৃতি পরিচয়, এবং ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনির কলকাতা শাখা জাতীয় পরিবেশ আদালতে (আঞ্চলিক) একটি মামলা করে। আঞ্চলিক আদালত পত্রপাঠ ওই মামলা খারিজ করে দেয় এই অজুহাতে যে, পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র না থাকায় এই মামলা এই মুহূর্তে বিচার্য নয়। এই অবস্থায় ওই সংগঠনগুলোর তরফে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াইয়ের দায়িত্ব নেন প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ ও সহকারি রিয়া যাদব। পরবর্তীতে যুক্ত হন গোপাল শঙ্করনারায়ণ ও রাহুল গুপ্তা। ওই তিনটি সংগঠন ছাড়াও ডলু চা-বাগানের সাতজন শ্রমিক এই মামলায় যুক্ত হন। অবশেষে প্রধান বিচারপতি ডি.ওয়াই. চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জে.বি. পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ রায় দেন যে, পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র ছাড়া শিলচরে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের সব কাজ বন্ধ রাখতে হবে। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য সরকার উন্নয়নের জন্য প্রকল্প পরিকল্পনা করতে পারে। কিন্তু পরিবেশ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উন্নয়নের রথ ছোটানো চলবে না। সুপ্রিম কোর্টে সরকারের তরফে ছিলেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা। তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জানান, কোনও ছায়াদায়ী গাছ কাটা হয়নি। চা গাছ কাটা হয়েছে রুটিন মাফিক যা হামেশাই করা হয়। তিনি মামলাকারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে অভিযোগ করেন যে, ১৩০০ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় বসে থেকে কেউ কেন এ বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন যদি না এদের রাষ্ট্র বিরোধী কোনও অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। এরা কোর্টকে বিভ্রান্ত করছেন। তিনি মামলাকারী তিনটি সংগঠনের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলার জন্য আবেদন জানান।

বাজার অর্থনীতির হাত ধরে উন্নয়নের চলতি মডেল প্রান্তিক মানুষকে আরো প্রান্তিক করে তুলছে। সবুজ ধ্বংস করে পরিবেশ দূষণ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জল, জমি, জঙ্গল দখল করে পরিবেশের অপরিমেয় ক্ষতি করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে আদিবাসী বনবাসীদের আন্দোলন গড়ে উঠছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। উড়িষ্যার বক্সাইট পাহাড় নিয়মগিরি দখলের বিরুদ্ধে, ওই একই রাজ্যে পস্কোর ইস্পাত কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে, ছত্তিশগড়ে কয়লা উত্তোলনের জন্য হরিহরপুরের এক বিস্তীর্ণ এলাকার জঙ্গল নিধনের বিরুদ্ধে লড়াই প্রতিরোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। তারই সঙ্গে যুক্ত হল ডলু চা-বাগানের শ্রমিকদের আন্দোলন। এই সমস্ত আন্দোলন আগামী দিনের দিশা হয়ে উঠবে। সমস্ত সংগ্রামী মানুষের সহযোগিতায় ডলু চা-শ্রমিকদের আন্দোলন সফল হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.