বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

নতুন কৃষি আইনে জমি হারানোর শঙ্কাই ঐক্যবদ্ধ করেছে কৃষকদের

নতুন কৃষি আইনে জমি হারানোর শঙ্কাই ঐক্যবদ্ধ করেছে কৃষকদের

ডা. আশিস মিত্তাল

photo

[৮ নভেম্বর শ্রমজীবী ভাষা আহুত "চলমান কৃষক সংগ্রাম" শীর্ষক এক মনোজ্ঞ অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এই সভায় আলোচক ছিলেন সারা ভারত কিসান মজদুর সভার সাধারণ সম্পাদক ডা. আশিস মিত্তল, সারা ভারত কৃষক সভার বাংলা মুখপত্র 'কৃষক সংগ্রাম'-এর সম্পাদক সঞ্জয় পুততুণ্ড, সারা ভারত কিসান মহা সভার পশ্চিমবঙ্গ সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, সাংবাদিক-গবেষক সায়ন্তন বেরা এবং লেখক-বিশ্লেষক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। আমরা এখানে ডা. আশিস মিত্তলের আলোচনার ভাষান্তর প্রকাশ করলাম।]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ নভেম্বর, ২০২১— সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের ব্যাপ্তি বিরাট, শিকড়ও অনেক গভীরে। এবং এই আন্দোলন ঐতিহাসিকও। এই আন্দোলনের বীজ ভারতের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং সর্বত্র কৃষকদের মধ্যে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও এই আন্দোলন বহু মানুষের নজর কেড়েছে। এই আন্দোলন মৌলিক ধরনের। এর রয়েছে একটা গণচরিত্র। নীতিগত দিক থেকে কৃষিক্ষেত্রে সরকার যে ধাক্কাটা দিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সারা দেশ ও বিশ্বে। অনেক দেশের সরকারও একথাটা জানিয়েছে বিজেপি সরকারের এই কৃষিনীতি কৃষকের স্বার্থবিরোধী। এই আন্দোলন ইতিমধ্যে বহু বিষয়কে সামনে এনেছে। এবং আগামী দিনে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ধীরে ধীরে সামনে নিয়ে আসবে। করোনা লকডাউনকে জনবিরোধী পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত করেই পাঞ্জাবে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। পাঞ্জাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। পাঞ্জাবের গণ আন্দোলনের কর্মীরাই প্রথম এই আওয়াজ তোলেন যে, করোনা সংকটকে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার কাজে ব্যবহার করতে চাইছে মোদি সরকার। এটার লক্ষ্য আসলে সঙ্কটগ্রস্ত কর্পোরেট স্বার্থকে রক্ষা করা।
কৃষক আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। তবে তাঁরা একসঙ্গে বসেই কর্মসূচি ঠিক করেন। এখানে তিন কৃষি আইনের মধ্যে যে সব বিষয়কে আড়াল করে রাখা হয়েছে সেগুলিই আমি আলোচনায় নিয়ে আসব।
এর মধ্যে কনট্রাক্ট আইন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এই আইন চলতি চুক্তিচাষের মতো কোনও ব্যবস্থা নয়। নতুন আইনে চুক্তির সময় কালে কৃষক এবং কৃষকের জমি— দুটোই যে কোম্পানি চুক্তি করছে তার কাছে বাঁধা পড়ে যাবে। এটা স্রেফ খাজনার বিনিময়ে জমি বাঁধা রাখার চুক্তি নয়। নতুন চুক্তি আইনে কৃষক কী চাষ করবেন তা ঠিক করে দেবে কোম্পানি এবং সেটা হবে বাণিজ্যিক পণ্য। এর মানে ওই জমিতে খাদ্যশস্য চাষ হবে না। সেকারণে এই চুক্তির পিছনে দাঁড়িয়েছে দেশি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলি। ভারতে নানা চরিত্র ও গুণমানের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। রয়েছে নানা ধরনের ফসলের চাষের উপযোগী অ্যাগ্রো ক্লাইমেটিক জোন। সেটা বিবেচনা করেই কর্পোরেটরা দুনিয়ার বাজারে দরকারি নানা ধরনের বাণিজ্যিক ফসলের চাষ করতে চাইছে এই দেশে। নতুন চুক্তি আইনে ফসলের বীজ, সার, কীটনাশক, সেচের জল, যন্ত্রপাতির পরিষেবা— সবই সরবরাহ করবে কর্পোরেট সংস্থা। তাদেরই তৈরি করি ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে এই সব পরিষেবা কিনতে হবে। এরপর সস্তা দামে ফসল কিনে বেশি দামে বাজারে বিক্রি করবে তারা। এই প্রক্রিয়ায় বীজও তারা বাছাই করে দেবে। ফলে এদেশে বীজের সার্বভৌমত্বও খর্বিত হবে। ভারতে পশুপালনে জড়িত বহু গোষ্ঠী। দেশে কৃষিকাজ থেকে আয়ের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আসে পশুপালন থেকে। নতুন চুক্তি আইনের আওতায় আসবে পশুপালনও। সেটাতেও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবে কর্পোরেট। এবং এটা ঐচ্ছিক থাকবে না। সরকারি অধ্যাদেশের জেরে হবে বাধ্যতামূলক।
চুক্তিচাষ কৃষকদের কতটা বিপদে ফেলতে পারে সে বিষয়ে আগেই অভিজ্ঞতা হয়েছে পাঞ্জাবের কৃষকদের। পেপসির সঙ্গে চুক্তি চাষের অভিজ্ঞতা তাঁদের আছে। এতে জমি বন্ধক দিতে হয়। চাষের বাড়তি খরচের জন্য ঋণ নিতে হয়। সব মিলিয়ে এটা কর্পোরেট ও ঋণদানকারী সংস্থার একটা দুষ্টচক্র যা চাষিদের ঋণফাঁদে ফেলে দেয়ে। নতুন চুক্তিচাষ আইন কার্যকর করা হবে সরকারি অধ্যাদেশের জোরে। এটা স্বেচ্ছামূলক নয়, বাধ্যতামূলক।
নতুন মান্ডি আইনে দরদাম কীভাবে ঠিক হবে তা ঠিক করে দেবে কর্পোরেট। এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যাবে। তবে এটা বড় প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, আদালত যাই বলুক না কেন, আসলে পুরো কাঠামোটা তৈরি হবে কর্পোরেট স্বার্থের দিকে তাকিয়ে। কেনাবেচার শর্তগুলো তৈরি করবে বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থা। ফলে এপিএমসি আইনে যে সরকারি নিরাপত্তাগুলি রয়েছে তা আদৌ আর পাবেন না কৃষকেরা। ফলে নতুন মান্ডি আইনে সব দিক থেকে বঞ্চিত হবেন কৃষকেরা। লাভ হবে কর্পোরেটদের।
নতুন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে খাদ্যপণ্য ও ডালের দাম বছরে ১.৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। সবজির দাম বছরে বাড়তে পারে দ্বিগুণ। এছাড়া বাফার স্টকের সীমা বলে কিছু থাকবে না। ফলে মজুত করা ও কালোবাজারে বেচার সুযোগ পাবে বড় ব্যবসায়ীরা। এতে বিপন্ন হবে খাদ্য নিরাপত্তা। এর প্রভাব পড়বে রেশন ব্যবস্থায়। সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থা উঠে যাবে। বাফার স্টক না থাকলে রেশন ব্যবস্থাটাই উঠে যাবে। নতুন আইনে গ্রামীণ সমবায়গুলো হবে অ্যাগ্রিগেটর কিংবা মিডলম্যান। তারা গরিব কৃষকদের হয়ে ফসলের বেশি দাম আদায়ের বদলে কাজ করবে কর্পোরেটদের মিডলম্যান হিসাবে। এছাড়া গ্রামাঞ্চল জুড়ে স্তরে স্তরে তৈরি হবে অসংখ্য মিডলম্যান। ফলে সমবায়ের মাধ্যমে জোর ফলানোর যে ব্যবস্থা কৃষকদের জন্য এখন চালু রয়েছে, নতুন ব্যবস্থায় সেগুলোই হবে কর্পোরেটের মিডলম্যান যারা কৃষকদের সঙ্গে কর্পোরেটের হয়ে দর কষাকষি করবে। এখন আখচাষিদের একটা নথি দেয় সমবায় সমিতি। তাতে দাম লেখা থাকে। সেই স্লিপ দেখিয়ে সুগার মিলে আখ দিয়ে আসেন চাষি। দেরিতে হলেও ফসলের দাম পান তাঁরা। নতুন আইনে সমবায়ের এই ভূমিকা আর চাষি দেখতে পাবেন না। ফসলের মান, চাষের পরিষেবা, দাম মেটানো — সবকিছুর জন্য থাকবে মিডলম্যান বা সুপারভিশন সংস্থা। খরচ দিতে হবে চাষিকে যা ঠিক করে দেবে কোম্পানি। বেসরকারি মান্ডিতে ফসল বেচতে গেলে কর্পোরেট সংস্থা নির্ধারিত হারে কর দিতে হবে চাষিকে। ভারতে এখন প্রক্রিয়াকরণ করা খাদ্যের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকা। নতুন আইন চালু হলে এক বছরের মধ্যে এই বাজার দাঁড়িয়ে যাবে ২.১ লক্ষ কোটি টাকার ওপর।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেন এই আন্দোলন পাঞ্জাবে এত তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠতে পারল। প্রথমত, পাঞ্জাবে ফসলের সংগ্রহ মূল্য নিয়ে আগেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পাঞ্জাবে ১৮.৬ মিলিয়ন টনের বেশি গম উৎপন্ন হয়। তার মধ্যে সরকার সংগ্রহ করে ১৩ মিলিয়ন টনের বেশি। মানে মোট উৎপাদনের দুই তৃতীয়াংশ গম সরকার কেনে। ধানের ক্ষেত্রেও তাই। এবং পুরোটাই কেনা হয় সরকারি দামে। এখন ধানের দাম কুইন্টাল পিছু ১৯৪০। সরকার এই দামে কেনে বলে বেসরকারি সংস্থাকেও ধান এই দরে কিনতে হয়। পাঞ্জাবের গম উৎপাদনের হারও জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ। পাঞ্জাবের চাষিরা তাদের উৎপন্ন গমের বেশিরভাগটাই বিক্রি করেন। বাংলায় এক একরে ধান হয় ২০ কুইণ্টাল। এর থেকে চাষি ৫ কুইন্টাল বিক্রি করেন। ১৫ কুইন্টাল নিজে রাখেন। পাঞ্জাবে এক একর জমিতে ধান হয় ৪০ কুইন্টাল। তা থেকে ৫ কুইন্টাল রেখে ৩৫ কুইন্টালই বিক্রি করেন চাষি, তাও আবার ১৯৪০ টাকা কুইন্টাল দরে। ফলে এমএসপি উঠে গেলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে এখানকার চাষিদের। সবচেয়ে বড় কথা, পাঞ্জাবে ভাগ চাষ হয় মাত্র ১২ শতাংশ জমিতে। এখানকার বেশির ভাগ চাষি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি। মধ্য চাষিও নয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিকেরা নিজেরাই নিজেদের জমি চাষ করেন। পাঞ্জাবে ৮৭ শতাংশের বেশি চাষির জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের কম। এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিরাই পাঞ্জাবের এখনকার কৃষক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি। কৃষিই এদের জীবন ধারনের মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ভরসা। এমএসপিতে বেশি বেশি ধান ও গম বিক্রি করাই তাদের আয়ের উৎস। এসব কারণে তাঁদের জীবনে কৃষি মূল ভরসা।
এছাড়া এখানকার কৃষি বাণিজ্যের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদেরও স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে কৃষির সঙ্গে।
দেখতে হবে পূর্ব উত্তর প্রদেশ, বিহার বা পশ্চিমবঙ্গে যেখানে ভাগ চাষ বেশি, ক্ষু্দ্র চাষির সংখ্যাও বেশি, রয়েছেন বহু পশুপালক, তাঁদের অবস্থা এই আইনে কী দাঁড়াবে। এই আইনে গোটা দেশের কৃষি কর্মকাণ্ড চলে যাবে কর্পোরেটের হাতে। যারা পশুপালক তারা কোন পশু পালন করবেন, কত দামে সেই পশু বিক্রি করবেন, কত দামে দুধ বিক্রি করবেন— সব কর্পোরেটই ঠিক করে দেবে। এর পর সবধরনের কাজে নাগানো হবে যন্ত্র। এতে চাযের খরচ বাড়বে। আবার শ্রমিকের চাহিদা কমবে। গড়ে বছরে ৭০ দিন কৃষিকাজ কৃষিশ্রমিকেরা আর পাবেন না। ভাগচাষের চেহারাও বদলাবে। যেসব ছোট বা মাঝারি জমির মালিক ভাগে জমি দিয়ে শহরে চাকরি করতে যেতেন, এখন তাঁরা অন্য চাষিকে জমি ভাগে দিতে পারবেন না। দিতে হবে কর্পোরেট সংস্থাকে। কর্পোরেট এলেই চাষের খরচ বাড়বে। এমনকি স্থানীয় নদী, পুকুর, জলাভূমিতে মাছ ধরার অধিকারও চলে যাবে কর্পোরেটের হাতে। কৃষিক্ষেত্রে ছাড়াও খনি ইত্যাদি ক্ষেত্রে শ্রমিক নিয়োগ ও মজুরির ওপরেও এই কর্ম সংকোচনের প্রভাব পড়বে। এই বিষয়গুলির প্রভাব পড়বে বাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়সহ বিভিন্ন রাজ্যের গরিব মানুষের জীবনযাত্রার ওপরেও। কারণ নতুন তিন কৃষি আইনে পুরো কৃষি ব্যবস্থাই চলে যাবে কর্পোরেটদের হাতে। ফলে এদেশে কৃষি কতটা সামন্ততান্ত্রিক, কতটা আধা সামন্ততান্ত্রিক— এই বিতর্কটাই তখন চলে যাবে। কারণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে পুরো কৃষি ব্যবস্থা। জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে কৃষকেরা হয়ে পড়বেন শহুরে বস্তিবাসীর মতো। এটা একদিনে হবে না। তবে কয়েক বছরের মধ্যে হবে।
মনে রাখতে হবে, কৃষক আন্দোলনে সবকিছু নেতারা ঠিক করেন না। চাপ দিয়ে ঠিক করেন সাধারণ কৃষকেরা। যেমন, প্রথমে নেতৃত্ব চেয়েছিলেন হরিয়ানা সীমান্তে অবস্থান হোক। কিন্তু আম্বালার যুবরা জানিয়ে দেন তাঁরা দিল্লিতেই যাবেন। কৃষক নেতারা চেয়েছিলেন অবস্থান সরে যাক বুরারি ময়দানে। কিন্তু সাধারণ আন্দোলনকারীরা তা মানেননি। ফলে অবস্থানও সরেনি। এই বিষয়টি লাগাতার চলছে। সাধারণ কৃষকেরাই বার বার বলেছেন, কোনও সমঝোতা দরকার নেই। পুরো আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
এটা ঠিক পাঞ্জাবে যেভাবে এমএসপি বা অন্য ইস্যুতে কৃষক জমায়েত হচ্ছে সব রাজ্যে তা একইরকম হবে না। রাজ্যভিত্তিক আন্দোলনের চেহারা বদলাবে। এমএসপি, রেশন ব্যবস্থা, এনআরইজিএ, কৃষি জমি জলে ডুবে যাওয়া, সেচ বা বিদ্যুতের মতো ইস্যু যে সব রাজ্যে গুরুত্ব পায় সেখানে সেই সব ইস্যুতে ব্যাপক জমায়েত করতে হবে। নানা ইস্যুতে কৃষকসহ গরিব মানুষের দীর্ঘকালীন জমায়েত যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলেই সরকার চাপে পড়বে। তবেই উত্তর ভারতের কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হবে। জমায়েত যত বড় হবে সরকার তত চাপে পড়বে। গ্রামীণ মানুষের জীবন যাপনের কোনও উপায় কর্পোরেটের হাতে ছাড়া যাবে না— এটাকেই মূল লক্ষ্য করতে হবে।
আমাদের সামনে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প পথ কি খোলা আছে। কৃষি সমবায় গড়ে কি বিকল্প বাঁচার পথ পাওয়া যাবে। আমি আগেই বলেছি, নতুন কৃষি ব্যবস্থায় সমবায়কে করে ফেলা হবে কর্পোরেটের এজেন্ট। সেগুলি হয়ে উঠবে দুর্নীতির আখড়া। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, পশ্চিমবঙ্গে কর্পোরেটের হাতে চাষের জমি তুলে দেবেন না বলে ঘোষণা করেছেন মমতা। তাতেই ভোটে জিতেছেন। তবে বাস্তবে তিনি কিছুই করেননি। এই রাজ্যেও কৃষিতে কর্পোরেটের দাপট বাড়ছে। এমনকি কৃষকদের ডাকা ধর্মঘটকেও সমর্থন করেনি তাঁর সরকার বা দল। আসলে এদেশে অনেক দিন থেকেই কৃষিক্ষেত্রে ঢুকছে কর্পোরেট। তারা জমি, জল, সেচ, পশুপালন, মাছ চাষ— পুরোটা দখল করতে চায়।
এখন আওয়াজ উঠছে উত্তরপ্রদেশে — বিজেপিকে হারাও। এতে সুবিধা হচ্ছে এসপি, বিএসপি, কংগ্রেসের। কারণ, তারা আর আলাদা করে ঘোষণা করছে না যে আন্দোলনের দাবিগুলি তাদের সরকার ক্ষমতায় এলে মেনে নেব। কৃষকদের মধ্যেকার বিজেপি বিরোধী হাওয়া কাজে লাগিয়ে ওরা ক্ষমতায় আসতে চায়। তাই এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যাতে বিরোধী দলগুলি ভোটের জাতপাতভিত্তিক সমীকরণ ছেড়ে কৃষকদের সমস্যার ভিত্তিতে নতুন সমীকরণ গড়ে তুলতে বাধ্য হয়।
পাঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গেলে বোঝা যাবে এই আন্দোলনের শিকড় কত গভীরে। গরিব, ক্ষু্দ্র, প্রান্তিক চাষিরা বার বার একথা বলছেন— আমাদের জমি আমরা ছাড়ব না। তাঁদের মধ্যে এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে তিন কৃষি আইন চালু হলে তাঁদের জমিটাই চলে যাবে। তাঁরা নিঃস্ব হয়ে পড়বেন। এই অনুভূতি গ্রাম সমাজের অনেক গভীরে চারিয়ে গেছে। কর্পোরেটের হাতে সব জমি চলে যাবে, এই বিষয়টিই এখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে কৃষকদের। সেকারণেই এত জমায়েত, এত তৎপরতা, এত সক্রিয়তা। জমি হল আবেগের প্রশ্ন। এখানে কৃষক কোনও সমঝোতা করবেন না। আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু নীচুতলার লোকেরা ঐক্যবদ্ধ। তারা এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বেন না। ওপরের দিকে যাই হোক, এখানেই গোটা গরিব, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক সমাজ পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.