বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

গুজরাট-হিমাচল ও দিল্লি নির্বাচনের বার্তা

গুজরাট-হিমাচল ও দিল্লি নির্বাচনের বার্তা

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

(১)
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২— বিধানসভা নির্বাচনে গুজরাটে রেকর্ড জয় বিজেপির। অন্যদিকে হার হিমাচল ও দিল্লিতে। এমনকি উপনির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের মৈনপুরীর মতো সংসদীয় আসনে ২ লক্ষের বেশি ভোটে বিজেপির পরাজয়। বিধানসভার ৬টি আসনের উপনির্বাচনে বিজেপি জয় পেয়েছে ২টি আসনে। অন্যদিকে, কংগ্রেস ২টি, ইউপিএ ১টি এবং ওড়িশায় বিজেডি ১টি আসনে জয়ী হয়েছে। সেদিক থেকে দেখলে বিজেপি ২ এবং বিরোধীরা ৪। অথচ সংবামাধ্যম বলছে, সমানে সমানে টক্কর। যেন যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ ভুলে গেছেন সংবাদমাধ্যমের পাঠকেরা! তবে দিল্লি, হিমাচল এবং উপনির্বাচনে বিজেপির হার মেনে নিতে পারছে না একচেটিয়া ক্রোনি পুঁজি ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াকুল। এখন সবাই মিলে এটাই দেখানের চেষ্টা করছে, বিজেপির গুজরাটে রেকর্ড জয়টাই আসল। বাকিগুলো সব এলেবেলে, সেখানে কিছুই ঘটেনি। কিন্তু কেন?
এক এক করে দেখা যাক।
হিমাচলে হিন্দু ভোটারই একচেটিয়া। মুসলিম জনসংখ্যা খুবই নগণ্য। বিজেপির তথাকথিত এই ‘দেবভূমি’কে মোদি ঘোষণা করেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্বদেশ হিসাবে। প্রচারে নেমে বলেছিলেন, কাউকে দেখার দরকার নেই। ভোট দিন মোদিকে আর কমল ফুলে। ভোটের আগের দিন চিঠি দিয়ে বিক্ষুব্ধ বিজেপি প্রার্থীদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবু না মোদির নিজস্ব ভাবমূর্তি, না তাঁর আর্জি— কিছুতেই কাজ হয়নি। হিন্দুপ্রধান হিমাচল হিন্দুত্বের রাজনীতি আঁকড়ে না ধরে আঁকড়ে ধরেছে অন্যান্য ইস্যুকে। তার মধ্যে প্রধান দিক হল, বিজেপি বা কংগ্রেস, কাউকেই একভাবে ক্ষমতায় রাখা হবে না। রাজ্যের ভোটদাতারা তাঁদের ৪৫ বছরের ঐতিহ্য মেনে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলেন বিজেপিকে। এর পিছনে কাজ করেছে অগ্নিবীর প্রকল্প চুক্তিভিত্তিক সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্ত, আপেল চাষিদের আর্থিক ক্ষতির মতো সব অর্থনৈতিক ইস্যু। এর সঙ্গে কংগ্রেস মোক্ষম চাল দিয়েছিল পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। নয়া উদারাবাদী অর্থনীতির আমলে এই সমাজ গণতান্ত্রিক, জনকল্যাণকর অর্থনৈতিক ইস্যুটি রীতিমতো প্রভাব ফেলেছে হিমাচলের সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে। এতগুলো অর্থনৈতিক ইস্যুকে সামনে রেখে হিমাচলের ভোটাররা কংগ্রেসকে জিতিয়ে দিলেন। কাজে লাগল না মোদি ম্যাজিক। হিন্দু প্রধান হিমাচলে কাজ লাগল না বিভাজনের রাজনীতি। মোদির হুমকি সত্ত্বেও বিজেপির বিক্ষুব্ধরা ভোটে লড়লেন এবং ২টি আসনে জিতলেন। এসবই ক্রোনি পুঁজি ও তাদের দোসর বিজেপির কাছে খুব বড় একটা বার্তা। এর মানে, ক্রমশ বিভাজনের রাজনীতি ছাপিয়ে কোথাও কোথাও আম জনতার কাছে আর্থিক দাবি, সাময়িকভাবে হলেও, বড় হয়ে উঠছে। পিছনে চলে যাচ্ছে বিভাজনের রাজনীতি, আরএসএস-এর সাংগঠনিক শক্তির জোর। বিজেপির দাবি, তারা মাত্র ১ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। ঠিকই। তবে হিন্দুত্বের প্রবল হাওয়া এবং ক্রোনি পুঁজিদের টাকার থলিকে হারিয়ে যে কোনও শতাংশেই জেতাটা একটা গুণগত বিষয়। এখানে সংখ্যা পরিমাণ নয়, গুণগত উৎকর্ষ। এভাবেই বিষয়টিকে দেখতে হবে। একই মাপকাঠিতে দেখতে হবে ১ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে ব্রাজিলে লুলার জয়কে এবং বোলসোনারোর পরাজয়কে।
(২)
একই ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে। প্রথমে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তিনটি পুরসভাকে আইন করে মিলিয়ে দিল বিজেপি। এরপর গুজরাটে আপ সক্রিয় দেখে তাদের ব্যস্ত রাখতে গুজরাট নির্বাচনের আগেই ভোট ঘোষণা করা হল দিল্লি পুরসভার। এর পর নানা দুর্নীতির অজুহাতে চলল আপ নেতা ও মন্ত্রীদের হেনস্থা। এরই মধ্যে চলল প্রচারের ব্লিৎসক্রিগ। দলের শীর্ষনেতা, কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং দিল্লির হিন্দু নেতারা পালাক্রমে বিভাজনের রাজনীতির প্রচার করলেন। এর মধ্যে অমিত শাহ হুমকি দিলেন গুজরাটে ‘ওদের’ চিরতরে শিক্ষা দিয়েছি। এত কিছুর পরেও দিল্লি অধরাই রয়ে গেল বিজেপির কাছে। বিভাজনের রাজনীতির বদলে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারির মতো ইস্যু, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান বিষয়ে আপের কর্মসূচিই তফাৎ গড়ে দিল বিজেপির সঙ্গে। সিএএ, দিল্লি হিংসা, বুলডোজার কাণ্ড, বেছে বেছে সংখ্যালঘু ছাত্র নেতাদের গ্রেপ্তার— এক কিছুর পরেও দিল্লি বিজেপির কাছে অধরাই রইল। ফলে এবারের পুর নির্বাচনে হিমাচলের মতো অন্য বার্তা দিলেন দিল্লির ভোটাররাও। কেউ বলতেই পারেন, আম আদমি পার্টি তো সফট হিন্দু। এটা যেমন ঠিক তেমনি একথাও মনে রাখা দরকার যে, আপ বিজেপি নয়। আপের সঙ্গে বিজেপির মিলের চেয়ে ফারাকও অনেক। এবং প্রতিটি পার্থক্য একটি দ্বন্দ্ব।
সুতরাং আপের জয়কে নিখাদ হিন্দুত্বের শক্তির জয় বলে চিহ্নিত করাটা বাস্তবসম্মত হবে না। ঠিক যেমন হিমাচলে কংগ্রেসের জয়কে ১০০ শতাংশ নিখাদ পুঁজিবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির জয় বলে ধরে নেওয়া যাবে না। আসল কথা, কোন্ পরিস্থিতিতে মূল শত্রু দুর্বল হচ্ছে। ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ায় বিজেপি যদি হারে, তাহলে ধরে নিতে হবে এবার ভোটে খোদ রাজধানী দিল্লিতে, যে দিল্লি একচেটিয়া পুঁজি ও বিজেপির শক্ত ঘাঁটি, সেখানে বিজেপির পরাজয় মানে বিজেপি যে দুর্ভেদ্য নয় তা প্রমাণ হওয়া। এবং এখানেও বিভাজনের রাজনীতির চেয়ে নির্ধারক হয়ে উঠেছে অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইস্যু।
(৩)
এবং গুজরাট। সম্ভবত বিজেপি আগেই বুঝতে পেরেছিল হিমাচল ও দিল্লিতে জয় অনিশ্চিত। এক্ষেত্রে পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল হিসাবেই তারা সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গুজরাটে। যদি আগের বারের মতো কংগ্রেস ভাল সংখ্যক আসনে জিতত কংগ্রেস তাহলে প্রমাণ হতো গুজরাতেও বিজেপির জনপ্রিয়তার গ্রাফ নিম্নমুখী বা স্থবির। ফলে নজরকাড়া ফল করতে হলে কংগ্রেসের গড়গুলো দখল করা দরকার ছিল। পাতিদার আন্দোলনের নেতাদের সমর্থন আগাম দলের পক্ষে নিয়ে এসে বিজেপি সেটা করে রেখেছিল। রেশনে বিনা পয়সার চাল–ডালে নিশ্চিত করেছিল আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভোট। এর ওপর আপ প্রার্থীরা ১৩ শতাংশের বেশি ভোট কেটে কংগ্রেসের শোচনীয় ফল নিশ্চিত করে। ( ভারতের মতো দেশে অঞ্চল বিশেষে রাজনৈতিক দলের ভিন্নতর ভূমিকার সাম্প্রতিক নমুনা আপ)। কংগ্রেসও সম্ভবত জানত, দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে গুজরাটে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। তাই তাদের মধ্যে হালছাড়া মনোভাব ছিল গোড়া থেকেই। গুজরাটে বিজেপির মাথাব্যথা ছিল সরকারি কর্মচারীদের ভোট, হিরে শিল্পের শ্রমিকদের ভোট এবং সুরাটের ঐতিহ্যবাহী বন্ধ হয়ে যাওয়া সুতাকল শ্রমিক ও মালিকদের ভোট। বিক্ষুব্ধ মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকশ্রেণীর ভোট শেষ পর্যন্ত সম্ভবত গুজরাটি অস্মিতা দিয়ে ম্যানেজ করা গেছে। সব মিলিয়ে কট্টর হিন্দুত্ব, গুজরাটি অস্মিতা, দুই গুজরাটি নেতা মোদি–শাহকে নিয়ে গুজরাটের অহং বোধ, বিনা পয়সায় রেশনের চাল, পাতিদারদের জন্য সংরক্ষণ এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির দীর্ঘ প্রচার বিজেপিকে গুজরাটের গড় রক্ষায় এবং রেকর্ড সংখ্যক আসন জয়ে সাহায্য করেছে। তার মানে এই নয় যে, অর্থনৈতিক ইস্যুগুলি একেবারে চাপা পড়ে গেছে। ফাটলের ধার ধরে ফের তারা মাথা তুলতে পারে।
সুতরাং, দিল্লি–হিমাচলের পরাজয়ের ব্যর্থতা ঢাকতে গুজরাটের জয়কে বিশাল করে দেখানো ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প বিজেপি ও ক্রোনি পুঁজির কাছে নেই। এখন সেই সবেরই পুনারবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। তবে হিমাচল ও দিল্লির বার্তা যে কিছুটা অশনি সঙ্কেত তা অন্তত বুঝেছে বিজেপি নেতৃত্ব। উল্টোদিকে। পুরনো পেনশন প্রকল্পকে কর্নাটক সহ বাকি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে প্রচারের ইস্যু করে তুলতে চায় কংগ্রেস। বিজেপি জানে, এই ইস্যু হতে পরে তাদের শিকলের দুর্বলতম গ্রন্থি। তাই নির্মলা সীতারামনকে বার বার বলতে হচ্ছে, পুরনো পেনশন প্রকল্প চালু করতে চাইলে তাতে সম্মতি দেবে না কেন্দ্র। এই ইস্যুতে সরকারি কর্মচারী, কংগ্রেস ও বিজেপি — সবপক্ষই যুদ্ধং দেহি অবস্থানে রয়েছে। এবং আগামী দিনে এই সংঘাত জারি থাকবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.