বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

নির্বাচনের রায় দেশের জনগণের প্রাজ্ঞতার প্রতিফলন

নির্বাচনের রায় দেশের জনগণের প্রাজ্ঞতার প্রতিফলন

সঞ্জয় পূততুণ্ড

photo

সারাদেশে বহু চর্চিত অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি এককভাবে সরকার করতে ব্যর্থ হয়েছে। এনডিএ সরকারের নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তাঁর আস্ফালন আপাতত বন্ধ। ভারত রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর ঘটাবার প্রকল্প আপাতত অপূর্ণই থেকে গেল। দেশবাসীর প্রজ্ঞতায় এই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে।

পশ্চিমবাংলায় শাসকরা তাদের ক্ষমতা ধরে রেখে কিছুটা শক্তি বৃদ্ধি করতেও সক্ষম হয়েছে। নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের জয় ঘোষিত হবার পর বিভিন্ন জায়গায় বিরোধীদের উপর নতুন করে আক্রমণ শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকবে না বলে মনে হয়। শুরু হয়ে গেছে তৃণমূলের প্রকাশ্য অন্তর্দ্বন্দ্ব।

দেশে গত ১০ বছর ধরে নরেন্দ্র মোদির এনডিএ সরকার চলছিল। কিন্তু বাস্তবে বিজেপি একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় এনডিএ-র শরিক দলগুলির গুরুত্ব ছিল না। শরিকদলগুলির সঙ্গে সভা করে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো না। সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে সভা করে সিদ্ধান্ত করার রীতি ছিল না। যা করার বিজেপি একাই সিদ্ধান্ত নিত। কোনও সরকারি প্রকল্প বা কর্মসূচি কার্যকর করা হলে তা প্রধানমন্ত্রীর নামেই করা হতো। তিনিই ছিলেন সর্বময় একাধিপতি। এবার মন্ত্রিসভার শপথ নেওয়ার আগেই বোঝা গেছে সে পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এবার এনডিএ-র সভা করে সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকর করার বাধ্যবাধকতা কিছুটা হলেও থাকবে। কেবল সরকার চালানোর পদ্ধতি নয়, কী কাজ করবে সেক্ষেত্রেও নতুন পরিস্থিতি দেখা দেবে বলেই অনুমান।

ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার কর্মসূচি উচ্চারিত হচ্ছিল দ্বিধাহীনভাবে। দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক উপকরণ, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, গণতান্ত্রিক অধিকার — সবকিছুই বাতিল করার লক্ষ্যে বিজেপি এগোচ্ছিল। লোকসভা রাজ্যসভায় আলোচনা না করে, সংবিধান ও আইন অমান্য করেই কার্যত সরকার তার কার্যধারা চালিয়ে যাচ্ছিল। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন ছিল সময়ের অপেক্ষা — নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের অপেক্ষা। লোকসভা নির্বাচনে চারশোর বেশি আসন দখলে তারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কমিশনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা নির্বাচনের সময় স্পষ্ট হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভাঙার অভিযোগ গুরুত্ব বিশেষ গুরুত্ব পায়নি।

নির্বাচনের পরে সরকার গড়তেই বিজেপিকে ঘাম ঝরাতে হয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ ভারত বহুভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্মের, নানা জাতিবর্ণের এই দেশ। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতকে এক ভাষা এক ধর্ম এক নায়কের দেশ হিসেবে গড়ে তোলা আপাতত গতি হারাবে বলেই অনুমান।

cover

দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ঢেলে সাজাবার উৎসাহে যারা মশগুল ছিল নির্বাচনের রায় বেরোবার পর সরকার গঠন করতেই তাদের গলদঘর্ম হতে হয়েছে‌। সাংসদ কেনা বেচার টাকার অভাব ছিল না। তবুও শরিকদের দাবি মেটাতে সমস্যা এড়াতে পারছে না বিজেপি। শাসক শ্রেণীর মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে। দেশের বড় পুঁজির মালিকদের মধ্যে সংঘাত বেড়ে উঠেছে। আবার আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গেও দ্বন্দ্ব বেড়ে উঠেছে।

দেশবাসীর ক্ষোভ বিক্ষোভের কারণে গড়ে উঠে শাসক বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’। মোদি সরকার জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আলোচনা নানাভাবে বাধা দিয়েছে। এবার বিরোধীদের শক্তি বাড়ায় বিতর্ক এড়ানো যাবে না। বিরোধী শক্তির সঙ্গে পুঁজির স্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই একথা বলা যাবে না। কিন্তু দেশজুড়ে ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উত্থাপত দাবি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে কঠিন হবে। তবে দেশের ব্যাপকতম দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার দাবিগুলি সজোরে উত্থাপন করার মতো শক্তি দেশের বিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে গড়ে ওঠেনি। সারা দেশে বামপন্থীদের শক্তি প্রান্তিক হয়ে পড়া একটা বড় সমস্যা। এরকম অবস্থায় শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপ জনতার দাবিগুলি আদায়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।

আবার এই সময়ে নানান অনৈতিক আপোষের সম্ভাবনাও থাকবে। শ্রমজীবী শ্রেণীরগুলির জীবন-জীবিকা ও অধিকারের দাবিগুলি অর্জনের জন্য সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। ‘ইন্ডিয়া’ জোট অনেক দাবি উত্থাপন করেছে, আবার অনেক দাবি উত্থাপন করেনি। সমস্ত দাবিগুলি সজোরে সামনে আনতে বামপন্থী নেতা-কর্মীদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী হবে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি।
বড় পুঁজিপতিরা যেরকম শক্তিশালী সরকার চেয়েছিল, বর্তমান এনডিএ সরকার সেই ভূমিকা পালনে দ্বিধান্বিত হবে। সরকারকে নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত করার জন্য তারা টাকার থলি নিয়ে সক্রিয় থাকবে। সরকারের জনবিরোধী কাজকে প্রতিহত করতে সংগ্রাম এবং ঐক্যের উপযুক্ত ভারসাম্য রক্ষা করে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। বিজেপি বিরোধী জোট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাকে রক্ষা করেই এগোতে হবে। আবার ঐক্য কোন লক্ষ্যে সে সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। আপোস রফার নামে আত্মসমর্পণ শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে।

নির্বাচনী ফলাফলের গভীর পর্যালোচনা করতে হবে। বহু ইতিবাচক উপাদানের সঙ্গে ক্ষতিকর নেতিবাচক প্রবণতা অস্পষ্ট নয়। মনে রাখতে হবে, বামশক্তির বিকাশ না ঘটাতে পারলে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিপদ প্রতিহত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

পশ্চিমবাংলায় রাজ্যের শাসক দল বড় ধরনের জয় পেয়েছে। সংবাদমাধ্যম এই জয়কে লক্ষ্মী ভান্ডারের মতো প্রকল্পগুলির প্রতি মানুষের সমর্থন বলে বর্ণনা করছে। তবে সারা দেশে যেভাবে ব্যাপক সাধারণ মানুষ বিজেপিকে রুখতে ভোট দিয়েছেন সেই প্রবণতা এরাজ্যেও শাসক দলকে সুবিধে দিয়েছে। বিজেপিকে পরাস্ত করতে অনেক মানুষ তৃণমূলকে সমর্থন করেছে‌। বামপন্থী শক্তির দুর্বলতা এবং বাম-কংগ্রেসের জোটকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে না হওয়া এর কারণ। যে শক্তির জন্ম হয়েছিল কংগ্রেস ভেঙে এবং বামপন্থীদেরকে কোণঠাসা করার জন্য তারা কেবল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের উপর নির্ভর করে বসে থাকেনি। বহু জায়গায় ভোট লুঠ করা হয়েছে, অবাধে অর্থ বিলি করা হয়েছে। ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্র তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

অযোধ্যার ফৈজাবাদের জনগণ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল ও বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের দুর্বলতার কারণ খুঁজে বার করার জন্য গভীর আত্মঅনুসন্ধান প্রয়োজন।

তৃণমূল ও বিজেপি দলের সম্পর্কের বিবর্তনের পর্যায়গুলি ভুলে যাওয়া যথাযথ হবে না। ১৯৯৮-২০০৬ পর্যন্ত তৃণমূল ছিল এনডিএ-র শরিক; বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার মন্ত্রী। আবার ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলায় সরকার গঠনের পর অসংখ্য দুর্নীতির মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির তদন্তের পরিণতি কারো কাছেই অজানা নয়।

‘ইন্ডিয়া’ জোটের সঙ্গে তৃণমূলের অংশীদারি বিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে। প্রথমে জোটের উদ্যোক্তা। দ্বিতীয় পর্বে মন্তব্য, কংগ্রেস ৪০টি আসনও পাবে না। পশ্চিমবাংলায় জোট নেই, একাই সব। তৃতীয় পর্বে বাইরে থেকে সমর্থন। শেষে বিজেপির হাল খারাপ হওয়ার ইঙ্গিত মেলায় সরকারে থাকার ঘোষণা। নির্বাচনের পর ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অধিকাংশ শরিক বিরোধী আসনে বসার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার গড়ার উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব। কংগ্রেস ও বামদের বাদ দিয়ে আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে সমান্তরাল প্রচেষ্টা। শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার দাবি নিয়ে তৃণমূল লড়বে এমন দুরাশা নিশ্চয়ই কেউ করেন না।
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপি কিছুটা দুর্বল হয়েছে। কিন্তু তাদের নেতৃত্বেই এনডিএ সরকার গঠিত হয়েছে। বড় পুঁজিপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা এই সরকার পাবে। রয়েছে আরএসএস-এর দেশব্যাপী বিস্তৃত সংগঠনের জাল। তারা জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষ বপন করে চলেছে। সুতরাং বিজেপি-র শক্তিকে ছোট করে দেখা হবে ভুল। শ্রমজীবী জনগণের জীবন-জীবিকার আন্দোলনগুলির মধ্য দিয়েই পুঁজির স্বার্থের রক্ষক সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাভূত করা সম্ভব। সেই প্রক্রিয়াতেই বামপন্থীদের শক্তি বেড়ে উঠতে পারে। নবাগত তরুণ তরুণীদের শ্রমজীবী জনতার আপনজন হয়ে উঠতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যোগ্য হয়ে উঠতে হবে নবীন প্রজন্মকে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.