বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
‘এসআইআর হবে। দেড় কোটি ভোটারের নাম পশ্চিমবঙ্গে বাদ দেব।’ এই কথাটাই বলেছেন মেদিনীপুরের কাঁথির অধিকারী পরিবারের শুভেন্দু অধিকারী। এইসব রাজনৈতিক নেতাদের একটা সুবিধা হল, যা হোক কিছু বলে দিলেও কেউ উল্টে প্রশ্ন করেন না বা করতেই পারেন না। কিন্তু আমাদের তো প্রতিবাদ করতেই হবে, কথা বলতেই হবে, প্রশ্নও করতে হবে। কারণ যারা বলি হচ্ছেন তারা অধিকাংশ গতরে খাটা শ্রমিক। এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে, বিহারে ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়তে চলেছে। ওই রাজ্যের খসড়া তালিকায় এই বাদ যাওয়াদের মধ্যে অধিকাংশ ভোটাররা কারা? কেন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের প্রহেলিকা নির্মাণ করছে?
আমরা সকলেই জানি যে, জাতীয় নির্বাচন কমিশন তাঁদের ওয়েবসাইটে বিহারের ২০০৩ সালে এসআইআর (SIR) এর সময়কার নির্বাচক তালিকা প্রকাশ করেছিল। আমরা এখন তাঁদের কাছে আমরা কি ওই দাবি করতে পারি না? নির্বাচন কমিশনের উচিত এই নামগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ ভোটদাতাদের জন্যে তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করে জনসমক্ষে প্রকাশ করা। আমাদের তো বলা হয়, যে কোনও নির্বাচনের আসল শর্ত হল স্বচ্ছতা। হতেই পারে এমনিতেই বিহারের যাঁরা প্রবাসী শ্রমিক, তাঁরা অনেকেই এই প্রক্রিয়ার শর্ত পূরণ করতে পারেননি। প্রবাসী শ্রমিকরা পেশা, জীবিকার বা কাজের জায়গা থেকে ছুটি পাননি বলে আসতেও পারেন না। তাই অনেকের নাম বাদ যাচ্ছে। এভাবে নাম বাদ দেওয়া কোনও রাজনৈতিক দলের কি সমর্থন করা উচিত?
কেউ কি জানেন, এই প্রবাসী শ্রমিকেরা কী কী শর্তে কাজ করেন? এদের বেশিরভাগের শ্রমের সময় ১২ ঘন্টা, কোনও ছুটি নেই। ছুটি পান ছট পুজোয়, ঈদ, দেওয়ালি এবং ভোট দেওয়ার সময়। এ ছাড়া এইসব ভোটারদের বেশিরভাগ ছুটিই পান না। তার ছাড়া যাতায়াতের খরচ বহন করার মতো এদের অনেকের আর্থিক সঙ্গতি নেই। এই সংখ্যাও বেশ উল্লেখযোগ্য। তাই নির্বাচন ঘোষণা হলে তাঁরা যদি ফিরে এসে দেখেন, যে তাঁদের অনেকের নাম নেই, তাহলে অঞ্চলের বুথ স্তরের আধিকারিক এবং বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা হতে বাধ্য। যদি বাদ যাওয়া মানুষদের নাম নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়, তাহলে যেমন নির্দিষ্ট ব্যক্তিও যেমন বুঝতে পারবেন তেমন অন্যান্যরাও বুঝতে পারবেন যে, নির্বাচন কমিশন আদৌ সঠিকভাবে কাজ করেছেন কী না।
বিভিন্ন খবরে যা বলছে বা দেখাচ্ছে তাতে ভোটদাতাদের মধ্যে একটা ভয়, আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে বা আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। অজিত আঞ্জুমের মতো অনেক সাংবাদিকের প্রতিবেদনে যা দেখাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, এটা সঠিক কাজ হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে প্রতিটি ভোটার এইটুকু স্বচ্ছতা তো আশা করতেই পারেন। এখন কেন ভোটারদের তাকিয়ে থাকতে হবে দেশের সুপ্রিম কোর্টের দিকে? কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কি ওখান থেকে খুব বেশি কিছু আশা করতে পারি? অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা মনে রেখেই এই সংশয়। যাই হোক এই প্রসঙ্গে কয়েকটি মামলার উল্লেখ করি।
যেমন, ইন্দ্রজিৎ বড়ুয়া বনাম নির্বাচন কমিশন (১৯৮৫) মামলা। এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মূল কথা, যে কোনও ব্যক্তির নাম একবার ভোটার তালিকায় উঠেছে — সেটাই তার নাগরিকত্বের একটা শক্তিশালী প্রমাণ। তাকে আবার আলাদা করে ‘নাগরিক কি না” সেটা প্রমাণ করতে বলা ঠিক নয়। ভোটার তালিকা তৈরির সময় নাগরিক না হলে নাম তোলা যাবে না — এটাই ঠিক। কিন্তু একবার যদি কারও নাম ভোটার তালিকায় উঠে যায়, তাহলে তা ধরেই নেওয়া হবে সে ভারতের নাগরিক। কেউ যদি দাবি করে, ওই ব্যক্তি নাগরিক নয়, তাহলে তাঁর উপরই দায়িত্ব পড়ে প্রমাণ করার, ভোটার তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তির নয়।
লাল বাবু হুসেন বনাম নির্বাচনী আধিকারিক (১৯৯৫) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মূল কথা ছিল, ভোটার তালিকা থেকে কারো নাম বাদ দেওয়া খুব গুরুতর বিষয়। এটা সহজে বা সন্দেহের বশে করা যায় না। এ ছাড়াও কারও নাম বাদ দিতে হলে আগে তাকে জানাতে হবে এবং তাকে তার বক্তব্য বলার সুযোগ দিতে হবে। এই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, নির্বাচন কমিশন বা অফিসারদের যদি সন্দেহ হয়, তাহলেও তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নাম কাটতে পারে না। প্রথমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে লিখিত নোটিশ দিতে হবে। এরপর তাকে শুনানির সুযোগ দিতে হবে। তারপর সঠিক নিয়মে তার নাম বাদ দেওয়া যাবে।
চৌধুরী বনাম নির্বাচন কমিশন মামলা (১৯৯৪)র প্রেক্ষাপট ছিল আসামে এসআইআর। জাতীয় নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়ায় এই রাজ্যের নাগরিকত্ব যাচাই করার চেষ্টা করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ‘ভোটার তালিকা তৈরি করার সময় নাগরিকত্ব যাচাই করা যায় না। প্রাথমিক তালিকা তৈরি হয় শুধু পরিবারের তথ্য বিবরণী (ফর্ম ৪) এর ভিত্তিতে।’ অর্থাৎ নাগরিকত্ব যাচাই শুধু খসড়া তালিকা প্রকাশের পরে অভিযোগের ভিত্তিতে হতে পারে, নাগরিকত্ব যাচাই করা — জাতীয় নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপ ভ্রান্ত এবং আইন বিরুদ্ধ।
মহ. রহিম আলি বনাম আসাম রাজ্য মামলা (২০২৪)র বিষয় ছিল আসামে মহিলার বংশগত বানান ভুলের কারণে তাকে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছিল, যদিও তাঁর ভোটার তালিকায় নাম ছিল ১৯৬৫ থেকে। সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নেয় নামের অল্প ভুল বা তারিখের পার্থক্য দিয়ে নাগরিকত্ব সন্দেহ করা উচিত নয়, বিশেষ করে ভোটার তালিকায় দীর্ঘদিন নাম থাকলে।
মামেজা খাতুন (২০২৫) মামলার পরিপ্রেক্ষিত ছিল ডি-ভোটার তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের ভোটাধিকার বাতিল এবং তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে মামলা। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন যে ‘বুথ স্তরের আধিকারিকেরা বা BLO রা সনাক্ত করতে পারেন, কিন্তু নাম কাটার আগে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের সিদ্ধান্তই শেষ কথা।’
অথচ সর্বোচ্চ আদালতের এই সমস্ত রায়কে উপেক্ষা করে, অমান্য করে বিজেপি সরকারের মনোনীত জাতীয় নির্বাচন কমিশন এসআইআর-এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কোন যুক্তিতে?
বর্তমানে এই সমস্যার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মামলায় মমলাকারীরা যে হলফনামা জমা দিয়েছেন সেখানেও এইসব রায়গুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যদি বলে যে তাঁরাও একটা নতুন আদালত, যাঁদের আগের কোনও মামলার রায় নিয়ে ভাবার কোনও দায় নেই। তাহলে কী হবে? দেখছেন না মহারাষ্ট্রের উচ্চ আদালত বলেছে, প্যালেস্তাইনে মানুষের ওপর ইজরায়েলের নিধন যজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না! তাই এই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ আপাতত সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে। বিহারের বিধানসভা থেকে শুরু করে সংসদের বাদল অধিবেশনে বিরোধীরা এই সংক্রান্ত বিরোধিতা ঐক্যবদ্ধ ভাবে জারি রেখেছে এবং তা যৌথভাবেই হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে আগামীদিনে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এই লড়াই অনেকদূর যাবে। শ্লোগান উঠেছে বিহার থেকে ‘চুনাও চোর, গদ্দি ছোড়’।
বাংলাতেও এই লড়াই যে আরো জোরদার হবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। বাংলায় এই লড়াই নতুন কোনও সমীকরণ এবং নতুন কোনও শ্লোগানের জন্ম দেয় কি না, সেটাও দেখার। বামপন্থী কমিউনিস্টদের এই সমগ্র যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকে শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির অভিমুখে পরিচালিত করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। মার্কসবাদ থেকে শিখেছি, ‘নির্বাচন ও এমনি সরকারের মাধ্যমে ধাপে ধাপে জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করা হল চিরাচরিত সংস্কারবাদী ধারণা।’