বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের ভোটে বিপুল জয়ের পর জনদরদী মুখোশের আড়ালে থাকা বিজেপি শাসনের আসল চেহারাটা ফের সামনে চলে এসেছে। বেকারত্ব, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, মানুষের আয়— জীবনযাপনের এসব জরুরি দিকগুলির দিকে তাকালেই বিষয়টা বোঝা সহজ হয়। মূল্যবৃদ্ধির কথাই একে একে দেখা যাক।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের জেরে এক সময় বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম লাফিয়ে উঠেছিল ব্যারেল পিছু ৮৬ ডলার থেকে একেবারে ১৩৯ ডলারে। এর আগে করোনার সময় থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকা সত্ত্বেও দেশে তার দাম কমায়নি মোদি সরকার। উল্টে বাড়তে বাড়তে পেট্রোলের দাম ১০০ টাকা ছুঁয়েছিল। ডিজেল ঘোরাফেরা করছিল ১০০র কাছাকাছি। অক্টোবরে উপনির্বাচনে ধাক্কা খেয়ে প্রায় তিন মাস জ্বালানির দামবৃদ্ধি স্থগিত রেখেছিল কেন্দ্র। ভোটের ফলাফলে তার সুবিধা মিলেছে। এরপর থেকে এদেশে ফের পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম। পেট্রোলের সঙ্গে ডিজেলের দামও ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এমন নয় যে ব্যারেল পিছু তেলের দাম এখনও ১৩৯ ডলার। প্রথমত, রাশিয়া থেকে সস্তাদরে তেল কিনছে ভারত। দ্বিতীয়ত, এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে আগের মতই ১০০ ডলারের নীচে নেমেছে। এই দুই সুবিধা সত্ত্বেও পেট্রোল ও ডিজেলের ওপর কর কমায়নি কেন্দ্র। বরং তা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা কোষাগারে ঢুকছে। সম্ভবত বিনি পয়সায় করোনার টিকা দেওয়ার খরচ তোলা হচ্ছে এই ভাবে।
দেশের ভেতরে চালু মুদ্রার কেনার যা ক্ষমতা বা পারচেজিং পাওয়ার, তার ভিত্তিতে হিসাব কষলে দেখা যাচ্ছে ভারতে এলপিজির লিটার পিছু দাম বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। পেট্রোলের কথা ধরলে সবচেয়ে বেশি দামের দেশগুলির মধ্যে ভারতের স্থান তৃতীয়। ডলারের হিসাবে ভারতে ১ লিটার এলপিজির দাম ৩.৫ ডলার, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এরপরেই তালিকায় রয়েছে তুরস্ক, ফিজি, মলদোভা ও ইউক্রেন। সুইৎজারল্যান্ড, ফ্রান্স, কানাডা, ব্রিটেনে পেট্রোলের দাম লিটার পিছু ১ ডলার। এর মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সুইৎজারল্যান্ডকে গ্যাস আমদানি করতে হয়। এমাসেই বাণিজ্যিক এলিপিজির দাম বেড়েছে ২৫০ টাকা। এর জেরে কলকাতায় ১৯ কেজি বাণিজ্যিক গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম দাঁড়িয়েছে ২৩৫১ টাকা। গত ২ মাসে মোট দামবৃদ্ধি ৩৪৬ টাকা। এছাড়া মোদি জমানায় ৪৫০ টাকার রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার হাজার টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে দেখলাম আমরা। এবং ঘোষণা না করেই তুলে দেওয়া হয়েছে ভর্তুকি। বাজারের নামে বিপুল পরিমাণ বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। (সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৮ এপ্রিল, ২০২২)
সাধারণ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জেরে রীতিমতো চাপে সাধারণ মানুষ। গত বছর মার্চের তুলনায় এ বছর মার্চে জিনিসের দাম বেড়েছে ৬.৯৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। এই পর্বে ভোজ্য তেল ও চর্বির দাম বেড়েছে ১৮.৭৯ শতাংশ, আনাজ ১১.৬৪ শতাংশ, মাছ–মাংস ৯.৬৩ শতাংশ, জ্বালানি ও আলো ৭.৫২ শতাংশ, সামগ্রিকভাবে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৬৮ শতাংশ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে শিল্পোৎপাদন। এর মানে বিনিয়োগ বাড়ছে না এবং লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। যাঁরা চাকরি করছেন বর্ধিত মূল্যের কারণে তাঁদের প্রকৃত আয় কমছে। (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ এপ্রিল, ২০২২) এবছর ফেব্রুয়ারি মাসে দামবৃদ্ধির তালিকা ছিল এরকম— তেল ও স্নেহ জাতীয় পণ্য ১৬.৪৪ শতাংশ, মাছ–মাংস ৭.৪৫ শতাংশ, সবজি ৬.১৩ শতাংশ, জামাকাপড় ও জুতো ৮.৮৬ শতাংশ, আবাসন ৩.৫৭ শতাংশ, তামাক ২.৩৯ শতাংশ, পাঁচমিশেলি জিনিস ৬.৫২ শতাংশ। (সূত্র: মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন)। কেন্দ্রের এই মন্ত্রক জানিয়েছে জুন মাস পর্যন্ত বাড়বে ভোজ্য তেলের দাম। কারণ দেশের চাহিদার একটা বড় অংশ আসে ইউক্রেন থেকে যার সরবরাহ এখন অনিশ্চিত। এবার দক্ষিণ আমেরিকায় মার খেয়েছে সয়াবীনের উৎপাদন। ফলে দাম বাড়বে সয়া তেলেরও। এছাড়া পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে আলু ও ডিমের। গমের দাম বেড়েছে ১১.০৩ শতাংশ। (সূত্র: দ্য ইকনমিক টাইমস)।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি জানাচ্ছে, এবছর ফেব্রুয়ারিতে দেশে সামগ্রিগক বেকারির হার ছিল ৮.১০ শতাংশ। এপ্রিল মাসে এই হার কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৭.০৫ শতাংশ। শহরের বেকারির হার ৮.৫ শতাংশ এবং গ্রামে ৭.১ শতাংশ। তবে ভারতের মতো গরিব দেশে এই হারও বেশ চড়া। রাজ্যওয়াড়ি ছবিটা দেখলে জানা যাচ্ছে, মার্চে হরিয়ানায় বেকারির হার ছিল ২৬.৭ শতাংশ, রাজস্থান ও জম্মুতে ২৫ শতাংশ, বিহারে ১৪.৪ শতাংশ, ত্রিপুরায় ১৪.১ শতাংশ। উত্তরপ্রদেশে বেকারির হার ৪.৪ শতাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ৫.৬ শতাংশ। (সূত্র: সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি)। করোনা পরিস্থিতি কেটে যাওয়ায় কিছুটা স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে অর্থনীতি। তবে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিল্পোৎপাদন বাড়ছে না। ফলে তৈরি হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। গ্রামাঞ্চলে চৈতি ফসল তোলা ও বোরো ধান বোনার বোনার কাজে কিছু লোকের কাজ হয়ত হয়েছে। কিন্তু খুব শিগগরিই এই সব মরশুমি কাজ ফুরোবে এবং বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে।
ওপরের সংখ্যাতথ্যগুলো মেলালে যে সাংঘাতিক ছবিটা ফুটে ওঠে তাতে আমরা দেশের জনজীবনের অসহায় অবস্থাটা দখতে পাচ্ছি। এই চরম সংকটের দিনে বিজেপি বা তৃণমূলের মতো সরকারগুলো অনুদানের প্রকল্পে কিছু নগদ টাকা ছড়িয়ে অনুগৃহীত লোক তৈরি করে ভোট বাড়ানোর কৌশল অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, রিলিফের একটা সীমা আছে। বিজেপি সরকারের নীতিতে মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারি সেই সামা ছাপিয়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে এবার পথে নামার সময় এসেছে।