বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

জাহাঙ্গিরপুরিতে স্বৈরাচারী বুলডোজার এবং প্রতিরোধ

জাহাঙ্গিরপুরিতে স্বৈরাচারী বুলডোজার এবং প্রতিরোধ

পূবালী রাণা

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরিতে গরিব শ্রমজীবী মানুষের বস্তির উচ্ছেদের জন্য ধেয়ে আসা বুলডোজার রুখে দিলেন বামপন্থীদের নেতৃত্ব বস্তিবাসীরা।
২০২২ সাল। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের ৭৫তম বর্ষ। স্বাধীনতার পরবর্তীতে সবচেয়ে খারাপ সময়ে দাঁড়িয়ে আছি আপামর ভারতবাসী। অর্থনৈতিক মন্দার তালে তাল রেখে যেভাবে হুহু করে বেড়ে চলেছে দারিদ্র, বেকারি, ক্ষুধা, তাতে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির "অচ্ছে দিন" কথাটা উৎকট অশ্লীল রসিকতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
গরিব বিরোধী, জনগণ বিরোধী, পুঁজিপতিদের স্বার্থবাহী বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের কাজে ফ্যাসিস্ট প্রবণতা ফুটে বেরোচ্ছে প্রতি নিয়ত। সরকারের প্রতিটি কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট, যে তাদের দুটো অ্যাজেন্ডা রয়েছে। প্রথমত যে কোনও মূল্যে, পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখা। দ্বিতীয়ত, গোয়ালকরের "হিন্দু রাষ্ট্র"এর সংবিধান বিরোধী স্বপ্নকে, যা জনগণের কাছে দুঃস্বপ্ন, বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা। একদিকে, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে পুঁজিপতিদের কাছে জল-জঙ্গল-জমিন ও দেশটাকে বিক্রি করে দিচ্ছে মোদি সরকার। বেচে দিচ্ছে পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, জঙ্গল, খনি। অন্যদিকে, একের পর এক মুসলমানমেধ, দলিতমেধ যজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
এই কাজের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরিতে গরিব শ্রমজীবী মানুষের বস্তির উপরে বুলডোজার চালিয়ে দেওয়া। গরিব মানুষগুলোর মাথা গোঁজার ঠাঁই, দোকানঘর, ধর্মস্থান সবকিছু গুঁড়িয়ে ধুলিসাৎ করে দেবার চেষ্টা।
বলাবাহুল্য, এই ধরনের ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী কাজ করার টেমপ্লেট তাদের আগে থেকেই তৈরি করা থাকে।
প্রথমেই 'টার্গেট'কে 'দেশদ্রোহী' বা 'দেশবিরোধী' হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঠিক যেমনটা এনআরসি-র বিরোধী আন্দোলনকারীদের "দাঙ্গাবাজ ষড়যন্ত্রকারী দেশদ্রোহী" তকমা দিয়েছিল অমিত মালব্যের নেতৃত্বাধীন বিজেপির আইটি সেল। সর্বনাশা কৃষি আইনের বিরোধিতায় দিনের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কৃষকদের "খালিস্তানি জঙ্গি" তকমা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
সেই একই ফর্মুলায় প্রথমে রামনবমীর মিছিল থেকে বারবার জাহাঙ্গিরপুরির সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বস্তিতে পাথর ছোঁড়া হল। মসজিদে গেরুয়া ঝাণ্ডা লাগিয়ে দিয়ে, অস্ত্র নিয়ে হুঙ্কার, তারস্বরে জয় শ্রীরামের ডিজে চালিয়ে, অকথ্য ভাষায় সাম্প্রদায়িক গালাগালি ও ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হল।
তারপর যখন বস্তিবাসী মেহনতি মানুষেরা একজোট হয়ে প্রতিরোধ করলেন, তখন তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হল "বাংলাদেশী মুসলমান" বলে। বলা হল তারা হিংসা ছড়াচ্ছে, দাঙ্গা করছে। আরএসএস-এর আইটি সেল এবং কর্পোরেট মিডিয়ায় গোয়েবলসীয় কায়দায় বারবার প্রচার করা হল "দিল্লি রায়ট ২" ঘটাতে চলেছে জহাঙ্গিরপুরির বস্তিবাসী মুসলমানরা।
উদ্দেশ্য খুব পরিস্কার। বুলডোজার দিয়ে গরিব শ্রমজীবীদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ধুলিসাৎ করে দেবার আগেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা।
এনআরসি-র বিরোধী আন্দোলনের সময় প্রচার চালানো হয়েছিল যে আদতে এনআরসি করে বাদ দেওয়া হবে "বাংলাদেশী মুসলমান"দের। "অবৈধ অনুপ্রবেশকারী" শব্দগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল "বাংলাদেশী মুসলমান" শব্দগুলোর সঙ্গে। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানের আগ্রাসন চালানো শক্তি ধর্মের বেড়াজাল দিয়ে পৃথক করেছিল 'অনুপ্রবেশকারী' এবং 'শরণার্থী' শব্দদুটিকে। যদিও আসামে নাগরিকত্ব হারানো কুড়ি লক্ষ মানুষের মধ্যে ষোলো লক্ষই ছিল হিন্দু। এনআরসি করে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের কাছে সস্তা শ্রমিক সরবরাহ করার যে পরিকল্পনা করেছিল অমিত শাহদের সরকার, ডিটেনশন ক্যাম্পে হিন্দু মুসলমানের কোনও পার্থক্য অবশ্য করেনি। আসামে ষোলো লক্ষ হিন্দুদের বাদ পড়াটা নিছকই কো ল্যাটারাল ড্যামেজ নাকি বাঙালি বিদ্বেষ, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে।
ঘটনাচক্রে দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরিতে যে বস্তিগুলোতে ধেয়ে এসেছিল রাষ্ট্রের বুলডোজার, সেগুলোর বাসিন্দারা প্রায় সবাই বাঙালি এবং মুসলমান। এঁদের অনেকেরই আদি বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদীয়া, বীরভূম, বর্ধমানে। রুজির তাগিদে আজ তাঁদের কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ দর্জি কেউ বা সব্জি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা। নরেন্দ্র মোদির সরকার অবশ্য তাদের "বাংলাদেশি" বলতেই ভালোবাসে।
রাষ্ট্রের এই বুলডোজারের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রবীণ কমিউনিস্ট কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা, সিপিআই(এম) নেত্রী বৃন্দা কারাত, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রবি রাই— নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেহনতি মানুষের প্রতিরোধের। স্তব্ধ হয়ে গেছে বুলডোজারের চাকা। প্রথমে মানুষের প্রতিরোধে এবং
তারপর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আপাতত আটকানো গেছে উচ্ছেদ।
সেদিনের প্রতিরোধে দেশের বাম শক্তিগুলোকে যেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে দেখা গেছে, তেমনই লক্ষ্য করা গেছে দিল্লির কেজরিওয়াল সরকারের ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা। কংগ্রেসের হিরন্ময় নিরবতা।
উচ্ছেদ চলাকালীন তৃণমূলের বাইশজন সাংসদ নিরাপদ দূরত্বে ঠাণ্ডা ঘরে বসে একটি টুইটও করেন নি। বুলডোজারের মুখে বাম নেতৃত্বে প্রতিরোধের ঘটনার দিন কোনওরকম সক্রিয়তা না দেখা গেলেও, পরেরদিন তৃণমূলের প্রতিনিধি দল সেখানে উপস্থিত হন; পুলিশ বাধা দিলে তাঁরা অবশ্য আর এগোননি জাহাঙ্গিরপুরির ঘটনাস্থলে।
আরো একবার মেহনতি মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছে দেশের বাম শক্তিরা। পারস্পরিক মতবিরোধ সরিয়ে রেখে একজোট হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে নজির স্থাপন করেছে দেশের বামপন্থী দলগুলো, তা মে দিবসের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছে বৈ কি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.