বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনী বিশ্লেষণে চারটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে চর্চিত হচ্ছে। এক, কর্ণাটকের বিপর্যয়ের পরে মোদির নামে নির্বাচন লড়ে বিজেপি কি ভুল করছে? দুই, ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার সুবাদে হিমাচল ও কর্ণাটকে কংগ্রেসের নির্বাচনী সাফল্যের ধারা কি বজায় থাকবে? তিন, মণিপুরের মর্মান্তিক ঘটনাবলি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা ও কেন্দ্র-রাজ্যের নিদারুণ ব্যর্থতা মিজোরাম নির্বাচনে কি প্রভাব ফেলবে? এবং চার, এই পাঁচটা নির্বাচনের ফলাফল মোদির জনপ্রিয়তায় ও ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কি প্রভাব ফেলবে?
নির্বাচনী ফলাফল অনেক বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন, সরকার পক্ষ বা বিপক্ষের প্রচার, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, সাংগঠনিক শক্তি, সরকার বা দলের ভাবমূর্তি, ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে কোনটা নির্বাচনী ফলাফলকে কতটা প্রভাবিত করবে, তার নিখুঁত পরিমাপ সম্ভব নয়। সেটাই হল নির্বাচনী বিশ্লেষণ করার সমস্যা।
তবে রাজ্য নির্বাচনের ফলাফল একটু দীর্ঘ সময়কালের নিরিখে বিচার করলে কয়েকটি নকশা স্পষ্ট হয়। যেমন, কিছু রাজ্যে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার পাল্টে দেওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। উত্তর ভারতে হিমাচল প্রদেশ ও রাজস্থান তার মধ্যে পড়ে। কেরল, তামিলনাড়ুর মতো, প্রায় তিন দশক ধরে এই দুই রাজ্যেও মতদাতারা পাঁচ বছর অন্তর সরকার পালটে দিচ্ছেন। দুই, দেশের বেশির ভাগ রাজ্যে একটি সরকার দুই, কি বড়জোর তিনবার ক্ষমতায় ফিরে আসে, তার পরে ক্ষমতা বদল হয়। মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিসগড়, মিজোরাম পড়ে তার মধ্যে। তিন, রাজ্য নির্বাচনে সরকার বিরোধী হাওয়া থাকলেও, সেই হাওয়া সরকার-বিরোধী ভোটে রূপান্তরিত হতে গেলে বিরোধী পক্ষের সাংগঠনিক শক্তির ও বিশ্বাসযোগ্য কার্যসূচির প্রয়োজন হয়। ২০১৭-র গুজরাত বা ২০০৬-র পশ্চিমবঙ্গে সুস্পষ্ট বিরোধী হাওয়া ছিল, কিন্তু কংগ্রেস ও তৃণমূল সাংগঠনিক শক্তির দুর্বলতায় ও বিশ্বাসযোগ্য কার্যসূচির অভাবে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। এমন আরও উদাহরণ আছে। চার, কিছু রাজ্য আছে যা একই সরকারকে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় ফেরত আনে, অতীতের পশ্চিমবঙ্গ এবং এখনকার ওড়িশা, গুজরাট সেই পথের পথিক। পাঁচ, বিহারের মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ভারতের প্রায় সব রাজ্যই ক্রমশ দুই পার্টি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছে। দক্ষিণ ভারতে তা আগেই ঘটেছে, এখন সেই প্রবণতা বাকি ভারতেও বেশ স্পষ্ট। পাঁচটি রাজ্যেও নির্বাচন মূলত দ্বিমুখী।
পাশপাশি, এখনও রাজ্য নির্বাচন অনেকটাই দল-কেন্দ্রিক। দ্বিমুখী, দল-কেন্দ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কিছু বিশেষত্ব আছে। দলের নেতা-নেত্রীর ভাবমূর্তির পাশাপাশি প্রার্থীর ও সরকারের ভাবমূর্তি প্রায় সমান গুরুত্ব পায়, এবং এটা সরকার পক্ষের বেলায় বেশি করে খাটে। এক দিকে সরকার ও নেতা/নেত্রীর, আর অন্য দিকে দল ও প্রার্থীদের ভাবমূর্তিদের মধ্যে মানুষ ফারাক করে, এটা অনেকেই খেয়াল করেন না। বিরোধীদের ক্ষেত্রে দলের ভাবমূর্তির পাশাপাশি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ বছর মে মাসে কর্ণাটকে বিধানসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছিল যে, বিজেপি সরকারের দলের, নেতার ও প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেরই ভাবমূর্তি এতটাই খারাপ ছিল, যে অনেক প্রার্থী বদল করে, এমনকি নেতাকে আড়াল করেও শেষরক্ষা হয়নি। তুলনায় কংগ্রেসের সামজিক ন্যায়ের প্যাকেজ অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। ২০২১ সালে তৃণমূলের দলীয় ভাবমূর্তিতে ভাঙন ধরেছিল, কিন্তু শীর্ষ নেত্রীর ও সরকারের ভাবমূর্তি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল, তাই অনেক নতুন মুখ এনে দল তার সমর্থন রাখতে পেরেছে। তুলনায় রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির দলীয় ভাবমূর্তি, বা প্রতিশ্রুতির কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাই রাজ্যবাসীর কাছে ছিল না। প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল, বিজেপি একটা বহিরাগত পার্টি, বাংলা দখল করতে এসেছে।
এই মুহূর্তে ছত্তিসগড়ে কংগ্রেস সরকারের ভাবমূর্তি এখনো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তি নিয়েও খুব একটা প্রশ্ন নেই, কিন্তু দলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষত আদিবাসী সম্প্রদায়ের একাংশ মনে করে যে কংগ্রেস ওবিসি ও দলিতদের জন্য যত সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেছে, ততটা আদিবাসীদের জন্য করেনি। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ‘পেসা’ আইন এবং বন অধিকার আইন রূপায়ণে সরকারি প্রতিবন্ধকতা, ও খনিগুলি একের পর এক শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়া এই ধারণার কারণ। মধ্যপ্রদেশে তিনবার সরকারি ক্ষমতায় থাকার ফলে সরকার এমনিতেই বেশ কিছুটা অপ্রিয়। তার উপর নেতা, দল ও প্রার্থীদের ভাবমূর্তিও গুরুতর প্রশ্নের মুখে। তাই অনেকগুলি প্রার্থী বদল করতে হয়েছে, বিজেপির প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীকেই আড়াল করতে হয়েছে। রাজস্থান থেকে আগত প্রায় সব রিপোর্টেই বেশ কিছু জনমুখী প্রকল্পের সুবাদে সরকারের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির প্রমাণ মিলছে, কিন্তু রাজস্থানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে পরিবর্তনের হাওয়া খুবই জোরালো।
এই প্রসঙ্গে মিজোরামের ও তেলেঙ্গানার রাজনীতি নিয়ে আলাদা করে দু’কথা বলতেই হয়। মিজোরামের লড়াই দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে — একটি মিজো সত্ত্বা ও জনজাতীয়তাবাদী মিজো ন্যাশানাল ফ্রন্ট, আর একটি দেশের মূলস্রোত ঘেঁষা শক্তি, যা কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই শক্তি বিভাজনের পিছনে মিজোরামের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি ও চার্চ জড়িত। মিজো, এবং মারা, লাই, চাকমা, ব্রু প্রভৃতি ছোট আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক — কংগ্রেস আর মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট। ১৯৮৮ সাল থেকে মোটামুটি ১০ বছর অন্তর মিজোরামে এই দুই দলের মধ্যে পালাবদল হয়ে আসছে। সেই হিসেবে এবারও মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের পালা। তাদের নেতা জোরামথাঙ্গার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি প্রশ্নাতীত, কিন্তু তাঁর দল এনডিএ-র জোটসঙ্গী। বিজেপি-শাসিত মণিপুরে গত কয়েক মাসে মেইতেই এবং কুকি-জো জনজাতিদের মধ্যে যে রক্তাক্ত সংঘাত চলছে, তার প্রভাবে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের ভাবমূর্তি আহত হতে পারে। মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে জোরামথাঙ্গা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে খোলা প্রতিবাদ করলেও, এবং ভিটে ছাড়া কুকিদের একাংশকে তিনি মিজ়োরামে আশ্রয় দেওয়া সত্ত্বেও, নির্বাচনে এনডিএ-র জোটসঙ্গী হওয়ার প্রভাব পড়তে পারে।
তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন হওয়ার পর থেকেই বিআরএস ক্ষমতায়, এই নিয়ে তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকার জন্য লড়ছে। তাদের দল, সরকার এবং নেতা — তিনটেরই জনপ্রিয়তা ইতিমধ্যেই অনেকটা নিম্নমুখী। কিন্তু তাদের একটা বড় অস্ত্র তেলেগু ভাষাসংস্কৃতি-কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ, যা এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। অন্য দিকে, দীর্ঘ দিনের বিরোধিতার পর নিতান্ত অনিচ্ছায় তেলেঙ্গানা রাজ্য তৈরিতে মত দেওয়ায় কংগ্রেস তেলেগু জনমানসে ব্যাপক ও গভীর ভাবে অপ্রিয় হয়েছিল, তবে ১২ বছর কেটে যাবার পর সেই ক্ষত এখন অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসের সামাজিক ন্যায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এবং সেই প্রতিশ্রুতি পালনে কর্ণাটক সরকার যে দায়বদ্ধতা দেখিয়েছে, তা এখন তেলেঙ্গানাতেও অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার পর তেলেঙ্গানায় কংগ্রেস এখন আবার উজ্জীবিত। তেলেঙ্গানায় ১৫% সংখ্যালঘু ভোট ৪৫-৫০টি আসনের ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে এবং ভোটারের সেই অংশটা আবার কংগ্রেসের পিছনে ফিরে এসেছে। ফলে তেলেঙ্গানার লড়াই বেশ হাডাহাড্ডি লড়াই।
রাজ্য নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে মননশীল চর্চাগুলি থেকে দেখা যায়, প্রতিটি নির্বাচনের মরশুমে শুরু হওয়ার সময়েই রাজ্যগুলিতে ফলাফলের একটা প্রাথমিক প্রবণতা থাকে, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই প্রবণতাই চার পাঁচ মাস পরে, নির্বাচনী ফলাফল হয়ে দেখা দেয়। আবার প্রাথমিক প্রবণতার উল্টো ঘটেছে, এমন ঘটনা একেবারে বিরল নয়। ২০১৭-র পাঞ্জাব ও ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে তাই হয়েছিল। শুরুর প্রবণতা আরও দৃঢ় হয়, বা উল্টে যায়, সাংগঠনিক শক্তি, নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতায় বা তার অভাবে, এবং দলের নেতা ও সরকারের ভাবমূর্তির চড়াই উৎরাইতে। সরকারপক্ষ যদি তার নির্বাচনী প্রচারে শুধুই বিপক্ষকে আক্রমণ করে, সরকারের সাফল্য, ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সুস্পষ্ট ভাবে প্রচারে না আনতে পারে, তা হলে বোঝা যায় সরকার দুর্বল। আবার বিপক্ষ যদি শুধুই সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্নীতিকে আক্রমণ করে, নিজেদের প্রস্তাবকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরতে না পারে, তাহলে বোঝা যায় বিপক্ষ দুর্বল। প্রাথমিক প্রবণতা অনেক আগে থেকে টের পেতেই আজকাল রাজনৈতিক দলগুলি নানা পেশাদারি সংস্থার সাহায্য নিচ্ছে। তা ছাড়া প্রাথমিক প্রবণতা অনুযায়ী, দলের ভাবমূর্তি ও সাংগঠনিক গঠনতন্ত্রকে বদলাতে, প্রার্থী চয়নে, প্রচারের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে, প্রতিশ্রুতিগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য তৈরি করতে ও প্রতিনিয়ত প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারদের ও বিপক্ষের গতিপ্রকৃতি বুঝতে এখন পেশাদারি সংস্থাগুলিই ভরসা। কিন্তু তারাও প্রাথমিক প্রবণতার ভিত্তিতেই কাজ করে। প্রাথমিক প্রবণতা বুঝে তারা হয় সরকারকে, নয় বিপক্ষকে তাদের পরিষেবা দিয়ে থাকে।
রাজ্য নির্বাচনকে বুঝতে গেলে তাই প্রচার, ঢেউ, মিছিল-মিটিঙে জনতার সংখ্যা, ইস্তেহার, হোর্ডিং, রোড শো – এই সব আপাত চিহ্নগুলিকে অতিক্রম করতে হবে। আজকের মিডিয়ার একপেশে প্রচারকেও পেরিয়ে, একটু গভীরে গিয়ে রাজ্য-রাজনীতির মৌলিক প্রবণতাগুলিকে বোঝা দরকার। এই প্রবণতাগুলি কেন ও কিভাবে তৈরি হয়, তা অবশ্য আরও চিত্তাকর্ষক কাহিনী।