বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
২৯টি শ্রম ও শ্রমিক আইনের বদলে চারটি শ্রম কোড ১ এপ্রিল থেকে চালু হয়ে গেল। মজুরি, শিল্প সম্পর্ক, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, এবং সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি করে কোড। স্বাভাবিক প্রশ্ন হল এগুলি কতটা শ্রমিক ঘেঁষা না মালিক ঘেঁষা। মালিকরা চায় শিল্প বা ব্যবসার প্রয়োজনে শ্রমিককে খুশিমত ব্যবহার করতে, কারণ, যন্ত্রপাতি, মালমসলা, মূলধনের মতই শ্রমিকও উৎপাদন/ব্যবসার একটা উপাদান (factor of production), আর শ্রমিকদের চাওয়ার মূলে আছে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমিকের অধিকার কল্যাণ ও সুরক্ষা। ভারতে শ্রমিক বলতে ৫০ কোটির বেশি মানুষকে বোঝায়। এর মধ্যে সাদা ও নীল, দুই পোশাকের শ্রমিকদেরই বোঝায় যদিও সব ব্যাপারে তাঁদের অবস্থা সমান নয়।
এই শ্রমিকদের ৮০ ভাগের বেশি কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যার সিংহভাগ হল অতি ছোট উদ্যোগ, তা একটা দোকান, ছোট কারখানা, কি হকারি হতে পারে। নিজেই মালিক নিজেই শ্রমিক ধরনের উদ্যোগের সংখ্যা ৫.৫ কোটি, যাদের ইংরেজিতে On Account Enterprise বলে। কৃষিকাজ এর মধ্যে নেই, কিন্তু পারিবারিক শ্রম ধরা আছে, অর্থাৎ প্রায় নয় কোটি মানুষ এই ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত। একজন মালিক আর একজন নিযুক্ত শ্রমিক এমন উদ্যোগের সংখ্যা ৯৭ লক্ষ। মাত্র ২০ ভাগ শ্রমিক সংগঠিত ক্ষেত্রে অফিস, কারখানা, খনি বা বাগিচাগুলিতে কাজ করেন। দেশের ৯৫ ভাগ উদ্যোগে ৫ জনের কম শ্রমিক নিযুক্ত।
এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকের অধিকার, নিরাপত্তা সুরক্ষা ও মর্যাদা নিয়ে কথা বলতে গেলে ঠিক করতে হয় কোন শ্রমিকের কথা বলতে বসেছি আমরা। ভারতের শ্রম ও শ্রমিক আইনগুলি শ্রম কোড আসার আগে যতটুকু শ্রমিক ঘেঁষা ছিল তার উপকার সংগঠিত ক্ষেত্রে যে ২০ ভাগ শ্রমিক কাজ করেন সেই সাড়ে আট কোটি মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সরকারি রিপোর্টে ট্রেড ইউনিয়নের এক কোটি সদস্যের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, তবে ১৯ হাজারের মধ্যে মাত্র সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন হিসাব দাখিল করেছে, কাজেই সদস্যের সংখ্যাটি নিশ্চয়ই তার বেশি। মাত্র ৭.৪ কোটি কর্মী প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় এসেছেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রায় ৪২ কোটি শ্রমিকদের কপালে এই সৌভাগ্য জোটেনি।
তাই শ্রম কোড নিয়ে কথা বলতে গেলে কি ধরনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজব আমরা? একটা প্রশ্ন হতে পারে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিকের জন্য সরকার কি শ্রম নীতি নিল। অন্য একটা প্রশ্ন হতে পারে আগে যা ছিল তার তুলনায় এখনকার শ্রম কোড শ্রমিকের দিকে ঝুঁকল না মালিকের দিকে?
আসুন দেখি প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমরা কি পাচ্ছি? প্রথমত দেখছি ন্যূনতম মজুরি সর্বজনীন করা হয়েছে। যে কোনও শিল্প-ব্যবসায় ন্যূনতম মজুরি সুনিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার সব ক্ষেত্রের জন্যই একটা floor wage স্থির করবে, যার ভিত্তিতে রাজ্য সরকারগুলি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করবে। শুনতে ভাল, কিন্তু রাজ্য সরকারগুলি কেউ সেই মজুরি দিচ্ছে কিনা কিভাবে সুনিশ্চিত করবে তার কোনও উল্লেখ নেই। এই দুর্বলতা আগেও ছিল এখনো রয়ে গিয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কথা ভাবলে প্রায় প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতে, টাউনে প্রতি ওয়ার্ডে কোন একটা উদ্যোগ পাওয়া যাবে যার ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার কথা। বর্তমানের ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর নামক ব্যবস্থা দিয়ে তা সম্ভব হবে না, শুধুমাত্র ইন্সপেক্টর সংখ্যার স্বল্পতার জন্যে।
আরও দেখছি ২০ জনের কম শ্রমিক কাজ করছে এমন উদ্যোগের ক্ষেত্রে বোনাস দেবার বাধ্যবাধকতা নেই। আগে এটা ছিল ১০ জন শ্রমিক। এমনিতেই নানা সরকারি আধা সরকারি ও অন্যান্য অ-ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বোনাস দেবার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সমাজের চাহিদায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের নানা শিল্পে বা ব্যবসায় বোনাসের ব্যবস্থা আছে, ঠিক সেই নামে না থাকলেও আছে। অনেক শহরে গৃহকর্মীদেরও ১২ মাস কাজ করলে ১৩ মাসের মাইনে দেবার ব্যবস্থা আছে। যা সমাজে ইতিমধ্যেই স্বীকৃত তাকে অধিকার হিসেবে গণ্য করতে বাধা কোথায়?
শ্রমিকের দেড় শতাব্দিব্যাপী অর্জিত অধিকার হল আট ঘণ্টার কাজ। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনেক উদ্যোগেই তা মেনে চলা হয়, আবার স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, ছোট উদ্যোগের ক্ষেত্রে বা যারা বাড়িতে থেকে কাজ করেন (যেমন বিড়ি বা কাঁথা শ্রমিক) তাঁদের বেলায় এর ব্যতিক্রম আছে। তাহলেও অধিকারের বোধটি সর্বজনীন। মজুরি কোডে বলা হল ন্যূনতম মজুরির জন্য স্বাভাবিক কাজের ঘণ্টা সরকার নির্ধারণ করবে, আবার পেশাগত সুরক্ষা কোডটিতে বলা হল যে কোনও উদ্যোগে স্বাভাবিক কাজের সময় আট ঘণ্টাই মান্য হবে। অর্থাৎ একটা স্ববিরোধ রয়ে গেল। নারী পুরুষের মধ্যে মজুরির ভেদাভেদ করা যাবে না, এটাও শ্রমিকদের একটি অর্জিত অধিকার, এমনকি শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও নারী পুরুষ ভেদাভেদ করা যাবে না, এই ছিল কানুন। এখন মজুরি কোডে একটা লাইন লেখা হল যে ন্যূনতম মজুরির হিসেবের সময় নারী-পুরুষের ভেদাভেদ করা যাবে না। মানে ন্যূনতম মজুরির বেশি মজুরি দেবার সময় ভেদাভেদ করা যাবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে ভেদাভেদ বন্ধ করার কোন উল্লেখই নেই।
সাধারণভাবে শিল্প বিরোধের সংক্রান্ত আইনটি মাঝারি ও বড় শিল্পের প্রেক্ষিতে তৈরি, অসংগঠিত ক্ষেত্রের উদ্যোগগুলির ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ নিতান্তই কম। তাই সুযোগ ছিল এই ক্ষেত্রে শ্রম বিরোধের মৌলিক কয়েকটি বিষয় — ন্যূনতম মজুরি, আট ঘণ্টার কাজ, ওভারটাইম, নারী-পুরুষ সমান মজুরি, শ্রমিকের শারীরিক সুরক্ষা ইত্যাদি সংক্রান্ত বিরোধগুলির জন্য একটা আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করার। সেই সুযোগ থেকে ৪২ কোটি শ্রমিক বঞ্চিত হল। ক্ষেত্র নির্বিশেষে যদি শ্রমিককে পূর্ণ মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে একজন শ্রমিকের নিয়োগকারীকেও তা মেনে চলতে হয়। সামাজিক নিরাপত্তা কোডটিতে দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া হল শ্রমিক কল্যাণের, শ্রমিক অধিকারের নয়। এমনকি সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা বলা হল তাও ২০জন বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করে এমন উদ্যোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তার সংখ্যা ভারতে মোট উদ্যোগের এক কি দুই ভাগের বেশি হবে না।
সামাজিক নিরাপত্তা কোডটিতে আগের মতোই বিল্ডিং শ্রমিক নির্মাণ শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তবে একটা বড় রকমের ধারণাগত বিভ্রান্তি আছে। নির্মাণ শ্রমিক বিল্ডিং শ্রমিক সংগঠিত ক্ষেত্রেরও হতে পারে, অসংগঠিত ক্ষেত্রেরও হতে পারে। সেই স্পষ্টতা দেওয়া নেই। আমরা যেহেতু অসংগঠিত ক্ষেত্র নিয়েই কথা বলছি, দেখা যাক সেখানে কি আছে। অসংগঠিত শ্রমিক গিগ শ্রমিক আর প্লাটফরম শ্রমিকদের জন্য একটি অধ্যায় আছে এই কোডে। সেখানেও কোন অধিকারের কথা নেই, শুধু বলা আছে কেন্দ্রীয় সরকার এই সব শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য যোজনা তৈরি করবে। জীবনবীমা, স্বাস্থ্য, মাতৃত্ব, বৃদ্ধ বয়সের পেনশন, শিক্ষা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, দুর্ঘটনা, আবাস, ইত্যাদি বিষয়ে এই যোজনাগুলি তৈরি হবে। রাজ্য সরকারও এই সব বা অন্য বিষয়ে যোজনা তৈরি করতে পারে। মাতৃত্ব সংক্রান্ত অধিকারগুলি আগে যা ছিল তাই আছে, ১০ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করে যে সব উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠানে সেখানেই তা প্রযোজ্য। এছাড়া কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য স্তরে একাধিক সামাজিক সুরক্ষা বোর্ড তৈরির কথা আছে এই কোডে।
শ্রম কোডে শ্রমিকদের পেশাগত সুরক্ষা মালিকপক্ষকে সুরক্ষা সংক্রান্ত কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে তা আছে, সেগুলি আগেও ছিল। এছাড়া এই কোডটিতে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি অধ্যায় আছে, সেখানে বলা হচ্ছে যে, বছরে একবার শ্রমিকরা যাতে বাড়ি গিয়ে ফিরতে পারে তার জন্য মালিকদের থোক অর্থ সাহায্য করতে হবে। এব্যাপারে আরও বিশদ সংশ্লিষ্ট সরকার ঠিক করবে। সেই সরকারই এই শ্রমিকেরা যাতে রেশন পায় তার জন্য নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেবে। বিড়ি শ্রমিকদের জন্য একটি অধ্যায় আছে সেখানে নতুন কথা কিছু নেই। বাগিচা শ্রমিকদের জন্য রাজ্য সরকার চাইলে ক্রেশ, আবাস, পানীয় জল বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত নিয়ম বানাতে পারে, না চাইলে অসুবিধা নেই।
নতুন কথা কি আছে এই কোডগুলিতে? একদিকে যেমন পরিযায়ী শ্রমিক, গিগ শ্রমিক, প্লাটফর্ম শ্রমিকদের কথা এসেছে এই কোডে, তেমনি বিপজ্জনক শিল্প বা উদ্যোগের সংজ্ঞা থেকে ১০ জন শ্রমিকের যে ন্যূনতম সীমা ছিল সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ বাজির কারখানা যতই ছোট হোক না কেন বিপজ্জনক উদ্যোগের আওতায় আসবে। আবার চুক্তি শ্রমিক নিয়োগের ব্যাপারে নিয়মনীতিগুলি যে সব উদ্যোগে ৫০ জনের কম চুক্তি শ্রমিক কাজ করছে সেখানে লাগু হবে না। অন্যান্য বেশ কিছু বিধান সংগঠিত ক্ষেত্র এবং তার মধ্যেও বৃহৎ কারখানা বা অফিসের ক্ষেত্রেই লাগু হবে। সব মিলিয়ে এই শ্রম কোড সম্মিলিতভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের কাছে বিশেষ কোনও সুখবর দিতে পারল না। তার চেয়েও বড় কথা, শ্রম নিয়ন্ত্রণের যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আছে তাকেও এই শ্রমিকদের উপযোগী করে তোলার কোন চেষ্টা দেখা গেল না। দেশের ৮০ ভাগ শ্রমিক এই কোড সম্পর্কে বলতেই পারে, “বেল পাকলে কাকের কি?”
[১] https://www.business-standard.com/economy/news/own-account-enterprises-rose-by-6-5-mn-between-2010-and-2023-nso-data-124071001198_1.html
[২] https://www.thehinducentre.com/the-arena/current-issues/indias-informal-sector-the-feeder-economy-within/article68786567.ece#:~:text=Way%20back%20in%202016%2C%20the,fell%20from%203%20to%202.2.
[৩] https://labourbureau.gov.in/uploads/pdf/TU-2020-report.pdf page 9
[৪] https://economictimes.indiatimes.com/news/economy/indicators/number-of-epfo-subscribers-up-7-6-at-73-7-million-in-2023-24/articleshow/115143036.cms?from=mdr