বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

স্বাধীনতা ৭৫: অর্থনীতির বেহাল দশা

স্বাধীনতা ৭৫: অর্থনীতির বেহাল দশা

অতনু চক্রবর্তী

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২২— আজাদি কা “অমৃত মহোৎসব”! হর ঘর তিরঙ্গা! রাষ্ট্রীয় এই “মহোৎসব” এ বিরাট উন্মাদনা তুলে যখন মোদি সরকার 'দেশভক্তির' নয়া সংজ্ঞায় আসমুদ্রহিমাচলকে প্রবল বেগে ভাসাতে শুরু করল, তখন অর্থনীতির রূঢ় বাস্তব জানান দিল ভারতীয় মুদ্রা এক ডলারের সাপেক্ষে আবার গোত্তা খেয়ে গত ৮ আগস্ট নীচে নেমে দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬৩ পয়সায়! ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি তার সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম দিল,” ইন্ডিয়া অ্যাট ৭৫, রুপি অ্যাট ৮০! “ আর, সিএমআইই বহন করে নিয়ে এল আরও বড় দুঃসংবাদ, ৭ আগস্ট শেষ হওয়া সপ্তাহে দেশের বেকারত্ব এক লাফে পৌঁছেছে ৯.৬৬ শতাংশে, আগের সপ্তাহে যা ছিল ৬.৭৩ শতাংশে।
দেশের অর্থনীতির সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা ভয়াবহ বেকারত্ব। মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি। বিপুল সংখ্যক মানুষ গড়িয়ে পড়েছে দারিদ্র সীমার নীচে। ক্ষুধা ও নিদারুণ দারিদ্রের হাত ধরে ক্রমে ক্রমে নীচে নেমে যাচ্ছে স্বাস্থ্য সূচক, মুখ তুলছে শিক্ষাব্যবস্থার দেউলিয়ে স্বরূপ। সবচেয়ে খারাপ খবর হল, ৩১ মার্চ, ২০২০ তে দেশীয় অর্থনীতির যে আয়তন ছিল ( ১৪৫.১৬ লক্ষ কোটি টাকা) তা ৩১ মার্চ, ২০২২ এ প্রায় একই জায়গায় আটকে থাকল ( ১৪৭.৪৬ লক্ষ কোটি টাকা)। আর প্রতিটি নাগরিক আগের তুলনায় আরও গরিব হয়েছে, বিগত দু'বছরে কমেছে তাঁদের মাথা পিছু আয় ১,০৮,২৪৭ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১,০৭,৭৬০ টাকা!
এদিকে, ক্ষমতার অলিন্দে মাথানাড়া বিজ্ঞের দল নিজেদেরই পিঠ চাপড়ে বিরাট আত্মতৃপ্তি নিয়ে ঘোষণা করছেন, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৮.৭ শতাংশ, যা নাকি বিশ্বে বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম দ্রুত!
মূল্যবৃদ্ধি আজ আমজনতাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে। বিশেষ করে গরিব ও সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষকে। ভোগব্যয় ক্রমেই কমছে, সঞ্চয় সংকুচিত, ঘরে ঘরে ঋণ বাড়ছে, অপুষ্ঠি ক্রমেই মাথা তুলছে, বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের মধ্যে। কিন্তু, অবিসংবেদি কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে তা ধরা পড়ছে না। ক' দিন আগে, অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানালেন যে জিএসটির বর্ধিত হার সাধারণ মানুষের উপর কোন ছাপ ফেলেনি। সরকার সবচেয়ে বড় যে আর্থিক অপরাধ করেছে তা হল পেট্রল ডিজেলের উপর নির্মম মাত্রায় কর ও সেস বসিয়ে মূল্যস্ফীতিকে বিরাট পরিমাণে বাড়িয়েছে। তেল কোম্পানিগুলো মারফত কেন্দ্রীয় সরকার নিজের পকেটে ঢুকিয়েছে ২৬,০০,০০০ কোটি টাকা। যা কর - সেস ও লভ্যাংশের মাধ্যমে লুঠ করেছে মোদি সরকার আম জনতার কাছ থেকে।
কিন্তু, অন্য প্রান্তে, বৃহৎ কোম্পানিগুলোর মুনাফা বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সম্প্রতি একটা রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ-এ নথিবদ্ধ ৩,০০০টি কোম্পানি লাভ করেছে ৯.৩ লক্ষ কোটি টাকা— ২০২০ সালের সাপেক্ষে বৃদ্ধির হার ৭০ শতাংশ! কিন্তু, ওই একই সময়ে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ হারে! এখন গোটা দুনিয়া “শ্লোবালাইজেশন” এ প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ, অত্যন্ত মন্থর গতিতে ধুঁকে ধুঁকে এগোচ্ছে বিশ্বায়িত পুঁজি। একেই এক ডাচ অর্থনীতিবিদ নামকরণ করেছেন “স্লোবালাইজেশন” হিসাবে। এই জুলাই মাসেই আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) প্রকাশ করল “ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক, ২০২২, গ্লুমি অ্যান্ড মোর আনসার্টেন্টিজ”— আরও বিষন্নতা ও অনিশ্চয়তার বার্তা বহন করে আনল এই রিপোর্ট। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১এ অর্থনীতির আপেক্ষিক উন্নতির প্রাথমিক লক্ষণগুলো ২০২২ এর প্রথম ত্রৈমাসিক পর্যন্ত দেখা দিলেও, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে গোটা বিশ্বের প্রকৃত জিডিপি সংকুচিত হয়ে পড়ে। যতটা অনুমান করা হয়েছিল, তার তুলনায় দুনিয়া জুড়েই মুদ্রাস্ফীতির হার বিরাটভাবেই বৃদ্ধি পাওয়ায়, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রধান প্রধান ইউরোপীয় দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, চীনের আর্থিক মন্থরতা বা স্লোডাউন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘনিয়ে তুলেছে বহুমাত্রিক প্রভাব।
যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এখন বিশ্ব অর্থনীতির অনেকটাই নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভত শুরু হয়েছে টেকনিকাল রিশেসন (পর পর দু'টি ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক), প্রায় আট সপ্তাহ ধরে চীনের সাংহাইয়ে কঠোর লকডাউন বজায় থাকায় গুরুত্বপূর্ণ এই গ্লোবাল সাপ্লাই চেনের (যার আর্থিক প্রভাব বিশ্ব জুড়ে) শৃঙ্খল আবার ছিন্ন হওয়া, বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, শ্রম বাজারে নেমে আসা নতুন সংকট, জনগণের উপর নেমে আসা আর্থিক বোঝার জন্য চাহিদার নাছোড় ঘাটতি প্রভৃতি একগুচ্ছ চাপ আজ শ্রমিকশ্রেণী ও আমজনতার কাঁধে চালান করে সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছে দেশে দেশে ক্ষমতাসীন শাসককুল।
আইএলও প্রকাশ করেছে এক রিপোর্ট— ওয়েজ অ্যান্ড মিনিমাম ওয়েজ অ্যাট দ্য টাইম অফ কোভিড, যেখানে দেখানো হয়েছে, গোটা এশিয়ায় ভারতে মজুরির হার বেড়েছে সবচেয়ে কম গতিতে। ভারতে প্রকৃত মজুরির হার ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ তে বেড়েছে যথাক্রমে ২.৮, ২.৬ ও ২.৫ শতাংশ হারে। আর, ২০১৮ তে তা একই থাকে। এমনকি তা পড়শি দেশ পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা নেপাল থেকেও বেশ কম! আইএলও-র আর একটি রিপোর্ট দেখিয়েছে, ২০২০ সালে ভারত ১৪ শতাংশ শ্রম ঘন্টা হারিয়েছে, গোটা দুনিয়ায় যা ছিল ৯ শতাংশ। এমনকি, সাপ্তাহিক শ্রম ঘন্টা ভারতে সবচেয়ে কম, গোটা দুনিয়ার সাপেক্ষে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের যদি ইচ্ছাশক্তি থাকত তবে বেশ কিছু প্রশ্নে ইতিবাচক আর্থিক পদক্ষেপ রাখা সম্ভব হতো। বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী প্রভাত পট্টনায়েক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ উপরতলার মানুষের উপর ২ শতাংশ হারে সম্পত্তি কর আর তার পাশাপাশি ওই এক শতাংশ অতি ধনীদের উপর এক-তৃতীয়াংশ উত্তরাধিকার কর প্রতি বছর আদায় করলে পাঁচটি সর্বজনীন অধিকার অনায়াসেই কার্যকর করা যেত— খাদ্য অধিকার আইন, কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি (আর তা দিতে না পারলে পুরো মজুরি প্রদান), জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে নিঃশুল্ক ও উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, আর বৃদ্ধ বয়সে সম্মানজনক ভাবে বেঁচে বর্তে থাকার জন্য পেনশন ও প্রতিবন্ধীদের ভাতা।
বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে ভারতে বেকারত্ব আজ ভয়াবহ সীমায় পৌঁছেছে। কি কেন্দ্র কি রাজ্য, সরকারি শূন্য পদে নতুন নিয়োগ বন্ধ রেখে বিদ্যমান পদগুলোকেই অবলুপ্ত করে দিচ্ছে বিরাট পরিমাণে। সিএমআইই র প্রধান জানিয়েছেন, সরকারি ক্ষেত্রগুলোতে নিয়োগের প্রশ্নে গোটা বিশ্বের মধ্যে ভারতের স্থান সবচেয়ে নীচুতে। আর, এই অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে সেনাবাহিনীতেও নতুন নিয়োগ বন্ধ করে সেখানেও অস্থায়ী “সেনা” দের নিয়োগ করার “কর্মবীর” প্রকল্প চালু হল।
বিপুল সংখ্যক ভারতবাসীকে অনাহারে, অর্দ্ধাহারে অপুষ্টিতে রেখে পালিত হতে যাচ্ছে আজাদি কা অমৃত মহোৎসব! গত মাসে রাষ্ট্রসংঘের “ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) রিপোর্ট বে আব্রু করল বিশ্ব জোড়া খাদ্য-সংকট এর ভয়াবহ দিক, চরম বৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা। কোভিড কি মারাত্মকভাবে উন্মোচন করে দিল আমাদের খাদ্য সরবরাহ বন্টন ব্যবস্থার। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯৭ কোটি ভারতীয় বা ৭১ শতাংশ দেশের জনসংখ্যা আজ এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন যে তাঁদের  পুষ্টিকর খাদ্য কেনার আর্থিক সক্ষমতা নেই— এশিয়ায় যে সংখ্যাটা হল ৪৩.৫ শতাংশ আর আফ্রিকায় ৮০ শতাংশ। ওই রিপোর্ট জানিয়েছে, ভারতে দৈনিক মাথা পিছু পুষ্টিকর খাদ্য কেনার মূল্য ২৩৫ টাকা, যার অর্থ হল মাসে চার জনের পরিবারের জন্য তা হবে ৭,৬০০ টাকা। চীন (১২%), ব্রাজিল(১৯%) ও শ্রীলঙ্কায় (৪৯%) যা অনেক কম। যদিও  ভারতের তুলনায় নেপাল (৮৪%) ও পাকিস্থান (৮৩.৫ %) রয়েছে নীচে, এইটুকুই যা সান্ত্বনা! আর এই বিপুল সংখ্যক ক্ষুধার্ত মানুষকে গ্যাঁটের কড়ি ফেলে জাতীয় পতাকা কিনে ঘরে ঘরে তা উত্তোলন করার ফরমান জারি করা হয়েছে দিল্লির মসনদ থেকে।
ক্ষুধাতুর ভারত, বেকারত্বের জ্বালা-যন্ত্রণায় ছটফট করা ভারত, ভয়ঙ্কর বিদ্বেষ বিষে বিভক্ত ভারতবর্ষ আজ সেই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের অন্বেষায়, যেখানে সমস্ত বিভেদ ভুলে সমস্ত দেশবাসী, বর্ণ বৈচিত্র্যময় বহুত্ববাদী ভারত বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করবে সংবিধানের সেই অমোঘ প্রথম বাক্যটি “আমরা জনগণ (We the people)”। সেই সুন্দর সকালের লক্ষ্যেই শুরু হোক নতুন এক অভিযাত্রা!

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.