বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের দেশে মোটের ওপর দু’রকমের কথা সচরাচর প্রচলিত। এক রকমের কথা প্রচারিত হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিসর থেকে, আর এক রকমের কথা শোনা যায় তার বিপরীতে, ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী বক্তব্য হিসেবে। দুই গোত্রের বাগ্ধারাই স্বাধীন ভারতের সূচনা থেকে চলে আসছে, তবে দু’টি ধারাতেই কালক্রমে পরিবর্তন ঘটেছে, যে পরিবর্তন এখন এক অভূতপূর্ব রূপ নিয়েছে, বিশেষত ক্ষমতার ভাষায়। এর মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের বহু বিষয়েই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ভাবতে হচ্ছে স্বাধীনতার ধারণাটিকে নিয়েও। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ক্ষমতার ভাষ্য এবং তার প্রতিস্পর্ধী বয়ান নিয়ে এই আলোচনা।
প্রথমে ক্ষমতার ভাষার কথা। এটা অনস্বীকার্য যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধীশ্বররা বরাবরই স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে, বস্তুত একাকার করে দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন। পনেরোই অগস্টের সকালে লালকেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেওয়ার বার্ষিক আচারটি এই রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার অন্যতম নিদর্শন। স্বাধীনতা দিবসের প্রতীক হিসেবে এই দৃশ্যের ইতিহাস স্বাধীনতার সমবয়সি। গোড়া থেকেই দৃশ্যটি লোকতন্ত্রের নয়, প্রজাতন্ত্রের; রাষ্ট্রের মহামহিম নায়ক বা নায়িকা মোগল সম্রাটের তৈরি করা দুর্গপ্রাকারের সামনে অনেক উঁচুতে মাচা বেঁধে সেই অ-মর্ত্য ব্যবধান থেকে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ শুনিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেই দৃশ্যের— এবং তার স্রষ্টা রাষ্ট্রশক্তির— নিহিতার্থ সে-কালে যেমন ছিল, এ-কালে তেমনটি নেই, তার তাৎপর্যে বা ব্যঞ্জনায় মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। এক দিন রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে জনসাধারণের সম্মতির পরিণাম হিসেবে দেখবার রীতি ছিল, যাকে গণতান্ত্রিক রীতি বলে গণ্য করা হতো। সেই রীতির ধারণা এবং তার বাস্তব অনুশীলনের মধ্যে সে-দিনও অবশ্যই বিস্তর দূরত্ব ছিল, আমাদের গণতন্ত্র বরাবরই মূলত প্রজাতন্ত্র। কিন্তু আজ প্রজার উপর শাসকের দাপট যেখানে পৌঁছেছে, রাষ্ট্রের আধিপত্য যে ভাবে মানুষের স্বাধীনতার মূল শর্তগুলিকেই লঙ্ঘন করে নিজেকে সর্বগ্রাসী রূপ দিতে সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছে, সমস্ত রাষ্ট্রীয় ভাষণ যে দম্ভসর্বস্ব উগ্রমূর্তিতে একতন্ত্রের শাসন কায়েম করার বাগ্ধারায় পরিণত হয়েছে, তাকে ভারতীয় গণতন্ত্রের ‘ধারাবাহিক রূপান্তর’ বলে ব্যাখ্যা করা চলে না, এই মূর্তি এক নতুন ধারার শাসনতন্ত্রের প্রতিমা। গণতন্ত্রের বাতাবরণের মধ্যে দাঁড়িয়েই মানুষের স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে একাকার করে দেওয়ার ধারাবাহিক অনুশীলন দীর্ঘদিন ধরে এই উৎকট দুঃশাসনের ভিত তৈরি করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু একতন্ত্রের বর্তমান ধারাটি তার চরিত্রে ও আচরণে স্বকীয় এবং, স্বকীয় বলেই, ভয়ঙ্কর।
আবার, উল্টো দিকে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দাপট থেকে মানুষের স্বাধীনতাকে রক্ষা করবার কথাও আমরা গোড়া থেকেই শুনে আসছি। সেটা গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত বলেই পরিচিত। ‘নিরন্তর সতর্কতার মূল্য চুকিয়েই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হয়’— এই আর্ষবাক্যকে একদিকে রাষ্ট্র তার ঢাল তরোয়াল বন্দুক কামান ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা এবং আত্মসাৎ করে এসেছে বটে, কিন্তু অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী সচেতন নাগরিকরাও স্বাধীনতাকে রক্ষা করবার জন্য সতর্কতার গুরুত্ব ভোলেননি, রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নানা ভাবে সরব ও সক্রিয় থেকেছেন। আজ যখন রাষ্ট্রের চালকরা ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে মানুষের স্বাধীনতা হরণে তৎপর, তখন এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত পরিসরে প্রবলতম প্রতিবাদ গড়ে তোলা কেবল প্রয়োজনীয় নয়, অত্যাবশ্যক। কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, সমাজের নানা ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ যথেষ্ট সরব ও সক্রিয় হবেন, এটাই কার্যকর গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শর্ত এবং রক্ষাকবচ। বিদেশি শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের ছিয়াত্তর বছর পরেও স্বাধীনতার জন্য গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রয়োজন ফুরোয়নি, বরং তা উত্তরোত্তর প্রবল হয়ে চলেছে। গভীর উদ্বেগের কারণ এই যে, দেশ জুড়ে প্রতিস্পর্ধার ব্যাপ্তি ও গভীরতা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, ক্ষমতাবানের অনাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আরও অনেক বেশি জোরদার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। সেই সংগ্রামের জন্যই প্রতিবাদের স্বাধীনতা, প্রতিরোধের স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক, আবার সেই স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য এবং অনেক ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম জারি রাখাও কম আবশ্যক নয়। কেবল নিরন্তর সতর্কতা নয়, নিরন্তর প্রতিস্পর্ধাও স্বাধীনতার মূল্য বইকি।
কিন্তু এখানেই একটা প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্নটা ঈষৎ বেসুরো ও অপ্রিয় শোনাতে পারে, কিন্তু সেই কারণেই পনেরোই অগস্টের বারবেলায় সেটি স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করা দরকার। প্রশ্ন এই যে, স্বাধীনতা মানে কি কেবল রাষ্ট্রের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিস্পর্ধার স্বাধীনতা? যথেষ্ট মাত্রায় সেই প্রতিবাদ সংগঠিত করতে পারলেই কি আমাদের আজকের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ জারি রাখতে পেরেছি বলে কৃতার্থ বোধ করতে পারব? এক নিঃশ্বাসে আরও একবার বলে নেওয়া দরকার, সংগঠিত প্রতিবাদ অবশ্যই জরুরি, আজকের ভারতে প্রতিবাদের প্রচণ্ড ঘাটতি আছে বলেই তা অতিমাত্রায় জরুরি। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় সংগঠিত এবং নিরন্তর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের গুরুত্ব সম্পর্কে কোনও প্রশ্নই থাকতে পারে না। কিন্তু যা জরুরি, তাকে যথেষ্ট বলে মনে করে নিলে বড় ভুল হয়। এ ক্ষেত্রে সেই ভুল হচ্ছে না তো? উৎকট দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বাইরেও স্বাধীনতার যে অন্য মাত্রা, অন্য অর্থ, অন্য শর্ত থাকতে পারে, সেই কথাটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিচ্ছি তো?
এ-প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য স্মরণ করা দরকার স্বাধীনতার একটি পুরনো এবং বহুচর্চিত দ্বৈত-ধারণার কথা, যে ধারণা দু’টি সচরাচর অভিহিত হয়ে থাকে ‘ইতিবাচক’ এবং ‘নেতিবাচক’ স্বাধীনতা নামে। বহুচর্চিত বলেই এই ধারণা-যুগলের কথা সংক্ষেপে সেরে নেওয়া যেতে পারে, কিঞ্চিৎ অতিসরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েই। যখন আমাদের স্বাধীন ভাবে বাঁচার, কথা বলার, কাজ করার অধিকারকে জোর করে কেড়ে নেওয়া বা খর্ব করা হয়, তখন আমরা যে স্বাধীনতার দাবি জানাই, সেটা চরিত্রে নেতিবাচক। এখানে নেতিবাচক অভিধাটি নঞর্থক নয়, অবমূল্যায়নের সূচক নয়; যেহেতু ‘আমার অধিকার কেড়ে নিতে পারো না’ বলে এই স্বাধীনতা দাবি করা হচ্ছে, সুতরাং— ওই ‘না’ বলার ভিত্তিতেই— তা ‘নেতি’বাচক। নেতিতেই তার গুরুত্ব। কিন্তু এর পাশাপাশি আছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রশ্ন, শিক্ষা স্বাস্থ্য সুপরিবেশের প্রশ্ন, এক কথায় সামাজিক মানুষ হিসেবে সুস্থ, সক্ষম, মর্যাদাসম্পন্ন সার্থক জীবন যাপনের প্রশ্ন। এই প্রয়োজনগুলি পূরণের সুযোগ যাঁর নেই, তাঁর স্বাধীনতা কি খণ্ডিত, খর্বিত, এমনকি অর্থহীন নয়? স্বাধীনতাকে যখন এই অর্থে দেখি, তখন তার বাচনভঙ্গি পাল্টে যায়। সে দাবি ঘোষণা করে: সুষ্ঠু এবং সমৃদ্ধ জীবনযাপনের সুযোগ দিতে হবে। এই দাবির ভাষা নেতির নয়, সেই কারণেই এ হল ইতিবাচক স্বাধীনতা।
বহু ক্ষেত্রেই এই দুই রূপ একযোগে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যেমন, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ‘ইতিবাচক’ দাবির সঙ্গে মিলে যেতে পারে মানুষকে জোর করে স্বভূমি থেকে উৎখাত করার বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক’ প্রতিবাদের দাবি। আবার তেমনই, রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে বা উদ্যোগে সংখ্যালঘু নিপীড়নের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে থাকে সংখ্যালঘুর স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সঙ্কট, সুতরাং প্রথমটির প্রতিরোধ এবং দ্বিতীয়টির মোকাবিলা একসূত্রে জড়িত। স্বাধীনতার এই রূপ দু’টি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি অন্যটির পরম সহায়ক। বস্তুত, এই সংযোগকে যথাযথভাবে অনুধাবন করে তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রশক্তির প্রতিস্পর্ধী রাজনীতিকে গড়ে তোলা দরকার, এই সত্যেই আমরা পৌঁছতে চাইব। কিন্তু ঠিক সেই কারণেই, বিচার-বিশ্লেষণ বা চিন্তাভাবনার স্তরে এই দু’টি দিককে আলাদা করে বোঝা দরকার, তা না হলে কেবল স্বাধীনতার ধারণা এবং তার তাত্ত্বিক কাঠামোটি অসম্পূর্ণ থাকে না, এক ধরনের স্বাধীনতার ধারণায় জোর দিতে গিয়ে স্বাধীনতার অন্য দিকটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব না দিলে স্বাধীনতার জন্য আমাদের সংগ্রামও দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই আশঙ্কা হয় যে, স্বাধীনতার শর্ত হিসেবে আমরা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে, নাগরিকের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছি, অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদির সমাহারে সামাজিক ন্যায়বিধানের দাবিকে হয়তো ততটা গুরুত্ব দিচ্ছি না। এখানে দু’টি বিষয়কে আলাদা করা দরকার। প্রথমত, এই দাবিগুলি রাষ্ট্রের কাছে যথেষ্ট জোরের সঙ্গে পেশ করা হচ্ছে না। সর্বজনীন উন্নয়নের মৌলিক শর্তগুলি অবহেলিত হতে হতে আজ রাষ্ট্রনীতির বয়ান থেকেই কার্যত হারিয়ে গিয়েছে, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’কে স্লোগান বললেও অত্যুক্তি হয়, ‘খেলা হবে’ গোছের সস্তা চটক ছাড়া তার কোনও অর্থই নেই। এর পিছনে আছে অর্থনীতির গূঢ়তর বাস্তব। ঘটনা হল, উন্নয়নের গোটা কার্যক্রমটাই পর্যবসিত হয়েছে বৃহৎ পুঁজির তন্ত্রসাধনায়। অথচ বিরোধী রাজনীতির পরিসর থেকে এই বিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ এবং মৌলিক সমালোচনা অনুপস্থিত, পুঁজির স্বার্থের দ্বারা চালিত না হয়ে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের প্রতি মনোযোগী হওয়ার কোনও সুগঠিত দাবি তৈরিই হয়নি, এমনকি বামপন্থী দলগুলিও এ ব্যাপারে বাঁধা গতের কিছু কথা পুনরাবৃত্তি করেই দায় সারছে। সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটি ভারতীয় রাজনীতিতে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই অবহেলিত।
কিন্তু এই অবহেলার একটি দ্বিতীয় মাত্রাও আছে, আমাদের আলোচনায় যা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। সামাজিক ন্যায়ের কথা যখন বলা হয়, তার জন্য দাবি জানানো হয়, সেই দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়, এমনকি যখন তাকে অধিকারের দাবি হিসেবে দেখা হয়, তখনও সেই অধিকারকে স্বাধীনতা-র শর্ত বলে মনে করা হয় না। সমাজে সুস্থ ভাবে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার ছাড়া মানুষ স্বাধীন নয়— এই প্রাথমিক সত্যটিকে আমরা তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিই না। অর্থাৎ, পূর্বোক্ত আলোচনার সূত্র ধরে বলা যেতে পারে, কেবল নেতিবাচক স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে আমরা ইতিবাচক স্বাধীনতার স্বরূপটিকে উপেক্ষা করি। অন্ন বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্যের দাবি আর স্বাধীনতার দাবি, এই দু’টো জিনিস আলাদা থেকে যায়, বিচ্ছিন্ন থেকে যায়।
এর ফলে একটা বড় ক্ষতি হয়। কী ক্ষতি? সেটা বুঝে নেওয়ার জন্য প্রথমে খেয়াল করব যে, সামাজিক ন্যায়ের দাবি প্রধানত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের দাবি। সার্থক জীবন যাপনের যে সংজ্ঞাই আমরা বেছে নিই না কেন, সেই জীবনের শর্তগুলিকে যে ভাবেই নির্দিষ্ট করি না কেন, সেগুলি অপূর্ণ থাকে প্রধানত শ্রমজীবীর জীবনেই। এবং, আমাদের সমাজে অসাম্য যত প্রবল হচ্ছে, কেবল আয় ও সম্পদের অসাম্য নয়, সুযোগের অসাম্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার অসাম্য যত ব্যাপক ও গভীর হয়ে উঠছে, এই অপূর্ণতাও ততই বেড়ে চলেছে। ক্রমশই আরও অনেক মানুষ আরও অনেক বেশি মাত্রায় সুযোগবঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। এই কারণেই সামাজিক ন্যায়ের প্রসার ঘটানোর দাবিতে যে সংগঠিত আন্দোলনগুলি গড়ে উঠছে, সেগুলি প্রায় সম্পূর্ণতই বিভিন্ন শ্রমজীবী বর্গের আন্দোলন।
এখন, এই আন্দোলনগুলিকে আরও অনেক বেশি সংগঠিত ও জোরদার করে তাদের সংগঠিত শক্তিকে যদি সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করা না যায়, তা হলে ওই সংগ্রাম বহুলাংশেই সমাজের একটি সীমিত পরিসরে আবদ্ধ হয়ে থাকবে। এটাই বড় ক্ষতি। আমাদের অভিজ্ঞতাই দেখিয়ে দেয় যে, মানবাধিকার হরণের রাষ্ট্রীয় তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলন সবই আবর্তিত হয়ে চলে প্রধানত নাগরিক পরিসরে। যখন আমরা সেই প্রতিস্পর্ধাকে আরও অনেক জোরদার করে তোলার কথা বলি, তখনও ওই পরিসরটির মধ্যেই নিজেদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখি। এর ফলে দু’দিক দিয়েই ক্ষতি হয়— এক দিকে অধিকারের লড়াই দুর্বল হয়, অন্যদিকে কমজোরি হয় সামাজিক ন্যায়ের দাবি।
এই কারণেই স্বাধীনতাকে তার পূর্ণ রূপে, ইতিবাচক এবং নেতিবাচক স্বাধীনতার দ্বৈতরূপে দেখা দরকার, রাষ্ট্রের প্রতিস্পর্ধী শক্তি গড়ে তোলা দরকার তার ভিত্তিতেই। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসকে। সেই ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনের মধ্যে বহু টানাপড়েন চলেছে, অনেক সময়েই দ্বিতীয়টির চালকরা প্রথমটির দাবিদাওয়া থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখতে যত্নবান থেকেছেন, তার পরিণাম আমাদের স্বাধীনতার স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের পক্ষে ভাল হয়নি। আজ, সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে সেই পর্ব থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি, কিন্তু স্বাধীনতার স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন করে গভীর চিন্তার অবকাশ তৈরি হয়েছে, তার ভবিষ্যৎও ছায়াচ্ছন্ন। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে শ্রমজীবীর সংগ্রামের সঙ্গে— এক সূত্রে নয়, একই সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন সূত্রে— মেলানো জরুরি।
যে বাস্তবের মধ্যে আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি, তা থেকেই এই সংযোগের পথ খুঁজতে হবে। তার অগণন সম্ভাবনা আমাদের চার পাশে প্রতিনিয়ত তৈরি আছে এবং তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে থেকে একেবারে ঘটমান বর্তমানের ঝাঁপি থেকে একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে আলোচনা শেষ করা যেতে পারে। দৃষ্টান্তটি মণিপুরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির, যা নিয়ে দেশ জুড়ে বড় রকমের প্রতিবাদ হয়েছে, শাসকরা বহু চেষ্টা করেও সেই প্রতিবাদকে পুরোপুরি দমন করতে পারেননি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই প্রতিবাদের বেশির ভাগটাই সংগঠিত হয়েছে ক্ষমতার ভয়াবহ ও হিংস্র অপব্যবহারের বিরুদ্ধে। সেটা কেবল স্বাভাবিক নয়, অনিবার্য। কিন্তু এই হিংসার পিছনে, বিশেষত রাষ্ট্রশক্তির গূঢ় কার্যকলাপের পিছনে প্রাকৃতিক সম্পদ আত্মসাৎ করার যে বিপুল অভিযান সক্রিয়, তার ফলে স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকা যে প্রচণ্ড বিপর্যয়ের সম্মুখীন, সেই গভীর অন্যায় নিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধ অনেক কম, অনেক স্তিমিত। অভিজ্ঞতা বলে দেয়, এর পরিণাম কী হতে পারে। হিংসার এই পর্ব স্তিমিত হলে ক্রমশ মণিপুর থেকে প্রতিবাদী ও প্রতিস্পর্ধী ভারতের নজর সরে যাবে, ভূসম্পত্তির বিত্তহরণ এবং তার ফলে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার বিপর্যয় চলতেই থাকবে। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের প্রতিবাদকেই আমরা স্থানীয় মানুষের স্বাধীনতার দাবি হিসেবে দেখছি এবং দেখব, তাঁদের সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে তার সঙ্গে গ্রথিত করার কাজটিতে ফাঁকি পড়ছে এবং, সম্ভবত, পড়বে। ঠিক যেমন সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুতন্ত্রের লাগাতার আক্রমণের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমরা সচরাচর এই কথাটি যথেষ্ট জোর দিয়ে বলিনি এবং বলছি না যে, সংখ্যালঘু সমাজের মানুষ সামাজিক ন্যায়ের মাপকাঠিতে ভয়ানক ভাবে বঞ্চিত ও নিপীড়িত হয়ে আসছেন, যে নিপীড়ন এই জমানায় আরও বহুগুণ বেড়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই মনে হয় যে, স্বাধীনতার ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদ নিয়ে যে কথাগুলি বলা হচ্ছে সেগুলি আরও অনেক বেশি বলা দরকার, কিন্তু তার পাশাপাশি বলা দরকার আরও কিছু কথা, যা যথেষ্ট পরিমাণে বলা হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদী অভিযানের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধকে আরও অনেক বেশি প্রসারিত করতে হবে, তার ধারণায় ও বয়ানে নতুন মাত্রা যোগ করতে হবে, যে মাত্রা নিছক কথার মাত্রা নয়, কারণ তা উঠে আসবে সংগ্রামী বাস্তব থেকে। একযোগে সেই বাস্তব রচনা করবে সামাজিক ন্যায়ের জন্য শ্রমজীবীর সংগ্রাম এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে নাগরিকের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম।