বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
সামনে রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট। আগামী বছরে লোকসভা ভোট। গ্যাস, খাদ্যপণ্য সহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে পীড়িত ও ক্ষুব্ধ দেশের মানুষ, বিশেষ করে শ্রমজীবী-প্রান্তিক মানুষেরা। এই ক্ষোভের প্রকাশ যাতে ভোটবাক্স না পড়ে সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকার মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম একলপ্তে ২০০ টাকা কমিয়েছে সরকার। ৩০ অগাস্ট থেকে গ্যাসের সিলিন্ডার ১১২৯ টাকা থেকে কমে ৯২০ টাকায় পাওয়া যাবে।
খাদ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা ও দাম নিয়ন্ত্রণেও কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগস্ট মাসে সিদ্ধ চাল রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে কেন্দ্র। এর আগে ২০ জুলাই বাসমতী ছাড়া সব ধরনের সাদা চাল রপ্তানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। এমনকী বাসমতী চাল কত দামে রপ্তানি করা যাবে তাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। জুলাই মাসের প্রবল বৃষ্টিতে বহু রাজ্যে ধান চাষ নষ্ট হওয়ায় এক মাসের মধ্যে চালের দাম ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। চাল রপ্তানি হতে থাকলে দেশের বাজারে সরবরাহে টান পড়বে এবং দাম আরও বাড়বে এই আশঙ্কায় চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্র। বিশ্বে যত চাল রপ্তানি হয় তার ৪০ শতাংশ যায় ভারত থেকে। এর ফলে বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
এরপরেই জানা গেল আগামী কয়েক মাসের মধ্যে রাশিয়া থেকে আরও গম আমদানি করবে কেন্দ্র। এবছর মার্চ মাসেই প্রবল উত্তাপ ও এলোমেলো আবহাওয়ার কারণে গমের চাষ মার খেয়েছে। আগামী বছর রবি ফসল কাটার আগে নতুন করে গম বাজারে আসবে না। অতএব কম উৎপাদনের কারণে গমের সরবরাহে টান পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
একই চিত্র পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় যেমন গমের চাষ মার খেয়েছে, তেমনই মার খেয়েছে পেঁয়াজের চাষ। পরবর্তী খারিফ পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে উঠতে অক্টোবর হয়ে যাবে। ফলে সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে সরবরাহে ঘাটতির কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরপর বিদেশের বাজারে ভাল দাম পেয়ে পেঁয়াজের রপ্তানি যদি বেড়ে চলে, তাহলে ঘাটতির কারণে দেশের বাজারে পেঁয়াজের বাড়তি দাম ক্রেতার চোখে জল এনে দেবে। অতএব পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্র রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। এতেই ক্ষুব্ধ পেঁয়াজ চাষি ও পেঁয়াজের ব্যবসায়ীরা। তাদের শান্ত করতে ইতিমধ্যেই মজুত পেঁয়াজ বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্র এবং আরও মজুত ছাড়ার কথা জানিয়ে রেখেছে। একই সমস্যা দেখা দিতে পারে ডালের সরবরাহ নিয়েও।
এবং সবশেষে চিনি। এবছর কম বর্ষার কারণে মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের বহু এলাকায় মার খেয়েছে আখের চাষ। ফলে চলতি মরশুমে বাজারে চিনি উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এই আশঙ্কায় চিনি রপ্তানি নিষিদ্ধ করা নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে।
আমরা আগেই দেখেছি ফলন মার খাওয়ায় এবছর টম্যোটোর দাম কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল। ফলে মানুষের ক্ষোভ সামাল দিতে কেন্দ্রকে ভর্তুকি দিয়ে টম্যাটো বিক্রির ব্যবস্থা করতে হয় কেন্দ্রকে। যদিও এই সরকার খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে ভরতুকি দেওয়ার নীতির তীব্র বিরোধী এবং সবকিছুকেই তারা বাজারের হাতে তুলে দিচ্ছে। টম্যাটোর লাগমছাড়া দাম যে বাজারে ফিরে আসবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
কিন্তু টম্যাটো, চিনি, চাল, গম, পেঁয়াজ, ডাল — ধর্ম ও হিন্দুত্বের ইস্যু ছেড়ে আম আদমির জীবনের সাধারণ ইস্যুগুলি নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এত ভাবনা কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক মুদ্রাস্ফীতির ছবি।
এবছরের জুলাই মাসে খুচরো মুদ্রাস্ফীতি হার বেড়ে হয়েছিল ৭.৪৪% যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ জুন মাসেই মুদ্রাস্ফীতি কমে হয়েছিল ৪.৮৭%। এর মধ্যে আবার খাদ্যপণ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়েছিল ১১.৫১% যা ২০২০র জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। খাদ্যপণ্যের মধ্যে আবার শাকসবজিতে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৩৭.৩%, মশলায় ২১.৬%, দানাশস্যে ১৩%, ডালে ১৩.৩%, দুধে ৮.৩%। এরই মধ্যে জ্বালানির দাম বেড়েছে ৩.৭%, আবাসনের দাম বেড়েছে ৪.৫%, পাঁচমিশেলি জিনিসের দাম বেড়েছে ৫.১% এবং জামাকাপড় ও চটিজুতোর দাম বেড়েছে ৫.৬%। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতে মুদ্রাস্ফীতির সহনীয় মাত্রা হল ২ থেকে ৪ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসেই মুদ্রাস্ফীতির হার তার চেয়ে বেশি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য, যা সব আয়গোষ্ঠীর লোকজনকেই প্রতিদিন কিনতে হয়, তার দাম এককথায় লাগামছাড়া। (সূত্র–মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন)।
ওপরে চাল, গম, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, টম্যাটোর উৎপাদন ও সরবরাহ জনিত সঙ্কটের ছবি আমরা দেখেছি। আবার মুদ্রাস্ফীতির উদ্বেগজনক ছবিও স্পষ্ট। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে সামনেই উৎসবের মরশুম। তারপরেই তিন-চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। ২০২৪এর লোকসভা ভোটের আগে এই তিন রাজ্যের ফলাফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বিজেপিকে। তেলেঙ্গানাতেও জমি ছাড়বে না বিআরএস। কর্ণাটক, হিমাচলে মোদির মুখ জেতাতে পারেনি বিজেপিকে। মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, এই শ্লোগানের ধার কমছে। দেশে কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি দুর্বসহ। এই পরিস্থিতিতে যদি চাল, গম, চিনি, ডাল, পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া হয় তাহলে ভোটারদের ক্রোধ ঠেকাতে পারবে না বিজেপি। সেকারণেই, খুব নিঃশব্দে অন্তত আগামী ভোটের মরশুমে খাদ্যপণ্যের দাম যাতে লাগামছাড়া না হয় সেব্যাপারে সতর্ক রয়েছে বিজেপি সরকার। তাই বিভাজন ও হিন্দুত্বকে উসকে দেওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতির ফ্রন্টেও নামতে হচ্ছে কেন্দ্রকে। কারণ বিজেপি-আরএসএস জানে, যতই বিভাজন ও হিন্দুত্বকে উসকে দেওয়া হোক, চাল-ডাল-গম-তেল-চিনির হিসাব গোলমাল হয়ে গেলে হিন্দু ভোটারদের ক্রোধ থেকেও রেহাই মিলবে না। তাই রপ্তানি বন্ধ করা, কিংবা শুল্ক বসানো নিয়ে এত তৎপরতা কেন্দ্রের।
যদিও এত কিছুতেও রেহাই মেলা কঠিন। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিডের ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতিকেই গভীর সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বছরভর ঊর্ধবমুখীই থাকবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক। মার্কিন ফেডারাল রিজার্ভ জানিয়েছে, বিশ্বজুড়েই মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকবে। মুদ্রাস্ফীতিকে লাগাম পরাতে গেলে বাড়াতে হবে সুদের হার। সুদের হার বাড়লে মানুষ বাড়তি খরচ সামাল দিতে ভোগ্যপণ্যে খরচ কমাবে। এতে বাজারে চাহিদা সঙ্কুচিত হবে এবং উৎপাদন ও কর্ম সংস্থান কমবে। বিক্রি কমলে মুনাফার হার একই রাখতে পণ্যের দাম আরও বাড়াবে পুঁজিপতিরা। অথচ আয় না বাড়ায় বাজার আরও সঙ্কুচিত হবে। এভাবেই এক দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবেন সাধারণ মানুষ।
সুতরাং অর্থনীতির ফ্রন্টে যে গভীর খাদে পতনের সম্ভাবনা, তা শুধু চন্দ্রবিজয়ের গিমিক দিয়ে আটকাতে পারবে না আরএসএস ও বিজেপি।