বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

কৃষক আন্দোলনের গৌরবময় ৭৫ বছর

কৃষক আন্দোলনের গৌরবময় ৭৫ বছর

সঞ্জয় পুততুণ্ড

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২২— ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী দখলদারী কায়েম হওয়ার পর, প্রচলিত গ্রামীণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায়। সামন্ত্রতান্ত্রিক শোষণ অনেক বেশি তীব্রতা লাভ করে। কৃষকের উপর শোষণ তীব্রতর হবার ফলে দারিদ্র ভয়াবহ আকার নেয়। দুর্ভিক্ষ এবং মহামারির হানা চলছিল নিয়মিত। বিগত শতাব্দীর ২০-এর দশক থেকে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৩৬ সনে লক্ষ্ণৌতে সারা ভারত কৃষক সভা প্রতিষ্ঠার পর আন্দোলন যথেষ্ট গতি লাভ করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ যুবকরা এ কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
বাংলার তেভাগা আন্দোলন, মালাবার এলাকায় কৃষক সংগ্রাম, আসামের সুরমা উপত্যকা, মহারাষ্ট্রে ওয়ার্লি জনজাতিদের বিদ্রোহ ছাড়াও পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার সহ বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম তীব্রতা লাভ করে। আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করতে সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র তীব্র হয়। তবে তেভাগা সংগ্রাম যেখানে বিকশিত হয়, তার কোনও স্থানে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়নি। বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। স্বাধীনতা আসন্ন, এমন অবস্থায় আন্দোলন সংগঠিত করার কাজটি ছিল বেশ শক্ত। তবুও বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
স্বাধীন দেশে খাদ্য সংকট মোকাবিলা ও শিল্পের কাঁচামালের জন্য কৃষির বিকাশ ছিল জরুরি। এ লক্ষ্য পূরণে সামন্ত ব্যবস্থা ভাঙ্গা ছিল জরুরি। কিন্তু দেশের পুজিপতিরা সে পথে না গিয়ে তাদের সঙ্গে মিতালিবদ্ধ হল। ফলে সেচ ব্যবস্থা, কৃষি গবেষণা, সার উৎপাদন সহ যে সমস্ত ব্যবস্থা ভূমিকা গ্রহণ করা হল তাতে ধনী কৃষক এবং জোতদাররা উপকৃত হল। পরে সে উদ্যোগও বন্ধ হয়।
গ্রামে শিক্ষার অভাব, বেকারি, খাদ্য ও মূল্যবৃদ্ধির সংকট স্থায়ী রূপ গ্রহণ করে। একমাত্র জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে শেখ আবদল্লার নেতৃত্বে ভূমিসংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয়। তবে এ ভূমি সংস্কারেও ছিল যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা। দেশ স্বাধীন হবার পর পশ্চিমবাংলার চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, মালদা, জলপাইগুড়ি সহ অনেক জেলাতে প্রতিকূল অবস্থায় তেভাগা সংগ্রাম চলল ১৯৪৮-৫১ পর্যন্ত।
অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেঙ্গনায় কৃষক বিদ্রোহও এই সময় সংগঠিত। নিজামের বাহিনির বর্বর আক্রমণ মোকাবিলা করে কৃষক আন্দোলন এগিয়েছে। নিজাম বাহিনীকে প্রতিহত করার পর শুরু হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান – চলল নির্মম সন্ত্রাস। বাংলার তেভাগা আন্দোলনের এলাকাগুলিতেও চলছিল প্রবল সন্ত্রাস। স্বাধীনতার পরে ২৩শে মার্চ, ১৯৪৮ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়। ফলে কৃষক আন্দোলনের বহু কমিউনিস্ট নেতা গ্রেপ্তার হলেন বা আত্মগোপনে করতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতে চলছিল কৃষক আন্দোলনের কাজ। তেলেঙ্গানায় ৩৬ জনের মৃত্যুদন্ড এবং ১০০ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। কাকদ্বীপ ষড়যন্ত্র মামলাতেও অভিযুক্তদের দীর্ঘ সময় সাজা খাটতে হয়। কৃষক আন্দোলন বা ভূমি সংস্কারের বিকল্প হিসেবে শুরু হল ভূদান পর্ব। কৃষক সভা আওয়াজ তোলে—
১) বিনা ক্ষতিপূরণে জমি অধিগ্রহণ ও বিনা মূল্যে জমি বিতরণ।
২) কৃষকের ঋণ মুকুব, সেচ, ফসল ক্রয়, খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধি ও সামাজিক বৈষম্য দূর করা। কিন্তু করের বোঝা বাড়তে থাকল। ঘটল ব্যপক মূল্যবৃদ্ধি, উচ্ছেদ। ভূমি সংস্কার সম্পন্ন হল না। সরকারি সহায়তায় পুঁজিবাদি জমিদার তৈরির উদ্যোগ চলল। কৃষকের কাজ থেকে জোর করে লেভি আদায় চালু হল। দেশের বিভিন্ন অংশে সত্যাগ্রহ শুরু হয়। হাজার হাজার গ্রেপ্তার বরণ করে। এই সময় কেরালার নাম্বুদিরিপাদ সরকার ভাঙ্গা হয় ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে।
এই সময়েই বনাঞ্চলে কৃষক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে অমরাবতীতে আন্দোলন ব্যাপক রূপ নেয়। কর্ণাটকে মহারাজার জমি দখলের আন্দোলন সংগঠিত হয়। পশ্চিমবাংলা এবং ত্রিপুরায় ভাগচাষী ও কৃষকদে লড়াই চলতে থাকে। মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের বনের জমি বন্টনের জন্য ৩০ লক্ষ আদিবাসী লড়াই করেন। অন্ধ্রপ্রদেশে মজুরি ও কাজের দাবিতে, তামিলনাড়ুতে গবাদী পশু মিলিং বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয়।
সদ্য স্বাধীন দেশে প্রথম ভূমিসংস্কারের কাজ হয় কাশ্মিরে শেখ আব্দুল্লার নেতৃত্বে। তারপর দীর্ঘসময় সারা দেশে ভূমিসংস্কারের কাজ হয়নি। ১৯৬৭ সনে পশ্চিমবাংলা এবং কেরালায় রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়। অনুকূল পরিস্থিতিতে কৃষকের মধ্যে বিপুল উৎসাহ সৃষ্টি হয়। তবে অল্প দিনের মধ্যে এখানে শুরু হয় তীব্র সন্ত্রাস। জমি কেড়ে নেবার চেষ্টাও চলল। এই প্রবণতার পরিণতিতে ১৯৭৫ সনে সারা দেশে জরুরি অবস্থার ঘোষিত হল। এই সময় কৃষকের উৎপন্ন ফসলের দামের দাবি সামনে আসে। জমির কেন্দ্রীভবন বাড়তে থাকে। বেকারি বৃদ্ধি, কৃষকের ঋণ বৃদ্ধি, কৃষি সংকটের বৃদ্ধি বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়।
বাংলা-কেরালা-ত্রিপুরায় বাম সরকারের কাজ দেশের অন্য অংশেও অনুকূল প্রভাব দেখা দেয়। এই সময় রাজস্থান, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশে আন্দোলন বৃদ্ধি পায়। বিহার এবং অন্ধ্রে জমির আন্দোলন সংগঠিত হয়।
৯০-এর দশকে শুরু হল নয়া উদারবাদী পর্ব। তখন বাম কৃষক সংগঠন ছাড়া অন্য কৃষক সংগঠন নয়া উদারবাদী নীতির বিরোধিতা করেনি। তবে পরবর্তী সময়ে অন্যান্য অনেক কৃষক সংগঠন অবস্থান পরিবর্তন করে। সরকার কৃষি ক্ষেত্র থেকে হাত গুটিয়ে নিতে থাকে। পুঁজি যাতে সারা দেশে অবাধে লুটে খেতে পারে, তার ঢালাও ব্যবস্থা শুরু হয়। জমিতে কর্পোরেট মালিকানা, গণবন্টন ব্যবস্থা প্রত্যাহার, দেশীয় কৃষি গবেষণার বিদায়, কৃষি উপকরণের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে কৃষকের ফসলের নিম্নমুখী দাম, ভূমি সংস্কারের বিপরীত যাত্রা, প্রতিষ্ঠানিক কৃষি ঋণ দান স্থগিত রাখা হতে থাকে। এর বিরুদ্ধে ২০০০ সনে দিল্লী আভিযান সংগঠিত হয়। এরপর শুরু হয় শষ্য ভিত্তিক কৃষকদের সমাবেশ – নারকেল, রেশম, পাট, আখ, দুধ, টমেটো ইত্যাদির লাভজনক দামের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। ইতিমধ্যে দীর্ঘদিন কৃষক সভার অভ্যন্তরে কাজ করার পর ক্ষেতমজুর ও মৎসজীবীদের পৃথক সংগঠন গড়ে ওঠে। তারা বর্তমানে কৃষক সভার সফল আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকায়।
২০০৪ সালে বিজেপি সরকার পরাজিত হয়। জাতীয় স্তরে কৃষক আন্দোলনের হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বামপন্থীরা বিকল্প প্রস্তাব পেশ করে। তাদের দাবি ছিল – সেচ সম্প্রসারণ, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ, গ্রামীণ ঋণ দান বৃদ্ধি, জনজাতিদের বনের অধিকার, উচ্ছেদ বন্ধ, গ্রামীণ কর্ম সংস্থান, কৃষি পণ্য মূল্য কমিশন গঠন। এই সময়ে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্প, বনাধিকার আইন এবং স্বামীনাথন কমিশন গঠন সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সম্ভব হয়।
২০০৮ সনে তামিলনাড়ু, পন্ডিচেরি, কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশের সুনামিতে বিপুল ক্ষয় ক্ষতি হয়। কৃষক সংগঠনকে ত্রাণের কাজে নামতে হয়। এই সময় ৩টি সাধারণ ধর্মঘটে কৃষকরা সামিল হন। জিএম বিজ নিয়ে প্রবল বিতর্ক দেখা দেয়। পর্যাপ্ত পরীক্ষা না করে এ বীজ ব্যবহারে প্রবল বাধা সৃস্টি করা হয়।
২০১৪ সনে বিজেপি ক্ষমতাসীন হবার পর গণতন্ত্র এবং সংবিধানের মৌলনীতির উপর আক্রমণ প্রবলতর হয়। বনাঞ্চল আইন অধিকাংশ রাজ্য অস্বীকার করে। গ্রামাঞ্চলে বিমুদ্রাকরণের নেতিবাচক প্রভাব প্রবলভাবে দেখা দেয়। ফসল বীমা কার্যত কৃষকের জন্য নয়, কোম্পানির জন্য। শেষ পর্যন্ত দিল্লীর ধর্নার পর সরকার পিছু হটে।
বর্তমান শতাব্দীর প্রথম থেকে জমির কর্পোরেট গ্রাসের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। সারা দেশে দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০১৩ সনে নতুন আইন তৈরি হয়। সরকারে এসেই বিজেপি সেই আইন বাতিল করে। অধ্যাদেশ জারি করে বার বার। তীব্র বিরোধিতার ফলে ওই অধ্যাদেশ বাতিল করতে হয়। এই পর্যায়ে ১০০ সংগঠন নিয়ে তৈরি হয় ভূমি অধিকার আন্দোলন নামে একটি যুক্ত মঞ্চ। এই সময়ে মধ্যপ্রদেশে মন্দোসৌরে আন্দোলনরত কৃষকদের খুন করা হয়। আরও অনেক নতুন সংঠনকে যুক্ত করে তৈরি হয় সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমিতি। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনেক নতুন দাবি গ্রহণ করা হয় এবং কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক ও ক্ষেত মজুরদের যুক্ত হন।
কৃষিপণ্যের বাণিজ্য কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে মোদি সরকার তিনটি আইন পাশ করে। কৃষক বিরোধী তিনটি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে প্রথমে পাঞ্জাবে, তারপর শুরু হয় রাজধানী ঘিরে কৃষক অবস্থান। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে। নানা অপপ্রচার, নির্মম আক্রমণ ও ছলা-কলা করেও শাসকরা আন্দোলন দমন করতে পারেনি। এক বছর পার হবার পর সরকার ওই তিন আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। অবশ্য আজও পর্যন্ত তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছে। তাই কৃষকের অধিকারের দাবিতে লড়াই চলবে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে সুদীর্ঘ বৈচিত্রময় সংগ্রামের ঐতিহ্য আগামী কৃষক আন্দোলনকে পথ দেখাবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.