বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

এ'বছর ভারতবর্ষে ১০০-তম ‘মে-দিবস’

এ'বছর ভারতবর্ষে ১০০-তম ‘মে-দিবস’

দীপক পিপলাই

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ মে, ২০২২— ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম 'মে-দিবস' পালিত হয়েছিল ১০০ বছর আগে, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। মাদ্রাজে। কমিউনিস্ট নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের নেতৃত্বে। লালঝান্ডা না থাকায়, নিজের মেয়ের লাল একটা শাড়ি ছিঁড়ে তিনি 'লালঝান্ডা' বানিয়েছিলেন। তার পর থেকে প্রতি বছরই 'মে-দিবস' পালিত হয়ে আসছে। এবছর (২০২২) ১০০-তম 'মে-দিবস' পালন।
১৮৮৬ সালে শিকাগোতে সংগঠিত 'মে-দিবস' যা কিছু বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা হাজির করেছিল দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর সামনে, সে'গুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করা এবং বাংলায় তথা ভারতবর্ষে তাকে সচেতনভাবে প্রয়োগ করাই সচেতন শ্রমিক শ্রেণীর ঐতিহাসিক কর্তব্য। ওইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে শুধুমাত্র 'লাল পতাকা' উত্তোলন, শুধুমাত্র "দুনিয়ার মজদুর, এক হও" শ্লোগান তোলা, কিম্বা মিটিং মিছিল ভাষণ পোস্টারিং লিফলেটিং প্রবন্ধ কাগজ ম্যাগাজিন ইত্যাদি প্রকাশ, - এ'গুলোই প্রধান কর্তব্য না। যুগ যুগ ধরে এগুলো সবই হয়ে চলেছে নিয়মমতো। পাশাপাশি, শ্রমিক শ্রেণীর উপর বুর্জোয়া শ্রেণীর নানা রকম আঘাতও তীব্রতর হয়ে উঠছে। কিন্তু, ১০০ বছর পরেও, বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী সম্মিলিতভাবে তীব্র আঘাত হানার অবস্থায় আজও পৌঁছাতে পারলো না!
মে-দিবসের প্রধান প্রধান শিক্ষা
'মে-দিবস' চারটে প্রধান শিক্ষা হাজির করেছিল দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর সামনে।
১) শ্রমিকশ্রেণী যদি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের হাত থেকে প্রকৃতই রাজনৈতিক দাবি ছিনিয়ে নিতে চায়, তবে নির্দয়ভাবে সেই প্রচেষ্টাকে দমন করতে চাইবে পুঁজিপতি শ্রেণী। মে-দিবসের ঘটনাকে কেন্দ্র ক'রে ছ'জন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির, দু'জনকে যাবজ্জীবন ও একজনকে পনেরো বছরের কারাদণ্ডের আদেশ তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।
২) অঞ্চল বা শিল্প নির্বিশেষে, সকল শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে। ১৩৬-বছর আগে, শুধু শিকাগোতেই চার লক্ষ সংগঠিত-অসংগঠিত শ্রমিক মে-দিবসের ধর্মঘটে সেইমতো শামিল হয়েছিলেন।
৩) বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে, শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার ছিনিয়ে নেবার এবং মর্যাদা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। আলাদা আলাদা শিল্পে/ কারখানায়, মালিকের বিরুদ্ধে নিজেদের অর্থনৈতিক দাবিতে, কিছু কিছু শ্রমিকের পৃথক পৃথক লড়াই নয়।
৪) বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও আপোষহীন শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তোলার কর্তব্যে যদি কোনও নেতৃত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেই নেতৃত্বকে অগ্রাহ্য করতে হবে। সাত লক্ষ তিরিশ হাজার শ্রমিকের বিশাল সংগঠনের খোদ প্রেসিডেন্ট (পাউডারলি)-র ধর্মঘটের বিরোধী মতামতকে অগ্রাহ্য করেই সংগঠিত এবং জয়যুক্ত হতে পেরেছিল মে-দিবসের যুগান্তকারী সংগ্রাম।
উপরের চারটি শিক্ষাই অনেক নামী-দামী শ্রমিক নেতাদের তথা কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে বাংলায় তথা ভারতবর্ষে চূড়ান্তভাবে অগ্রাহ্য করতেই দেখছি আমরা।
১) রাজনৈতিক ভাষণের পাশাপাশি শ্রমিক শক্তিকে ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো ক'রে ফেলা হয়েছে;
২) জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলনের বিরোধিতা থেকে শুরু ক'রে নানাভাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর দালালি করা হচ্ছে;
৩) শ্রমিকশ্রেণীকে বিষদাঁতহীন আপোষের রাস্তায় চালাতে সদা-তৎপর ভোটবাজ নেতাদের লেজুড়ে পরিণত করা হয়েছে;
৪) 'মে-দিবস' উদযাপনকে বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছে গ্রহণযোগ্য নেহাতই এক বিপদহীন, নির্বিষ, দুশ্চিন্তামুক্ত 'শ্রমিক আন্দোলন'-এ পরিণত করা হয়েছে।
ফলশ্রুতি, 'মে-দিবস' এখানে সংগ্রামী চরিত্রহীন এক নিছক আনুষ্ঠানিকতা হয়েই রইলো! যারা শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি বেইমানি এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে সহযোগিতা করেই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করে চলছে যুগ যুগ ধ'রে, তারাই এখানে 'মে-দিবস' পালনের প্রধান নেতৃত্ব! যেসব নেতারা পাশের শ্রমিকের সঙ্গেও ঐক্যবদ্ধ থাকেন না, শ্রমিক-ঐক্য ভাঙেন, তারাও তঞ্চকতার সঙ্গে শ্লোগান দেন "দুনিয়ার মজদুর, এক হও"! এদের হাতে যেন তুরুপের তাস 'লালঝান্ডা'।
'মে-দিবস' আসে, যায়, আবার আসে। 'মহান দিবস' পরিচয়েই তা উদযাপিত হয়। পাশাপাশি, বুর্জোয়া শ্রেণীর অকল্পনীয় সম্পদ এবং শ্রমিকশ্রেণীর উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, দুই-ই বাড়তেই থাকে। উজ্জ্বল শ্রমিক নেতাদের রক্তে রঞ্জিত 'মে-দিবস' বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিল "আট ঘন্টা কাজ"-এর অধিকার। আর বর্তমান ভারত রাষ্ট্রে কাজের সময় আট ঘন্টা থেকে বাড়তে বাড়তে আবার 'মে-দিবস' পূর্ববর্তী ১০, ১২, ১৪ ঘন্টায় পরিণত হয়েছে! অজস্র ট্রেড ইউনিয়ন এবং অগুনতি 'কমিউনিস্ট পার্টি'-তে ভরা ভারত রাষ্ট্র, একবিংশ শতাব্দীতে আবার ফিরে গেলো ঊনবিংশ শতকের ১৮৮৬-পূর্ববর্তী কালে!
গত ১৩৬ বছরে দুনিয়ায় বহু পরিবর্তন হয়েছে।
ক) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে।
খ) একের পর এক দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়াদের হাত থেকে শ্রমজীবী মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে; আবার নেতৃত্বের বিচ্যুতির কারণে সেখানে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের পরিবর্তে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে।
গ) বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের পথ ত্যাগ ক'রে নির্ভেজাল ভোটবাদীতে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু একটা বিষয়ে কোনও পরিবর্তনই হয়নি। পুঁজিবাদ তার মুনাফার স্বার্থে শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ-পীড়ণ এতটুকুও কমায়নি তো বটেই, বরং নানা কৌশলে তা বহুগুণ বাড়িয়েছে। আরও নির্মম হয়েছে। কর্মহীন ও কর্মচ্যুত মানুষের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। অতি-মুনাফার স্বার্থে পৃথিবী জুড়ে কতোবার তারা যুদ্ধ-ধ্বংস-হত্যার তান্ডব চালিয়েছে, মৃত্যুর কারবারি হিসাবে কতো কোটি কোটি টাকার ভয়ঙ্কর সব মারনাস্ত্র এদেশে-সেদেশে চালান ক'রে যুদ্ধের এবং শ্রমজীবী মানুষের উপর হত্যা ও হামলার সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে, এবং কতো কোটি মানুষকে তারা হত্যা করেছে দুনিয়াব্যাপী, এসবের হিসেব কোনোদিনই মিলবে না!
সময়ের সঙ্গেসঙ্গে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা শ্রমজীবীদের প্রতি যতো বেশি নির্দয় ও শত্রু মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে, 'মে-দিবস' ততোই বেশি বেশি ক'রে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে দুনিয়া জুড়ে।
মে-দিবস: পুঁজিবাদী রাষ্ট্রবিরোধী সংগ্রামের দিন
'মে-দিবস' বাংলায় তথা ভারতবর্ষে কেউ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে, কেউ শহীদ স্মরণের দিন হিসেবে, কেউ বা নিজেদের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের দিন হিসাবে, কেউ হয়তো শ্রমিকশ্রেণীর উৎসবের দিন কিম্বা নিছকই একটা ছুটির দিন হিসেবে কাটান। কিন্তু এটা যে পুঁজিবাদী শ্রেণীর তথা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দিন, "শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তিযুদ্ধের সুদীর্ঘ যাত্রাপথে প্রথম পদক্ষেপের দিন", সেকথা কজনের স্মরণে আছে তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকেই যায়।
অগাস্ট স্পাইস, অ্যাডলফ ফিশার, জর্জ এঙ্গেল এবং অ্যালবার্ট পারসনস, এই চার শ্রমিক নেতাকে রাষ্ট্রশক্তি মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে খুন করে। লুইস লিং ফাঁসিকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে জেলেই আত্মহত্যা করেন। আন্তর্জাতিক চাপের কাছে রাষ্ট্র্র কিছুটা নতিস্বীকার ক'রে মাইকেল স্কোয়াব এবং স্যামুয়েল ফিল্ডেনের ফাঁসির আদেশকে বদলে করেছিল যাবজ্জীবন কারাদন্ড। অস্কার নিব-এর হয়েছিল পনেরো বছরের জেল। 
রাষ্ট্রশক্তির এতো হিংস্র আচরণের মূল কারণ ছিল শ্রমিক নেতাদের গভীর ও বলিষ্ঠ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রবিপ্লববাদী বক্তব্য। তথাকথিত অভিযোগের জবাবে আটজন শ্রমিক নেতাই আদালতে যে অসাধারণ দৃপ্ত রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছিলেন, তা রাষ্ট্রশক্তিকে আতঙ্কগ্রস্ত ক'রে তুলেছিল। কারণ তাঁরা সকলেই তাঁদের বক্তব্যে আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি আর ইতিহাস বিষয়ে তাঁদের সকলেরই যে পরিস্কার এবং যথেষ্ট গভীর জ্ঞান ছিল, তা তাঁদের ভাষণগুলো থেকেই অত্যন্ত স্পষ্ট।
আট নেতার স্মরণীয় বক্তব্যের কিছু কিছু অংশ
১) অগাস্ট স্পাইস তাঁর দীর্ঘ ভাষণে আদালতে বলেন, "সংক্ষেপে বললে মজুরি শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তোলা আমার উদ্দেশ্য।… সমাজব্যবস্থা চলবে সহযোগিতার ভিত্তিতে – সমাজতন্ত্র তার নাম।… শ্রমজীবী মানুষকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে, কেননা সম্ভাব্য সমস্ত বিচারে বল তথা শক্তিই হবে 'চূড়ান্ত নির্দ্ধারক'।… আমি গত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সমাজ দর্শনকে বিশেষভাবে অধ্যয়ন করেছি।…আমরা সমাজকে তার জন্যই প্রস্তুত করে চলেছি, এবং এই বিষয়ে জোর দিচ্ছি যে শ্রমিক জনগণ যেন সংগ্রামে নামার প্রস্তুতি নিয়ে নিজেদের শস্ত্রমন্ডিত রাখেন। যতবেশি নিজেদের তারা শস্ত্রমন্ডিত রাখবেন লড়াই ততটাই সহজতর হবে এবং রক্তপাত তত কম হবে।… সমাজতন্ত্র্র চায় মানবসভ্যতার সুফলগুলিকে মানব সমাজের প্রতিটি সদস্যের অধিগম্য করে তুলতে, যাতে সাধারণভাবে সকলের ভালো হয় – যেমনটি প্রকৃতপক্ষে হওয়া উচিত।… যেখানে বুদ্ধিমত্তা নৃশংস ক্ষমতার পক্ষে দাঁড়াবে না, তথাকথিত শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ তথা সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন হবেনা।… রাষ্ট্রবিপ্লববাদ অথবা সমাজতন্ত্রের বৈজ্ঞানিক আদর্শের ভিত্তিতে সমাজের পুনর্গঠনের কথা বলে – যেসব কারণে সমাজে অপরাধ জন্ম নেয় সেইসব কারণগুলিকে অপসারণের কথা বলে।"
২) অ্যাডলফ ফিশার বলেন, "ছাপার জন্য প্রদত্ত প্রচারপত্রে মুসাবিদায় এই বাক্যবন্ধটি আমি লিখেছিলাম, 'শ্রমজীবী মানুষ, আপনারা সশস্ত্র হয়ে সভায় সামিল হোন।' এই বাক্যবন্ধ ব্যবহারের হেতু ছিল। কেননা, আমি চাইনি যে ওই সভায়, অন্য সময়ে যেরকম হয়, সেরকম শ্রমজীবী মানুষকে গুলি করে মারা হোক।… কমরেড স্পাইস তার একটি পড়ে দেখলেন। আগেই তাঁকে আমি এই সভায় বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। বিজ্ঞপ্তিটা আমাকে দেখিয়ে স্পাইস বললেন, 'দেখ ফিশার, এই বিজ্ঞপ্তি যদি বিতরিত হয় তবে আমি সভায় বলব না।' আমি মেনে নিলাম যে আপত্তিজনক শব্দগুলি বাদ দেওয়াই ভাল হবে, এবং মি. স্পাইস ভাষণ দিয়েছিলেন।... একজন রাষ্ট্রবিপ্লববাদী নিজের আদর্শের জন্য সবসময় মরতে প্রস্তুত।… আপনারা বুঝতে পারবেন যে, কোনও আদর্শকে হত্যা করা অসম্ভব, যদিও সেই আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের জীবন আপনারা হরণ করতে পারেন।'
৩) জর্জ এঙ্গেল তাঁর দৃপ্ত ভাষণে বলেন, "সুশীল নাগরিকের আন্তরিকতা নিয়ে আমি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলাম, কিন্তু অচিরেই আমি বুঝলাম যে, 'মুক্ত স্বাধীন ব্যালট বাক্স'-র শিক্ষা এক পৌরাণিক গল্পকথা। এবং বুঝলাম যে আবারও আমি প্রতারিত হয়েছি।… শ্রমিকশ্রেণী ভোটের মাধ্যমে কখনও সেই সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলতে পারবেনা যেখানে নিশ্চিত হতে পারে রুজি, রুটি ও সুখী জীবন।… এ দেশের রাজনীতিকরা আপাদমস্তক কলুষিত।… খুব শীঘ্রই আমি বুঝতে পারলাম যে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নীচুতলার কর্মীদের মধ্যেও রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার সেঁধিয়ে গেছে। আমি দল ছেড়ে দিলাম এবং 'আন্তর্জাতিক মানুষের শ্রমজীবী সংঘ'-তে যোগ দিলাম। এই সংঘ, সবে গড়ে উঠছিল। এই সংঘের সদস্যরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো যে, শ্রমজীবী মানুষ ধনতন্ত্রের নৃশংসতা থেকে কেবলমাত্র বলপ্রয়োগের দ্বারাই নিজেকে মুক্ত করতে পারে।… আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুলনামূলকভাবে অনেক কম সময়ে প্রলেতারিয়েতরা বিপুল সংখ্যায় হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে যে, বাঁধন থেকে তাঁরা মুক্ত হতে পারবে কেবলমাত্র সমাজতন্ত্রের পথ ধরেই।… অন্য সকল বিবেচনার তুলনায় মানবিকতা সর্বাগ্রগণ্য হয়। সমাজতন্ত্র্রের মূল লক্ষ্য এটাই এবং আমি সানন্দে এই লক্ষ্যের সমর্থক।… রাষ্ট্রবিপ্লববাদের অনুসারিরা সংখ্যা বেড়েই চলেছে।… শ্রমজীবী মানুষ যেন কে তার বন্ধু, কে তার শত্রু চিনতে পরে – আমার পরম আকাঙ্খা এটাই।"
৪) অ্যালবার্ট পারসনস আদালতে বলেন, "একজন শ্রমজীবী মানুষ হিসাবে শ্রমিকশ্রেণীর ন্যায্য দাবি বলে যা আমি অনুভব করি, তারই পক্ষাবলম্বন করেছি।… আমাদের প্রাণদণ্ড বিধান সর্বৈবভাবে বিচার বিভাগীয় হত্যার সমতুল হবে, এবং বিচার বিভাগীয় হত্যা বিনা বিচারে দন্ড আইনের চাইতেও জঘন্য, আরও বাজে।… মামলার শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ করে জুরিরা দাবি করলেন, তারা আমাদের দন্ডাজ্ঞা দেবেন কারণ আমরা রাষ্ট্রবিপ্লববাদী।… আমি একজন রাষ্ট্রবিপ্লববাদী।… বিবর্তন ও বিপ্লব সমার্থক। বিবর্তন হচ্ছে বিপ্লবে তা দেওয়ার পর্যায়। বিবর্তন হচ্ছে প্রক্রিয়া আর বিপ্লব হচ্ছে প্রসূত। বিবর্তনের প্রক্রিয়াতেই জন্ম নেয় বিপ্লব।…আগে প্রভু দাসকে বেছে নিতে; আজকে দাস প্রভুকে বেছে নেয়।… আমি একজন সমাজতন্ত্রী। যদিও আমি একজন মজুরি দাস… মানুষ নিজের ক্ষুধা, অভাব, আর দুর্দশার দ্বারা তাড়িত হয়ে অন্ধের মত আঘাত হানে। অজ্ঞতাবশত তারা জানেনা কেন তাদের এই অবস্থা – জানে শুধু নিজেদের ক্ষুধা, অভাব আর দুর্দশাকে।… অজ্ঞ যারা তারা যেন জ্ঞানের আলো পায়, তাদের বুদ্ধি যেন বিকশিত হয় – সেটাই আমরা চাই।… সামাজিক দুর্দশা, মানসিক অবনমন, রাজনৈতিক নির্ভরতা ইত্যাদি দোষ বা ত্রুটি যা সমাজকে তাড়না করে, সে সবেরই উৎস হচ্ছে অর্থনৈতিক অধীনতা… আমি এখন খোলাখুলি অভিযোগ করছি যে – আমাদের বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত এই দণ্ডাদেশ কার্যকর করার জন্য বাদী পক্ষ, রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা, আইনি ব্যবস্থার শপথবদ্ধ আধিকারীকরা – যারা জনগণের কাছে আইনী অনুশাসন মেনে চলার এবং শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ – তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে, বিদ্বেষপরায়ণ মানসিকতায় উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে প্রতিটি আইনকে লঙ্ঘন করেছেন… মুক্ত স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারকে তারা লঙ্ঘন করেছেন। জনতার সমবেত হওয়ার অধিকারকে তারা লঙ্ঘন করেছেন।… 'তাদের ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমেই আপনারা তাদের চিনে নেবেন।' – তাদের নিজেদের এই মুখনিঃসৃত বাণীতেই তারা দণ্ডার্হ।… কাজ হারিয়ে যারা অলস হয়ে যেতে বাধ্য হয় তাদের সংখ্যাটা আপনারা বাড়িয়ে চলেন… বেকার বাহিনীটাকে বাড়িয়ে তোলেন… অসন্তোষের নতুন উপাদান সৃষ্টি করেন… এই অবস্থা হিংসা ডেকে আনতে বাধ্য।… ভোট দিয়ে কি একজন মানুষ নিজের জন্য রুটি-কাপড়া-মকান, কাজ আর পরিচ্ছদের বন্দোবস্ত করতে পারে? আমেরিকার মজুরিদাসদের মুক্তি কিসে আছে? গরীবেরা সর্বত্রই ধনীদের ক্রীতদাস। ভোট ক্ষুধার যাতনা থেকে রক্ষা করেনা, পুলিশের গুলি থেকেও রক্ষা করেনা। খাদ্যই মুক্তি, মুক্তিই খাদ্য। শিকাগোর রাস্তায় যারা 'পথ দাঙ্গা'র মহড়া দেয়, তাদের গুলি থেকেও ভোট কাউকে রক্ষা করতে পারেনা। এই অবস্থায় শিল্প শ্রমিকদের কাছে ভোট মূল্যহীন।… অধিকারের কথা বলা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায় যদি সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা কারুর না থাকে।… সমাজতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে মজুরি দাসত্বের বিলোপ।… যারা দেশের শিল্পগুলি নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই পারে দেশের অন্যদের ভোটকেও নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাই তারা করে।… যে মানুষকে নিজের শ্রম বিক্রি করতে হয়, নইলে থাকতে হয় অনশনবন্দী হয়ে, সে মানুষ খাদ্যের বিনিময়ে ভোটটাকেও বিক্রি করতে পারে।… আমার মনে বিশ্বাস ছিল যে, আমি নিরপরাধ মানুষ। আমার মনে হয়েছিল, আমার সামনে এগিয়ে আসা উচিত। আমার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যা ঘটছে তার ভাগ আমারও নেওয়া উচিত। এবং যদি প্রয়োজন হয় ফাঁসিকাঠে দাঁড়ানোও উচিত। শ্রমিকের অধিকারকে, স্বাধীনতার সাধনাকে, উৎপীড়নের উপশমকে সমর্থন করা উচিত।"
(পারসনস প্রথম দিন তিন ঘন্টা এবং পরের দিন পাঁচ ঘন্টা, মোট আট ঘন্টার এই ভাষণ দিয়েছিলেন আদালতে দাঁড়িয়ে।)
৫) মাইকেল স্কোয়াব তাঁর ভাষণে বলেন, "এক শ্রেণী যখন আর এক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত, তখন ন্যায়ের কথা বলা অলসতা, দ্বিচারিতা।… আমরা কমিউনিজম এবং রাষ্ট্রবিপ্লবের পক্ষে ওকালতি করি।… সমাজতন্ত্রের অর্থ আমরা যেভাবে বুঝি তা হচ্ছে – উৎপাদনক্ষেত্র ও যন্ত্রপাতির মালিকানা বর্তাবে জনগণের যৌথ মালিকানায়।… বড় বড় সব রাজনৈতিক দলগুলি গরীবদের জন্য কী করেছে? শপথ নিয়েছে অনেক কিছু করার, কিন্তু করেনি কিছুই।… আমরা কেবল সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট না, আমরা রাষ্ট্রবিপ্লববাদীও বটে।… আমরা হিংসার বিরুদ্ধে, শুধুমাত্র হিংসারই বিরুদ্ধে হিংসা প্রয়োগের কথা বলেছি। কেননা, সেটাই আত্মরক্ষার অপরিহার্য উপায়।"
৬) অস্কার নিবে বলেন, "বিগত কয়েকদিনে আমি বুঝতে পেরেছি আইন বস্তুটি কী। এর আগে আমি জানতাম না। এর আগে আমি সত্যিই জানতাম না যে আমায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে কেননা – স্পাইস, ফিল্ডেন এবং পারসনসকে আমি চিনতাম, এই ভদ্রমহোদয়দের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল। আমার অপরাধ, সাক্ষ্য-প্রমাণে যেমন দেখানো হয়েছে, আমি টার্নার হলে অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় সভাপতিত্ব করেছিলাম। – যে সভায় মাননীয় মহোদয়, আপনিও উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রিত ছিলেন। বস্তুতপক্ষে বিচারক, যাজক, সংবাদপত্রের সাংবাদিক, সম্পাদক সকলেই আমন্ত্রিত হয়েছিলেন রাষ্ট্রবিপ্লববাদ এবং সমাজতন্ত্রের বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিনিধিস্থানীয় কেউই শ্রমিকদের সঙ্গে এই প্রশ্নে অর্থাৎ শ্রমের প্রশ্নে, রাষ্ট্রবিপ্লববাদ, ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আলোচনা করতে এগিয়ে আসেননি। না, তারা এই আলোচনা মানতে পারছিলেন না।… আমরা সমাজতন্ত্রীরা ভীষণভাবে একথা বিশ্বাস করি যে, শ্রমজীবী মানুষকে নিজেদের অবশ্যই শিক্ষিত করে তুলতে হবে; মূর্খ বিদ্যাভিমানি হিসাবে নয় – অজ্ঞ রাষ্ট্রবিপ্লববাদীদের মতো কেউ কেউ নিজেদের যেভাবে পরিচিত করান।… আমায় ফাঁসি দিন।… আমার দুঃখ একটাই যে – অন্যদের সঙ্গে আমাকেও ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হচ্ছে না।"
৭) লুইস লিং তাঁর ভাষণে বললেন, "গ্রিনেল বারেবারেই, অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে হত্যার জন্য নয়, আমি রাষ্ট্রবিপ্লববাদী এটাই দণ্ডবিধানের হেতু। কী এই রাষ্ট্রবিপ্লববাদ? এই বিষয়ে আমার সাথী বন্ধুরা এই আদালতে খুবই প্রাঞ্জল ভাবে বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, সে সম্পর্কে আবারও কিছু বলা, আমার বিচারে অপ্রয়োজনীয়।… ঘটনা হচ্ছে, প্রতিবারেই যখন নির্বাচনী ব্যালটকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে, উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার, তখনই আপনারা নিষ্ঠুর পুলিশি সন্ত্রাস প্রদর্শন করেছেন। তাই আমি উগ্র পুলিশি অত্যাচার প্রতিরোধ করতে উগ্রতর বলপ্রয়োগের পদ্ধতি সুপারিশ করেছি। আপনারা আমাকে 'আইন শৃঙ্খলা' অবজ্ঞা করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন।… আপনাদের আইন শৃঙ্খলার প্রতিনিধি হচ্ছে পুলিশ – পুলিশের মধ্যে এমন অনেক আছে যারা নিজেরাই চোর।… রাষ্ট্রবিপ্লববাদের অর্থ হচ্ছে কোনও আধিপত্য নয়, কোনও মানুষ অন্যের উপর কর্তৃত্ব ফলাবে না। তবুও আপনারা একে বলছেন 'বিশৃঙ্খলা'। রাষ্ট্রবিপ্লববাদ এমন এক সমাজব্যবস্থা যা কিনা সেই 'শৃঙ্খলা'-র কথা বলেনা যাকে রক্ষা করতে চোর আর দুর্বৃত্তদের মদত নিতে হয়। আর তাকেই কিনা আপনারা বলছেন 'বিশৃঙ্খলা'!... আমি আবারও খোলামনে এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা করছি যে আমি বলপ্রয়োগের পক্ষে।… তোমরা যদি আমাদের উপর কামান দাগো, আমরা তবে তোমাদের উপর ডিনামাইট ফাটাবো।… আমি তোমাদের ঘৃণা করি, তুচ্ছ করি তোমাদের নিয়মনীতি শৃঙ্খলাকে, তোমাদের আইনকে, তোমাদের ক্ষমতা প্রপীড়িত কর্তৃত্বকে। এই জন্যই আমায় ফাঁসিকাঠে ঝোলাও।"
৮) স্যামুয়েল ফিল্ডেন তাঁর ভাষণে বলেন, "পৃথিবীর সর্বাগ্রগণ্য সুসভ্য দেশ হিসেবে মাঝেমাঝে যার উল্লেখ করা হয়, সেই দেশেও বিপ্লবমনস্ক হওয়াটা অপরাধ।… বুদ্ধিজীবী মানুষেরা যদি বিপ্লবমনস্ক হন, তবে সাধারণ বিচারে তাদের দোষ ধরা হয় না। কিন্তু যদি গরীব মানুষেরা বিপ্লবমনস্ক হন, তাহলে দোষ ধরা হতে পারে।… কিছুকিছু মানুষ আছেন যারা কখনও পরিবেশের বাইরে আসতে পারেন না। তাদের কখনও বিকাশ ঘটেনা। এক পা-ও এগোয় না তারা।… মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হচ্ছে নিজেদের চারপাশে যে মানুষজনেরা আছে তাদের সুখের নিশ্চিতি।… বিশ্বের ভাল করার হিসেব কষে যা তৈরি হয়েছে, তার প্রচারে আমার শক্তি ব্যয় করা আমার জন্য যথোপযুক্ত কাজ এবং সেই কাজই আমি করতাম, না করে পারতাম না।… আসলে সমাজতন্ত্র হচ্ছে সাম্য। সমাজতন্ত্র একথা স্বীকার করে যে, সমাজে কোনও মানুষই তার অবস্থার জন্য দায়ী নয়। সব সামাজিক রোগের উৎস হচ্ছে দৈন্য-দারিদ্র। আর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলে সামাজিক ত্রুটি বা দোষের উৎসমূলে যেতে।… ম্যাককর্মিক-কে ধর্মঘটীদের কয়েকটা দাবি মেনে নিতে হয়। ইউনিয়নের জোর ছিল বলেই তাকে ওইসব দাবি মানতে হয়।… তারপর ম্যাককর্মিক দেখতে পেল, এমন কিছু ব্যবস্থাও আছে যা ইউনিয়নের আওতায় আসে না। সেটা ছিল ছাঁচ ঢালাইয়ের যন্ত্র। ছাঁচ ঢালাইয়ের যন্ত্র যখন তার হাতে এলো তখন সে এমন এক যন্ত্রের মালিকানা পেলো, যে যন্ত্র মাত্র ২৫ জন শ্রমিকের সহায়তা নিয়ে সেই কাজ করে দেবে যে কাজটা আগে ১২৫ জন শ্রমিক করতো।… এই যুক্তি হাস্যকর যে, যন্ত্র তৈরি করতেও তো মানুষ লাগে, আর সেই পথে কাজও সৃষ্টি হয়। শ্রমিক ছাঁটাই যন্ত্র কেনার জন্য যে পরিমাণ অর্থরাশি লাগে এবং যে পরিমাণ শ্রম সময় উদ্বৃত্ত হয়, যদি সমপরিমাণ অর্থ ও শ্রম সময় ওই যন্ত্র তৈরিতে প্রয়োজন হ'তো, তবে কোনও মানুষের আর যন্ত্র কেনার কোনও ইচ্ছা থাকতো কী? এই প্রশ্ন নিজেই তার উত্তর দিয়ে দেয়।… আমি বলি, এই ব্যবস্থার কোনও অনুকম্পা বোধ নেই। তবে কেন ওই মানুষগুলির অনুকম্পা বোধ থাকবে এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য? কেন তারা এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে না যখন এই ব্যবস্থা তাদের ধ্বংস করছে?... এখানে তো রয়েছে পঁচিশজন পেশাদার মিথ্যেবাদী।… আমার সঙ্গী মানুষদের আমি ততটাই ভালবেসেছি, যতটা আমি ভালবেসেছি নিজেকে। আমি ছল-চাতুরি, অসততা এবং অন্যায়কে ঘৃণা করেছি। উনবিংশ শতাব্দী তার সবচেয়ে বড় বন্ধুকে খুন করার অপরাধ করছে। অনুতাপ করার জন্য শতাব্দী থাকবে।… আমি বিশ্বাস করি সেই সময় আসবে যখন শুভ্রতর বোধ, উন্নততর বুদ্ধিবৃত্তি – অসাম্য, অন্যায় আর ভ্রষ্টাচারের শিখর ছাড়িয়ে দেখা দেবে। আমি আশা রাখি, সত্য এবং ন্যায়ের সূর্যালোক মুক্ত এক পৃথিবীকে আলোর প্রলেপ বুলিয়ে ধুইয়ে দেবে।"
শেষ কথা
মে-দিবসের উজ্জ্বল নেতৃত্বের এইসব পুঁজিবাদ বিরোধী এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রবিরোধী বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাকে বাংলায় তথা ভারতবর্ষে অবজ্ঞা করেই চলা হয়েছে এবং হচ্ছে। 'মে-দিবস' নিতান্তই একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে! নেতৃত্বের এইসব চিরউজ্জ্বল ভাষণ না পড়লে, বুঝলে, এবং উপলব্ধি করলে 'মে-দিবস' সম্পর্কে সম্যক কোনও বোধই গড়ে উঠতে পারেনা। অথচ বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে, ১০০-তম 'মে-দিবস' পালনের বছরেও, বাংলায় তথা ভারতবর্ষে ক'জন এইসব নেতাদের অসামান্য বিপ্লবী তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণগুলি পুরোটা পড়বার সুযোগ পেয়েছেন, কিম্বা চোখে দেখেছেন, অথবা এই ভাষণগুলির অস্তিত্বের কথা জানেন, তা-ও জোর দিয়ে বলা যায়না!
একটা কথা হয়তো বলাই যায়। এখানকার শ্রমিক আন্দোলন তথা কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রধানত যে ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, তা পুঁজিবাদ বিরোধী মে-দিবসের মৌলিক বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার পরিপন্থী। এখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের বৃহত্তম অংশ যে ভোটবাদী রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরেছেন এবং রাষ্ট্রবিপ্লবের পথকে পরিহার করেছেন, উপরোল্লিখিত নেতারা ছিলেন ঘোষিতভাবেই তার বিরোধী। সেই কারণেই সম্ভবত এইসব ভাষণগুলির যথাযথ প্রচার/ অনুবাদ হয়নি। ষোলো বছর আগে (১ মে, ২০০৬) বন্ধু অমিত চক্রবর্তী পুরো ভাষণগুলি বাংলায় ভাষান্তর ও সঙ্কলন ক'রে ২৬২ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশ করেন ('ফাঁসীর মঞ্চে জীবনের গান')। এ'ব্যাপারে অপর কোনও উদ্যোগ/ প্রকাশনার কথা আমার অন্তত জানা নেই। সম্ভবত, অপর কোনও ভারতীয় ভাষাতেও ভাষণগুলি এর আগে অনুদিত হয়নি। শ্রমিক আন্দোলন তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই বেদনাদায়ক বিপথগামিতাকে উপলব্ধি করতে হবে। গভীরভাবে আত্মস্থ করতে হবে মে-দিবসের পুঁজিবাদ-বিরোধী এবং পুঁজিবাদী-রাষ্ট্রবিরোধী, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রকৃত রাজনৈতিক তাৎপর্য। সেই অনুযায়ী, সচেতন শ্রমিকশ্রেণীকেই ঠিক করতে হবে শ্রমিক সংগ্রামের তথা কমিউনিস্ট সংগ্রামের পথরেখা।
কোনও পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশ, কোনও কর্পোরেট হাউস, কিম্বা 'ক্রোনি ক্যাপিটাল' এসব কোনও কিছুই এখানকার শ্রমিক শক্তিকে ভাঙেনি। শ্রমিকশ্রেণীর শক্তিকে এখানে ভেঙে টুকরো টুকরো ক'রে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করেছে তথাকথিত 'মে-দিবস পন্থী' রাজনৈতিক নেতারাই। এই সত্যকে উপলব্ধি করতে না পারলে 'মে-দিবস' পালন নেহাতই এক আনুষ্ঠানিকতা হয়েই থাকবে, আগামী দিনেও। শ্রমিক শ্রেণীর তথা সমাজের কাজে আসবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.