বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ জুলাই ২০২২ -
পৃথিবীর নানা দেশের বর্তমান ঘটনাবলী দেখলে কী মনে হয় ‘গণতন্ত্র’ হৈ হৈ করতে করতে দুনিয়াজুড়ে এগিয়ে চলেছে? যুদ্ধ-অস্ত্রশস্ত্র-হত্যা-রক্ত-ধ্বংসের অমানবিক দাপট কী ‘গণতন্ত্র’-র জয়যাত্রাকে চিহ্নিত করছে? দুনিয়াজুড়ে উন্মাদের মতো চলছে পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্রের প্রতিযোগিতা! বর্তমান পরিস্থিতি সকলকেই বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে - “নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/ শান্তির ললিত বাণী শোনাবে ব্যর্থ পরিহাস” (রবীন্দ্রনাথ, ১৯৩৭) । জনগণও তাঁদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সেকথা হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছেন।
বইয়ের পাতা থেকে বাস্তব জন্ম নেয় না, বাস্তবের অধ্যয়ন থেকেই বইয়ের তত্ত্ব সৃষ্টি হয়; এবং সেই তত্ত্ব আবার পরবর্তী প্রয়োগের দিশা দেখায়। হাতেকলমে কাজের মাধ্যমে পাওয়া অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়। গড়ে ওঠে ‘তত্ত্ব’।
প্রযুক্তি থেকেই বিজ্ঞানের জন্ম। আগুনের বিজ্ঞান জেনে মানুষ আগুন জ্বালেনি; ঘর্ষণে ঘর্ষণে আগুন জ্বালানো এবং আগুন ব্যবহারের হাজার হাজার বছর পরে মানুষ আগুনের বিজ্ঞান জেনেছে। চাকা আবিষ্কার এবং ব্যবহারের হাজার হাজার বছর পরে মানুষ চাকার বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে। তেমনি, শত-সহস্র বছর ধরে সমাজে ঘটে চলা মানুষের সংগ্রামকে নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেই গড়ে উঠেছে শ্রেণীসংগ্রামের মার্কসবাদী তত্ত্ব। নিরলসভাবে শ্রেণীসংগ্রাম করতে করতেই আবিষ্কৃত হবে দেশ-কাল-পরিস্থিতি নির্ভর মানবমুক্তির নতুন নতুন পদ্ধতি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এখান থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল প্রধানত সশস্ত্র আন্দোলনের গুঁতোয়। শোষণ অত্যাচার অবিচারে ভরপুর বর্তমান সমাজটাও পাল্টাতে পারে বাংলার তথা ভারতীয় সমাজের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শোষকশ্রেণীকে মোক্ষম ধাক্কা দেবার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেই। বলা যায় না, হয়তো সমাজ পরিবর্তনের সেই পদ্ধতি হবে ইতিহাসে নতুন, চমকপ্রদ, অভূতপূর্ব।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষকের শাসন কায়েম হবার পর থেকে, প্রথমে রাশিয়ায় এবং পরে সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে খাদ্য, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই যে অভূতপূর্ব এবং অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছিল, তা ঘোর কমিউনিস্ট-বিরোধীদের সহ সমগ্র পৃথিবীকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
চীনের অর্থনৈতিক নীতি, রাজনৈতিক লাইন, সামরিক কৌশল ইত্যাদি নিয়ে দ্বিমত কিম্বা বহুমত থাকতেই পারে। কিন্তু, ভারতবর্ষের দু’বছর পরে (১৯৪৯) প্রকৃত স্বাধীনতা লাভের পর থেকে চীনের চোখধাঁধানো অগ্রগতির পাশে ভারতবর্ষের তুলনামূলক অন্ধকার, বিপ্লবে জয়লাভ আর “সাংবিধানিক স্বাধীনতা”-র পার্থক্য বুঝতে অনেককেই সাহায্য করে।
১৯৫৯ সালে, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট বাতিস্তা সরকারের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া কিউবা-ও আজ পৃথিবীর বিস্ময়। শাসন ক্ষমতায় রয়েছে ‘কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি’। সেখানে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যপরিষেবা সম্পূর্ণ অবৈতনিক। স্বাক্ষরতার হার ৯৯.৮। অতটুকু দেশ, যার বর্তমান জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় দশভাগের একভাগ, তারা পৃথিবীর ৬৯টি দেশে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী এবং ৪০টি দেশে কয়েক হাজার ডাক্তার পাঠিয়েছে। এখানে জনগণের জন্য মাথাপিছু ডাক্তারের সংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কিউবা-বিপ্লবের অন্যতম নেতা, চিকিৎসক আর্নেস্টো চে গুয়েভারাকে বলিভিয়ায় গ্রেপ্তারের সঙ্গেসঙ্গেই সিআইএ তাঁকে সাতবার গুলি চালিয়ে হত্যা করে, ৯ অক্টোবর ১৯৬৭। প্রথম গুলিতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, পরবর্তী ছয়টি গুলি ছিল বিপ্লবী চে-র প্রতি সাম্রাজ্যবাদের অপরিসীম ঘৃণার নিদর্শন।
প্রথমে ফরাসি এবং তারপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভয়ঙ্কর অমানবিক সশস্ত্র আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, অত্যন্ত ছোট এবং কৃষিপ্রধান দেশ ভিয়েতনামের দীর্ঘ ও অভূতপূর্ব সশস্ত্র জনযুদ্ধের বিজয় (১৯৭৫) ‘মুক্তিসংগ্রাম’-এর এক উজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করে। বাংলায় সে’সময়ে মুক্তিকামী মানুষের কন্ঠে আওয়াজ উঠেছিল - “তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।”
আত্মরক্ষার তাগিদেই বলপ্রয়োগের অনিবার্য ‘সাধারণ’ শিক্ষাকে সামনে রেখে, ‘নির্দিষ্ট’ স্থানীয় পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিল রাশিয়া, চীন, কিউবা এবং ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রাম।
বুর্জোয়া শ্রেণীও “অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ” করে। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম অ-কংগ্রেসী ‘যুক্তফ্রন্ট’ সরকার ক্ষমতায় আসে। বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সেই সরকারের অংশীদার। ‘কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসেছে! এবার বড় বড় ব্যবসায়ীদের কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে!’ - এই আতঙ্কে কলকাতার বড়বাজারে ‘বনধ’ হয়। তারপর থেকে সরকারি কমিউনিস্টদের চলন-বলন-কর্মকাণ্ড সবই বুর্জোয়া শ্রেণী দেখেছে। দশ বছর পর, ১৯৭৭ সালে যখন ‘বামফ্রন্ট’ সরকার ক্ষমতায় এলো, তখন বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স বিবৃতি দিয়ে জানালো, তারা “বামফ্রন্টের জয়কে স্বাগত জানাচ্ছে।” (Welcomes the victory of Left Front.) এটাই সংসদীয় পথের মহিমা!
আপোষহীন নিরলস শ্রেণীসংগ্রামের পথেই আসতে পারে শ্রমজীবী জনগণের জয় এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর পরাজয়।
বর্তমানে আমরা দেখছি –
১) দুনিয়ার দিকে দিকে, সশস্ত্র হামলার মুখে মানুষের অবর্ণনীয় জীবনযন্ত্রণা। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে, কোটি কোটি অসহায় মানুষকে ঘর-বাড়ি-ভিটে-দেশ হারিয়ে, সর্বহারা উদ্বাস্তু হিসেবে মৃত্যুর মুখে পড়ার করুণ চিত্র।
২) বিভিন্ন দেশে, কোটি কোটি মানুষকে হয় অনাহারে-অর্ধাহারে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে, কিম্বা শুকিয়ে যাওয়া মৃতদেহে পরিণত হচ্ছে।
৩) প্রত্যেকটি মহাদেশে, জনগণের উপর ভয়ঙ্করতম মারণাস্ত্র নিয়ে কোনও-না-কোনও রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির ঘৃণ্যতম হামলা ও হত্যালীলা চলছে। ইস্কুল-হাসপাতাল-বৃদ্ধাবাস, ধর্মীয় উপাসনালয়, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাগৃহ, শিল্পকারখানা-কৃষিক্ষেত্র— সর্বত্রই নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে কাতারে কাতারে!
৪) বাংলা তথা ভারতবর্ষেও, উর্দিধারী সরকারি সশস্ত্র বাহিনী এবং উর্দিহীন ঘাতক শক্তির সশস্ত্র দাপটে নিহত ও আহত হবার ঘটনাও ঘটেই চলেছে। “সংবিধানসম্মত আইনের শাসন” মানুষের জীবনযন্ত্রণা এবং অসহায় মৃত্যুকে ঠেকাতে ব্যর্থ!
৫) বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাদের তরফ থেকে ‘গণতন্ত্র’-র বাণী নিয়মিতভাবেই বিশ্বের আকাশ-বাতাস ভারি করে তুলছে। আবার সেইসব নেতারা নিজেরাই ভয়ঙ্করতম পারমানবিক অস্ত্র এবং ধ্বংসাত্মক অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রর বিপুল ভাণ্ডারের উপর বসে আছে। মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষার মৌলিক সমস্যাকে প্রধান গুরুত্ব না দিয়ে, অকল্পনীয় অর্থ ব্যয় করে আরও ভয়ঙ্কর, আরও অমানবিক, আরও ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র আবিষ্কারের এবং/ অথবা আমদানির অবিরাম চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
৬) দেশের কোটিকোটি গতরে খাটা শ্রমিক কিম্বা কৃষকদের কেউই ভারতবর্ষের সংসদে/ বিধানসভায় কোনওদিনই যেতে পারেননি। লক্ষণীয়, এই দুই জায়গাই কোটি কোটি টাকার মালিকে মালিকে ছয়লাপ। চোর, জোচ্চোর, জালিয়াত, দাঙ্গাবাজ, গণহত্যাকারী ইত্যাদি নানারকম ক্রিমিনালদেরও মজলিস এইসব জায়গা! বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষাকারী এইসব ‘জনপ্রতিনিধি’দের মধ্য থেকেই দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির হর্তাকর্তারা মনোনীত হন। এবং সেইসব পরগাছাদের ইচ্ছা, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশেই ‘দেশ’ চলে।
৭) বাংলায় তথা ভারতবর্ষে চুরি, জালিয়াতি, খুন, মারদাঙ্গা, ধর্ষণ আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়েই চলেছে সমাজে। কিন্তু শাসকরা এ’সব ব্যাপারেও মদদদাতা অথবা নির্বিকার; জনগণ আতঙ্কিত।
৮) বারবার সরকার বদল হয়েই চলেছে, এবং বেড়েই চলেছে দেশজুড়ে কর্মহীনের/ বেকারদের সংখ্যা। ভাষণ দেওয়া, নানারকম ‘পরিকল্পনা’ করা মাতব্বররা কেউ-ই মেহনত দিয়ে দেশের সম্পদ সৃষ্টি করেনা। যাঁরা সত্যিকারের স্রষ্টা, যাঁদের দুই হাত সুযোগ পেলে সম্পদে ও আনন্দে ভাসিয়ে দিতে পারতো সমাজকে, তাঁরা ক্রমবর্ধমানহারে দেশের বেকার-বাহিনীতে পরিণত হচ্ছেন!
সরকার যখন বদল হয়, মন্ত্রীরা যখন পাল্টায়, শোষক রাষ্ট্রযন্ত্রের সবকিছু তখন একই থাকে। আমলাতন্ত্র, সশস্ত্র বাহিনী, আইন-আদালত— কিছুরই বদল ঘটে না।
রাজ্যের তথা কেন্দ্রের দু’চারটে উদাহরণ দেওয়া যেতেই পারে।
কংগ্রেস এবং বিজেপি— দুই ‘পরস্পরবিরোধী’ শাসকের আমলেই দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির অন্যতম পরিচালক ছিলেন একই ব্যক্তি, মন্টেক সিং আহ্লুয়ালিয়া। সিদ্ধার্থ রায় এবং জ্যোতি বসু, দুই মুখ্যমন্ত্রীর আমলেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব ছিলেন রথীন সেনগুপ্ত। ‘বামফ্রন্ট’ শাসনে যে স্বরাষ্ট্রসচিবের দেখভালে একঝাঁক কংগ্রেস কর্মী পুলিশের গুলিতে মারা যান, সেই মনিশ গুপ্তই তৃণমূল কংগ্রেসের ক্যাবিনেট মন্ত্রী। ‘যুক্তফ্রন্ট’ আমলে দু’দিন আগেই যে দু’জন পূর্ণমন্ত্রীকে, বিশ্বনাথ মুখার্জী (সিপিআই) এবং অমরপ্রসাদ চক্রবর্তী (ফরোয়ার্ড ব্লক), দেখলেই পুলিশ সেলাম ঠুকতো, মন্ত্রিসভা পতনের পরে সেই পুলিশই তাঁদের মাটিতে ফেলে পেটালো ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে।
কোনও সরকারের মন্ত্রীরা ভোটে জিতে, কেন্দ্রে বা রাজ্যে, নিজেদের রাজাগজা ভাবতেই পারেন। কোনও দলের নেতা-কর্মীরাও নির্বাচনে জিতে মহা-উল্লাসে ফেটে পরতেই পারেন। কিন্তূ, মন্ত্রীরা আসলে আমলাতন্ত্র-সশস্ত্র বাহিনী-আদালত ইত্যাদির উপর বসে থাকা ‘নৈবেদ্যর নাড়ু’ ছাড়া আর কিছুই না। তারা থাকলেন কিম্বা গেলেন, তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কিচ্ছু যায় আসে না। মাসের পর মাস যখন কোনও কোনও রাজ্যে ‘রাষ্ট্রপতি শাসন’ জারি থাকে, তখন কোনও মন্ত্রী ছাড়াই রাজ্য চলে। জনজীবনে সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ যে শ্রেণী-শোষণ এবং শ্রেণী-আধিপত্য, সে ব্যাপারে ভোটে জেতা মন্ত্রীদের কুটোটি নাড়ানোর ক্ষমতা কোনওদিনই থাকে না। তবে, জনগণের প্রতিবাদী দাবি-আন্দোলন-সংগ্রামকে গুলি-লাঠি-জেলের সাহায্যে দমন করার ক্ষমতা ভালোরকমেই থাকে। সরকারি অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদরত শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক, নার্স, ডাক্তার, কর্মচারী, কর্মপ্রার্থী, মহিলা কর্মী - ইত্যাদি সকলের উপরেই নির্মম পুলিশী হামলা যেমন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে অতিপরিচিত ঘটনা হয়ে উঠেছে।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের কিম্বা রাঘব-বোয়াল বেনিয়াদের অথবা বৃহৎ ভূস্বামীদের মৌলিক স্বার্থে কোনও সংসদবাদী সরকারই আঘাত করেনা। তাই তারা বছরের পর বছর শাসন ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে পারে। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের টিঁকে থাকতে দেয়। শোষকশ্রেণী কখনও কখনও তাদের আপদ মনে করলেও, কখনোই বিপদ বলে মনেই করেনা। বরং, নানা রং-বেরঙের সরকার ক্ষমতায় থাকলে “ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র”-র আসল জনবিরোধী চরিত্র বেশ খানিকটা আড়াল করা যায়।
শ্রমিকশ্রেণী অকস্মাৎ ‘যদি’ কোনও জাদুমন্ত্র বলে শতশত কোটি টাকা খরচ করে ‘গণতান্ত্রিক’ পথে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেই ফেলে, তা হলে কী হবে? আপাদমস্তক মারণাস্ত্রে সজ্জিত শোষকশ্রেণী তখন তাদের অস্ত্রশস্ত্র শ্রমিকশ্রেণীর পায়ে সমর্পণ করে সুবোধ বালকের মতো শাসনক্ষমতা থেকে সরে যাবে? একমাত্র রূপকথাতেই তা সম্ভব। শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে, অস্ত্রের জোরেই বুর্জোয়া শ্রেণী দুনিয়াকে শোষণ, অত্যাচার, ধ্বংস, হত্যা, রক্তের বন্যায় ভয়ঙ্কর করে তোলে। রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যেই তারা বারবার সশস্ত্র হামলাবাজি, হত্যা, যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের পথে হাঁটে। তারাই সবরকম ‘অন্যায় যুদ্ধ’-র হোতা। এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে একমাত্র ‘ন্যায় যুদ্ধ’-র মাধ্যমে পরাজিত করেই শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে শাসন ক্ষমতা দখল করা, ‘দেশ’কে এবং দুনিয়াকে সুস্থ ও সুন্দর করে তোলা সম্ভব।
‘শান্তি’ ‘অহিংসা’ ‘নির্বাচন’ ‘গণতন্ত্র’ ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর শব্দের সুগন্ধি জাল বিস্তার করে শ্রমজীবী মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং বিপথে চালিত করা যায়। নির্বাচনের পথে বারবার শাসক পাল্টানোও যায়। কিন্তু শোষণহীন, সুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা কখনোই সম্ভব না। সমাজে সত্যিকারের সুস্থতা ও শান্তি আসতে পারে একমাত্র শ্রমজীবী মানুষের সরাসরি নেতৃত্বে। তাঁদের সংগঠিত শক্তির বিরামহীন শ্রেণীসংগ্রামের জোরে; বুর্জোয়া শ্রেণীকে পরাজিত এবং মেহনতী মানুষের শাসন কায়েম করেই। শ্রেণী সমঝোতার পথে কখনোই সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব না।
সমাজে শান্তি, ন্যায় ও সুস্থতা বজায় থাকবে কিনা, তা কোনও ব্যক্তি বা দল কিম্বা ‘‘গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত’’ সরকারের ‘ইচ্ছা’র উপর নির্ভর করেনা। আজ পর্যন্ত বহু সৎ, আত্মত্যাগী, দেশপ্রেমিক মানুষ সংসদে ও বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তাতে কিছুই এগোয় নি। জনগণের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক সুস্থতা ঠিকমতো আছে কিনা, সেটাই মূল বিষয়। শেষ বিচারে দেখা যাবে, মানুষের দারিদ্র্যই আসলে গোড়ার সমস্যা। শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব সংগঠিত ও সচেতন প্রয়াস ছাড়া যা কোনওদিনই দূর হবেনা। বুর্জোয়া শ্রেণী এবং তাদের তল্পিবাহক শক্তিকে সমাজের ঘাড় থেকে নামানোই আসল কাজ।
মানবসভ্যতার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রমজীবী মানুষ যতো তাড়াতাড়ি বুর্জোয়া শ্রেণীর হাত থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নিতে পারবে, ততোই তাড়াতাড়ি শান্তি, ন্যায় ও সুস্থতা আসবে সমাজে। গতরে খাটা মানুষের শ্রমের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা সমাজের উপর তলার পরগাছাদের মোড়লি বন্ধ করাই আসল পথ।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা খুবই জরুরি। অমানুষতা ও বীভৎসতা কিন্তু শুধুই শ্রেণীঘৃণা কিম্বা রাজনৈতিক ঘৃণা থেকে আসে না। জাতিগত (nationality) ঘৃণা, জাতগত (caste) ঘৃণা, ধর্মীয় (religious) ঘৃণা, ভাষাগত (language) ঘৃণা ইত্যাদিও অনেকসময় বর্বরতার উৎস হিসাবে কাজ করে। স্বার্থান্বেষী মহল থেকে সমাজে এইসব অবাঞ্ছিত ঘৃণা বাড়িয়ে তোলার পরিকল্পিত প্রয়াস চলে।
লক্ষ লক্ষ ইহুদি নিধনের জন্য কুখ্যাত আউশভিৎস ক্যাম্পকে বিপুল সংখ্যক মগজ-ধোলাই হওয়া জার্মান জনতা সমর্থন করেছিল। সিরিয়ায় ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ বিরোধী তাদমোর কারাগারে বর্বরতম হত্যা ও নারকীয় অত্যাচারের ঘটনাবলীও সেখানকার ধর্মীয় উন্মাদনায় ভেসে চলা মানুষদের সমর্থন পেয়েছিল। আসামে শাসকদের পরিকল্পিত বাংলাভাষা-বিরোধী গণ-উন্মাদনায় বাঙালিদের শহীদ হওয়ার ঘটনাও ইতিহাস। ভারতবর্ষের দিল্লীতে শিখ-গণহত্যার (১৯৮৪) এবং গুজরাটে মুসলমান-গণহত্যার (২০০২) বর্বরতাও জনগণের একাংশের সমর্থন পেয়েছিল। এইসব প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাসকশ্রেণীর অমানবিক/ প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা লক্ষণীয়। তাদের রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও আশ্রয়েই মানবিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পেরেছে। সমাজে ব্যাপক ও গভীর মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কী রূপ নেবে, তা আগে থেকে কল্পনাও করা যায় না। জনগণের মধ্যে তার বিষক্রিয়াও অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়।
সব সরকারের প্রতিটি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। সেটা জনগণের নিত্যদিনের অধিকার ও ইজ্জতের ন্যায়সঙ্গত লড়াই। কিন্ত সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়কে ঠেকানোর জন্য অবিরাম মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণও একান্তই জরুরি। ভারতবর্ষের সমাজ-দার্শনিকগণ (মহাবীর, বুদ্ধ, নামদেব, কবীর, রবিদাস, নানক, চৈতন্য, দাদু, তুকারাম, ইত্যাদি) শত-সহস্র বছর ধ’রে গভীরতম মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। ১) সমাজে পুরুষ ও নারীর মর্যাদা সমান; ২) অনৈতিক যৌনাচার এবং মিথ্যাচার, যুদ্ধাস্ত্র ও নেশার দ্রব্য নিয়ে ব্যবসা অন্যায়; ৩) নিজের সাথে অপরের পার্থক্য করা উচিত না; ৪) হিন্দুত্ব ও ইসলামের মধ্যে সমন্বয় দরকার; ৫) অস্পৃশ্যতা অপরাধ; ৬) রাজা ও প্রজার মধ্যে কোনও তফাৎ নেই; ৭) ‘জাত’ দিয়ে না, ‘কর্ম’ দিয়ে মানুষকে চিনতে হবে; ৮) শোষণ ও জালিয়াতি অপরাধ; ৯) ‘অহং’ অত্যন্ত বিপজ্জনক; ১০) ধর্মীয় বা কোনও রকম সঙ্কীর্ণতার উপর ‘ঈশ্বরের উপাসনা’ নির্ভর করে না; ১১) হিন্দু ধর্মের জাত-ভেদ (caste-hierarchy) প্রথাকে অগ্রাহ্য করতে হবে; ইত্যাদি। এইসব স্বর্ণোজ্জ্বল ও ‘আধুনিক’ (!) মূল্যবোধ ভারতবর্ষীয় সমাজে শত-সহস্র বছর যাবৎ প্রচারিত হয়েছে সমাজ-দার্শনিকদের দ্বারা। যেসব মানবিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে আধুনিক বাংলা তথা ভারতবর্ষ তথা সারা দুনিয়াই আজ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তার বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ সামাজিক সংগ্রাম এখানকার গর্বোজ্জ্বল উত্তরাধিকার। আক্ষেপের বিষয়, বাংলায় তথা ভারতবর্ষে কোনও সংগঠিত শক্তি কোনওদিনই এইসব মনীষীদের মানবিক ও সামাজিক শিক্ষাগুলো প্রচারের আন্তরিক, দীর্ঘমেয়াদি ও অবিরাম কর্তব্যের গুরুত্ব কোনওদিনই উপলব্ধি করলো না!
কংগ্রেস, বিজেপি, ‘বামফ্রন্ট’, তৃণমূল কংগ্রেস, কিম্বা যে কোনও সরকারের আমলেই শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার জনগণের ক্রোধ থেকে রেহাই পেতে পারেনি। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র তথা সমাজ-বদলের পরিবর্তে শুধু সরকার ও মন্ত্রী বদলের সাময়িক উল্লাসই এখানে শেষ কথা হয়ে রইলো!
সরকার-পরিবর্তন না, সমাজ-পরিবর্তনই আসল কথা। সেই লক্ষ্যেই সচেতনভাবে এগোতে হবে। অর্থনৈতিক আন্দোলন কখনোই আপনা থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হতে পারে না। তেমনি, লাগাতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে গেলেও তা কখনোই আপনাআপনি সামাজিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়ে যাবে না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির সাথে সাথে অবিরাম ও গভীর মানবিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচিও অত্যন্ত জরুরি। এই মূল কথাটা সবসময়েই মনে রাখা প্রয়োজন। ৭৫ বছর যাবৎ মন্ত্রীদের ‘আশ্বাস’, সরকারের ‘প্রতিশ্রুতি’, সংবিধানের ‘অভয়বাণী’, এবং পাশাপাশি দুর্বিষহ বাস্তব অভিজ্ঞতা— সবকিছুই যেন আমাদের হিসেবের মধ্যে থাকে। না হলেই বারবার হতাশা জনগণকে গ্রাস করবে। বিভ্রান্তির অনন্ত গোলকধাঁধায় জনগণ ঘুরপাক খেতেই থাকবেন। সুস্থ সমাজ অধরাই থেকে যাবে।