বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
দেশের লোককে আর কত বোকা বানানো যায় বলুন তো?
এমনিতেই রাজনৈতিক দলেরা, কোথা থেকে টাকা পান দেশের লোক তা জানে না। ২০১৩ সালে দেশের জাতীয় তথ্য কমিশন রায় দিয়েছিল যে ছয়টি দল জাতীয় দল বলে স্বীকৃত, তারা তথ্য জানার অধিকার আইনের আওতায় পড়ে। সেই রায়ের পরেও আজ পর্যন্ত আপনারা কেউ তা মানেন নি। সুপ্রিম কোর্টে এই নিয়ে একটি মামলা ঝুলে রয়েছে। কিন্তু জাতীয় তথ্য কমিশনের রায়ের উপর তো কোনও স্থগিতাদেশ নেই। তবু আজ পর্যন্ত আপনাদের কোনও দলই ওই আইনে কোনও তথ্য দেয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো বলে এসেছে যে তারা নাকি পাবলিক প্রতিষ্ঠান নয়! তাহলে, পিএম কেয়ার ফান্ড যদি বলে থাকে তারা পাবলিক প্রতিষ্ঠান নয়, তারা নাকি একটা প্রাইভেট ট্রাস্ট, তাদের দোষটা কি?
দুই, দেশের আপামর রাজনৈতিক দলগুলি ভারতের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যাদের অডিট রিপোর্ট ২০১৫ সাল পর্যন্ত জনসমক্ষে ছিল না। আপানাদের আয়-ব্যয় দেশের লোক জানতই না। নির্বাচন কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত এই বিষয়ে হয়ে একটি গাইডলাইন জারি করে। তার ১০ বছর আগে ১৯৯৫ সালে কমন কজ ও এ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফরমস এর করা রিট পিটিশনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের আয় ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে হবে। কোনও দলই তা মানে নি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন এবং অন্যদের সুপ্রিম কোর্টে করা নানা পিটিশনের ফলে রাজনৈতিক দলগুলি ২০১৫ সাল থেকে তাদের অডিট রিপোর্ট নির্বাচন কমিশনকে জমা দিতে শুরু করে।
দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে অডিট রিপোর্ট কোনও স্বাধীন অডিট সংস্থাকে দিয়ে তৈরি করতে হয়, শুধু রাজনৈতিক দলের বেলায় সে রকম কোনও নিয়ম নেই। এমনকি কোনও অডিট স্ট্যান্ডার্ডও তৈরি হয় নি। রাজনৈতিক দলগুলি যে এত রাজ্যে আর দেশে এত বছর রাজত্ব করলেন, কই রাজনৈতিক দলের অডিট রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে এমন কোনও আইনও তো করলেন না। তাই তিনটি ঘটনা ক্রমাগত ঘটে চলেছে। এক, অডিট রিপোর্ট কোনও দলের ওয়েবসাইটে নেই। দুই, এমন অনেক দল আছে যাদের অডিট রিপোর্ট স্বাধীন অডিট সংস্থা তৈরি করে না, তৈরি করে দলেরই কর্মীরা। তিন, রাজনৈতিক দলগুলি যখন খুশি সেই অডিট রিপোর্ট ইলেকশন কমিশনে জমা দেয়। দেরির জন্য কোনও খেসারত নেই।
তিন, আপনারা কাকে প্রার্থী করছেন, সে ব্যাপারে কোনও দায়বদ্ধতা নেই। আজকে যে বিধানসভা লোকসভা নির্বাচনে প্রতিটি প্রার্থীকে তার সম্পদ ও ফৌজদারি মামলার রেকর্ড জানাতে হয়, তাও এ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফরমস-এর করা রিট পিটিশনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলশ্রুতি। তাই আমরা আজ দেখি যে বর্তমান লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে ৪০ ভাগ এমপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে, এবং ২৫ ভাগের ক্ষেত্রে খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি সিরিয়াস মামলা রয়েছে। দেশের প্রায় ৫০ ভাগ বিধায়কের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এই তথ্য দেবার ব্যাপারেও প্রতিটি রাজনৈতিক দল ধারাবাহিকভাবে বিরোধিতা করে গেছে। সুপ্রিম কোর্টকে এই ব্যাপারে চারবার রায় দিতে হয়েছে – ১০ই মার্চ ২০১৪, ১১ই নভেম্বর ২০১৭, ২৫শে সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২০। শেষ রায়টা ছিল রাজনৈতিক দলকে তাদের ওয়েবসাইটে বা সোশাল মিডিয়ায় জানাতে হবে কেন তারা একজন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তকে টিকিট দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে সব ক্ষেত্রেই দলগুলি জানাচ্ছে যে সেই প্রার্থীরা নাকি ভীষণ জনপ্রিয়, জনদরদী মানুষ, তাই।
চার, দেশের গণতন্ত্রের মূল কাণ্ডারি নাকি আপনারা, মানে রাজনৈতিক দলগুলি, কিন্তু আপনাদের কোনও দলের মধ্যেই গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যায় না। দলের অভ্যন্তরে নিয়মিত নির্বাচন হয় না, লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থী চয়ন গণতান্ত্রিক উপায়ে হয় না, এমনকি দলের সদস্য হবার বিশেষ কোনও নিয়ম নেই, একজন মানুষ চাইলে একাধিক দলের সদস্য হতে পারে। টাকা দিলেই সদস্য হওয়া যায়। বেশির ভাগ দলের স্থানীয় ইউনিটগুলিতে সদস্য রেজিস্টারই খুঁজে পাওয়া যাবে না। দলে হয় হাইকমান্ড তন্ত্র, নয়ত পলিটব্যুরো তন্ত্র চলতে থাকে, এখন তো ব্যক্তিতন্ত্রই সবচেয়ে শক্তিশালী। দেশের গণতন্ত্র যে রক্ষা করবে তার অন্দর মহলেই গণতন্ত্র নেই।
পাঁচ, রাজনৈতিক দলের টাকা পয়সার প্রশ্নটা চিরকালই ঘোলাটে। একথা সবারি জানা যে আপনারা দু’ ভাবে টাকা পেয়ে থাকেন - ক্যাশ আর ২০,০০০ টাকার উপর হলে চেক বা ড্রাফট। এই দানের শতকরা ১০০ ভাগ আয়করমুক্ত! ব্যক্তি চেক দিলে সে আয়করে ছাড় পায়, কোম্পানি চেক দিলে তা কোম্পানির লাভ ক্ষতির খাতায় দেখাতে হয়, ডিরেক্টর বোর্ডে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, শেয়ার হোল্ডারদের জানাতে হয়। ক্যাশ দিলে সে সবের বালাই নেই। ইলেক্টরাল বন্ড আসার আগে কোম্পানি তার লাভের মাত্র ৭.৫% রাজনৈতিক দলকে দিতে পারত, বিদেশি কোম্পানিরা পারত না, যে কোম্পানি লাভ করছে না, তারা পারত না। ইলেক্টরাল বন্ড আসায় সে সব উঠে গিয়েছিল। তখন লোকসভায় আপনাদের অনেক দলই প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু কয়েকটা বামপন্থী দল বাদে, বাকি সবাই সুড়সুড় করে বন্ডের টাকা নিয়ে গেছেন।
এছাড়া ইউপিএ-২ আমলে আরও একটা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, যার নাম ইল্কেটোরাল ট্রাস্ট যোজনা ২০১৩। তখন কিন্তু এর বিরোধিতা কোনও রাজনৈতিক দল করে নি। এক বা একাধিক কোম্পানি একসঙ্গে এসে একটা ট্রাস্ট বানায়, যেখানে অন্য কোম্পানি বা ব্যক্তিরা টাকা জমা দিতে পারে। সেই ট্রাস্ট তারপর রাজনৈতিক দলকে টাকা দিতে পারে। বর্তমানে ১৮টি এই রকম ইলেক্টরাল ট্রাস্ট আছে, সবচেয়ে বড় হল প্রুডেন্ট ইলেক্ট্রোরাল ট্রাস্ট। তখন বলা হয়েছিল এতে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির রাজনৈতিক দান স্বচ্ছ হবে। অথচ একটা ট্রাস্টেরও ওয়েবসাইট নেই। তারা কিভাবে কাকে টাকা দিচ্ছে তাও স্পষ্ট নয়। শুধু রয়টার্সের একটা রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, প্রূডেন্ট ট্রাস্ট তাদের ২৭০০ কোটি টাকা দানের ৭৫ ভাগ শুধু বিজেপিকেই দিয়েছে।
আর ইলেক্টরাল বন্ড তো বোকা বানানোর চমৎকার কাহিনী। বিজেপি যে বোকা বানানোর খেলায় সবাইকে টেক্কা দিয়েছে তা তো দেখাই যাচ্ছে। গত কয়েকদিনে যা জানা গেল, তাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি যে দেশকে বোকা বানানোর খেলায় বিশ্বগুরু হয়েই গেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কত বিস্ময়কর সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে – পাঁচ বছর ধরে লাভের মুখ দেখেনি এমন কোম্পানি কয়েকশ কোটি টাকার বন্ড কিনে দিচ্ছে, কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হওয়ার বছরেই বা দু’ তিন বছরের মধ্যেই সেই কোম্পানি কয়েকশ কোটি টাকার বন্ড দান করছে, কোম্পানির লাভের কয়েকশ গুণ টাকা বন্ড বাবদ দান করা হচ্ছে, ইডি, সিবিআই হানার পরপরই বন্ড কেনা হচ্ছে, বন্ড কেনার পর বড় সরকারি কন্ট্রাক্ট হাতে আসছে, ওষুধ সরকারি পরীক্ষায় ফেল হবার পর বন্ড কিনে দান করা হচ্ছে, বন্ড কেনার পর ওষুধের ছাড়পত্র হাতে আসছে, আরও কত কি। রাজনৈতিক দলের প্রতি ভারতীয় কোম্পানিগুলির এত ভালবাসা হতচকিত করে দেবার মতো। তবে এই ভালবাসাটা শুধু কেন্দ্রে বা রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলির জন্য। এমন কোনও দল টাকা পায় নি যারা কেন্দ্র এবং কোনও না কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। এই কাহিনীতে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম কয়েকটি বামপন্থী দল, বিশেষত সিপিএম যারা এই স্কিমের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছিল।
দেশকে বোকা বানানোর সর্বশেষ চেষ্টা হয়েছে যাতে কে কাকে কত টাকা দিয়েছে তা জনসমক্ষে না বেরোয়। প্রথমে স্টেট ব্যাঙ্ক, তার পর বার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান, তার পর আবার স্টেট ব্যাঙ্ক, সঙ্গে আসোচাম ও ফিকির মত বাণিজ্য সংস্থা। পাশাপাশি গোদি মিডিয়া তার কাজ করেই যাচ্ছে। অবাক হবার কিছু নেই। এই পর্যায়ে এসে বোকা বানানোর খেলায় শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সঙ্গে সরকার, মিডিয়া, বাণিজ্যিক সংস্থা – সব একাকার হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দল বলছে তারা জানেই না কে বন্ড দিয়েছে, এমন কথাও শোনা গেছে বন্ড নাকি ডাক বাক্সে রেখে গেছে, আর কেউ বলছে বন্ড কে কিনেছে আর কাকে দিয়েছে একথা জনতার জানাই উচিত নয়। শেষ পর্যন্ত এডিআর, কমন কজ জাতীয় নাগরিক সংস্থাগুলি, কিছু নির্ভীক সাংবাদিক ও মিডিয়া সংস্থা ও আদালতের চাপে সব খবর বেরচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলি এখনো কাদা ছোড়াছুড়ি ছাড়া বিশেষ কিছু করছে না।
আসুন স্বীকার করি যে রাজনৈতিক দলগুলি নানাভাবে আমাদের বোকা বানিয়ে চলেছে। আসুন এও স্বীকার করি যে গত ৩০ বছরে দেশে প্রান্তিক মানুষ, শ্রমিক কৃষক আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্র যা কিছু করেছে – ১০০ দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষা আইন, বন অধিকার আইন, স্ট্রিট ভেন্ডর আইন, তথ্য জানার আইন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, নির্ভয় আইন, সামাজিক অডিট, পরিবেশ সঙ্ক্রান্ত নানা আইন, সাম্প্রতিক রাজস্থানে গিগ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা আইন, তার কোনওটাই কোনও রাজনৈতিক দলের কোল থেকে উঠে আসেনি, উঠে এসেছে জনসমাজের কোল থেকে, দেশের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার কাজটাও সেই জনসমাজের প্রতিষ্ঠান থেকেই হয়েছে, যার মধ্যে এডিআর, পিইউসিএল, কমন কজ, রিপোর্টারস কলেক্টিভ, আর নিউজ মিনিট, নিউজ লন্ড্রি, নিউজ ক্লিক ইত্যাদির মত ছোট প্রতিষ্ঠানগুলি অন্যতম।
কাজেই সময় এসেছে আমাদের চোখ খোলার, এবং নতুন রাজনীতি তৈরি করবার, দলের রাজনীতি নয়, নাগরিকের রাজনীতি।