বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
দৃশ্য-এক: হরিয়ানার রোহতক লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এক গ্রামে এপ্রিলের ২০ তারিখে, বিজেপি প্রার্থী অরভিন্দ শর্মা এসেছেন সভা করতে। এক মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললেন, আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই। প্রার্থীর কাছে জানতে চাইলেন “আপনি তো গত পাঁচ বছর ধরে সাংসদ, এই গ্রামে কবার এসেছেন?” এই এক প্রশ্নেই শুরু হয়ে গেল উত্তেজনা। মহিলার কথার সুর ধরে আরও কেউ কেউ একই প্রশ্ন করতে লাগলেন, পাঁচ-দশ মিনিট বাদে প্রার্থী উঠে চলে গেলেন। সেই মহিলার নাম মনিকা নেইন, তিনি ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের রোহতক জেলার মহিলা বিভাগের অধ্যক্ষ।
দৃশ্য-দুই: ২৫ মে, অমৃতসরের বিজেপি প্রার্থী চরঞ্জিত সিং সন্ধুর বাড়ীর সামনে কিসান আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটা প্যান্ডেল লাগানো হয়েছে, সেখানে সারা দিন ধরে কিসান আন্দোলনের কর্মীরা লাউডস্পীকার লাগিয়ে প্রার্থীকে কিছু প্রশ্ন করেছেন। ২৮শে মে পাঞ্জাবে বিজেপি-র প্রতিটি প্রার্থীর বাড়ির সামনে প্যান্ডেল খাটিয়ে এই একই প্রোগ্রাম করা হয়েছে।
এই দৃশ্য দুটি বিরল নয়। হরিয়ানার সোনিপথ, হিসার, সিরসা, পাঞ্জাবের মালোয়া ও মাঝা অঞ্চলে ফরিদকোট, লুধিয়ানা, পাতিয়ালা ইত্যাদি জায়গায় পাঁচজন বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধেও কিসান নেতা কর্মীরা এক কাট্টা হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন তাঁদের ঘিরে ধরে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই বিজেপি প্রার্থীরা তাঁদের মিটিং করতে পারেন নি।
শুধু বিজেপি নয়, হরিয়ানার তাদের সহযোগী দল জেজেপি-র নেতা দুস্মন্ত চৌতালাও কিসান আন্দোলনের রোষ থেকে বাদ যান নি। এপ্রিলের গোড়ায় তিনি হিসার জেলার নারা, গামরা, খানপুর, সিন্ধাহার গ্রামে মিটিং করতে ঢুকতেই পারেন নি। ওই দলেরই প্রেসিডেন্ট আজয় চৌতালাকেও নানা জায়গায় একই প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিপদ বুঝে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া নেতা বিজয়েন্দ্র সিংহকে কংগ্রেস টিকিট দেওয়া নিয়ে আন্দোলনকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদেরই চাপে কংগ্রেস বিজয়েন্দ্র সিং-কে টিকিট দিতে পারে নি। মহারাষ্ট্রেও কিসান আন্দোলনের রেশ জারি থেকেছে, দিন্ডোরি, নাসিক, মাধা, শোলাপুর অঞ্চলে। রাজস্থানেও প্রায় নয়টি লোক সভা কেন্দ্রের নির্বাচনে কিসান আন্দোলনকারীরা তাদের নানা কর্মসূচি জারি রেখেছেন।
নির্বাচন শুধুই হারা জেতার খেলা নয়, নির্বাচন এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কাজ হল প্রার্থীদের প্রশ্ন করা, তাঁরা কি করেছেন, কি করতে চান, দেশের কিছু মৌলিক প্রশ্নে প্রার্থীদের কি বক্তব্য ইত্যাদি। নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত এই মৌলিক প্রক্রিয়াটি আমাদের দেশে আবার মনে করালেন কিসান আন্দোলনের নেতা-নেত্রীরা। শাসক দলের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য কারণ, যারা আজ ভোট চাইতে আসছেন তাদেরই দলের নিয়ন্ত্রিত পুলিশ এই আন্দোলনকারীদের দিল্লী যেতে দেয় নি, ড্রোন দিয়ে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে, তাঁদের আতঙ্কবাদী বলেছে, আন্দোলনকারীদের অস্থায়ী ক্যাম্পের জলের লাইন কেটে দিয়েছে, খাবারের গাড়ি আটকে দিয়েছে। ৭০০-র বেশি কিসান গরমে ও ঠাণ্ডায় প্রাণ হারিয়েছেন, পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন এক যুবক শুভকরণ সিং।
আন্দোলনকারীরাও গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় নির্বাচনের সময়, কিসান আন্দোলন বিশেষ কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি এক কথা সবারই জানা। তার কারণ তাঁরা নির্বাচন থেকে সরে ছিলেন। তাঁদের দাবিদাওয়া সবই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, তাই তাঁরা মনে করেছিলেন রাজ্য নির্বাচনে তাঁদের কোন ভূমিকা নেই। এবার তাঁরা আন্দোলনকে নির্বাচনের আঙ্গিনায় নিয়ে এসেছেন। এবছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই প্রতিটি দলের কাছে তাঁদের মূল দাবিগুলি জানিয়েছেন, রাজস্থান হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের গ্রামে গ্রামে এই নিয়ে মিটিং করেছেন। হরিয়ানায় সেই প্রচারের প্রভাবে তিনজন নির্দলীয় বিধায়ক সরকারের প্রতি তাঁদের সমর্থন তুলে নিয়েছেন, লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্বালে হরিয়ানার সরকার তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। অন্যদিকে কংগ্রেস সহ একাধিক পার্টি তাদের ইশতেহারে এমএসপির গ্যারান্টি-র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিজেপির ম্যানিফেস্টো বা মোদির গ্যারান্টি-র মধ্যে কিন্তু তার দেখা মেলেনি। কোনও বিকল্প প্রস্তাবও ছিল না। কাজেই প্রশ্ন তো উঠবেই।

লোকসভার ফলাফল কিসান আন্দোলনকারীদের সাফল্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। হরিয়ানায় সোনিপথ, হিসার, রোহতক, সিরসা, আম্বালা – পাঁচটি, পাঞ্জাবেও লুধিয়ানা, গুরুদাসপুর, অমৃতসরসহ সাতটি লোকসভা সিট জিতেছে কংগ্রেস, বাকি তিনটে সিট জিতেছে আম আদমি পার্টি। পাঞ্জাব থেকে বিজেপি সাফ হয়ে গেছে। রাজস্থানেও কংগ্রেসের জেতা ১১টির মধ্যে নয়টিতে কিসান আন্দোলনের প্রভাব যথেষ্ট। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ৪টি আসন, মহারাষ্ট্রের কমপক্ষে ৭টি আসনে সাফল্যের পিছনে কিসান আন্দোলনের প্রভাব দেখা গেছে। ফলে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রে কিসান আন্দোলনের প্রভাবে মোট ২৫ থেকে ২৭টি আসন বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে। বিজেপির আসন সংখ্যা ৩০৩ থেকে ২৪০তে নেমে আসার পিছনে প্রায় ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে এই আন্দোলন তার প্রভাব ফেলেছে বলা যায়।
তবে অন্য আরেকটা সম্পর্কিত বিষয়ও এই প্রসঙ্গে উঠে আসে। তা হল অগ্নিবীর। ভারতের যে গ্রামীণ অঞ্চল থেকে সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হবার জন্য সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তার মধ্যে অন্যতম হল হরিয়ানা, পূর্ব রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার। এর মধ্যে হরিয়ানা, ও পূর্ব রাজস্থান থেকে সৈন্যবাহিনীতে যায় মূলত কৃষক পরিবারের ছেলেরা। অগ্নিবীর প্রকল্প সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই প্রকল্পে যে সেনা বাহিনীর মত ছিল না, সে কথাও এখন সবাই জেনে গেছে। তাতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। কিসান আন্দোলন যদি মূলত চল্লিশ ঊর্ধ মানুষের আন্দোলন হয় অগ্নিবীর নিয়ে ক্ষোভ ছিল মূলত যুবাদের মধ্যে। সেই ক্ষোভের প্রকাশ পেয়েছে এই নির্বাচনে। পেপার লিক হয়ে চাকরির প্রক্রিয়া বাতিল হওয়া নিয়েও যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল।
এই নির্বাচন আরও তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই নির্বাচন প্রমাণ করল হিন্দুত্বের আকর্ষণ কমছে। হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি ছিল গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং কর্ণাটক। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, ও কর্ণাটকে হিন্দুত্বের আকর্ষণ এই নির্বাচনে সুস্পষ্ট ধাক্কা খেয়েছে। সব থেকে বেশি ধাক্কা খেয়েছে উত্তরপ্রদেশে, যেখানে এক দলিত প্রার্থী, অব্ধেশ প্রসাদ মৌর্য ফৈজাবাদ (অযোধ্যা) আসনে বিজেপিকে ৫৪০০০-এর বেশি ভোটে হারিয়েছেন। মোদি যোগি-র ডবল হিন্দুত্বের ইঞ্জিন সত্ত্বেও বিজেপির আসন অর্ধেক হয়ে গেছে। ধাক্কা খায় নি, গুজরাট, উত্তরাখণ্ড, ও মধ্যপ্রদেশ-এ। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, আসলে ওই তিন রাজ্যে প্রধান বিপক্ষ কংগ্রেসের সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। সুরাট, ইন্দোরের ঘটনা তারই প্রতীক। দুই, মোদির ব্যক্তিগত আকর্ষণ কমছে। তিনি যেখানে যেখানে সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী বক্তৃতা করেছেন, সেখানেই বিজেপির আসন সংখ্যা কমছে, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা তার প্রমাণ। এছাড়া ইউটিউব সহ একাধিক সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে মোদির তুলনায় রাহুল গান্ধির কথা অনেক বেশি মানুষ বেশি শুনেছেন। এবং তিন, দরবারি মিডিয়ার প্রভাব কমছে, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব বাড়ছে। তার প্রমাণ দরবারি মিডিয়ার সঞ্চালকেরা এখন খোলাখুলি সোশাল মিডিয়াকে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন। আগামী নির্বাচনগুলিতে দরবারি মিডিয়ার প্রভাব আরও কমবে। গণতন্ত্র হত্যার প্রধান কাণ্ডারি এই দরবারি মিডিয়া, সময় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার।