বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

সঙ্ঘের আদর্শ ‘ভারত ভাবনা’র পক্ষে বিপজ্জনক

সঙ্ঘের আদর্শ ‘ভারত ভাবনা’র পক্ষে বিপজ্জনক

রতন গায়েন

photo

এবছরের ২ অক্টোবর বিজয়া দশমী থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন শুরু হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই উদযাপনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার মঞ্চে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে জাতীয় ক্ষেত্রে আরএসএস এর অবদানের জয়গানে মুখর হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অবদান জাতীয় ক্ষেত্রে একশ বছরের গৌরবের কর্মপন্থা এবং একটি সোনালী অধ্যায়’। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর্যালোচনার আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট সঙ্ঘের মুখপত্র অর্গানাইজার পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রতিবেদনটিকে স্মরণ করা জরুরি। সেদিন তেরঙ্গা পতাকার তীব্র অবমাননা করে লেখা হয়েছিল, “যাঁরা ভাগ্যের দৌলতে ক্ষমতা দখল করে তেরঙ্গা পতাকা তুলে দিয়েছেন সেই পতাকাকে হিন্দুরা কখনই সম্মান করবে না বা নিজেদের বলে মান্যতা দেবে না। তিন সংখ্যাটিই অপয়া এবং তা দেশের পক্ষে মানসিক ও অন্য ক্ষতির কারণ হবে”। প্রধানমন্ত্রীর ‘বিস্মরণ’ ঘটলেও দেশবাসীর স্মরণে আছে যে, সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক এম এস গোলওয়ালকর তাঁর অনুচরদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে শক্তিক্ষয় না করে সঙ্ঘকে শক্তিশালী করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সঙ্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান থেকে বিরত থেকেছে। আর এটাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঙ্ঘের ‘গৌরবময়’ ইতিহাস।
অবশ্য এর একটি পরম্পরা তৈরি করে গিয়েছেন সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর কে বি হেডগেওয়ার (“ডক্টর সাহেব”)। তিনি ১৯২৫ সালের বিজয়া দশমীতে আরএসএস সংগঠনটির পত্তন করেন। হিন্দু পুরাণ মতে, এই দিনে রামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন। সঙ্ঘ ও তার অধীনস্থ সংগঠনগুলি — জনসঙ্ঘ (এখন বিজেপি), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) হিন্দু ভোট নিশ্চিত করতে রামের নাম ব্যবহার করে নিরন্তর মুসলিম বিরোধী ঘৃণা উসকে দিয়ে চলে। আরএসএস এর আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা সংগঠন হল — বজরং দল (ভিএইচপি’র যুব শাখা), এবং বনবাসী কল্যাণ সঙ্ঘ, যা আদিবাসীদের সংগঠিত করতে গঠিত। আরএসএস এর আদিবাসী নামে ঘোর আপত্তি আছে, তারা এদের বনবাসী বলেই অভিহিত করে। এছাড়া আছে ছাত্র সংগঠন এবিভিপি এবং শ্রমিক সংগঠন বিএমএস। এই সংগঠনগুলি মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পাশাপাশি ভারতে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অভিযুক্ত।
এই ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার বীজ পুঁতেছিলেন সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং। তিনি প্রচার করেন যে, অহিন্দুরা — মুসলিম, খ্রিস্টানরা — হিন্দু প্রথা, চিন্তা ও সংস্কৃতিকে যেহেতু অস্বীকার করে তাই তারা জাতির অংশ নয়। এদের বাদ দেওয়া হলে জাতীয় ঐক্য আসবে। ডক্টরজীর এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করে যান তাঁরই ভাবশিষ্য দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক এম এস গোলওয়ালকারের মধ্যে। অন্যদের বাদ দিয়ে চলার সবচেয়ে ভাল বিবরণ পাওয়া যাবে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ পুস্তিকায়।
পুস্তিকার এক অংশে বলা হয়েছে, “জার্মান জাতি গর্ব আাজ সবার আলোচানার বিষয়। জাতি ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য জার্মানি সেমেটিক জাতির লোকেদের — ইহুদিদের — বের করে দিয়ে জাতির গর্ব তার সর্বোচ্চ উচ্চতায় প্রকাশ পেয়েছে। দেখিয়েছে যে জাতি ও সংস্কৃতির পার্থক্য যেহেতু শিকড় পর্যন্ত প্রসারিত, তাই মিশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার। আমাদের হিন্দুস্থানের (অর্থাৎ হিন্দুদের ভূমি) পক্ষে এটি একটি ভাল ও লাভজনক শিক্ষা।” আরএসএস এর কাছে বইটি অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠায় বইটি বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু এটি আজ পর্য়ন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি। ১৯৩৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর নাগপুরে আরএসএসের সদস্যদের সভায় হিন্দু মহাসভা নেতা সাভারকার ঘোষণা করেন, “‘আমরা হিন্দুরা যদি শক্তিশালী হয়ে উঠি তাহলে আমাদের মুসলিম বন্ধুদের অবস্থা হবে জার্মানির ইহুদিদের মতো।”
সঙ্ঘের লক্ষ্য হিন্দু রাষ্ট্র গঠন। এই লক্ষ্য পূরণে অপরিহার্য হল জনসমর্থনের ভিত্তির সম্প্রসারণ। কিন্তু সমস্যা হল গরিব ও নিচু জাতের মানুষদের কাছে সঙ্ঘের হিন্দুত্বের ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারণা বিশেষ সমর্থন পায় না। তাদের হিন্দু আধিপত্যবাদী ধারণার মধ্যে জাত ও শ্রেণীগত, ভাষাগত ও স্থানীয় আনুগত্যের বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করা হয়। এইসব সমস্যার মোকাবিলায় সঙ্ঘ তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দু’টি বিষয় সামনে নিয়ে আসে। এক, জাতীয় কংগ্রেস ও অন্যান্য সমাজবাদী দল ও তাদের সরকারের প্রতি
ঘৃণা। দুই, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগিয়ে তোলা। এই দুটি লক্ষ্য পূরণে তারা রাম জন্মভূমি কর্মসূচি হাতে নেয়। পাশাপাশি দেশজুড়ে সঙ্ঘের জঙ্গি কর্মীদের দিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা সংগঠিত করে। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতার সময়কালে খোদ নাগপুরেই হিংসা সংগঠিত করে সঙ্ঘের বিস্তার লাভ ঘটে। এই সুফল অব্যাহত রাখতে হিংসাত্মক কর্মসূচি সংগঠিত করা সঙ্ঘের এক জরুরি কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। রাম জন্মভূমি আন্দোলন থেকে গুজরাটের গণহত্যা সহ অজস্র হিংসার ঘটনা সংগঠিত করে সঙ্ঘ ও তার রাজনৈতিক মুখ বিজেপি সাংগঠনিক ও জনভিত্তির বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। আর এর প্রধান শক্তি হল সঙ্ঘের শাখা সংগঠনের সদস্য সৈনিকবৃন্দ। সঙ্ঘ পরিবার অবশ্য এইসব হিংসার ঘটনায় তাদের যোগাযোগ অস্বীকার করে।
ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার চাষ করে সঙ্ঘ তার শাখাগুলির দ্রুত বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভার প্রকাশিত তথ্যে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে মেদি জমানার শুরুতে আরএসএসএর ৪৪৯৮২টি শাখা ২৯৬২৪টি স্থানে তাদের কর্মসূচি পালন করত। ২০২৫ সালে শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩,১২৯টিতে এবং ৫১,৭১০টি স্থানে কর্মসূচি পালিত হয়। উল্লেখ্য আরএসএস এর প্রথম ৯০ বছরে শাখার সংখ্যা যেখানে ছিল ৪৫০০০, বর্তমান শাসকের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদতে নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে আরও প্রায় ৩৮,০০০টি শাখা। এই শাখাগুলি গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, আদিবাসী এলাকায় নানান কর্মসূচি পালন, ছয়টি ‘পবিত্র দিন’ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। লক্ষ্যণীয়ভাবে সঙ্ঘের উৎসব তালিকায় ভারতের স্বাধীনতা দিবস অনুপস্থিত। নেতাজী, গান্ধীজী, তিলক, ক্ষুদিরাম প্রমুখদের নামমাত্র স্মরণ করা হয়।
সঙ্ঘ ও তার রাজনৈতিক মুখ বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনায় সাফল্যের জন্য প্রয়োজন এমন কিছু নায়ককে তুলে ধরা যাঁদের সর্বসাধারণের মধ্যে রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণযোগ্যতা। তাই তাদের নেতাজী, গান্ধী, আম্বেদকর প্রমুখ নেতাদের উত্তরাধিকার আত্মসাৎ করার চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু সঙ্ঘ ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে ছিল নেতাজীর অবস্থান। আম্বেদকার আরএসএস এর মনুবাদী জাত বিভাজনের পবিত্রতা ও বেদের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সামাজিক ন্যায়, সমতা, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর ধারণাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তার সঙ্গে আরএসএস এর ধারণার আকাশ পাতাল ফারাক। গান্ধী ধর্মবিরোধী ছিলেন না। কিন্তু তিনি সব সম্প্রদায়ের মিলনের পক্ষে এক আপোষহীন যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর “রামরাজ্য” যে নৈতিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত তার সঙ্গে সঙ্ঘ-বিজেপির “রামরাজ্যের” কোনও সাদৃশ্য নেই। কাজেই আত্মসাতের রাজনীতি সঙ্ঘের পক্ষে আত্মঘাতী হবে। অনুরূপভাবে, বিবেকানন্দকে সঙ্ঘ আসমুদ্র হিমাচলে হিন্দুধর্মের প্রচারক হিসাবে মান্যতা দিয়ে থাকে। অথচ তিনি ভারতে মুসলিম বিজয়কে নিচের তলার মানুষের কাছে, দরিদ্রের কাছে মুক্তি হিসাবে অভিহিত করে বলেন যে, এজন্যই দেশের এক-পঞ্চমাংশ মানুষ মুসলমান হয়ে যান। (কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন, খণ্ড ৩, পৃ: ২৯৪)। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমরা মানব জাতিকে এমন একটা লক্ষ্যে নিয়ে যেতে চাই যেখানে বেদ থাকবে না, কোরান থাকবে না। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মিলনই একমাত্র আশা।” আর শ্রীরামকৃষ্ণের যত মত, তত পথের বাণীতেই নিহিত আছে বহুমতে সম্মান রাখার বার্তা। সঙ্ঘ এঁদের বাণীর বিক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি দিয়ে হিন্দু মননে ‘অপরের’ ধারণা পাকা করতে নিরন্তর প্রয়াস জারি রেখেছে।
গুরুজী তাঁর ‘বাঞ্চ অফ থটস’ (সাহিত্য সিন্ধু প্রকাশনা, প্রথম খণ্ড ১৯৬৬) গ্রন্থটিতে দেশের ভাষা, শাসন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে নিদান দিয়েছেন তা আদ্যন্ত বর্তমান শাসকের ব্যবস্থাপত্র। তিনি ভারতীয় ধাঁচে সংবিধানের পুনর্লিখন দাবি করেছেন। সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর তীব্র বিরোধী গুরুজী অনুকূল পরিস্থিতিতে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত না করার সমালোচনা করে লিখেছেন, “এক দেশ, এক আইনসভা ও এক প্রশাসনিক কেন্দ্র গঠন সম্ভব হয়নি”। (পৃ: ২২৫) রাষ্ট্রের যোগাযোগের ভাষা হিসাবে হিন্দিই ততদিন বহাল থাকবে যতদিন না সংস্কৃত ভাষা ঐ পর্যায়ে উন্নীত হয়। সঙ্ঘের সওয়াল হল হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তান।
১৯১৫ সালে হিন্দু মহাসভা ও ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে তারা বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের বিপরীতে হিন্দুত্ববাদের প্রসারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বিরোধী মহাকাব্যিক সংগ্রামের পর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্ম নিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সামিল হওয়ায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তার জোরালো কোনও বিরোধিতার পথে যেতে পারেনি। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকের ভেদাভেদের রাজনৈতিক কৌশলে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী গঠন সহ অনেকগুলি পক্ষপাতমূলক নীতির ফলে মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত থাকে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় থাকায় তাদের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। পরে ব্রিটিশ মদতে ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়।
এই পদক্ষেপে আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবার বিক্ষুব্ধ থাকলেও প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষাতার পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান ও বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি জনমনে বড়সড় ছাপ ফেলতে পারেনি। কিন্তু যতই বাম শক্তি দুর্বল হয়েছে ও কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ হিন্দুমননের দোলাচল বেড়েছে, ততই তার সুযোগে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির জোরালো উত্থান ঘটে। গত শতকের নব্বই দশক থেকে সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক মুখ বিজেপি ক্ষমতা দখল করার পথে এগিয়ে চলে। এই পরিক্রমা পূর্ণতা পায় ২০১৪ সালে। সঙ্ঘের রাজনৈতিক মুখের সাফল্যের পরে আরএসএস এর বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে। এখন এই শক্তি বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক ভারতের ধারণাকে ধ্বংস করে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের সর্বাত্মক চেষ্টা জারি রেখেছে। এই লক্ষ্যে তারা রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে দখল করতে শুধু কেন্দ্রীয় শাসকের আসনে বসেছে তাই নয়, সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে সঙ্ঘ অনুগতদের শীর্ষ পদে নিয়োগ করে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে চলেছে। সঙ্ঘের ছাড়পত্র নিয়েই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি ও পুস্তক চূড়ান্ত করা হয়। এমনকি বিজ্ঞান ও ইতিহাস কংগ্রেসের শীর্ষস্থনীয় পদাধিকারীরা সঙ্ঘের নির্দেশনামা মেনে প্রাচীন ভারতের অতিকথন করে চলেছেন।
লক্ষ্যণীয় যে, সাফল্য পেতে সঙ্ঘ নরম ও গরম দু’রকম কর্মসূচি চালু রেখেছে। এক, আগ্রাসী পন্থা অনুসরণ করে গোরক্ষকদের সাহায্যে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, ঘরওয়াপসি ও লাভ জিহাদের নামে জবরদস্তি, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার চেষ্টা, যুক্তিবাদীদের হত্যা করা ইত্যাদি ভয়াবহ কাজ করে চলেছে। দুই, আরএসএস-এর মোহন ভাগবত সুর নরম করে আরএসএস-কে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে সদর দপ্তরে আমন্ত্রণ, ২০১৭ সালে সঙ্ঘের ইতিহাসে প্রথম মুনওয়ার ইউসুফ নামে বোরা সম্প্রদায়ের মুসলিমকে বিজয়াদশমীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বরণ করা বা ২০০২ সালে আরএসএস প্রধান কে এস সুদর্শনের ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা এবং পিছিয়ে থাকা পসমন্দা মুসলিমদের সঙ্গে সখ্য এই কর্মসূচির অংশ।
বিস্মৃত হলে চলবে না যে ভারতীয় জীবন ও সমাজের মধ্যে অন্তঃস্থ আছে এমন এক কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক প্রবণতা যা সঙ্ঘ-বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রসারে অন্তরায়। প্রথমত, জাতপাত ভিত্তিক হিন্দুসমাজে সার্বিক প্রাধান্যে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদের পাল্টা হিসাবে রয়েছে বর্ণভিত্তিক বিন্যাস যা নিম্নবর্গীয়দের সবসময় সমাজ থেকে বিযুক্ত করে রাখে। এর ফলে সমসত্ত্ববাদী হিন্দুসমাজ গঠন যা সঙ্ঘ-বিজেপির স্বপ্নের ভারত, তা নিজেই এক অনতিক্রম্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘুদের সঙ্গে হিন্দুসমাজের সাংস্কৃতিক সমন্বয়ে অনেক দুর্বলতা থাকা সত্বেও তাদের নির্মূল করার বা তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযানে আরএসএস হিন্দুসমাজের গরিষ্ঠ অংশের সমর্থন পায় না। যে ভারতে আমরা বাস করি তা হিন্দু সমসত্ত্ববাদী বা পরিপূর্ণ সমন্বয়বাদী সমাজ নয়। তবে মূল প্রবণতা সমন্বয়ের। বিভাজনের মতাদর্শটি চাপিয়ে দেওয়া। বর্ণবাদী সমাজের বাইরে থাকা নিম্নবর্গীয় অগণিত মানুষের সামগ্রিক অবদানে ভারত নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। এবং এভাবেই গড়ে উঠেছে ‘ভারতের ধারণা’ ও সংস্কৃতি। এই বহুত্ববাদের বিপরীতে সঙ্ঘ ও বিজেপি গড়ে তুলতে চাইছে এক ধরণের সংযুক্তিকরণ বা সংমিশ্রণ (amalgamation) যার একদিকে আছে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদ আর অন্যদিকে নরম মাত্রার মানিয়ে নেওয়ার কৌশল।
আরএসএস এর শতবর্ষের ইতিহাস জাতীয় জীবনে কোনও প্রেরণা জোগায় না। তাদের কাছে ঐক্যের অর্থ উচ্চ বর্ণের আধিপত্যের কাছে নতিস্বীকার, মুসলিম, খ্রিষ্টান, কমিউনিস্ট শত্রু খোঁজার ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের নিরন্তর প্রয়াস। স্বদেশির আহ্বান শূন্যগর্ভ যখন জাতীয় সম্পদ তুলে দেওয়া হয় ক্রোনি ক্যাপিটালের হাতে। এদের স্বার্থেই পরিচালিত হয় কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। প্রধানমন্ত্রী তাঁর শতাব্দী-ভাষণে আরএসএস এর কাজের মূল্যায়ন না করে ইতিহাসের পুনর্লিখন করেছেন।
মহকাব্যিক স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী শক্তির বিক্রম হিন্দুত্ববাদীদের স্বাধীন ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার অপচেষ্টা ব্যর্থ করেছিল। সেই বিক্রমেই সব বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই সঙ্ঘ-বিজেপির বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ধ্বংস করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে রুখে দেওয়া যাবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.