বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

শ্রমিক আন্দোলনে অসংগঠিত ক্ষেত্রের গুরুত্ব বাড়ছে

শ্রমিক আন্দোলনে অসংগঠিত ক্ষেত্রের গুরুত্ব বাড়ছে

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— বিংশ শতকের শুরুতে যে শিল্প প্রলেতারিয়েতকে বিশ্বমঞ্চে দেখা গিয়েছিল এবং যে প্রলেতারিয়েত ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারা ১৮৪৮ এর পর থেকে পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশের প্রক্রিয়ায় ক্রমশ আত্মপ্রকাশ করে এবং প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক, জার্মান সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির লাগাতার সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রচার আত্মস্থ করে রাজনৈতিক ভাবে পরিণত হয়ে ওঠে।
বিংশ শতকের গোড়ার দিকের সেই সংগঠিত শিল্প প্রলেতারিয়েতের শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সোভিয়েতের বিজয়ের ফলে আরও বেশি প্রসারিত হয়। তার ধাক্কায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে নানা ধরনের সমঝোতা করতে বাধ্য হয় পুঁজিবাদ। সেকারণে গত শতকের ৫০ থেকে ৭০ দশকের শেষ পর্যন্ত আমরা শিল্প প্রলেতারিয়েতকে দেখেছি কিছুটা সুস্থিত অবস্থায়। এবং পুঁজিবাদকে দেখি অনেকটা সমঝোতা করে টিকে থাকার অবস্থায়। পরিস্থিতি ফের বদলে যায় সোভিয়েতের পতনের পর নয়া উদারবাদী অর্থনীতির কাঠামোয়। এর কিছু আগে থ্যাচার ও রেগান পুঁজিবাদের নতুন আগ্রাসন পর্বের সূচনা করেন। পরে ’৯০এর দশকের গোড়ায় পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বড়সড় বদল নিয়ে আসে প্রযুক্তি বিপ্লব। নতুন শতকে নয়া উদারবাদী অভিযান ও প্রযুক্তি বিপ্লব শিল্প শ্রমিকের কাজের ধরন, মজুরি, কাজের ঘণ্টা, বেঁচে থাকার পরিবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের চেহারা, তার শক্তি ও দুর্বলতা— সবকিছুতেই বড়সড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আজকের দিনে শ্রমিক আন্দোলনকে যদি কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে হয়, তবে এই সব পরিবর্তনকে শ্রমিক আন্দোলনের রণনীতি ও রণকৌশলে যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন বা আইএলওর সূত্র অনুযায়ী, যে কোনও লাভজনক কাজ তা স্বনিয়োজিত হোক বা মজুরিশ্রম, যা নথিবদ্ধ নয়, যে কাজের আইনি রক্ষাকবচ নেই, কিংবা আয় করে এমন সংস্থায় কাউকে বিনা মজুরিতে খাটানো হয়, তাকে ইনফরমাল ক্ষেত্র হিসাবে ধরতে হবে। এই ক্ষেত্রে চাকরির চুক্তির নিরাপত্তা নেই, শ্রমিকদের মতো কোনও সুবিধা এঁরা পান না, নেই সামাজিক নিরাপত্তা কিংবা দাবি নিয়ে আলোচনার সুযোগ।
আইএলও জানিয়েছে, এখনকার বিশ্বে মোট যত লোক কর্মসংস্থানে যুক্ত তার ৬১ শতাংশের বেশি কাজ করেন ইনফরমাল ক্ষেত্রে। এঁদের সংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি। এই ইনফরমাল সেক্টরে কর্মরতদের অধিকাংশই রয়েছেন বিকাশশীল এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। এখানেই পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার মতো সাবেকি পুঁজিবাদী দেশগুলির শিল্পশ্রমিকদের সঙ্গে ফারাক হয়ে যাচ্ছে পিছিয়ে পড়া দেশগুলির শ্রমিকদের। আবার উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির সংগঠিত শিল্প শ্রমিক বা প্রলেতারিয়েতের যে চেহারা ১০০ বছর আগে দেখা গেছে, তার সঙ্গে সেই সব দেশের এখনকার শিল্পশ্রমিকদের বৈশিষ্ট্যে অনেক ফারাক আছে।
আইএলও জানাচ্ছে, এই ২০০ কোটি ইনফরমাল ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নেই, কাজের ক্ষেত্রে অধিকারগুলি সংকুচিত এবং কাজের পরিবেশও সুস্থ নয়। ফলে এঁদের যদি সুস্থ কাজের পরিবেশ দিতে হলে দরকার সংগঠিত শিল্পের বিকাশ। আর ঠিক এখানেই সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শিল্পকে সংগঠিত করে তোলার ক্ষেত্রে বাধা দেয় পুঁজিমালিকেরা। কারণ অসংগঠিত মানবসম্পদ শোষণ করেই সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করাটা পুঁজির পক্ষে সুবিধাজনক।
যদি ধরে নেওয়া হয় উপরোক্ত ২০০ কোটি শ্রমিকের মধ্যে ১০০ কোটি কৃষিক্ষেত্রে জড়িত, তাহলে বাকি ১০০ কোটিকে পাওয়া যাবে শিল্প, পরিষেবা, পরিকাঠামো, নির্মাণ, আবাসন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। মহাদেশ ধরে বিচার করলে আফ্রিকার দেশগুলিতে ৮৫.৫ শতাংশ চাকরিই অসংগঠিত বা ইনফরমাল ক্ষেত্রে। এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এই অনুপাত ৬৮.২ শতাংশ, আরব দেশগুলিতে ৬৮.৬ শতাংশ, দুই আমেরিকায় ৪০ শতাংশ এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ২৫.১ শতাংশ। দেখাই যাচ্ছে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া, যার মধ্যে পড়ে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপ, রাশিয়া সহ পূর্বতন ইউএসএসআরএর ভেঙে যাওয়া অংশগুলি, সোভিয়েত বিপ্লবের ধাক্কায় এসব দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শ্রমিকের অধিকার যতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অনেকটাই এখনও টিকে রয়েছে। তাই এই অঞ্চলে ইনফরমাল নিয়োগ কম। অন্যদিকে আফ্রিকায় শ্রমের বাজার অবাধে শোষণ করছে পুঁজি। এমনকি, পুঁজিবাদের স্বর্গ আমেরিকাতেও অসংগঠিত বা ইনফরমাল শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ শতাংশ। এখানেই বদলে গেছে পরিস্থিতি।
আইএলও জানাচ্ছে, বিশ্বে ইনফরমাল ক্ষেত্রের ৯৫ শতাংশ কর্মসংস্থানই রয়েছে বিকাশশীল তথা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। বিশ্বের মোট কর্মরত পুরুষ ও নারীদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৮.১ শতাংশ নারী কাজ করেন ইনফরমাল ক্ষেত্রে। মোট ২০০ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে মহিলারা হলেন ৭৪ কোটি। এঁদেরকে সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হয়।
রিপোর্টে আরও জানা যাচ্ছে, যারা মাধ্যমিক বা সমস্তরের শিক্ষা শেষ করেছেন তাদের তুলনায় যাঁরা পড়াশোনা শেখেননি কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেননি তাঁদের বেশিরভাগই ইনফরমাল সেক্টরে কর্মরত। গ্রামে থাকা লোকজন শহরের লোকের তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যায় এই ধরনের অনিশ্চত কাজগুলিতে যুক্ত থাকেন। এবং কৃষিতে ৯০ শতাংশ নিয়োগই ইনফরমাল।
আইএলও রিপোর্টের দুই লেখক ফ্লোরেন্স বনেট ও ভিকি লিয়ুঙ জানিয়েছেন, সব ইনফরমাল শ্রমিকেরাই গরিব নন। তবে শিল্পের অসংগঠিত চেহারার জন্যই টিকে রয়েছে দারিদ্র। লিয়ুঙের কথায়, গরিবেরাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ইনফরমাল ক্ষেত্রে কাজ করতে বাধ্য হন, এবং ইনফরমাল শ্রমিকদের মধ্যে দারিদ্রের হার সবচেয়ে বেশি। এই কোটি কোটি শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা নেই, কর্মস্থলে কোনও অধিকার নেই, কাজের পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। এই উদ্যোগগুলি পুঁজির অভাবে ভোগে ও উৎপাদনশীলতাও নীচু মানের।
মোট কর্মরতদের মধ্যে ভারতে ৮১ শতাংশ শ্রমিক কর্মরত ইনফরমাল সেক্টরে। ফর্মাল বা সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মাত্র ৬.৫% শ্রমিক এবং গৃহস্থালির কাজে যুক্ত ০.৮ শতাংশ শ্রমিক। ভারত ও নেপালে ৯০.৭ শতাংশ, বাংলাদেশে ৪৮.৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৬০.৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ৭৭.৬ শতাংশ শ্রমিক ইনফরমাল বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত। দেখা গেছে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসগারর এলাকায় ১৫ থেকে ২৪ বছরের শ্রমিকদের ৯৮.৩ শতাংশ কাজ করেন ইনফরমাল ক্ষেত্রে। ২৫ বছরের বেশি বয়স্ক শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই হার ৬৭.৩ শতাংশ। এদেশের গ্রামাঞ্চলে ৮৫.২ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৪৭.৪ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে।
দেখাই যাচ্ছে একবিংশ শতকের শিল্প শ্রমিকের চেহারায় কতটা বদল এসেছে। বিশেষত বিকাশমান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কী বিপুল পরিমাণ শ্রমিক কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর উল্টোদিকে দেখা যাবে, পশ্চিম ইউরোপের সাবেকি পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শ্রমিকদের মজুরি, কাজ ও সামাজিক নিরাপত্তা এখনও অনেকটাই অটুট। যদিও সেখানে ইনফরমাল নিয়োগ বাড়ছে এবং শিল্পশ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার অনেকটাই সঙ্কুচিত রাষ্ট্রায়ত্ত সেক্টর কমে আসার কারণে। আবার স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিতে শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা কমছে ও সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ছে।
চীনের দিকে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে দেশের মোট শ্রমিকের ২৩.৬ শতাংশ কৃষিতে, ২৮.৭ শতাংশ শিল্পে এবং ৪৭.৭ শতাংশ পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মরত ছিলেন। ২০১০ সালে এই অনুপাতগুলি ছিল যথাক্রমে ৩৬.৭ শতাংশ, ২৮.৭ শতাংশ এবং ৩৪.৬ শতাংশ। দেখাই যাচ্ছে, চীনে কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিক সংখ্যা এক দশকে কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। চীনের মতো জনসংখ্যার দেশে এই সংখ্যা বিপুল। পরোক্ষে এর অর্থ হল কৃষির মতো অসংগঠিত বা ইনফরমাল ক্ষেত্র থেকে শ্রমিকদের মুক্ত করে এনে চীন ক্রমশ তাদের পরিষেবা ক্ষেত্রের দিকে নিয়োজিত করেছে। এবং শিল্প শ্রমিকদের শতাংশ প্রায় একই রয়েছে। এক দশকে শ্রমিকদের নিয়োগের চেহারায় এই বদল চীনের পরিকল্পিত অর্থনীতির ফল যা এশিয়ার অন্য কোনও দেশ অর্জন করতে পারেনি। এর মানে এমনটা নয় যে চীনে ইনফরমাল শ্রমিক নেই। যথেষ্টই আছে। কিন্তু শ্রমের বাজারে তাদের অবস্থা ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা,পাকিস্তান বা নেপালের মতো নয়। এখানেই পরিকল্পিত অর্থনীতির সঙ্গে উদারিকরণের ঢালাও অর্থনীতির মৌলিক ফারাক। পরিকল্পিত অর্থনীতি ধাপে ধাপে শ্রমিকদের অধিকার ও সুযোগসুবিধা সম্প্রসারিত করে। উদারিকরণের অর্থনীতি শ্রমিকদের চালু অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে আরও নির্মম শোষণের টার্গেট করে তোলে। উল্টোদিকে সম্পদ বাড়ে আম্বানি বা আদানির।
সব মিলিয়ে এটা এখন স্পষ্ট যে, বিশ্ব পরিসরে, এবং ভারতেও, ইনফরমাল বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। এর মানে শ্রমিক আন্দোলনেও এঁদের গুরুত্ব অনেক বেশি বেড়েছে আগের তুলনায়। তুলনায় সংগঠিত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা কমছে। আবার ইনফরমাল ক্ষেত্রের মধ্যে ধরতে হবে কৃষিতে যুক্ত বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবীদেরও। এই ছবি বেশি করে সত্যি বিকাশশীল ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। সুতরাং, শ্রমের শিবিরের তরফে যদি এসব দেশে পুঁজিকে ধাক্কা দিতে হয় তাহলে অবশ্যই সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকদের শক্তির মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। এবং সেই লক্ষ্যে ট্রেড ইউনিয়নকে নানা উদ্ভাবনী পদক্ষেপও নিতে হবে যা গত শতকের শ্রমিক আন্দোলনের রূপের তুলনায় আলাদা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, শ্রমিক শ্রেণীর সেই পুরনো বিন্যাসটাই এখন অনেকটা বদলে গেছে। এখানেও বাঁধধরা, চিরাচরিত পদ্ধতি আঁকড়ে না থেকে শ্রেণী ঐক্যের নতুন দিগন্তকে প্রসারিত করার প্রয়োজন রয়েছে। আবার পশ্চিম ইউরোপের সাবেকি পুঁজিবাদী দেশ, আমেরিকা, স্ক্যান্ডিনেভিয় দেশগুলির শ্রমজীবীদের কথা যদি ধরা যায়, তাহলে এই সব দেশের অনেকটা এগিয়ে থাকা এবং এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অনেকটা পিছিয়ে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে পুঁজির বিরুদ্ধে বিশ্ব পরিসরে লড়ার জন্য কীভাবে আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে তোলা যাবে, সেই ভাবনাও নতুন করে ভাবার দরকার হয়ে পড়েছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.