ইতিহাসের বাঁকের মুখে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ
ইতিহাসের বাঁকের মুখে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ
বসন্ত মুখোপাধ্যায়
সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে ফ্যাসিবাদের পথে ভারত
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে ভারতবর্ষ একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কটের পর্বের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে উপনিবেশবাদকে বিধ্বস্ত করে ভারত যে স্বাধীনতা লাভ করেছিল, তার চরিত্র একমুখী ছিল না। সেই পর্বে উপনিবেশবাদকে অনেকদূর পর্যন্ত পরাস্ত করে অর্জিত হয়েছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও ঔপনিবেশিক জোয়াল পুরোপুরি উচ্ছেদ করা যায়নি। এর ফলে অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভারতের অগ্রগতির রোডম্যাপ তৈরি হয়েছিল এমনভাবে যা পুরোপুরি ভারতেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।
সাংবিধানিক গণতন্ত্রের অনুশীলন ভারতে শুরু হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমল থেকেই। ক্ষমতা পুরোপুরি হারানোর ভয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সংসদীয় গণতন্ত্রের নানা কাটছাঁট করা সুবিধা এদেশে চালু করতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রিটিশের একচ্ছত্র অধীনে থাকায় সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে আধুনিক ভারত গড়েই উঠছিল ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের আবহে। এর বিপরীতে একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও সামন্ততান্ত্রিক যুদ্ধবাজ প্রভুদের অধীনে থাকায় চীনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সশস্ত্র বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব। এই দুই ভিন্ন পথই মূলত ভারত ও চীনকে ভিন্ন ঐতিহাসিক পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। এই পথের ফারাকের কারণেই চীন আজ এক ধরনের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে তাকে আরও প্রসারিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। অন্যদিকে ভারত তার ৭৫ বছরের বুর্জোয়া নেতৃত্বাধীন সমাজ–গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে গিয়ে কর্পোরেট ও হিন্দুত্ব শক্তি জোটের চরম ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকে এগিয়ে চলেছে। ভারতের এই পরিণতির অন্যতম কারণ নিশ্চয়ই বিশ্ব পরিসরে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবসান।
সংক্ষেপে বললে, সংবিধান রচনা করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে স্বাধীন ভারত যে যাত্রা শুরু করেছিল, তৎকালীন দ্বিমেরুবিশিষ্ট বিশ্বে সেই যাত্রা সম্ভব ছিল। সম্ভব ছিল পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক— দুই শিবিরের মধ্যে ভারসাম্য রেখে এগোনোর সুযোগ। সেই পথে হেঁটেই ভারত হয়েছিল মিশ্র অর্থনীতির দেশ। কিন্তু উপনিবেশ পরবর্তী পর্বের মৌলিক কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ এদেশের বড় জমিদার-বড় বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী নিজেদের শ্রেণী স্বার্থেই এড়িয়ে গিয়েছিল। এই অর্থনৈতিক কর্তব্যগুলির মূল বিষয় ছিল ভূমি সংস্কার করে সামন্তবাদকে উচ্ছেদ করা ও সমাজের ধনতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ সুগম করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিটি তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অনুসারী দলগুলি ছাড়া আর কারো পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। সেকারণে চীন, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্বোডিয়া আমূল ভূমি সংস্কার করে সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্রের দিশায় অর্থনৈতিক রূপান্তরের কাজে হাত দিয়েছিল। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগোনোর সময় এপথ সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোই এসেছে।
স্বাধীন ভারতের শাসকশ্রেণী, তাদের শ্রেণীস্বার্থেই আমূল ভূমিসংস্কারের পথ পরিত্যাগ করে ছোট-বড় সংস্কারের মধ্যে দিয়ে সামন্তবাদের অবশিষ্টের সঙ্গে আপোস করে চলেছিল। বলা যায়, ওপর থেকে একটু একটু করে পুঁজিবাদকে চাপিয়ে দেওয়া এবং সামম্তবাদের অবশিষ্টকে টিকিয়ে রাখা এটাই ছিল ভারতীয় বড় বুর্জোয়া-বড় জমিদারদের বেছে নেওয়া পথ। গত ষাট বছরে এই পথে হেঁটে ভারত পেয়েছিল ইউরোপের ধাঁচে এক ধরনের ছাঁটকাট করা সমাজ গণতন্ত্র, যা সব শ্রেণীর মানুষের টিকে থাকার উপযোগী একটা সহনীয় কাঠামো তৈরি করেছিল। এরই মধ্যে জাতপাত, ধর্মীয় বিভাজন, বিপুল অশিক্ষা, গ্রাম ভারতের প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো— পশ্চাদপদতার এই উপদানগুলি টিকে ছিল। এগুলির মধ্যে দিয়ে শুধু সামন্ততান্ত্রিক নয়, তারও আগের যুগের ভারতের অস্তিত্ব টিকেছিল, যা আটকে রেখেছে তার পুঁজিবাদী রূপান্তরকে।
এই দোলাচলের কাঠামো কতটা আলগা ও ভঙ্গুর তা বোঝা গেল বিশ্বজুড়ে নয়া উদারবাদের আগ্রাসী অভিযান শুরুর পরে। এই পর্বে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ হাতে নিল কর্পোরেট ও ক্রোনি পুঁজি। তারাই কংগ্রেস আমলের সমাজ গণতন্ত্রী অর্থনীতিকে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ছকে নতুন করে গড়ে তোলার কর্মসূচি হাতে নিল। এবং এই পর্বে তারা ভারসাম্যের রাজনীতি করা কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ধরল বিজেপিকে, যারা নয়া উদারবাদী পুঁজির বিপুল লুঠ নিশ্চিত করতে স্বৈরতান্ত্রিক, এমনকি ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করতেও পিছপা নয়। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে কর্পোরেট ও ক্রোনি পুঁজির জোট হয়ে দাঁড়াল হিন্দুত্বের শক্তির সঙ্গে কর্পোরেট পুঁজির জোট। এই জোটের লক্ষ্য বিপুল আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভারতের বাজারকে একটাই কেন্দ্রীভূত বাজারে পরিণত করা। আঞ্চলিকতার ভারতকে শেষ করে দেওয়া। জিএসটি, জাতীয় শিক্ষা নীতি, ভাষানীতি, নাগরিকত্ব আইন, এক দেশ এক রেশন কার্ড, এক দেশ এক ভোট — এসবের পিছনে রয়েছে একট কেন্দ্রীভূত শাসনের অধীনে ভারতকে সমস্বত্ত্ববিশিষ্ট একটাই লুঠের বাজারে পরিণত করা। এরই জন্য আনা হচ্ছে চার কোডের শ্রম বিল যাতে আট ঘণ্টার কাজের দিনের অবসান ঘটিয়ে শ্রমকে অবাধে লুঠ করতে পারে নয়া উদারবাদী দেশি-বিদেশি পুঁজি। এই লক্ষ্যেই ধীরে ধীরে সংবিধানের গণতান্ত্রিক উপাদানগুলিকে ছেঁটে ফেলে দেশটিকে এককেন্দ্রিক শাসনের আওতায় নিয়ে আসার কুটিল প্রয়াস চলছে।
নয়া উদারবাদী যুগে গত দু’ দশক ধরে আমরা এক ধরনের সমাজ-গণতন্ত্রী, ভারসাম্যের ভারতের বদলে সংবিধানের খোলস বজায় রেখে এক স্বৈরাচারী ভারতের উত্থান ধাপে ধাপে দেখতে পাচ্ছি। এই কর্মসূচি সজোরে কার্যকর করছে কর্পোরেট-হিন্দুত্ববাদী জোট। এই জোট এতদিনের চেনা ভারতকেই বদলে দিতে চায়। তার আজন্মলালিত বৈচিত্র ও সহনশীলতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে এক আগ্রাসী, সাম্প্রদায়িক, নয়া উদারবাদী ভারত গড়ে তুলতে চায় এবং এই লক্ষ্যপূর্ণে ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদের পথেও এগিয়ে চলেছে এই জোট।
পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণপন্থা
কংগ্রেস স্বাধীনতার পর যে ভারসাম্যের ভারত গড়ার পথ ধরে এগোচ্ছিল, সেখানে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ছবি দেখেছিল পশ্চিমবঙ্গ। এখানে বিভিন্ন বাম শক্তি আমূল ভূমি সংস্কারের দাবিতে স্বাধীনতার আগে থেকেই কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। স্বাধীনতার পর বামেরা শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের জোট গড়ে একটি ন্যায্য বন্টন ভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে এগোয়। পরে এই আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়। একপক্ষ সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের পথে এগোনোর চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে বামফ্রন্টের শক্তিগুলি যৌথ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে রাজ্যে বিকল্প সরকার গড়ার পথে এগোয়। সেই প্রক্রিয়া পূর্ণতার পথে পৌঁছয় ১৯৭৭ সালে এবং তার পরবর্তী তিন দশক সমগ্র দেশের তুলনায় এক ভিন্নতর পথে এগোয় পশ্চিমবঙ্গ। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতি প্রয়োগ করে এবং জনমুখী অর্থনৈতিক নীতি চলতি বুর্জোয়া কাঠামোর মধ্যেই এক ধরনের ইগালিটেরিয়ান সমাজ গড়ে তোলে, যেখান আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার শিকড় অনেকটা চারিয়ে গিয়েছিল সমাজের নীচুতলায়।
তবে এই দিশায় বিকাশেরও একটা সীমা আছে। কৃষি সংস্কার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একটা পর্ব পর্যন্ত সফল হওয়ার পর, প্রশ্ন ওঠে অতঃ কিম। এখন অভিজ্ঞতার নিরিখে উত্তরটাও স্পষ্ট। ভূমি সংস্কারের পরবর্তী পদক্ষেপ হল অর্থনীতির পুঁজিবাদী রূপান্তর, শেষ বিচারে যা নিয়ে যাবে সমাজতন্ত্রের পথে। এখানেও প্রশ্ন রয়েছে। বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্রের কোনও অঙ্গরাজ্যের পুঁজিবাদী রূপান্তর যদি অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং যদি তার দায়িত্ব এসে পড়ে বামেদের কাঁধে, তাহলে সেই রূপান্তরের পথ কী পুঁজিবাদের চিরাচরিত বিকাশের পথের চেয়ে আলাদা হবে?
উত্তর হল, আলাদা হতেই হবে। তবে তার রূপ কী হবে তা এখনও অনির্ধারিত।
এসব নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্বেই পশ্চিমবঙ্গে ঘটে গেল প্রতিবিপ্লব। যে হিন্দুত্ব-কর্পোরেট নয়া উদারাবাদী জোট ভারতকে জিতে নিতে চাইছিল তারা জানতো এখানে পশ্চিমবঙ্গ একটি বিকল্প মডেল যা তাদের গুজরাট মডেলকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। অতএব খুব পরিকল্পনা করেই এই রাজ্যের ক্ষমতা থেকে বামেদের হঠানোর কৌশল রচনা করা হয়। বিজেপি, আরএসএস এবং কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ রাজ্যের ক্ষমতা থেকে বামপন্থীদের উচ্ছেদ করার সামিল হল তৃণমূল কংগ্রেস। এবং একাজে মদত এসেছিল বামপন্থা বিরোধী আন্তর্জাতিক পুঁজির তরফ থেকেও।
তৃণমূল ও বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ
তৃণমূলের গত এক দশকের শাসনে তাদের ছকটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। প্রথম দিকে হিংস্র হামলা চালিয়ে তারা বামেদের প্রতিরোধের শক্তিকে দুর্বল করেছে। এরপর পুলিশ, বেকার যুবক, স্থানীয় ক্লাব, সিভিক পুলিশদের নিয়ে গড়ে তুলেছে একটা হিংস্র হামলার কাঠামো যা যে কোনও গণ আন্দোলনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। একদিকে বেকার যুবক-যুবতীদের চুক্তিভিত্তিক কাজের সুযোগ দিয়ে তাদের আনুগত্য কেনা হয়। অন্যদিকে সরকারি সম্পত্তির বিপুল লুঠ এবং নেতাদের বিপুল তোলাবাজির টাকায় এই দমনপীড়নের কাঠামোটিকে তৈলাক্ত করে রাখা হয়। এর সঙ্গে রয়েছে দলীয় তহবিলে কর্পোরেটদের ঢালাও অনুদান। এই ভাবে অর্থ আদায় ও লুঠ করে দমনপীড়নের হাতিয়ার সংগঠন তৈরি করা ও তাকে চালানো, এই মডেল তৃণমূল শিখেছে সঙ্গ পরিবারের কাছ থেকে। এভাবে কর্পোরেটের টাকায় সর্বক্ষণের কিংবা আংশিক সময়ের কর্মী রেখে সঙ্ঘ পরিবার তাদের সংগঠনগুলিকে সচল, কর্মক্ষম রাখে যার পিছনে রয়েছে কর্পোরেট-হিন্দুত্ব জোট। তৃণমূলের গড়ে তোলা সাংগঠনিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের সাংগঠনিক কাঠামোর অনেক মিল রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বামদের হাত থেকে মুক্ত পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক রূপান্তর নিয়ে তৃণমূলের কোনও ভাবনা নেই। একটা লুঠের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার মতো করে সরকারি প্রশাসন এবং বেসরকারি নিপীড়নের সংগঠনকে তৈলাক্ত রাখাই তাদের মূল রাজনৈতিক কাজ। এর সঙ্গে নানা ধরনের শ্রীযুক্ত কর্মসূচি ও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা দুয়ারে সরকার ধরনের কার্যকলাপের সাহায্যে সরকারের মানবিক মুখটিকে সর্বদা পালিশ করে রাখার প্রয়াস বিদ্যমান।
এভাবে তৃণমূল শুধু নিজেরাই দক্ষিণপন্থী শক্তি হয়ে ওঠেনি। তারা এরাজ্যে ডেকে এনেছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারকে। তৃণমূলের শাসনে এরাজ্যের আদিবাসী এলাকায় নিঃশব্দে সংগঠন বাড়িয়ে চলেছে আরএসএস। তাদের লক্ষ্য হল, যখন তারা বুঝবে আযোজন সম্পূর্ণ, তখনই তারা পশ্চিমবঙ্গকে দখল করার কাজ শুরু করে দেবে। এসব কাজ সঙ্ঘ পরিবার করে চলেছে দীর্ঘ দিন ধরে এবং লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে এই রাজ্য দখলে আরএসএসের চেয়ে বিজেপির তাড়া বেশি। যেহেতু আগামী লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের বেশি আসন চাই, তাই তারা ধারাবাহিক ভাবে তৃণমূলকে উচ্ছেদ নয়, দুর্বল করে ফেলার কাজে লেগেছ। একাজে তাদের হাতিয়ার সিবিআই, ইডি, আয়কর দপ্তর। তৃণমূল নেতা-বিধায়কদের বিপুল দুর্নীতি উন্মোচন করে, সেই সব নেতা ও বিধায়কদের জেলের ঘানি টানার ভয় দেখিয়ে বিজেপি এই রাজ্যে তাদের লোকসভা ও বিধানসভার আসন বাড়িয়ে নিতে চায়। গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে তারা ধারাবাহিকভাবে এই কৌশলেই এগোচ্ছে। এক কথায়, মতাদর্শগত ভাবে দুই দক্ষিণপন্থী শক্তি, বিজেপি-আরএসএস ও তৃণমূল এবং আদানিদের মতো ক্রোনি পুঁজি পশ্চিমবঙ্গকে তাদের নিজস্ব পরিসর হিসাবে গড়ে তোলার ও টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
উঠে আসছে আর এক পশ্চিমবঙ্গ
তৃণমূল-বিজেপি-কর্পোরেট জোটের বিরুদ্ধে গত প্রায় এক বছর ধরে উঠে আসছে আরেক পশ্চিমবঙ্গ। এ হল সেই পরিচিত প্রতিবাদী পশ্চিমবঙ্গ, যারা তাদের লুঠ হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরে পেতে চায়। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এই নতুন ধারাটির সূচনা হয়। ক্রমশ তা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। আদালতে শিক্ষা দুর্নীতি ফাঁস এবং চাকরি বিক্রিকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার ঘুষ আদায়ের তথ্য সামনে আসায় আরও জোরদার হয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবাদী আন্দোলন। একইভাবে ডিএ-র দাবিকে কেন্দ্র করে নতুন করে লড়াই শুরু হয়েছে এ রাজ্যে। ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার ভয় দেখিয়ে কর্মচারীদের লড়াই থেকে বিরত করা যায়নি। বামেরাও নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছে এরাজ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারায়।
সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে যেভাবে তৃণমূল এতদিন সংখ্যালঘু ভোটকে এককাট্টা রাখার চেষ্টা করেছে সেখানেও ভাঙন ধরেছে। ধর্মীয় পরিচিতি সত্ত্বাকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে তার সাধারণ নাগরিক সত্ত্বা, যার সাহায্যে অনুদানের রাজনীতিকে ছাপিয়ে মানুষের কাছে বড় হয়ে উঠছে তার অর্থনৈতিক দাবি। সাগরদীঘির উপনির্বাচনে এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে।
রাজ্যের মানুষের এই যে সঠিক চেতনার দিকে মোড় ফেরার বিষয়টি নজরে এসেছে দুই দক্ষিণপন্থী শক্তি তৃণমূল ও বিজেপির। তাই রামনবমীকে কেন্দ্র করে ফের শুরু হয়ে গেল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তৎপরতা, যাতে মানুষের নবজাগ্রত গণতান্ত্রিক চেতনাকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিতে ঢেকে ফেলা যায়, আটকে দেওয়া যায় গণতন্ত্র ও বামপন্থার দিকে পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতি।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বহু অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পোড় খেয়ে এগিয়েছেন। তৃণমূল ও বিজেপি কী ও কেন— এটা তাঁদের কাছে ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। এবার হাওয়া ঘোরার পালা। আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে তার প্রমাণ মেলার ইঙ্গিত জোরালো হচ্ছে।