বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

ভারতীয় রেল: শতবর্ষের আলোকে

ভারতীয় রেল: শতবর্ষের আলোকে

নির্মলেন্দু নাথ

photo

ভারতীয় অর্থনীতিতে রেল পরিবহণ ব্যবস্থার ব্যাপ্তি সুবিদিত। এই পরিবহণ ব্যবস্থার ব্যাপ্তি ডাক ব্যবস্থার ব্যাপ্তির সঙ্গে তুলনীয়। তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিপুল পরিমাণ ভারী পণ্য চলাচল ও একত্রে বিপুল পরিমাণ যাত্রী বহন করা হল রেলওয়ে ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। রেলওয়ে ব্যবস্থা হল অর্থনীতির ‘‌লাইফ লাইন’‌। বিগত ৫–‌৬ বছরে এই ‘‌লাইফ-‌লাইন’-এ দু’ ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একটি দৃশ্যত, যা সহজেই চোখে পড়ে। অপরটি অন্তর্নিহিত যা লোকচক্ষুর বাইরে রাখার চেষ্টা হলেও ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে আসছে। রেলওয়ে ব্যবস্থায় যে পরিবর্তনগুলি সহজেই চোখে পড়ে তা হল স্টেশনগুলির সম্প্রসারণ ও চেহারায় চাকচিক্য আনা, রেললাইনের সম্প্রসারণ ইত্যাদি। অপরদিকে অন্তর্নিহিত পরিবর্তন হল পৃথকভাবে রেলওয়ে বাজেটের অবলুপ্তি ও রেলের বেসরকারিকরণ। বস্তুতপক্ষে অন্তর্নিহিত বিষয়টির পরিবর্তনের জন্যই বাহ্যিক পরিবর্তন। এই কারণে প্রাথমিকভাবে অন্তর্নিহিত বিষয়টি অর্থাৎ ‘‌বাজেটের পৃথক সত্তার অবলুপ্তি’র বিষয়টা আলোচনা করা হবে. তারপর বহিরঙ্গের পবিবর্তন অনুধাবন করা হবে।
আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ‌ আগে ১৯২৪ সালে উইলিয়াম অ্যাকওয়ার্থ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রেলওয়ের বাজেট ও সাধারণ বাজেটকে আলাদা ভাবে পেশ করা শুরু হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে রেল পরিবহণ ব্যবস্থার পত্তন ঘটে ১৮৫৩ সালে, ‘‌সিপাহী বিদ্রোহে’‌র চার বছর আগে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই পরিবহণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল প্রায় ৩৩টি ‘‌গ্যারান্টেড কোম্পানি’‌র ওপর। কোম্পানিগুলির মধ্যে সংহতির অভাবে সম্প্রসারণ সুসংহত হয়নি। এর ফলে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ২৪-‌২৫টি মন্বন্তরের ঘটনা ঘটে, সেই সব এলাকায় সরকারের তরফে খাদ্যশস্য পাঠানোর প্রক্রিয়া ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। সে সময়ে দুই-‌তিন বছর অন্তর মন্বন্তরের জন্য প্রায় দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। সেই সময়েই মন্বন্তরের ভয়াবহতা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের নজরে এসেছিল। অবস্থার সুরাহার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯২০ সালে অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম অ্যাকওয়ার্থয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি ভারতে রেল পরিবহণ ব্যবস্থার জাতীয়করণের সুপারিশ করে ও সম্পূর্ণ পৃথক ভাবে রেলওয়ে বাজেট পেশ করার বিধান দেয়। কমিটির সুপারিশ সরকার গ্রহণ করে এবং সেইভাবে রেল পরিবহণ ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। দেখা যায় ১৮৯০ সালে রেলপথের দৈর্ঘ্য যেখানে ছিল মাত্র ২৫৪৯৫ কি‌‌মি‌, ১৯৪৬–‌৪৭ সালে তা সম্প্রসারিত হয়ে দাঁড়ায় ৬৫২১৭ কি‌মি। একই সঙ্গে দেখা যায় ১৯০১ সালে রেল ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৮৩ হাজার, ১৯৪৭ সালে তা ছাড়িয়ে যায়। যে সব আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও বাস্তুতান্ত্রিক রূপান্তরের পরিণতিতে স্বাধীনতা-‌উত্তর ভারতবর্ষ গড়ে ওঠে, রেলব্যবস্থা ছিল যেন তার সাংগঠনিক ও প্রযুক্তিগত কেন্দ্রকোষ। (‌সুজিত সরকার, মডার্ন টাইমস্‌ পৃ-‌২০৪)
দেশভাগের পর স্বাধীন ভারতে রেল পথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৫৮০০০ কি‌মি। এরপর রেল পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি ও সামগ্রিক সামঞ্জস্য আনার জন্য একের পর এক প্রায় শতাধিক কমিটি গঠন করা হয়। এক্ষেত্রে সর্বশেষ কমিটি হল বিবেক দেবরায় কমিটি (‌২০১৫)‌। এই কমিটি রেলওয়ের জন্য পৃথক বাজেটের প্রয়োজনীয়তা খারিজ করার কথা বলে এবং রেলওয়ের উন্নতির জন্য বেসরকারিকরণের সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৭ সালে রেলওয়ে বাজেট ও সাধারণ বাজেট একত্রে পার্লামেন্টে পেশ করা হয় এবং ‘‌‌রেল ব্যবস্থা‌ নির্মাণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে’‌ বেসরকারিকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়। সংক্ষেপে বললে ভারতীয় রেল সম্পর্কে প্রায় ১০০ বছর আগে অ্যাকওয়ার্থ কমিটি যা সুপারিশ করেছিল, ২০১৫ সালে বিবেক দেবরায় কমিটি তার বিপরীত দিশার সুপারিশ করে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হচ্ছে পটভূমির রূপান্তর সম্পর্কে বিশ্লেষণ ও বর্তমান ভারতে রেল পরিবহণ ব্যবস্থার পর্যালোচনা।
পটভূমি রূপান্তর প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, বিগত ১০০ বছরে পুঁজিবাদ কোনও নতুন স্তরে উন্নীত হয়নি। রূপান্তর যা ঘটেছে তার অভ্যন্তরে। বিংশ শতকের গোড়াতেই পুঁজিবাদ তার শিখরে পৌঁছে যায় অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়। মার্কসীয় বীক্ষা অনুসারে, গোটা পর্যায়ে পুঁজি কেন্দ্রীভবন ও সমাহরণের (‌কনসেনট্রেশন ও সেন্ট্রালাইজেশন)‌ মাধ্যমে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়েছে এবং অপেক্ষা করেছে উপযুক্ত বিনিয়োগ ক্ষেত্রের জন্য। এদিকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আফ্রিকা-এশিয়া-‌দক্ষিণ আমোরিকার অনেক দেশের মতো ভারতও ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে মুক্তি পায় এবং সমাজের উৎপাদনের উপকরণের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যেই কতটা কী করা যায় তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। এতে যে সাফল্য আসেনি তা নয়, আয় বৈষম্য যথেষ্ট হ্রাস পায়।‌ তবে অর্থনীতিতে বিধিনিষেধের কড়াকড়ির চাপও তৈরি হয়েছিল। এতে দেশীয় পুঁজিপতি মহলে একটা চাপা অসন্তোষও তৈরি হয়। ১৯৮০ সালে শুরু সংস্কার। সংস্কারের হাত ধরে বিদেশি পুঁজির ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়ে যায়। বিশ্বায়নের ফলে পুঁজি সর্বত্রগামী হয়। পুঁজি দ্রুতগামী হয় এবং ভারতেও আসে। পুঁজির আবাহনে কেন্দ্রীভূত অর্থব্যবস্থার সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির মিশেল (‌পাবলিক প্রাইভেট-পার্টনারশিপ)‌ চালু হয়। ইতিমধ্যে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। এই প্রেক্ষিতে ভারতীয় রেল ব্যবস্থাকে ‘‌আত্মনির্ভরতা’‌র‌ মোড়কে সাজাবার তোড়জোড় শুরু হয়। রেলওয়েতে বিদেশি পুঁজির আগমন এবং কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। এই অভিযানে যে শক্তিগুলি মাথাচাড়া দিল তার অন্যতম সুবিধাভোগী হিসাবে আবির্ভূত হল বাজারি (‌ধান্দা)‌ পুঁজি, যার একমাত্র উদ্দেশ্যে হল যে কোনও উপায়ে মুনাফা অর্জন করা। সংক্ষেপে বললে, অ্যাকওয়ার্থ কমিটি বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তির পুঁজির অধিকার খর্ব করে কেন্দ্রীভূত অর্থব্যবস্থার সওয়াল করেছিল। এর বিপরীতে বিবেক দেবরায় কমিটি ‘‌আত্মনির্ভরতা’‌র মোড়কে কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাকে খর্ব করে বাজারি (‌ধান্দা)‌ পুঁজির বিকাশের পথকে সুগম করে।
এই পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে, এই নিবন্ধে, ১৯৫০ থেকে ২০২০ এই পরিসরে ভারতীয় রেল ব্যবস্থার বস্তুগত দিক, অর্থনৈতিক দিক ও সামাজিক দিক পর্যালোচনা করা হবে। বস্তুগত দিকের মধ্যে পড়ে রেললাইনের সম্প্রসারণ, ন্যারোগেজ-মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজ-এ রূপান্তরকরণ, বৈদ্যুতিকরণ, রেলওয়ে লোকোমোটিভ ও কোচ-এর সংখ্যা বাড়ানো, নতুন ট্রেনের সংযোগ, পণ্য পরিবহণের জন্য রেলের চাকা, ওয়াগনের সংখ্যা বাড়ানো, স্টেশন সমূহের আধুনিকীকরণ ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি পরিবহণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। এছাড়া রেলের অন্যান্য সম্পদ আছে যেমন, পুরাতন শেড, পার্ক, বিদ্যালয়, কলোনি, স্টেডিয়াম, অব্যবহৃত ইয়ার্ড প্রভৃতি। অর্থনৈতিক বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই আসে বিভিন্ন পদে নিয়োজিত কর্মচারীর সংখ্যা। এখানে বলা দরকার রেল ব্যবস্থাতে অনিবার্যভাবে বহু রকমের ‘‌শ্রমপ্রক্রিয়া ও সাংগঠনিক’‌ রূপ ব্যবহৃত হয়। নিতান্ত সরল থেকে শুরু করে অত্যন্ত জটিল ধরনের কাজকর্ম করতে হয়। রেলের কর্মীদের কয়েকটি স্তরে ভাগ করা হয়। ওপরের দিকে প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার আর ড্রাইভারদের বর্গ, তার নীচে রয়েছে স্টেশনমাস্টার আর কেরানিদের এক মধ্যম বর্গ আর একেবারে তলায় রয়েছে অনিয়মিত ভিত্তিতে ঠিকাদারদের ভাড়া করা গতরে-‌খাটা ঠিকা শ্রমিকদের এক মস্ত দল। অর্থনৈতিক বিষয়ের মধ্যে আসে যাত্রী সাধারণের সংখ্যা, পণ্য পরিবহণের মাত্রা, বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত আয় ও রেল ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য সার্বিক খরচ। সামাজিক বিষয়ের মধ্যে আসে আঞ্চলিক ভারসাম্য বজায় রাখা, ‘‌ভারতীয় আত্মপরিচয়’‌ গড়ে তোলা, আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থার (‌তীর্থভ্রমণ)‌ সম্প্রসারণ ইত্যাদি। এক কথায় বললে বিষয়টা বহুমাত্রিক।
পরিবহণ অর্থনীতির দিক থেকে বিচার করলে বহুমাত্রিক এই বিষয়গুলিকে পাঁচটি সূচকের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। এগুলি হল রেলপথের দৈর্ঘ্য, বৈদ্যুতিকরণের হার, কোচ পিছু যাত্রীর সংখ্যা, যাত্রী সাধারণের ভ্রমণের গড় দূরত্ব, পরিবাহিত পণ্যের গড় দূরত্ব ও অপারেটিং রেশিও। বৈদ্যুতিকরণের হার হল মোট রেলপথের কত শতাংশ বৈদ্যুতিকরণ হয়েছে। কোচ পিছু যাত্রীর সংখ্যা হল মোট কোচ ও মোট যাত্রীর সংখ্যার অনুপাত। যাত্রী সাধারণের ভ্রমণের গড় দূরত্ব হল যাত্রীরা গড়ে কত কি‌মি যাচ্ছে অর্থাৎ কতদূর যাচ্ছে। পরিবাহিত পণ্যের গড় দূরত্ব হচ্ছে পণ্য সামগ্রীকে কতদূর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর অপারেটিং রেশিও হচ্ছে ওয়ার্কিং খরচ ও মোট রাজস্বের অনুপাত। প্রতিটি সূচকের মান সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্যভাণ্ডারের সাহায্যে নিরূপণ করা হয়েছে। আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্য গত আট দশকে সূচকগুলির মান দুটি সারণিতে রাখা হয়েছে।

cover

সারণি–‌১ এ দেখা যায় ১৯৫০-৫১ সালে রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৫৩৫৯৬ কিমি এবং ২০২০-২১ সালে হয়েছে ৬৮১০৩ কিমি। এর তাৎপর্য হল বিগত ৭০ বছরে রেলপথের দৈর্ঘ্য মাত্র ২৭.‌০৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।  বৈদ্যুতিকরণের ক্ষেত্রে অবশ্য অগ্রগতি লক্ষ্যণীয়। মূল রিপোর্টে দেখা যায় ১৯৫০-৫১ সালে মোট রেলপথের মাত্র ৩৮৮ কিমি অর্থাৎ ০.‌৭৩ শতাংশ রেলপথের  বৈদ্যুতিকরণ হয়েছিল। ১৯৮০-৮১ সাল পর্যন্ত এই  বৈদ্যুতিকরণের গতি শ্লথ ছিল। এরপর  বৈদ্যুতিকরণ যথেষ্ট দ্রুতগতিতে হয়। ২০২০-‌২১ সালে দেখা যায় মোট রেলপথের প্রায় ৬৫.‌৭৮ শতাংশ বৈদ্যুতিকরণের আওতায় এসেছে। মূল রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৫০-‌৫১ সালে মোট যাত্রীর সংখ্যা ছিল ১২৮৪ মিলিয়ন আর কোচের সংখ্যা ছিল ১৩১০৯টি। এই হিসাবে ১৯৫০-৫১ সালে কোচ পিছু যাত্রী পরিবহণের সংখ্যা ছিল ০.‌০৯ মিলিয়ন। ২০২-২১ সালে যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪৩৯ মিলিয়ন। কিন্তু কোচের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৫৭০৮টি। ফলে কোচপিছু যাত্রী পরিবহণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪.‌০৮ মিলিয়ন। এ থেকে বোঝা যায় দূরপাল্লার গাড়িগুলিতে যাত্রীদের চাপ কত প্রবল। আর বেশি চাপের অর্থ স্বাচ্ছন্দ্য তলানিতে। অথচ আয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণে। ১৯৫০-‌৫১ সালে যাত্রীসাধারণের ভ্রমণের গড় দূরত্ব ছিল ৫১.‌৮ কিমি আর ২০২০-২১‌এ এই সূচকের মান হয় ১৮৭.‌৯ কিমি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই সূচকের মান ১৯৭০-৭১ পর্যন্ত কমেছে, তারপর দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করে। অর্থাৎ সূচকের মান নির্দেশক রেখাটি ইংরাজিতে U আকৃতির‌। এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা দরকার। ভারতীয় অর্থনীতিতে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ হল সমাজের উৎপাদনের উপকরণের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে কতটা কী করা যায় তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ। অর্থাৎ নেহরু-‌মহলানবিশ প্রজ্ঞা অনুযায়ী পরিকল্পিত অর্থনীতির যুগ। এখানে বলা দরকার, এই যুগে কাজকর্ম অনেকটাই কেন্দ্রীভূত ছিল। তাছাড়া সাবেকি শিল্পাঞ্চলগুলি যেমন ব্যারাকপুর-‌কাঁচড়াপাড়া বা দুর্গাপুর-‌আসানসোল-‌রানিগঞ্জ শিল্পাঞ্চল যথেষ্ট উৎপাদনমুখর ছিল। ফলে লোকজনকে কাজের সন্ধানে দূর-‌দূরান্তরে যাওয়ার প্রয়োজন কম ছিল। ১৯৮০-এর পর থেকে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। শুরু হয় শ্রমের চলাচলের যুগ। এরই প্রতিফলন ঘটেছে পরবর্তী দশকগুলিতে অবিশ্বাস্য রকমের যাত্রীসাধারণের ভ্রমণের গড় দূরত্ব বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে। সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে দক্ষিণগামী দূরপাল্লার ট্রেন বা হাওড়া স্টেশন থেকে উত্তরগামী দূরপাল্লার ট্রেনে পিঠে ব্যাগসর্বস্ব ১৮-‌২৫ বছর বয়সের তরুণর দেখলে একথা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
পণ্য পরিবহনের গড় নির্দেশক রেখচিত্রটি অবশ্য ইংরেজি ওল্টানো U ‌আকৃতির মতো। কারণ সূচকের মান ১৯৮০-‌৮১ পর্যন্ত বেড়েছে, তারপর কমতে শুরু করেছে। ২০২১-২১ সালে এই সূচকের মান ৬০৩.‌০ কিমি হয়। বিগত চার দশকে পরিবাহিত পণ্যের গড় নির্দেশক রেখচিত্রটির অধোগতির তাৎপর্য হচ্ছে রেল পরিবহণের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী পরিবহণের তরঙ্গ হ্রাস পাচ্ছে ও রেলের আয় হ্রাস পাচ্ছে। এখানে মনে রাখা দরকার পণ্য পরিবহণজনিত আয় রেলের প্রধান আয়। এই আয় থেকেই যাত্রী পরিবহণের ঘাটতি পোষানো হয়। এটাই রেলের বৈশিষ্ট্য। আয় কম হওয়ার সম্ভাব্য কারণ হল অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ও কিছুটা আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস। এসবের ফলে কয়লা, লোহা, খনিজ তেল, শিল্পজাত পণ্য, খাদ্যশস্য চলাচল যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। ১৯৬০ সালে দেশের মোট পরিবাহিত পণ্যের ৮৫%‌ বহন করত রেল। বর্তমানে তা কমে ৩৫%‌ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া যুগটা হচ্ছে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এই যুগে এই সব যন্ত্রপাতি রেলওয়ের মাধ্যমে পরিবাহিত হয় না বললেই চলে।
এখানে যে সূচকগুলির কথা বলা হল তার মধ্যে পরিবাহিত পণ্যের গড় দূরত্বের সূচকটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বিষয়টিই রেলওয়ের আগের প্রধান নির্দেশক। এটি অপারেশন রেশিও (Operation Ratio)–‌‌‌রও নির্দেশক। এই অপারেশন রেশিও বিগত আট দশকে কীভাবে বদলেছে হয়েছে তা সারণি–‌২তে রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয় সারণি দেখা যাচ্ছে ১৯৫০-‌৫১ সালে ভারতীয় রেল পরিবহণ ব্যবস্থায় মোট পরিচালন ব্যয় ও মোট রাজস্বের অনুপাত অর্থাৎ অপারেটিং রেশিওর মান ছিল ৮১.‌০০। ১৯৬০-৬১ সালে এই সূচকের মান হয় ৭৮.‌৭৫। তারপর পরপর দুটি দশক এই সূচকের মান ঊর্ধ্বগামী হয়। ১৯৮০-‌৮১ সালে এই সূচকের মান ৯৬.‌০৭ শতাংশ হয়ে এবং পরের দশকগুলিতে সামান্য ওঠানামা করে ২০২০-‌২১ সালে এটা ৯৮.‌৪১ হয়। এর অর্থ হচ্ছে উদ্বৃত্তের পরিমাণ কম, আয়ের প্রায় সবটাই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক দিক থেকে বিচার করলে আয়ের সবটাই যদি ব্যয় করতে হয় তাহলে তা সদর্থক নয়। কেবলমাত্র বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে যা দাঁড়ায় তা হল রেলের আয়, রেলের পরিকাঠামো ও পরিষেবা প্রদানের মধ্যে একটা ‘‌দুষ্টচক্র’‌ আছে। বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ আয়ের অভাব, সেই অভাবের জন্য দুর্বল পরিকাঠামো আর দুর্বল পরিকাঠামোর জন্য দুর্বল পরিষেবা। বিবেক দেব রায় কমিটি (‌২০১৫)‌ এই ‘‌দুষ্টচক্র’‌ ভাঙার জন্য প্রধান তিনটি প্রস্তাব দিয়েছে। এই তিনটি হল (‌ক) কর্মী (‌স্থায়ী)‌ সংকোচন করে ব্যয়ভার কমানো, (‌খ)‌ রেলের ‌সম্পত্তি বিক্রয় করা বা দীর্ঘকালীন মেয়াদে লিজ দেওয়া এবং (‌গ)‌ রেল বেসরকারিকরণ করা।
কর্মী সংকোচনের বিষয়টা কী মাত্রায় ঘটেছে তা সার‌ণি ‌২ এর সর্বশেষ কলম থেকে প্রতিভাত হয়। বিগত আট দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মী পরিলক্ষিত হয় ১৯৯০-৯১ সালে। ওই বছরে রেলের কর্মীর সংখ্যা ছিল ১৬.‌৫২ লক্ষ। তারপর এটা দ্রুত গতিতে হ্রাস পেতে থাকে। ২০২০-‌২১ সালে দেখা যাচ্ছে কর্মীর সংখ্যা ১২.‌৫২ লক্ষ হয়েছে। এর তাৎপর্য হল রেলওয়েতে গত তিরিশ বছরে ৪ লক্ষ পদের অবলুপ্তি ঘটেছে এবং বেশিরভাগ অবলুপ্তি ঘটেছে পিওন, ওয়েটার, জমাদার, মালি, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ইত্যাদি। স্কুলের শিক্ষকতার কাজটি বাদ দিলে বাকি কাজগুলি গ্রুপ ডি-‌র। এই সমস্ত কাজ কন্ট্রাক্টরদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান রেলের অধীনে ১৬টি সাবসিডিয়ারি ও পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং সংস্থা আছে। ‌এদের মধ্যে IRCTC ‌অন্যতম— যেখানে কর্মীদের একটা বড় অংশ ঠিকাদারদের মাধ্যমে নিযুক্ত হয়। রেলের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার আর CAG ‌রিপোর্ট অনুযায়ী এঁদের ২৩ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি পান। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার ঠিকা শ্রমিকদের অনুপাত বাড়ছে। ২০০১–‌০২ সালে ঠিকা শ্রমিক ছিল ১৫ শতাংশ। দেড় দশক বাদে তা দাঁড়ায় প্রায় ২৮ শতাংশ। ২০২০ সালে তা ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি। বর্তমানে ট্রেনের সমস্ত সাফাই কর্মী, কম্বল বিলি করা, খাবার সরবরাহ করা ধরনের সমস্ত কাজই এইসব ঠিকা শ্রমিকদের দিয়ে করানো হয়। ঠিকা শ্রমিক নিয়োগবৃদ্ধি নীতি প্রণেতাদের সমর্থন পেয়েছে। একে কাজে লাগিয়ে সমস্ত আইন পাশ কাটানো হচ্ছে। জনকল্যাণকর, আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার শর্ত পূরণ করতে এদেশে শ্রমিক সুরক্ষায় যেসব আইন হয়েছিল, যেমন ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট (‌১৯৪৮)‌, কন্ট্র‌্যাক্ট লেবার অ্যাক্ট (‌১৯৭০)‌, মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট (‌১৯৪৮)‌, মাইনস্‌ অ্যাক্ট (‌১৯৫২)‌, শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার, সব অকেজো করে দিয়েছে ঠিকাদারি ব্যবস্থা। আজ ঠিকাদারের হাতে চাবুক নেই ঠিকই কিন্তু ঠিকা শ্রমিকের অস্তিত্ব বিপন্ন।
রেলের আয় বাড়ানোর জন্য যেমন স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা হ্রাস করা হয়েছে তেমন ভাড়ার ক্ষেত্রে ২০১৩ সালে ‌flexi-fare system ‌‌চালু করা হয়। এই ব্যবস্থায় ভাড়া একইরকম থাকে না। প্রথম ১০ শতাংশ আসনের জন্য যা ভাড়া পরের ১০ শতাংশ আসনের জন্য ভাড়া বাড়বে। কতগুলি নির্বাচিত ট্রেনের জন্য এটা চালু হয়েছিল। তবে রেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয় এতে আয় ৬০০ কোটি টাকা বাড়লেও যাত্রী পরিবহণের সংখ্যা ৭০,‌০০০ কমে যায়। রেলের যাত্রী আর বিমানের যাত্রী যে একই শ্রেণীর নয় তা রেলের নীতিনির্ধারকদের বোধহয় স্মরণে ছিল না। রেলের আয় বাড়নোর জন্য অপর গৃহীত পন্থা হল রেলের সম্পত্তি বিক্রয় করা বা দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে লিজ দেওয়া। রেলের সম্পত্তি বলতে বোঝায় ইয়ার্ড, পুরনো শেড, পার্ক, স্টেডিয়াম ইত্যাদি। সরকার আশা করেছিল, ২০২২ সালে এই সম্পত্তি থেকে ১৭০০০ কোটি টাকার মতো অর্থের সংস্থান হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা হিসাব তাতে কোনও সম্পত্তির ব্যবস্থা করা যায়নি। যেখানে চাহিদা নেই সেখানে জোগান দিলে তা অবিক্রিত থাকাই স্বাভাবিক। আমাদের ধারণা রেলের ‘‌অ্যাসেট মানিটাইজেশন’‌ প্রকল্পে তাই ঘটেছে।
রেলের পুনরুজ্জীবনের লক্ষে সরকার ‘‌রেলওয়ে ভিশন ২০৩০’‌ তৈরি করেছে। এতে বেসরকারিকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই বেসরকারিকরণ দু’‌ ধরনের। প্রথমত, রেলের ওয়ার্কশপগুলিতে ধীরে ধীরে বেসরকারি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটানো। দ্বিতীয়ত, রেলের পরিকাঠামো ব্যবহার করে বেসরকারি কোম্পানিগুলির ট্রেন চলানোর উদ্যোগ। রেলের নিজস্ব ওয়ার্কশপগুলিতে বেসরকারি পুঁজির অনুপ্রবেশের পথকে সুগম করার জন্য চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস (‌পশ্চিমবঙ্গ)‌, ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি (‌তামিলনাডু)‌ সহ রেলের ৭টি প্রোডাকশন ইউনিটকে ভারতীয় রেলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এনে ‘‌ইন্ডিয়ান রোলিং স্টক কোম্পানি’‌ তৈরি করা হয়েছে।। এটা হল বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে কর্পোরেট সংস্থাগুলির অনুপ্রবেশের পথ সুগম করা। এ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য হল যে, প্রায় ২ লক্ষ রেলের চাকা চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ-এ উৎপাদন না করে বাইরে তৈরি করার অর্ডার দেওয়া হয়েছে।
রেলের পরিকাঠামো ব্যবহার করে বেসরকারি কোম্পানিগুলির ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত সুদূরপ্রসারী। ২০২০ সালে রেলবোর্ডের ঘোষণা অনুযায়ী ১০৯টি প্রান্তিক স্টেশন থেকে ১৫১টি আন্তর্জাতিক মানের পরিষেবাযুক্ত ট্রেন বিভিন্ন কোম্পানি চালাবে। এর ফলে বছরে ৯০,‌০০০ কোটি টাকা রেলের ঘরে আসবে। সরকার পক্ষের দাবি, বছরে প্রায় ৫ কোটি যাত্রী উপযুক্ত আসন না পেয়ে ট্রেন সফর করতে পারেন না, নতুন ট্রেন সেই সমস্যা মেটাবে। সরকারের বিবৃতি অনুযায়ী ভারতীয় রেলের চালু ২৮০০ মেল ও এক্সপ্রেস ট্রেনের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ হবে এই ধরনের ট্রেন। ধাপে ধাপে এই সব ট্রেন চালু করা হবে। রেলের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা অবশ্যই আসে। প্রথমত, বেসরকারি কোম্পানিগুলির রেলের বর্তমান ট্র‌্যাক, স্টেশন, সিগন্যাল প্রভৃতির জন্য কোনও পয়সা খরচ করেনি, ভবিষ্যৎতেও করবে না। শুধুমাত্র লাইসেন্স ফি দিয়ে জনগণের করের টাকায় তৈরি পরিকাঠামো ব্যবহার করার সুযোগ নেবে। ট্রেন চালাবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দুই কর্মী অর্থাৎ ড্রাইভার ও গার্ড রেলের নিজস্ব স্টাফ থাকবে। অর্থাৎ জনগণের টাকায় রেলে যে উন্নত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী তৈরি করে তাদের ব্যবহার করবে এই বেসরকারি কোম্পানিগুলি। এক্ষেত্রে বাকি যেসব কর্মচারী থাকবেন তা হবে চুক্তিভিত্তিক বেসরকারি কোম্পানিগুলির অধীন।
সাধারণ যাত্রীদের ওপর এই বেসরকারিকরণের প্রভাব কী পড়বে সে সম্পর্কে দু’ একটা কথা বলা দরকার। বহু ট্রেনকে চিরকালের মতো বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। একদিকে সাধারণ ট্রেনের সংখ্যা কমবে অপরদিকে বেসরকারি ট্রেনগুলিতে চড়া ভাড়ার কারণে তা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। দেখা যাচ্ছে দিল্লি-‌লক্ষ্মৌ শতাব্দী এক্সপ্রেসে এসি চেয়ার কারের ভাড়া ৬৮০ টাকা। পাশাপাশি ওই রুটে IRCTC ‌পরিচালিত ‘‌তেজস্‌’ এক্সপ্রেসের ভাড়া ১৭০০ টাকা, ‌অথচ দুটি ট্রেনের গন্তব্য পৌঁছানোর সময়কাল একই। গড়পড়তা হিসাবে এক্সপ্রেস ট্রেনে ভারতীয় রেল প্রতি ১০০০ কিমি যাত্রার জন্য ধার্য করে ৭০০-‌৯০০ টাকা, সেখানে ‘‌তেজস্‌’-এ‌র অভিজ্ঞতা বলছে বেসরকারি ট্রেনের ক্ষেত্রে ১০০০ কিমি যাত্রার জন্য ভাড়া ধার্য হবে ন্যূনতম ২২০০ টাকা। রেলওয়েতে যাতায়াত কীভাবে সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে তার উদাহরণ হল গত ১০ বছরে রেল বোর্ড দূরপাল্লার ট্রেনের ক্ষেত্রে যত আসন বৃদ্ধি করেছে তার ৭০ শতাংশই বাতানুকুল কোচ, বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ স্লিপার কোচ। এ সবের পরিণতিতে দেখা যায় যে কোনও দূরপাল্লার গাড়িতে স্লিপার কোচগুলিতে উপচে পড়া ভিড়।
নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ এই সংস্কার প্রক্রিয়ার ফলে যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তার অন্যতম উদাহরণ হল স্টেশনগুলির বেসরকারিকরণ। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (‌পিপিপি)‌ মডেল-এ গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলিকে দিয়ে দেওয়া হবে। যে কোম্পানিগুলি স্টেশনের দায়িত্বভার হাতে নেবে তারা ১৫ বছর ধরে রেলস্টেশনকে দেখাশোনা করবে, বিনিময়ে ১৫ বছর ধরে স্টেশনের সম্পত্তি ভোগ করার ‘‌লিজ’‌ পাবে। রেলের জমিতে বেসরকারি কোম্পানিগুলি শপিং মল, সিনেমা হল, হোটেল গড়ে তুলতে পারবে। যে ২৩টি স্টেশনকে নির্বাচিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে কানপুর সেন্ট্রাল, এলাহাবাদ, উদয়পুর, হাওড়া, শিয়ালদহ, ইন্দোর প্রভৃতি। ধাপে ধাপে এই সমস্ত স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম টিকিট, খাবারের দাম ১০-‌১২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে ঘণ্টা প্রতি টাকার বিনিময়ে ওয়েটিং লাউঞ্জের ব্যবস্থা করা হয়েছে, অন্যদিকে স্থান সংকোচনের দোহাই দিয়ে বিনামূল্যের সাধারণ যাত্রী প্রতীক্ষালয়গুলিকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রেল ব্যবস্থাকে সাধারণত তার অভিঘাতের দিক থেকেই বিচার করা হয়। এখন রেল ব্যবস্থায় বিদ্যমান ‘‌দুষ্টচক্র’‌–এর অবসানকল্পে দেবরায় কমিটি যে বেসরকারিকরণের সুপারিশ করেছেন তা রেল পরিষেবায় হয়তো গতি আনবে, তবে তার সুযোগ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে না। সব মিলিয়ে ভারতীয় রেলে ‌এখন বেসরকারি পুঁজির সুদিন। শতবর্ষ পূর্বে অ্যাকওয়ার্থ কমিটি ব্যক্তি পুঁজির প্রাধান্য খর্ব করে রেল পরিবহণ ব্যবস্থায় যে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার পত্তন করে, ২০১৫ সালে সরকার সেই ব্যবস্থা খারিজ করে ‘‌ধান্দা’‌ চালিত বেসরকারি পুঁজিকেই আত্মনির্ভর ভারতীয় রেলপথের ভগীরথ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।‌‌‌‌‌‌

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.