বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
ভূমিকা
২ জুন ২০২৩। ওড়িশার বালেশ্বর জেলার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটে। বেলাইন আপ করমণ্ডলের সঙ্গে ডাউন যশোবন্তপুর এক্সপ্রেস ও একটি পণ্যবাহী মালগাড়ির মধ্যে ধাক্কা লাগে। যাত্রীবাহী দুটি ট্রেনই তাদের গতির সর্বোচ্চ সীমায় ছিল। ফলে দুর্ঘটনা মর্মান্তিক হয়। করমণ্ডলের ২৪টি কোচের মধ্যে ২১টি কোচ তাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং যশোবন্তপুর এক্সপ্রেসের ৪টি কোচ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় করমণ্ডলের এস ১ ও এস ২ কোচ। সঙ্ঘর্ষের তীব্রতায় এই কোচ দুটি একে অপরের মধ্যে গেঁথে যায়। সাধারণভাবে রেলের স্লিপার (এস)কোচে ৭৫ জন যাত্রীর শোয়ার ব্যবস্থা থাকে। তবে কার্যত দেখা যায় এই সব কোচে যাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণ বা তার বেশি থাকে। এই ছবি রেলের ট্রাঙ্ক রুটের সর্বত্র। রেলের অসংরক্ষিত কোচে যাত্রী সংখ্যা যে আরও বেশি হবে তা সহজেই অনুমেয়। এ হেন অবস্থায় ২০–২২টি কোচের তীব্রগতিসম্পন্ন যাত্রীবাহী ট্রেন যদি দুর্ঘটনায় পড়ে তবে তার ক্ষয়ক্ষতি যে মারাত্মক হবে তা স্বাভাবিক। ৫ জুন ২০২৩ পর্যন্ত দেখা গেছে বাহানাগার ট্রেন দুর্ঘটনায় করমণ্ডলের ১৩টি কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মৃতের সংখ্যা ২৭৫, আহত ১১৭৫। সবচেয়ে মর্মান্তিক হল ২৭৫ জনের মধ্যে প্রায় ১০০ জনকে শনাক্ত করা যায়নি। এছাড়া রেলে কোচের ক্ষতি, রেলওয়ে ট্র্যাকের ছিন্নভিন্ন দশা অবিশ্বাস্য। সরকারি তরফে একে এক নিছক দুর্ঘটনা হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলছে। এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে এটা যান্ত্রিক ত্রুটি না কর্তব্যে গাফিলতি তা নির্ধারণ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জ্ঞানেশ্বরীর মতোই প্রচলিত বিধি ভেঙে গোটা বিষয়ের তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যার রিপোর্ট কবে সূর্যের আলো দেখবে কেউ জানে না। বাহানাগার রেল দুর্ঘটনা ব্যতিক্রমী বিষয় নয়। এটা হল বিগত এক দশক ধরে অনুসৃত তথাকথিত আধুনিকীকরণের ‘অনিবার্য’পরিণতি।
পূর্বরেলের যে ছবিটা মানুষের মধ্যে ছিল তা হর কিছুটা ‘পথের পাঁচালি’র অপু–দুর্গার জীবনে প্রথম রেল দেখার মতো। ছবিতে দেখা যায় কাশফুলে পরিপূর্ণ দিগন্তবিস্তৃত এক প্রান্তরের এক পাশ থেকে অন্যপাশে রেলে চলে যাওয়া। এখানে বিষয়টা হচ্ছে রেলের গতি আছে, কিন্তু চাকচিক্য বা তীব্রতা নেই। বিগত কয়েক দশক ধরেই এই চাকচিক্য ও তীব্রতা আনার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। এটাই হল আধুনিকীকরণ। এই আধুনিকীকরণের সর্বশেষ সংস্করণ হল ২০১৫ সালে বিবেক দেবরায় কমিটির সুপারিশ। দেবরায় কমিটির মূল সুপারিশ দুটি। পৃথক রেল বাজাটের অবলুপ্তি এবং রেলের বেসরকারিকরণ। পৃথক বাজেটের জন্য রেলের পৃথক সত্তার অবসান ঘটে, সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে রেল বোর্ডের যে বাধ্যবাধকতা তা শিথিল করা হয়, রেলওয়ে সেফটি কমিশন তার গুরুত্ব হারায়। সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির ৩২৩তম রিপোর্টে একথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এর তাৎপর্য হল বোর্ডের ‘মুষ্টিমেয়’কিছু ব্যক্তি যা করবে তাকে ঘিরে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না।
রেলের বেসরকারিকরণের পরিপ্রেক্ষিতে রেল পরিবহণ ব্যবস্থায় মোট পরিচালন ব্যয় ও মোট রাজস্বের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাবের কথা বলা হয়। সাধারণভাবে এটিকে বলা হয় অপারেটিং রেশিও। দীর্ঘকালীন পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যাবে, ১৯৫০–৫১ থেকে ১৯২০–২১ এর পরিসরে এই সূচক নির্দেশক রেখাটি কমবেশি ইংরেজি Uআকৃতির অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে হ্রাস পেয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে ১০৮০–৮১ থেকে এই সূচকের মান ঊর্ধ্বগামী হয়ে ৯৮.১৪ হয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে উদ্বৃত্তের পরিমাণ কম। আয়ের প্রায় সবটাই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক দিক থেকে বিচার করলে যা কখনই অনভিপ্রেত নয়।
অনভিপ্রেত এই অপারেটিং রেশিওতে সামঞ্জস্য আনার জন্য রেল যে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহল, ১) কর্মী (স্থায়ী) সঙ্কোচন করে ব্যয়ভার কমানো, ২) রেলের ‘অপারেটিং’ নামক বিষয়টিকে ক্রমশ যন্ত্রনির্ভর করে তোলা, ৩) মেনটেন্যান্সে ক্রমশ ঠিকেদারি প্রথার প্রসার ঘটানো, ৪) রেলের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে কিছু চমকপ্রদ ও দ্রুতগামী (মাঝারি পাল্লার) ট্রেন চালু করা এবং ৫) রেলের জমিজমা, সম্পত্তি বিক্রয় করা বা দীর্ঘমেয়াদে লিজ দেওয়া। বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে করমণ্ডলের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম চারটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এই বিষয়গুলি নিয়ে কয়েকটা কথা বলা দরকার।
১৯২০–২১ সালে রেলে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ছিল ১২.৫২ লক্ষ। যদি ১৯৯০–৯১ এর সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে বিগত ৩০ বছরে প্রায় ৪ লক্ষ পদের অবলুপ্তি ঘটেছে। এখানে যেটা উল্লেখ করা দরকার যে, অবলুপ্ত পদগুলির সিংহভাগ হল গ্রুপ ডি গোত্রের। রেলের কর্মচারীদের যে কাঠামোগত বিন্যাস তাতে সবার নীচে অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রুপ ডি কর্মচারী। এই গোত্রের মধ্যে পড়ে গ্যাংম্যান, সুইচম্যান, ট্র্যাকম্যান, কেবিনম্যান, লিভারম্যান, পয়েন্টসম্যান, শান্টার, হেল্পার (ইলেকট্রিক ও মেকানিক), ওয়েল্ডার, ফিটার, পিয়ন, ঠাপাল বয়েজ ইত্যাদি। আধুনিকীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে যা হচ্ছে তা হল ট্রেনকে নির্দিষ্ট পথে চলাচলের জন্য সিগন্যাল, পয়েন্ট ও ট্র্যাকের মধ্যে মেলবন্ধনের যে কাজটা আগে মানুষ করত, তা যন্ত্রের সাহায্যে করা। এই ব্যবস্থার নাম ইন্টারলকিং। স্বয়ংক্রিয় ইন্টারলকিংয়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হল ইলেকট্রনিক ইন্টারলকিং সিস্টেম। একটা সফটঅয়্যারের মাধ্যমে সিগন্যাল, পয়েন্ট ও ট্র্যাকের মধ্যে যে সার্কিট আছে তার মেলবন্ধন ঘটায়। আধুনিকীকরণের এই ধাক্কায় রেলের গ্রুপ ডি কর্মচারীর সংখ্যা ২০১৬–১৭ সালে হয়েছে মাত্র দেড় লক্ষ। হিসাবে দেখা যায় ২০০৭–০৮ এর তুলনায় গ্রুপ ডি কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে দুর্ঘটনার কারণ হল যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা।
একই কথা ‘অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম’ (যা ‘কবচ’ নামে পরিচিত) সম্পর্কে প্রযোজ্য। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই প্রযুক্তি। ২০১১ সালে এই পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলেও এই সিস্টেমের আওতায় দক্ষিণ–মধ্য রেলের ১০৯৮ কিমি রেলওয়ে ট্র্যাক এবং ৬৫টি স্টেশন জায়গা পেয়েছে। হিসাবে দেখা যায় সমগ্র রেলওয়ে ট্র্যাকের মাত্র ৪ শতাংশ এর আওতায় এসেছে। কাজেই সব কাজ যন্ত্রের সাহায্যে করা যাবে, এই চিন্তাভাবনা বাস্তবসম্মত নয়।
আয় বাড়ানোর জন্য মাঝারি পাল্লার কিছু দ্রুতগামী ট্রেন কয়েকটি রুটে রেল কর্তৃপক্ষ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবেই অনুধাবন করবে পণ্যসামগ্রী পরিবহণ থেকে আয় ষাটের দশকের মতো হবে না। কাজেই আয় বৃদ্ধির জন্য যাত্রী পরিবহণের ওপর জোর দেওয়া দরকার। পণ্যসামগ্রী পরিবহণ ও যাত্রী পরিবহণের মধ্যে যাত্রী পরিবহণের আপেক্ষিক গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার জন্য দুটি বিষয় ঘটছে। অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ এই বিলাসবহুল ট্রেন চালানোর জন্য মূল্যবান সম্পদের কিছুটা অপব্যয় হচ্ছে। প্রসঙ্গত বলা দরকার প্রতিটি বন্দে ভারত ট্রেনের জন্য ন্যূনতম ব্যয় ১৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয়ত ‘বন্দে ভারত’মার্কা ট্রেনের জন্য রেলের রেলের অন্যান্য কাজ অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ২০১৭–১৮র মধ্যে ইস্ট কোস্ট রেলওয়ের কোনও ধরনের ট্র্যাক ও ওয়েল্ডিং টেস্ট হয়নি। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে মাইসুরুর কাছে সম্পর্ক ক্রান্তি এক্সপ্রেসের সঙ্গে মালগাড়ির মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ কোনওক্রমে এড়ানো গিয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ পশ্চিম রেলের চিফ অপারেটিং ম্যানেজার এই জোনের সমস্ত পয়েন্ট–সিগন্যালিংকে নতুন করে করার আবেদন জানান। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনম্।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক হল ভারতীয় রেল। বছরে প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ রেলে যাতায়াত করেন। দৈনিক হিসাবে ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ ট্রেনের ওপর নির্ভরশীল। এই বাস্তবতায় রেলের নিরাপত্তাজনিত বুনিয়াদি পরিকাঠামোর যথাযথ সংস্কার অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বিগত বছরগুলিতে এই বিষয়টাই অবহেলিত হয়েছে। আমাদের অনুমান, এই কারণেই কবচ–কুণ্ডলহীন করমণ্ডল ২ জুন ২০২৩ এ বাহানাগা বাজার স্টেশনের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে তাসের ঘরের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কাশের ঝালর দোলানো প্রান্তরের এক ধার দিয়ে অপু–দুর্গার দেখা ট্রেন দুই কিশোর মনকে বিস্মায়াবিষ্ট করে ফেলে এক ঘোরলাগা ভালবাসার অনুভূতি তৈরি করেছিল। আর বাহানাগার কিশোর দেখল মৃত্যু এক্সপ্রেস করমণ্ডল। চারপাশে ছড়ানো ট্রেনের কামরা, মৃতদেহের সারি আর আহতের আর্তনাদ। সেদিনের ট্রেনযাত্রাকে আজ কোথায় এনে ফেলেছেন এদেশের রেলকর্তারা, সেটা কি নতুন করে বলে দিতে হবে!