বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

দেশ এগোচ্ছে নাকি ইতি গজ?

দেশ এগোচ্ছে নাকি ইতি গজ?

অশোক সরকার

photo

একই ভাবে প্রশ্ন ওঠে বিশ্বের পঞ্চম সবচেয়ে বড় অর্থনীতি কথার মানে কি? অথবা ৭% বার্ষিক অগ্রগতিরই বা কি মানে? দেশে বৈষম্য বাড়ছে কথাটারই বা মানে কি? আসুন সহজভাবে কতকগুলো মূল কথা বুঝে নেওয়া যাক।
এগোনো, পেছোনো, বড় ছোট – এসব মাপতে গেলে একটা সময়সীমা ঠিক করতেই হয়, এবং সেখানেই প্রথম ঝামেলা, কারণ এক এক রকমের তথ্য আলাদা আলাদা সময়ের ব্যবধানে সংগ্রহ করা হয়, তাই ঠিক শুরু-র থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কি হল তা বলা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য একটা রাস্তা আছে, আমরা যদি মোটামুটি অমুক সময়ের থেকে তমুক সময়ের ব্যবধানে কে এগোল কে পেছোলো দেখি তাতেই কাহিনীর মূল কথাটা ধরা পড়ে। আমরা তাই করব। দ্বিতীয় মুশকিল হল বড় ছোট, এগোনো পেছোনো মাপতে কার সঙ্গে তুলনা করব? আমেরিকার সঙ্গে? সে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল ২৫০ বছর আগে। না কি জাপানের সঙ্গে যে কোনও দিন পরাধীন ছিলই না। নাকি চীন, কোরিয়া প্রভৃতি কিছু দেশের সঙ্গে যারা প্রায় একই সময়ে স্বাধীন হয়েছিল, অথবা আমাদের চারপাশের দেশগুলির সঙ্গে? কার সঙ্গে তুলনা করব তারও কিছু ভিত্তি লাগে। আমরা এমন দেশের সঙ্গে তুলনা করব না, যাদের সঙ্গে আমাদের তুলনার কোনও ভিত্তি নেই।
এই দুই সতর্কবাণী সঙ্গে নিয়ে আমরা এগোতে পারি। হ্যাঁ দেশের অর্থনীতি যে এগোয়নি তা তো নয়। ১৯৯০ এর দশক থেকে একটানা দেশের জাতীয় গড় আয় প্রতি বছর ৩.৬% হারে বেড়েছে, এমনকি ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ৪.৫% হারে বেড়েছে, এটা কম কথা নয়। অবশ্য পড়শি দেশ চীনে ১৯৯০-র পর থেকে প্রতি বছর গড় আয় ৬% থেকে ৭% হারে বেড়েছে, এবং এখন চীনের গড় আয় ভারতের পাঁচ গুণেরও একটু বেশি। তবু ভারতের গড় আয়ের অগ্রগতি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। এর সঙ্গে দেখতে পাব জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি ও তার হার। একটা অনুপাত দিয়ে তা মাপা হয় সম্পদ ও আয়ের অনুপাত, এই অনুপাত যত বেশি হতে থাকে ততো ভাল। ভারতে ১৯৯৫ সালে এই অনুপাত ছিল ৩.৬, সেটা বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছে ৫.৮৫ যেটা খুবই উল্লেখযোগ্য।
অর্থনীতির সাইজ নিয়েও একই কথা। বিশ্ব ব্যাঙ্কের গত জুলাই মাসের হিসেব অনুযায়ী ভারতের জিডিপি ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, জার্মানি ৪.০ ট্রিলিয়ন ডলার, জাপান ৪.৩ ট্রিলিয়ন, চীন ১৭.৯ ট্রিলিয়ন ডলার, আর আমেরিকা ২৫.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। সেদিক থেকে দেখলে ভারত সত্যিই বিশ্বের পঞ্চম সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। কিন্তু এর মধ্যে প্যাঁচ আছে। ধরা যাক চীনের একজনের কাছে ১০০ রেনমিনবি আছে, আমার কাছেও ১০০ টাকা আছে। এই দুটি মুদ্রার মূল্য এক নয়। চীনে মানুষটি ১০০ রেনমিনবি দিয়ে যা কিনতে পারবে আমি ১০০টাকা দিয়ে তার চেয়ে বেশি বা কম জিনিস কিনতে পারব। কাজেই শুধু ডলার দিয়ে হিসেব করলে কিছুটা সত্য আড়াল হয়ে যায়। দরকার পড়ে ক্রয় ক্ষমতার সমন্বয় করে জিডিপি-কে দেখা, যাকে purchasing power parity বলে। এই হিসেবে দেখলে ভারত উঠে আসে তিন নম্বরে। চীন পৌঁছে যায় প্রথম স্থানে।
কিন্তু জিডিপি মানে আসলে কি? দেশের উৎপাদন, ব্যবসা, পরিষেবা, ও মানুষের দ্বারা ব্যয় থেকে যত মূল্য (value) তৈরি হচ্ছে তাকে টাকা বা ডলারের হিসাবে দেখলে মোট মূল্যটি হল জিডিপি। উৎপাদন, ব্যবসা, পরিষেবা বা খরচা তো মানুষই করে। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। জাপানের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ১০ কোটি, তারা তৈরি করছে ৪.৩ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্য, আর ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ৯৯ কোটি, তারা তৈরি করছে ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্য – এই দুটি তুলনীয়? চীনের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ৯৬ কোটি, তারা তৈরি করছে প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার, ভারতের পাঁচ গুণের বেশি, সেটাও কি তুলনীয়? মোটেই নয়। তাই বলা হয় জিডিপি আসলে প্রতি ব্যক্তির তৈরি মূল্যের নিরিখে তুলনা করতে হবে। মানে ব্যক্তি প্রতি জিডিপি। এই বিচারে ভারতের স্থান ১৩৬ নম্বরে, ক্রয় ক্ষমতার সমন্বয় করে দেখলে ১২৫ নম্বরে। এমনকি চীনও চলে যায় ৬৮ নম্বরে, ক্রয় ক্ষমতার সমন্বয়ে দেখলে ৬৫ নম্বরে। আমেরিকা চলে যায় ৬ নম্বরে।
কিন্তু এই সম্পদ বৃদ্ধি কোথা থেকে আসছে? দেখা যাচ্ছে ১৯৯১ সালে একজনই ভারতীয় ছিলেন যার সম্পদ ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি, সেটা ২০১১ সালে হল ৫২, এখন হয়েছেন ১৬২ জন। এঁদের সম্মিলিত নেট আয়ের পরিমাণ দেশের নেট জাতীয় আয়ের ২৫ ভাগের মত। ১৯৯১ সালে ১% মানুষ আয়কর দিতেন ২০২২ গিয়ে দেখছি ৯% মানুষ আয়কর দিচ্ছেন। জাতীয় সম্পদের ভাগভাগি করলে দেখব দেশের ১ ভাগ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের জাতীয় সম্পদের ৪০ ভাগ।
এই চিত্রটাকে অন্যভাবেও দেখা যায়। যদি ১০০ জন প্লেনে চাপেন আর ১০০টা ফ্লাইট চলাচল করে, তাহলে দেখা যাচ্ছে মাত্র এক ভাগ মানুষই ৪৫ ভাগ ফ্লাইটে চলাচল করছেন। দেশের মাত্র ৪ ভাগ মানুষ প্লেনে চাপছেন। মিউচিউয়াল ফান্ডে টাকা রাখছেন মাত্র ২.৬ ভাগ ভারতীয়, ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবহারকারীদের মাত্র সাড়ে ছয় ভাগ ৪৪ ভাগ ডিজিটাল পেমেন্টের অংশীদার, জোমাটোর খদ্দেরদের মাত্র ৫ ভাগই জমাটোর ৩৩ ভাগ অর্ডারের ভাগীদার। এক বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারীদের সম্মিলিত সম্পদ ২০১৪ থেকে ২০২২ – এই আট বছরে ১৮০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কিনা গড় জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির ১০ গুণ। অর্থাৎ দেশের একাংশ সত্যিই তরক্কি করেছে। এই একাংশ আসলে কতজন?
সেটা জানতে গেলে দেশের লোকের আয় ও সম্পদ মাপতে হয়। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি সাম্প্রতিককালে আয়ের আর সম্পদের অসাম্য – দুইই মাপতে চেষ্টা করেছেন। এই হিসেবে, ২০২২ সালে ৪৬ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক ভারতবাসীর মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় ছিল ৭১ হাজার টাকা, আরও প্রায় ৩৭ কোটি প্রাপ্তবয়স্কদের মাথা পিছু গড় বার্ষিক আয় ছিল ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। ৯ কোটি ২২ লক্ষ ভারতীয়ের মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় ছিল ১৩.৫০ লক্ষ টাকা, মাত্র ৯২ লক্ষের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় ছিল ৫৩ লক্ষ টাকা। এঁরাই হলেন সেই ১%। ৯২ লক্ষের মধ্যে মাত্র ৯ লক্ষ ২২ হাজারের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল ২ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা, আর মাত্র ৯২ হাজারের মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় ছিল ১০ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা। সবচেয়ে বিত্তশালী ৯২২৩ জনের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল ৪৮ কোটি টাকার বেশি। পিকেটি সম্পদের অসাম্যেরও হিসেব করেছেন। দেখা যাছে, প্রথম ৪৬ কোটি প্রাপ্তবয়স্কদের মাথাপিছু গড় সম্পদ ১ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকার মত, পরের ৩৭ কোটি প্রাপ্তবয়স্কদের মাথাপিছু গড় সম্পদ ৯ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা, তার পরের ৯ কোটি ২২ লক্ষের সম্পদ প্রায় ৮৮ লক্ষ টাকা, তার উপরে ৯২ লক্ষ ভারতীয়ের — মানে সেই ১%-এর সম্পদ ৫ কোটি ৪১ লক্ষ টাকার বেশি, আর তারই মধ্যে ৯ লক্ষ ২২ হাজার মানুষের সম্পদ ৪০ কোটি টাকার বেশি, ৯২ হাজার জনের মাথাপিছু গড় সম্পদ ৩০০ কোটি টাকার মত, আর মাত্র ৯২২৩ জনের মাথাপিছু গড় সম্পদ ২১৬০ কোটি টাকার মত।
এবারে কি কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে কে প্লেনে চাপছেন, কে মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা ঢালছেন, আর কে জোমাটোয় খাবার অর্ডার দিচ্ছেন? প্রথম ও দ্বিতীয় বর্গের মোট ৮৩ কোটি মানুষদের এই তালিকা থেকে সাধারণভাবে বাদ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া যে ছয় কোটি মত বেকার আছেন তাঁরা এই তালিকার বাইরে। বাকি যে প্রায় ১০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ রইলেন তাঁরা ও তাদের পরিবারেরাই দেশের অগ্রগতির মূল অংশীদার। এঁদেরই মধ্যে ১% ভারতীয় দেশের নেট আয়ের ২২% শতাংশের মালিক, তুলনায় চীনের ১% সে দেশের নেট আয়ের মাত্র ১১ শতাংশের মালিক। ১০% ভারতীয়রা আমাদের দেশের নেট আয়ের ৫৭% এর মালিক, চীনের ১০%, তাদের দেশের নেট আয়ের ৪৩% এর মালিক। ইউরোপ আমেরিকা জাপানের সঙ্গে তুলনা করাই যাবে না, কারণ সে সব দেশের ১% এবং ১০%-রা নেট আয়ের অতি সামান্য অংশের মালিক।
এর প্রতিফলন দেখা যায় জিডিপি-তে। ভারতের জিডিপির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আসে মানুষের খরচা থেকে, তুলনায় চীনের জিডিপি-র মাত্র ৩৮% শতাংশ আসে মানুষের খরচা থেকে। সব মিলিয়ে আসল গল্পটা এই যে ভারতের জনসংখ্যার একটা ক্ষুদ্র অংশ অনেক তরক্কি করেছে, তারাই জাতীয় আয়ের এবং জাতীয় সম্পদের সিংহ ভাগের মালিক। তারাই অনেক খরচা করছে, আর তাতেই জিডিপি বাড়ছে। বাকি ভারতবাসীকে বোঝানো হচ্ছে “তুমি না এগোলে কি হবে, দেশ তো এগিয়েছে”।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.