বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

সিলেবাসে ব্রাত্য রবীন্দ্রনাথ – হে মোর দুর্ভাগা দেশ!

সিলেবাসে ব্রাত্য রবীন্দ্রনাথ – হে মোর দুর্ভাগা দেশ!

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট, ২০২১— ৬-৮ জুলাই, ২০২১ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল এনসিইআরটি-র সিলেবাস অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশ বোর্ড তাদের সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ইংরেজি অনুবাদ, দার্শনিক ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণনের রচনা, ঐতিহাসিক এ এল ব্যাশমের (“ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া”-র লেখক) লেখা ইত্যাদি ডজন খানেক লেখা বাদ দিয়েছে। কারণ?

ঐতিহাসিকভাবে যে কোনও শাসনব্যবস্থা, অল্প কথায়, প্রাথমিকভাবে দুটি কাজে হাত দেয় – (১) ইতিহাসের পুনর্লিখন, এবং (২) শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাস পরিবর্তন। সিলেবাস পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী ফলাফল হচ্ছে কয়েক লক্ষ বা তারও বেশি ছাত্রছাত্রী কিছু সৃষ্টির কথা, কিছু নাম কখনওই জানবে না– প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। ভিন্ন আরেক ধরনের নাম এবং চরিত্র বুঝতে ও চিনতে শিখবে। রাষ্ট্র তার দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী সুবোধ, সুশীল, অনুগত ও বাধ্য ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরির কৃৎ-কৌশল চালু রাখতে পারবে যতদিন না ক্ষমতার ধরন বদলায়। এবং আমাদের সাধারণ সহজ বুদ্ধিতে বোঝা যায় এ প্রক্রিয়াটি এক টিউৎপাদন যন্ত্রের মতো – এক বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামত ক্রমাগত উৎপাদন করেই চলবে, ছড়িয়ে যাবে পরিবারে এবং পারিপার্শ্বিকতায়।

কিন্তু আর সবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও যখন বাতিল হয়ে যান তখন বিস্মিত হতে হয় বৈকি। হাজার হোক তিনি প্রতিবেশী দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, ভারতের প্রথম নোবেল বিজয়ী এবং বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানের জন্মদাতা। তাহলে কি তাঁর সম্প্রদায় নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং ইতিহাসের বোধ ও জীবনবীক্ষা বর্তমান ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনায় বৌদ্ধিক সমস্যা তৈরি করছে?

বেশ কিছুদিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর একটি প্রবন্ধ ‘যেন লজ্জা স্বীকার করি’ (১৮.০১.২১)। মূলত তিনটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি – (১) ‘ফেক নিউজ’, (২) খণ্ডিত উদ্ধৃতি – বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মতো স্রষ্টার যাঁর সৃষ্টিসম্ভার বিপুল, এবং (৩) ইতিহাসের কোনও বিশেষ সময়ক্রমে কোনও উক্তি বা বক্তব্য জন্ম নিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে। তৃতীয় ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত উদাহরণ হিসেবে তিনি ১৯২১-এর মোপলা বিদ্রোহ, ১৯২১এর কিছু হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ১৯২৫-২৬এর ‘কাজিয়া তুঙ্গে’ ওঠার প্রসঙ্গ এনেছেন। সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন “একটি সাময়িকভাবে শান্ত বছরে চিঠিটি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ।”

এ প্রসঙ্গের সূত্র ধরে প্রাক-উপনিবেশিক ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের চালচিত্র বোঝার চেষ্টা করা যায়, ইতিহাস ও কল্প-কাহিনির (মিথ) মধ্যেকার সম্পর্কের পুনর্বিবেচনাও করা যায়। তেমনি বিপরীত পথে ধূর্ত পায়ে হেঁটে ইতিহাসের মধ্যে পুরাণ, কল্প-কাহিনির উপাদান নতুন করে প্রবিষ্ট করানো যায়। এর ফলে অতি সহজে বিশ্বাস করার বা শক্তিশালী গুজবে প্রভাবিত হবার মতো মানুষের মাঝে কোনটি ইতিহাস আর কোনটিই বা ‘ফেক নিউজ’ তথা মশলাদার কল্প-কাহিনি এ বিভাজনরেখা অস্পষ্ট হয়যায় শুধু দুটি কাজ নিষ্ঠাভরে করে গেলে – প্রথম, ফেক নিউজ নিরন্তর, ছেদহীনভাবে তৈরি করে যেতে হবে; দ্বিতীয়, ‘নির্মিত’ খবরগুলোকে অবিরত এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে দিতে হবে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে। যদিও একাজের জন্য একটি তৃণমূল স্তর পর্যন্ত প্রসারিত ও সজীব রেজিমেন্টেড সংগঠন থাকতে হবে, যা এখন আমরা ভারতবর্ষে প্রতিমুহূর্তে বিপজ্জনকভাবে প্রত্যক্ষ করছি। সাম্প্রতিক সময়ে অড্রে টুসকের লেখা দ্য ল্যাঙ্গোয়েজ অফ হিস্টরি: স্যান্সক্রিট ন্যারেটিভ অফ মুসলিম পাস্টস বইটি শাসকশ্রেণীর পক্ষে কিছু অস্বস্তিকর তথ্য উদ্ঘাটিত করেছে।“হিন্দু-মুসলিম” সম্পর্কের ক্ষেত্রে টুসকে সংস্কৃতে লেখা আখ্যানে ব্যবহৃত শব্দভাণ্ডারের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখিয়েছেন যে প্রাক-আধুনিক অতীতে সমাজকে হিন্দু-মুসলমান দ্বিত্বতায় দেখা হত না। এটা অনেক পরের নির্মাণ।

ফেক নিউজ – সামান্য কথা

নেচার জার্নালে প্রকাশিত নোয়েবল ম্যাগাজিন-এর একটি সংবাদ “Synthetic Media: The Real Trouble with Deep Fakes”(১৬.০৩.২০২০) বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করে জানায় যে এসমস্ত ছবি হল “deep fakes” – গভীর মিথ্যে। এগুলো হচ্ছে কম্পিউটারে তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত মিথ্যেকে সত্যি করে দেখানো ছবি। আপনি নিজেও নিজের সিন্থেটিক ছবি ThisPersonDoesNot Exist.com-এ তৈরি করতে পারেন। বায়োলজির দিক থেকে এটা বলার কথা যে যত বেশি মানুষ উপরিস্তরের নিউরনের কাজের মধ্যে আটকে থাকবে তত বেশি গুজব এবং মিথ্যের বাতাবরণ ফনফনিয়ে বেড়ে উঠবে। নিউরনের পাশে শুয়ে থাকা গ্লায়াল কোষের কাজ যত কম হবে তত মানুষের গভীরে গিয়ে ভাবার ইচ্ছে এবং ক্ষমতা কমবে। এতে রাষ্ট্র মানুষ-পিণ্ড তৈরি করতে পারবে যারা প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। শুধু দৌড়ে চলে নির্মিত মিথ্যা, অর্ধসত্য বা গুজবের পেছনে – নিজের মধ্যে আত্মীকরণও করে নেয়। যদি নিপুণতার সঙ্গে এই কাজটি ছেদহীনভাবে করা হয় তাহলে জনমানসে গুজব গেলানোর সঙ্গে ভোটের ঈপ্সিত ফলাফলের একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক তৈরি করা যায়।

ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে কীভাবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রামের মতো মাধ্যম ২০১৪ আর ২০১৯-এর নির্বাচনের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা ধরা আছে সিরিল স্যাম এবং পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার লেখা দ্য রিয়্যাল ফেসঅফ ফেসবুক (২০১৯) গ্রন্থে। সাংবাদিক রবীশ কুমার তাঁর দ্য ফ্রি ভয়েস গ্রন্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রেখেছেন – “বর্তমান সময়ে নাগরিকদের মাঝে এক নতুন প্রবণতা জন্ম নিচ্ছে ... যখন একজন ভোটার একজন নেতার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, সেসময়ে সে আর সাধারণ জনতা থাকে না, এমনকি একজন ভোটারও থাকেনা। তখন এক ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যাওয়া একটি ধূলিকণায় পর্যবসিত হয়।”

নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় রোমিলা থাপার একটি আমন্ত্রিত প্রবন্ধে (“They Peddle Myths and Call It History”, ১৭ মে, ২০১৯) বলেন – “জাতীয়তাবাদীরা একটা গ্রহণযোগ্য ইতিহাস নির্মাণ করে যেখানে এই রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে তাদের অবদানকে ইতিহাসে আনা হয় যাদেরকে এরা প্রয়োজনীয় মনে করে; অতি জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজন তাদের নিজস্ব এবং বিশেষ ধরনের ইতিহাস যেখানে এরা বর্তমানে যা করছে তাকে অতীত দিয়ে বৈধ করে তোলা যায়। ভারতের ইতিহাসের পুনর্লিখন এবং ইতিহাসের এই ভার্সনটিকে স্কুল-কলেজে শিক্ষার মধ্য দিয়ে চারিয়ে দেওয়া হল এদের মতাদর্শের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ... মুসলিম এবং হিন্দু উভয় জাতীয়তাবাদেরই শেকড় রয়েছে ব্রিটিশদের ভারতকে নিয়ে উপনিবেশিক বোঝাপড়ার মধ্যে।”

রবীন্দ্রনাথের চিঠি এবং অন্যান্য

১৯৪৬ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর চতুর্বিংশ খণ্ডে ৩৭৪ থেকে ৩৭৭ পাতা জুড়ে রয়েছে কালিদাস নাগকে লেখার বীন্দ্রনাথের চিঠিটি যা দীপেশ চক্রবর্তীর আলোচনার ভরকেন্দ্র। পরে এই চিঠিটি “কালান্তর’ সংকলনে সংকলিত হয়। সে চিঠিটি শুরু হচ্ছে এভাবে – “ঘোর বাদল নেমেছে। তাই আমার মনটা মানব-ইতিহাসের শতাব্দী চিহ্নিত বেড়ার ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছে।” এরপরে লিখছেন – “ঠিক এমন সময় সমুদ্রপার হতে তোমার প্রশ্ন এল, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কী। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মানব সংসারে আমার কাজ আছে – শুধু মেঘমল্লারে মেঘের ডাকের জবাব দিয়ে চলবে না, মানব-ইতিহাসের যে-সমস্ত মেঘমন্দ্র প্রশ্নাবলী আছে তারও উত্তর ভাবতে হবে। তাই অম্বুবাচীর আসর পরিত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে হল।”

এখানে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন – “পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র – সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান-ধর্ম।” এরপরে – “অপরপক্ষে হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয় – অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent non-co-operation। হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরও কঠিন। মুসলমান ধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ।” আরও বললেন – “আধুনিক হিন্দুধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল – এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যান। সকল প্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু-মুসলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই। আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত।” এ অংশটি আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সমান সত্যি! যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায় তারা পৃথক, বাধাগ্রস্ত। তাদেরকে পৃথক করে বাধা দেবার এক প্রবল রাষ্ট্রিক উদ্যোগ দুর্মর বেগে সমাজকে প্লাবিত করছে।

পরে “হিন্দু মুসলমান” প্রবন্ধে বলছেন – “আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তাঁর বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলেম, ‘এ কেন’ তখন জবাব পেলেম, যে-সব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসাতেও হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে এসেছে; অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে, হিন্দুও মেনে এসেছে। জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে।” “কোট বা চাপকান” প্রবন্ধে বললেন – “এক্ষণে যদি ভারতবর্ষীয় জাতি বলিয়া একটা জাতি দাঁড়াইয়া যায়, তবে তাহা কোনও মতেই মুসলমানকে বাদ দিয়া হইবে না। যদি বিধাতার কৃপায় কোনও দিন সহস্র অনৈক্যের দ্বারা খণ্ডিত হিন্দুরা এক হইতে পারে, তবে হিন্দুর সহিত মুসলমানের এক হওয়াও বিচিত্র হইবে না। হিন্দু মুসলমানের ধর্মে না-ও মিলিতে পারে, কিন্তু জনবন্ধনে মিলিবে— আমাদের শিক্ষা আমাদের চেষ্টা আমাদের মহৎ স্বার্থ সেই দিকে অনবরত কাজ করিতেছে।অতএব যে বেশ আমাদের জাতীয় বেশ হইবে তাহা হিন্দুমুসলমানের বেশ।”

“কালান্তর” সংকলনে লিখলেন – “আমার অধিকাংশ প্রজাইমুসলমান। কোরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করিনি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিল। আমাদের সেখানে এপর্যন্ত কোনও উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন।”

প্রাক-উপনিবেশিক এবং উপনিবেশিক যুগে সাম্প্রদায়িকতার সংক্ষিপ্ত চেহারা

সি এ বেইলি ১৯৯৫ সালে মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ-এ প্রকাশিত তাঁর “The Pre-history of ‘Communalism’? Religious Conflict in India, 1700-1860” প্রবন্ধে দেখাচ্ছেন যে প্রাক-উপনিবেশিক সময়ে ও সমাজে ধর্মীয় সংঘাত থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রেই, অন্তত ১৮২০ পর্যন্ত, তা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের চেহারা নিয়েছে। অর্থাৎ, ধর্মীয় দূরত্ব মানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এরকম কোনও সরল সমীকরণ করার যাথার্থ্য নেই। তিনি ঐতিহাসিকভাবে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যুদ্ধজীবী (warbands) রাজপুত শ্রেষ্ঠদের হারেমে মুসলমান রমণীদের রাখা হত। এবং এই প্রথা উলেমাদের অসীম বিরক্তির কারণ ছিল। দেখিয়েছেন হিন্দুরা যেমন বহু ক্ষেত্রে মসজিদ রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে, তেমনি মুসলমান সুলতানরাও বহু মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এমনকি শিখেরা গুরুদ্বারের মধ্যে মসজিদও বানিয়েছে। জমি নিয়ে যুদ্ধ কীভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে উঠলো? অনেক কারণের মধ্যে সম্ভাব্য একটি কারণ, বেইলির মতে, গোঁড়া জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। হিন্দুমুসলমান সম্পর্কের প্রসঙ্গে ইংরেজ শাসনের একেবারে গোড়ার দিকে যারা বিভিন্নভাবে লিখেছেন সেই শ্রীরামপুরের ত্রয়ী কেরি-মার্শমম্যান-ওয়ার্ডের একজন উইলিয়াম ওয়ার্ড। তাঁর লেখা পুস্তক (শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮সালে ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়) হল A View of the History, Literature, and Mythology, of The Hindoos-এ বলছেন – কলকাতার কুখ্যাত এবং লম্পট চরিত্রসম্পন্ন বাড়ির সংখ্যা অবিশ্বাস্য – “কয়েক বছর আগে ক্ষত্রিয় জাতের হিন্দু রাজারা ইংরেজ উপপত্নী রাখতো, এবং পরবর্তী সময়ে মুসলিম রমণীর পরিবারকেও পুষতো। এদের পুত্রদের হিন্দুমতে পৈতাও দেওয়া হয়েছিল এবং সবার বিয়ে হয়েছিল হিন্দুদের সঙ্গে। চারপাশের সমস্ত হিন্দু এই মহিলার বাড়িতে রান্না হওয়া খাবার খেতো। ফলে শাস্ত্রাচারীদের মতে কয়েক হাজার হিন্দুর জাত খোয়া গিয়েছিল।”

ওয়ার্ড একথাও জানাচ্ছেন যে কলকাতা, ঢাকা, পাটনা, মুর্শিদাবাদের মতো বড়ো শহরগুলোতে অনেক ধনী হিন্দুর মুসলিম উপপত্নীর সঙ্গে সহবাস করে এবং “নীচুতলার মানুষদের মাঝে সব ধরনের মেলামেশা খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল।” (১ম খণ্ড, পৃ:২১০)। স্মরণে রাখবো, ওয়ার্ড পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে কিংবা নৌকোয় করে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামের অভ্যন্তরে মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশেছেন। ফলে ঊনিশ শতকের শুরুতে তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ফেলে দেবার মতো নয়।পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ইতিহাসের উত্তরাধিকার” (নিম্নবর্গের ইতিহাস, ১৯৯৮, পৃ: ১২১-১৬০) প্রবন্ধে বলছেন –“সেকুলার ইতিহাস চর্চার সংকট এইখানেই – আজকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয়তার ইতিহাসের সামঞ্জস্য আনা। সংকট এই জন্য যে জাতীয়তার যে ইতিহাস গত শতাব্দী থেকে লেখা হয়ে এসেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে এমন সব কাহিনি, ধারণা, ব্যাখ্যা যা আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের প্রধান উপাদান।” ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের রাজাবলী (১৮০৮) দিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনা শুরু। রাজাবলী কার্যত পৌরাণিক উপাদান সমৃদ্ধ হিন্দু বিবরণ বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। এই বইটি নিয়ে উইলিয়াম ওয়ার্ডও তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। (পৃ: ২৬)“আলোকপ্রাপ্ত” ওয়ার্ডেরও নজরে এসেছে রাজাবলী-র ইতিহাসের ঢংয়ে পৌরাণিক চরিত্র এবং প্রধানত হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের কাহিনি বলা। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন – “বঙ্কিমের যুগে এসে পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক কালের মধ্যে যে তফাৎ করা হবে, পৌরাণিক বিবরণের থেকে ইতিহাসের মালমসলা বের করার পদ্ধতি নিয়ে যে আলোচনা হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তায় তার আভাসটুকুও নেই।” মৃত্যুঞ্জয়ের মতো যারা উপনিবেশিক কালে ইতিহাস রচনা করেছেন তারা হিন্দু গরিমায় উজ্জ্বল একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি গড়ে নেওয়ার কাজ করেছেন। বিপরীতদিকে, মুসলমান রচয়িতা যারা তাদের কাছে মক্কা এবং মহম্মদের গরিমা কীর্তন প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম ভাবে যেখানে ইতিহাস লেখার একটি জাতীয়তাবাদী তথা হিন্দু ইতিহাস লেখার উদ্যোগ শুরু হল সেখানে, পার্থ প্রশ্ন করছেন, “তাহলে হিন্দু নয় অথচ ভারতের অধিবাসী, এমন জনগোষ্ঠীর স্থান কোথায়?”

তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৫৮ থেকে ১৮৭৮ সালের মধ্যে ১৮টি সংস্করণ হয়েছিল) আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন – “রাষ্ট্র সার্বভৌমত্বের আধুনিক চিহ্ন রামচন্দ্রের হাতে পতপত করে উড়ছে, এ-ছবি একশো বছর আগের ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ব্রাহ্মণের কল্পনায় সহজেই এসে গিয়েছিল।” জাতীয়তাবাদীর কাছে প্রাচীন ভারত হয়ে উঠল তার ক্ল্যাসিকাল আদর্শ। বেইলি তাঁর লেখায় যে ইঙ্গিত করেছিলেন জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনও অসঙ্গতি নেই বরঞ্চ সাযুজ্যপূর্ণ, সেকথাই অন্যভাবে পার্থর বিশ্লেষণেআমরা দেখতে পাচ্ছি। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই জাতীয়তাবাদী চেতনায় ইতিহাস রচনার সঙ্গেই সংপৃক্ত হয়ে আছে সাম্প্রদায়িক বোধের বিকাশ। পার্থর পর্যবেক্ষণে – “বস্তুত জাতীয়তার অর্থ হিন্দু জাতীয়তা, এই ধারণাটিকে কোনও প্রাক-আধুনিক ধর্মীয় মতাদর্শের বলে ভাবলে মারাত্মক ভুল করা হবে। ধারণাটি সম্পূর্ণ আধুনিক। আধুনিক অর্থেই তা যুক্তিবাদী; অযৌক্তিক আচার-ব্যবহার কুসংস্কার বিরোধী। আধুনিকঅর্থেই তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক; রাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কট্টরপন্থী এবং সমাজনীতি নির্ণয়ও সংস্কারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী।” (পৃ:১৫৩)। এখানেই এই “নির্মিত” ইতিহাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসবোধ, নেশন তথা রাষ্ট্রিক চেতনা এবং সমাজে মুক্ত মানুষের ভূমিকার বোধের মাঝে অনপেনয় দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথকে ফেলাও যায় না, গেলাও যায় না, আবার রাখাও যায় না। ফলে রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের মতো করে আত্মীকরণের জন্য টুকরো টুকরো অংশে ভেঙ্গে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা জরুরি হয়।

ইতিহাস রচনার তাত্ত্বিক এবং বৌদ্ধিক পরিসরের বাইরে ছিল ব্যবহারিক দিক – উপনিবেশ সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পরে। কলকাতা থেকে ঊনিশ শতকের শুরুর দিক থেকে ফার্সিতে সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং নরমপন্থী সংবাদপত্র ছিল জাম-ই-জাহান-নুমা। ১৮৪৫ পর্যন্ত এই সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। (এ এফ সালাহউদ্দিন আহমেদ, সোশ্যাল আইডিয়াজ অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল – ১৮১৮-১৮৩৫, প্যাপিরাস, ২০০৩, পৃ: ১২৭) কোর্টের ভাষা ছিল ফার্সি। পরিণতিতে, ইংরেজিতে শিক্ষিত হিন্দুদের ফার্সি আয়ত্ত্ব করা আবশ্যিক ছিল। হিন্দুদের ক্ষেত্রে এটা অসন্তোষ এবং বিরোধিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। মে, ১৮২৮-এ ইংরেজ সরকার পয়সা বাঁচানোর জন্য ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোর subscription বন্ধ করে দেয়। (প্রাগুক্ত, পৃ:১৩২) ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫-এ হিন্দু কলেজের পরিচালকবৃন্দ সহ কলকাতার ৬,৯৪৫ জন অধিবাসী (এর মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকেরাও ছিল) উইলিয়াম বেন্টিককে স্মারকলিপি দেয় যেখানে বলা হয় কোর্টে ইংরেজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা আছে তুলে নেওয়া হোক। স্মারকলিপি প্রদানকারীরা উল্লেখ করে যে ফার্সি “as foreign to the natives of Bengal as to their rulers”। এসবের ফলশ্রুতিতে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি জুডিশিয়াল ডেসপ্যাচে (২৬ জুন, ১৮৩৫) ফার্সিকে ভাষার ব্যবহারিক মাধ্যম হিসেবে বিলোপ করা হয়। (প্রাগুক্ত, পৃ: ২০৪)এর বিপরীত একটি ঘটনাও ঘটেছিল। সে বছরেই (১৮৩৫) ফার্সিতে ৮,৩১২ জন মুসলিম অধিবাসীর স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয় – “Petition on behalf of the Muslims of Calcutta against the Proposed Abolition of Madrasa”। (প্রাগুক্ত, পৃ: ২৬৪-২৬৭) কিন্তু সংখ্যাধিক্য থাকা সত্বেও ফলপ্রসূ হল না। একদিকে ভাষা হিসেবে ফার্সি নির্বাসিত হল, অন্যদিকে শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ইংরেজের তৈরি মাদ্রাসা ইংরেজদেরই সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে গেল। মুসলিম সমাজের গণমানসিকতায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়লো। শুধু মাদ্রাসাই নয় ১৮৩৫-এ ভারতের প্রথম আধুনিক মেডিক্যাল স্কুল “নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন”ও বন্ধ হয়ে গেল। সংস্কৃত কলেজ বা হিন্দু কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষিত হিন্দুদের ওপর যে রকম প্রভাব পড়ত, এ প্রভাবও সেরকম। মুসলিম মানসিকতায় “অপর” নির্মিত হতে শুরু করল – একদিকে হিন্দু, অন্যদিকে ইংরেজ।

আবার রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলন কালান্তর প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৭এ বিশ্বভারতী থেকে। এই সময়কাল জুড়ে একাধিক ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। এ সংকলনের “হিন্দুমুসলমান” প্রবন্ধে স্পষ্টভাবে বললেন – “যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ।” (পৃ: ৩২৮-২৯) অন্য আরেকটি প্রবন্ধ “স্বামী শ্রদ্ধানন্দ”-তে তিনি বলছেন –“আজকে দেখতে হবে, আমাদের হিন্দু সমাজের কোথায় কোন ছিদ্র, কোন্ পাপ আছে; অতি নির্মমভাবে তাকে আক্রমণ করা চাই।... আমাদের পক্ষে এ বড়ো সহজ কথা নয়। কেননা, অন্তরের মধ্যে বহু কালের অভ্যস্ত ভেদবুদ্ধি, বাইরেও বহু দিনের গড়া অতি কঠিন ভেদের প্রাচীর।... আমাদের মধ্যে কত ছোটো ছোটো সম্প্রদায়, কত গণ্ডী, কত প্রাদেশিকতা– উত্তীর্ণ হয়ে কে আসবে?” (পৃ: ৩২৪-২৫)

এ সত্যকে কি আমরা স্বীকার করতে পারব? কিংবা প্রত্যেকের নিজের আত্মচিহ্ন মুছে ফেলে একটি সমস্বত্ত্ব রাষ্ট্রিক সংস্কৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাব? রবীন্দ্রনাথ আমাদের বড়ো শক্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.