বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
অপরাধ সংক্রান্ত তিনটি আইন বদল হয়েছে। অপরাধের সংজ্ঞা ও তার শাস্তি সংক্রান্ত আইন, নাম ছিল ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, বদলে হল ভারতীয় ন্যায় সংহিতা। অপরাধ ঘটলে কি উপায়ে তার অনুসন্ধান হবে, বিচার হবে, অভিযুক্তের ও পুলিশের কি অধিকার ও কর্তব্য থাকবে ইত্যাদি নিয়ে আইন — আগে নাম ছিল ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড, এখন হল ভারতীয় ন্যায় সুরক্ষা সংহিতা, আর তৃতীয় আইন ছিল সাক্ষ্য প্রমাণ বিষয়ক। আগে নাম ছিল ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, এখন হল ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম।
যা হল তা ভাল হল, না মন্দ হল তা ঠিক করতে গেলে কাকে ভাল কাকে মন্দ বলে, সেটাই তো আগে স্পষ্ট করতে হয়।
অপরাধ কাকে বলে? সমাজ ও রাষ্ট্রে তিন রকম অপরাধ আছে। এক ধরনের অপরাধ সর্বজন স্বীকৃত, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে তা নিয়ে সহমত আছে। যেমন চুরি, ধর্ষণ, ডাকাতি, লুট, ইত্যাদি। সমাজ আর রাষ্ট্রের মধ্যে এই অপরাধ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই, শাস্তির ব্যাপকতা বা গভীরতা নিয়ে কথা হতে পারে। কেউ বলবেন, ধর্ষণে চাই মৃত্যুদণ্ড, কেউ বলবেন আজীবন কারাবাস, কেউ বা অন্য কিছু। আরেক ধরনের অপরাধ আছে যা সমাজের বিভিন্ন অংশে দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু রাষ্ট্র তাকে অপরাধ বলে স্বীকার করতে পারে না। যেমন অনার কিলিং। জাঠ সমাজে আছে। ভিন্ন জাতে বিয়ে করলে তা অপরাধ বলে ধরে নেওয়া হয়, ভারতের রাষ্ট্র তা অপরাধ বলে স্বীকার করে না। কিন্তু অনার কিলিংকে অপরাধ বলে স্বীকার করে কি? তেমনি আদিবাসী সমাজে আছে ডাইনি প্রথা। কাউকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করলে সমাজে সে অপরাধী হয়ে যায়, তার গুরুতর শাস্তি হয়। এই প্রথা কি রাষ্ট্র সমর্থন করতে পারে? সমাজে দলিত ও আদিবাসীদের উপর যে মানসিক, পার্থিব (জমি কেড়ে নেওয়া) ও শারীরিক অত্যাচার হয়, তা কি অপরাধ বলে স্বীকৃত? হ্যাঁ SC-ST Atrocities (prevention) Act 1969 অনুযায়ী তা অপরাধ। কিন্তু এই তিনটের কোনওটাই নতুন আইনে অপরাধ বলে স্বীকৃত নয়। আগেও ছিল না। তৃতীয় ধরনের অপরাধ হল রাজনৈতিক। তার মধ্যে পড়ে উগ্রপন্থা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এই নিয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক দ্বিমত আছে।
অপরাধের তালিকায় সে সব সংযোজন হয়েছে তাতে সমাজের একাংশের ভাবনার সঙ্গে রাষ্ট্রের ভাবনা মিলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। যেমন ভিন্ন ধর্মের ছেলে ও মেয়ের বিয়ে সমাজ স্বীকার করে না। রাষ্ট্র এতদিন করত। এখন ঘুরপথে তা আটকানোর চেষ্টা হয়েছে, ৬৯ নম্বর ধারায়। কোনও অছিলায় যদি যৌন সংসর্গ হয়, তাহলে ১০ বছর জেল যোগ্য। অছিলা প্রমাণ করা কঠিন কিন্তু সেই অভিযোগে গ্রেপ্তার করে বিচারাধীন বন্দি করে রেখে দেওয়া সহজ। আবার ডাকাতি, অপহরণ, গাড়ি চুরি, জুলুমবাজি, কন্ট্রাক্ট কিলিং, ইত্যাদি ‘সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ’ (organized crime) বলে স্বীকার করা হয়েছে। সমাজও সাধারণত তাই ভাবে, তাই ধরা পড়লে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে সেই ‘অপরাধী’কে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। রাষ্ট্রও এ সব ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাবাসের ব্যবস্থা করেছে। এমনকি ‘লোভে’ পড়ে সন্তান বিক্রি করে দেওয়াকেও মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তির যোগ্য বলা হয়েছে। অন্য দিকে ভিড় দ্বারা হত্যাকেও (mob lynching) অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে, সেই অপরাধে ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ আজীবন কারাবাসের বন্দোবস্ত আছে। বোঝাই যাচ্ছে সমাজের একাংশের মতো রাষ্ট্রও এ ব্যাপারে নরম মনোভাব নিয়েছে। রাজনৈতিক অপরাধের বেলায় রাজদ্রোহ কথাটা বাদ গেছে তার বদলে এসেছে ভারতের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংহতি ক্ষুণ্ণ হওয়াটা জঘন্যতম অপরাধ। নামটা নেই, মানেটা আছে! মোট ৫১১টি ধারার পেনাল কোডের ২৩টি ধারা বাদ গেছে, আর ২৪টি ধারা যুক্ত হয়েছে। বাকি সবটাই কপি পেস্ট!
এতো গেল অপরাধ ও তার শাস্তির কথা। এবার ন্যায় সুরক্ষা সংহিতার কথায় আসি। এই আইনটি অভিযুক্ত আর পুলিশের অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ক। এখানে তো সুস্পষ্টভাবে পুলিশের অধিকার, অভিযুক্তের অধিকারের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। ১৫ দিনের বদলে ৯০ দিন পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখা যাবে, এফআইআর, পুলিশ রিপোর্ট, চার্জশিট ফাইল হবার ১৪ দিন বাদে অভিযুক্তকে তার কপি দেওয়া যাবে। নাগরিক চাইলেই পুলিশ এফআইআর নাও নিতে পারে, পুলিশ বলতেই পারে ‘আমরা অনুসন্ধান করে ১৪ দিন বাদে জানাব’। আগের আইনে বিচারাধীন অবস্থায় কোনও অভিযুক্ত যদি সর্বোচ্চ সাজার আধা সময় বন্দি অবস্থায় থাকে তাহলে সে অবশ্যই জামিন পেত, সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। হাতকড়া পরানোর ব্যবস্থা ফেরত এসেছে। বদলি হয়ে যাওয়া পুলিশ অফিসারের সংগৃহীত সাক্ষ্য আদালতে পেশ করা যাবে কিন্তু সেই বদলি হওয়া অফিসারকে আদালতে হাজির হতে হবে না, ফলে তাকে পালটা প্রশ্ন করা যাবে না। এই রকম অজস্র পুলিশকেন্দ্রিক ধারায় ভর্তি, এই সংহিতা। এটা পুলিশের সুরক্ষা সংহিতা, নাগরিকের নয়। এটা আসলে চটপট শাস্তি দেওয়ার সংহিতা।
কিন্তু সমস্যা আর অনেক গভীরে। পেনাল কোড ও প্রসিডিউর কোড নিয়ে আদালতে অনেক মামলা হয়েছে, আদালতের বিচার থেকে ঐ দুটি আইন অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। সেই সমস্ত শিক্ষাকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে এই দুটি আইন। আইনের খসড়া বানানোর কমিটিতে একজনই উকিল ছিলেন হরিশ সাল্ভে বাকি সবাই ছিলেন আইনের শিক্ষক, আর দু’ একজন আমলা। তাছাড়া উপনিবেশিক সময়ের পেনাল কোড আর ১৯৭৩ এর প্রসিডিওর কোড অনুসরণ করেই তো আজকের তারিখে (৫ই আগস্ট ২০২৪) ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ফৌজদারি মামলা দেশের আদালতগুলিতে ঝুলে আছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা মামলা এক কোটি ১২ লক্ষের বেশি। ২০২২ সালের হিসেবে, চার লক্ষ ৩৪ হাজার বিচারাধীন বন্দি জেলে পচছে, এরা মোট বন্দির ৭৬%। নতুন আইনগুলিতে ঝুলে থাকা মামলা ও বিচারাধীন বন্দি কমবে এমন কোনও ভরসা নেই। সে বিষয়ে কোন কথাই নেই।
ন্যায় বিচারের চারটি ভিত্তি আছে। প্রথমটিকে বলা হয় Access to Justice, অর্থাৎ ন্যায় বিচারের দ্বার প্রশস্ত কিনা। নাগরিক চাইলে সহজপ্রাপ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায় বিচার পেতে পারে কিনা। এর মধ্যে অনেক কিছু আসে। সহজে এফআইআর হবে কিনা, পুলিশ তাকে হয়রানি করবে কিনা, পুলিশ কি করছে তার কাছে স্পষ্ট থাকবে কিনা, সহজে উকিল পাবে না, উকিলরা কি করছে তার উপর অভিযোগকারীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কিনা, আদালতে মামলা সহজে উঠবে কিনা, আদালতের কথাবার্তা তার বোধগম্য হবে কিনা, সে কোনও কথা বলার হলে বলতে পারবে কিনা আরও অনেক কিছু। দ্বিতীয় হল ন্যায় বিচারের খরচা, মানে Cost of Justice। দ্বার প্রশস্ত হবার সঙ্গে এটি জড়িত। ন্যায় বিচারের দরজা যদি খোলা হয় কিন্তু তা যদি সামর্থ্যের বাইরে হয় তাহলে পরিণতি একই হবে। ন্যায় বিচারের খরচা মানে শুধু উকিলের খরচা নয়, পুলিশ, উকিল আদালত, সময়, যাতায়াত, ইত্যাদি অনেক রকমের খরচা। তৃতীয় হল ন্যায় বিচার পেতে কত দিন লাগবে, অর্থাৎ Efficiency of Justice। যত দিন যাবে তত খরচা বাড়বে, দ্বারও রুদ্ধ হবে। আর চতুর্থ হল Fairness of Justice, অর্থাৎ সত্যিই ন্যায় বিচার হবে কিনা।
এই চারটি আধারে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থাকে দেখলে দেখব এর কোনওটাই সাধারণ নাগরিকের হাতের নাগালে নয়। প্রথমত ন্যায় বিচারের দ্বার প্রশস্ত নয়, বিশেষত আদিবাসী দলিত, মহিলা, সংখ্যালঘু ও ওবিসিদের কাছে তো নয়ই। অথচ তারাই দেশের ৭৫ ভাগ। পুলিশ এফআইআর নেবে না, অনুসন্ধান করবে না, কেস ফেলে রাখবে, উকিল আদালতের কাছে একের পর এক তারিখ নিয়ে যাবে, আদালতও খুশিমনে তারিখ দিতে দিতে কসুর করবে না, সে যদি অভিযুক্ত হয়, জামিন পাবে না, অথবা যার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ সে জামিন পেয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, খরচা সম্পর্কে চালু কথা হল, বাঘে ছুলে ১৮ ঘা, উকিল ছুলে ২১ ঘা। আর সময়? সে তো আমাদের সমাজের বিশ্বাসের মতোই অনন্ত। তথ্য দেখাচ্ছে, এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত ঝুলে থাকা ফৌজদারি মামলা ৮০ লক্ষ, ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত ঝুলে থাকা মামলা ৪৮ লক্ষ, দশ থেকে কুড়ি বছর ঝুলে আছে এমন মামলা ৩০ লক্ষ। আর ন্যায়বিচার? সেটা বলা মুশকিল কারণ বিচারের আগেই তো জেল খাটা হয়ে গেছে। ন্যায় বিচার হল কি না হল কি এসে গেল?