বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

হিজাব এবং ভারত

হিজাব এবং ভারত

কবিতা রায়চৌধুরী

photo

শ্রমজীবী ভাষা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— হিজাব পরিধান মুসলমান নারীর ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অঙ্গ। স্বাধীন দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে সে হিজাব পরবে কি পরবে না তা একান্তই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি কর্ণাটকের মাণ্ডা প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজের একটি ভিডিও নেটমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিও-টিতে দেখা যায়, হিজাব পরিহিত এক ছাত্রীর দিকে তেড়ে যাচ্ছে গেরুয়া উত্তরীয় পরিহিত একদল যুবক, যাদের মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। এর আগে আরও চারজন বোরখাপরিহিত ছাত্রীকে কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় এবং কলেজের অধ্যক্ষের হস্তক্ষেপের ফলে অবশেষে তারা প্রবেশের অনুমতি পায়। যে সব স্কুল–কলেজে ইউনিফর্ম আছে সেসব স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা ইউনিফর্ম পরেই ক্লাশে আসে, সেটাই নিয়ম। কিন্তু যেখানে পোষাক সংক্রান্ত বিশেষ কোনও নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই, সেখানে যে কোনও ছাত্র বা ছাত্রী তার পছন্দের সুবিধাজনক পোষাক পরে আসতেই পারে। গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন নাগরিকের জন্য তো এর অন্যথা হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু বর্তমান ভারতবর্ষে পোষাককে, খাদ্যকে ধর্মীয় পরিচিতির অঙ্গ করে বিশেষভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অত্যাচার ও হেনস্থা করা হচ্ছে। কয়েকদিন অন্তর অন্তর নানাভাবে দেশের বিভিন্ন অংশে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরি করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা স্পষ্টতই প্ররোচনামূলক। হিজাব সংক্রান্ত সাম্প্রতিক ঘটনাটি সারা দেশে আলোড়ন ফেলেছে। হিন্দুরাষ্ট্রের ধ্বজাধারী মোদি সরকার এবং জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে উদবেলিত গেরুয়া বাহিনী দেশের শান্তি শৃঙ্খলা এবং সহিষ্ণুতাকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করতে মেতে উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন কর্ণাটক সরকার। যতদিন না কর্ণাটক হাইকোর্ট স্কুল-কলেজ হিজাব পরা না-পরা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও রায় দেবেন, ধর্মীয় কোনও পোষাক পরিধান করে স্কুল-কলেজে যাওয়া যাবে না এমনই সিদ্ধান্ত কর্ণাটক সরকারের। হিজাব-সংক্রান্ত বিষয়টির প্রেক্ষিতে সারা দেশে ধূমায়িত হয়ে উঠছে আরও নানারকম রাজনৈতিক অসন্তোষ-কোথাও টুপী, কোথাও ধর্মীয় অন্য কোনও পোষাক, কোথাও অহিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত বিধিনিষেধ বারে বারেই জনজীবনে বিভেদ-বিভাজনের সূত্রপাত করছে। সারা দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন নাগরিকেরা মুখর হয়েছেন প্রতিবাদে। সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে এ বিষয়ে আশু সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ। অপরদিকে কাশ্মীরে দ্বাদশ শ্রেণীতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ ছাত্রীটি হিজাব না পরার কারণে ভর্ৎসিত হচ্ছে। এই সমস্ত ঘটনা খোলামনে যুক্তিসহকারে বিশ্লেষণ করলে একথা সহজেই বোঝা যায় যে ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার দুরভিসন্ধিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অবদমিত এবং ভীত রাখার অভিপ্রায়ে মোদি সরকার এবং তার সঙ্গী আরএসএস এই সকল উসকানিমূলক কাজ করে চলেছে। এই ফ্যাসিবাদী সরকারের লক্ষ্য অহিন্দু জনসমষ্টিকে উত্যক্ত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করা। ‘হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্থান’ অর্থাৎ এক ধর্ম, এক ভাষা, এক দেশ-তীব্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের তাড়নায় আজ বিপন্ন কেবলমাত্র সংখ্যালঘুরা নয়, সমগ্র ভারতের ১৩০ কোটি জনগণ।
‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’-- আমরা জানি এটাই ভারতের প্রকৃত স্বরূপ। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক এই দেশের সংবিধান তার নাগরিকদের জন্য নির্ধারিত করেছে কয়েকটি মৌলিক অধিকার। সেই মৌলিক অধিকারগুলি এই দেশে বসবাসকারী সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ যাঁরা জন্মসূত্রে অথবা তৎপরবর্তী কোনও কারণে হয়ে উঠেছেন এই দেশের নাগরিক, সকলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। পচাত্তর বছর আগে ধর্মের নামে দেশভাগের কালিমা নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল ভারত। ১৯৫০ সালে সংবিধান রচনাকালে দেশে সম্প্রীতি এবং সৌভ্রাতৃত্বের স্বার্থে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এই ধর্মনিরপেক্ষ নামক শব্দটির অর্থ কি আজও রাষ্ট্র সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে? গ্রহণ করতে পেরেছে এর অন্তর্নিহিত অর্থের গুরুত্ব? ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বিশেষ কোনও ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের অপক্ষপাত। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দ্বারা সংখ্যালঘুর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা। আজকের ভারত মোদি সরকারের হাতে প্রকৃত অর্থে ‘হিন্দুস্থান’ বা ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হয়ে উঠতে চলেছে, তারা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে যেন বদ্ধপরিকর। প্রয়োজন এর বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে তোলা, সংবিধানকে পরিপূর্ণ মর্য্যাদা দিয়ে এই ভারতকে সকল ভারতবাসীর বসবাসের একটি নিরাপদ আশ্রয় করে তোলা। খাদ্যাখাদ্য, পোষাক-আশাক ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার, রাষ্ট্রের এ বিষয়ে নাকগলানোর কোনও এক্তিয়ার নেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.