বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ নভেম্বর, ২০২১— ভারতীয় কৃষি যে সংকট কবলিত একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন সে কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। শুধুমাত্র কৃষি জমির স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রাখলেই আমরা বুঝতে পারব গোটা কৃষি ব্যবস্থাটা কোন্ খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকার করছে দেশের সমগ্র কৃষি জমির এক তৃতীয়াংশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একাদশ পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার এই রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সমস্যা কতটা বিপজ্জনক। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র পৃথিবী জুড়ে কৃষি জমির উর্বরতা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়ে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনছে। সংকট এতটাই গভীর যে কোনও কোনও কৃষি বিজ্ঞানী একে বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে তুলনা করতে দ্বিধা করছেন না। বিশ্ব উষ্ণায়নের ভয়াবহ পরিণাম যেমন অলঙ্ঘনীয়, ঠিক তেমনি কৃষি ক্ষেত্রের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমি ঊষর মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। অথবা লবণাত্মক হয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। হাজার হাজার মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশার খোঁজে শহরে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। আবার চাষ করতে গিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে প্রতি বছর অসংখ্য কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ২০১৯ সালের ন্যাশানল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে কৃষক এবং চাষের কাজে নিযুক্ত ১০,৮৮২ জন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। মোট আত্মহত্যার নিরিখে যা ৭.৪ শতাংশ। এছাড়া আরো অসংখ্য বিপর্যয়ের নমুনা আমাদের জানা আছে। আলোচনার এই ছোট পরিসরে তা আর উল্লেখ করার অবকাশ নেই। দীর্ঘ নয় মাস ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলা কৃষক আন্দোলন সেই সংকটকে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এখন আমরা এই বিপর্যয়ের পেছনে ক্রিয়াশীল কারণগুলো একটু খোঁজার চেষ্টা করব।
কৃষি অর্থনীতিবিদদের একটা অংশ এই সংকটকে টেকনিক্যাল সমস্যা হিসেবে দেখতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। তারা মনে করেন, জলসেচ ব্যবস্থাকে উন্নত করে, উন্নত বীজ প্রয়োগ করে, জমিতে অনুখাদ্যকে সার হিসেবে সরবরাহ করে এই সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব। তাঁরা নিদান দিচ্ছেন, মাটি থেকে অনুখাদ্য সংগ্রহে পারদর্শী জেনেটিক্যালি মডিফাইড (GM) শস্য চাষের। দেশের সরকার এই নিদানের ভিত্তিতে কৃষিক্ষেত্রে পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। কৃষকরা সয়েল হেল্থ কার্ডের মাধ্যমে তাঁর জমির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুসারে অনুখাদ্য ব্যবহার করে শস্য ফলাচ্ছেন। অন্য ঘরানার কৃষি বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই সমাধান সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, কৃষি সংকটের মূল শেকড় লুকিয়ে আছে কৃষি বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসের মধ্যে। সবুজ বিপ্লবের পর রাসায়নিক নির্ভর চাষবাসের ফলে কৃষি বাস্তুতন্ত্র ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের মতে এই বিপর্যয়ের তিনটি অভিমুখ— (১) জমির উর্বরতা হ্রাস, (২) রোগ পোকার উপদ্রব, (৩) জলের অভাব।
(১) আমাদের দেশের কৃষি জমির উর্বরতা ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে সমগ্র কৃষি জমির দুই তৃতীয়াংশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।এ ই অসুস্থতার তিনটি কারণ- (ক) জমিতে পুষ্টিগুণের অভাব, (খ) জৈব কার্বনের পরিমাণ হ্রাস, (গ) জলমগ্ন বা লবনাক্ত হয়ে যাওয়া।
(২) ফসলের উপর রোগ পোকার উপদ্রব ৫০০ শতাংশ বেড়েছে। ফসলের ক্ষেতে নতুন নতুন প্রজাতির পোকামাকড়ের আগমন ঘটছে প্রতিনিয়ত। গত কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে আপনারা নিশ্চয় পড়েছেন বাদামি শোষক পোকার আক্রমণে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৯৪টি মৌজার মধ্যে ১৯০টি মৌজার ধান নষ্টের মুখে। কৃষি দপ্তরের অনুমান শোষক পোকার দাপট আগামী কয়েকদিনে ব্যাপক হারে পাশ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। প্রায় ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্টের অপেক্ষায়। কোনও রকম কীটনাশক এই পোকাকে মারতে পারছে না। কয়েক হাজার কৃষকের মাথায় হাত। অথচ ১৯৭৫ সালের আগে এই পোকা ধান খেতে বসবাস করলেও ধান খেত না। ১৯৮৫ সাল নাগাদ তারা টুকটাক ধান খাওয়া শুরু করে। তারপর থেকে এই শোষক পোকা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। এর অন্যতম কারণ ক্যামিক্যাল ফার্মিং। সবুজ বিপ্লবের পর থেকে কৃষিক্ষেত্র অনিয়ন্ত্রিত হারে রাসায়নিক ব্যবহার করে কৃষি বস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। প্রাক সবুজ বিপ্লব পর্বে এই সমস্যা ছিল না। চিরায়ত পদ্ধতির চাষাবাদে প্রাকৃতিক নিয়মেই জমির পোকামাকড় অন্য পোকামাকড়ে খেয়ে কৃষি বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করত। বিষয়টা আর একটু খোলস করা যাক। প্রথাগত চাষে জমিতে দেওয়া হতো গোবর সার। সেই সার পচন ধরে তৈরি হতো প্রচুর পরিমাণে প্লাংটন। এই প্লাংটন খাওয়ার জন্য জমিতে হানা দিতে এক ধরনের পোকা। পোকার লোভে আসত আর এক প্রকার মাংসাশী পোকা। এরা এই পোকা তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার অবকাশে ধান গাছ বেশ খানিকটা বড় হয়ে যেত। এইভাবে কীটনাশক ছাড়াই ফসল ফলান সম্ভব হতো। ফলে ফসলের ক্ষেতে পোকামাকড়ের উপদ্রব সেই সময় ছিল না বললেই চলে।রাসায়নিক নির্ভর চাষবাসের ফলে কৃষি জমির এই প্রকৃতিক শৃঙ্খল পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক ব্যবহারের জন্য পোকামাকড়ের মধ্যে তৈরি হয়েছে রেজিস্ট্যান্স। ফলে কীটনাশকে আর তাদের মারা যাচ্ছে না।
(৩) জলের অভাব ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে অচিরেই ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঢেকে আনবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জল স্তর মারাত্মকভাবে নেমে গেছে। পাঞ্জাবের ৮০-৯০ শতাংশ ব্লকে জল স্তর খুব নিচে নেমে গেছে। আবার কোনও কোনও জায়গায় একরের পর একর জমি জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। লবণাত্মক হয়ে হাজার হাজার একর কৃষি জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।

কৃষিজমির স্বাস্থ্যের এই চরম অবনতির কারণ কি? তার মধ্যে একটি কারণ হল, জমি থেকে পুষ্টির রপ্তানি। কৃষি জমিতে সাধারণত থাকে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, বোরন, কপার, আয়রন ইত্যাদি যৌগ। গাছেরা এই ধরনের প্রায় ১৫ রকমের মাইক্রো নিউট্রেন শোষণ করে নেয় মাটি থেকে। গাছের পাতায়, ফলে, ফুলে, কান্ডে এগুলো জমা হয়। ধানের ক্ষেত্রে যৌগগুলো ঠাঁই পায় খড়ে, চালে, খোসায়। কৃষি জমি থেকে এই অনুখাদ্যগুলো ফসলের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত রপ্তানি হয়ে যাচ্ছে। নগরায়ন যখন ব্যাপক আকার ধারণ করেনি তখন দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামেই বসবাস করত। তারাই এই শস্যের বেশির ভাগ অংশ ভোগ করত এবং মল, মূত্রসহ অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে এই যৌগ পদার্থ আবার জমিতে ফিরে আসত। পশুপাখির মল-মূত্রের মাধ্যমে জমি ফিরে পেত তার খাদ্য। ফলে সে নিজের পুষ্টি বজায় রেখে সুস্থ থাকতে সক্ষম হতো।কিন্তু পুঁজিবাদী উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকহারে শহর গড়ে উঠতে থাকায় গ্রাম থেকে শহরে ভিড় জমাতে শুরু করল মানুষ। গ্রাম থেকে রপ্তানি করা শহুরে মানুষের খাদ্যের মাধ্যমে জমির মাইক্রো নিউট্রেন শহরের বর্জ্যে মিশে গেলে। সেগুলো আর জমিতে ফিরে যেতে পারল না। একটি গবেষণা জানাচ্ছে, ২০০০-২০০১ সালে ভারতবর্ষের কৃষি জমি থেকে শুধু চাল আর গমের মাধ্যমে পটাশিয়াম শহরে চালান হয়েছে ৮০ হাজার মেট্রিক টান। ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্কসহ অন্যান্য যৌগ জমি থেকে কি পরিমাণে শহরের বর্জ্যে মিশে যাচ্ছে তা সহজে অনুমান করা যায়। ফলে শহরে জনসংখ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি জমির উর্বরতা পাল্লা দিয়ে হ্রাস পেতে থাকছে। এখন গ্রাম উজাড় করে শহরে ভিড় জমাচ্ছে মানুষ। কোনও ছোট জুটিয়ে নিয়ে শহর থেকে যাচ্ছে পাকাপাকিভাবে। UNOর একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শহুরে জনসংখ্যা বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। এই মানুষের খাবারের রপ্তানি তো গ্রামীণ ভারতের কৃষি জমি থেকেই আসবে। আর এভাবেই আরো নিঃস্ব হয়ে পড়বে চাষের জমি। শহুরে মানুষের ত্যাগ করা বর্জ্য নদীকে দূষিত করবে। তা আর কিছুতেই কৃষি জমিতে ফিরে যাবে না। ফেডরিক এঙ্গেলস এক জায়গায় বলেছিলেন, ইংল্যান্ডের মানুষের মূল-মূত্র টেমস্ নদীকে দূষিত করার কাছে ব্যবহার করা হচ্ছে যা চাষের জমিতে দেওয়া উচিত ছিল। জাপান এই শহুরে বর্জ্য তুলি নিয়ে কৃষি জমিতে একবার দিয়েছিল। এর ফলে সে দেশে মানুষ ক্যাডমিয়াম জনিত রোগে আক্রান্ত হয়।
পুঁজিবাদী বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে ইউরোপ ও আমেরিকার জমিতেও অনুখাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছিল। আমেরিকা সামুদ্রিক পাখির বিষ্ঠা জমে তৈরি হওয়া পাহাড় গুয়ানো আমদানি করে তাদের কৃষি জমির পুষ্টিকে তরাণ্বিত করে। ইউরোপ প্রথম থেকেই কৃষি জমিতে ফসফরাসের ঘাটতি পূরণের জন্য হাড়ের গুড়ো আমদানি শুরু করে। যুদ্ধক্ষেত্রে অভিযান চালিয়ে কবর খুঁড়ে মানুষের হাড় তুলে তা গুড়ো করে কৃষি জমিতে দিয়ে ফসফরাসের ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু আমাদের দেশে এই ধরনের কোনও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। বরং উল্টোপথে হেঁটে উপুর্যুপরি রাসায়নিক ব্যবহার করে কৃষি বাস্তুতন্ত্রের সমূহ সর্বনাশ করা হয়েছে।
ভারতীয় কৃষির সংকটকের বীজ লুকিয়ে আছে কৃষি বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসের মধ্যে। পুঁজিবাদী বিকাশ সেই ধ্বংসলীলায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে সেকথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। সবুজ বিপ্লবের নাম করে আমাদের দেশের পরম্পরাগত বীজ ভান্ডার, বিশেষ করে ধানের লক্ষাধিক ভ্যারাইটিকে ধ্বংস করে বেশি ফলনের গাজর ঝুলিয়ে আইআর৮ জাতীয় হাইব্রিট ধানের চাষ করিয়ে ক্যামিক্যাল ফার্মিংএ যেতে বাধ্য করে এই সর্বনাশকে ঢেকে আনা হয়েছে। সবুজ বিপ্লবের প্রবক্তারা যুক্তি হিসেবে যে উচ্চ ফলনের ধুয়ো তোলে তা ধোপে টেকে না। কারণ দেশীয় বীজে উচ্চ ফলন সম্ভব। সে সময় অনেক কৃষি পন্ডিত দেশীয় বীজ চাষ করে হেক্টর প্রতি ১৪ টন ধান ফলিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি। অজানা কারণে তাদের কথায় কর্ণপাত করা হয়নি।তার পরিণাম এখন ভুগতে হচ্ছে।